বা ঙা ল না মা

নবগঙ্গা থেকে আদিগঙ্গা, ভুঁইফোঁড়দের সুলুক-সন্ধান*

Posted by bangalnama on September 13, 2010


– লিখেছেন রবি-দা


গড়ের মাঠ থেকে শিয়ালদা স্টেশন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে ঠনঠনে কালীবাড়ি জোরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে আমার উদ্বাস্তু শৈশব – খালি পায়ে এবং পায়ে পায়ে হেঁটে – যার স্মৃতি রোমন্থন করেই শুধু কাটিয়ে নেওয়া যায় অবসরের অলস দুপুর আর খুঁচিয়ে দেওয়া যায় স্বপ্নপূরণের খিদেটাকে। হাঁটা শিখেছিলাম নিজের অজান্তে, দুর্বিসহ যন্ত্রণার মধ্যে – গেদে থেকে ঠাকুমার হাত ধরে লং রুট মার্চের প্রশিক্ষণ, অচেনা পথ চলার হাতেখড়ি। শুনেছিলাম কিছু একটা গাড়ি থাকবে বর্ডারে, ছিলও সত্যি সত্যি, কিন্তু ছিল না দশজন মানুষের হঠাৎ করে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা। যা ছিল তার বেশিটাই তো কেড়েকুড়ে নিয়েছিল আগেই, আর মওকা বুঝে স্বাধীন ভারতের নতুন প্রভাতে ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর কিছু বণিক কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল বাস/ট্রাকের ভাড়া – কারণ চাহিদা আর যোগানের দাবিটা ছিল দিনের আলোর মত পরিষ্কার। রেলপথ বন্ধ কিন্তু আরোহীর অভাব ছিল না। খাদ্যের খোঁজে বেরনো লাল পিঁপড়ের সারির মতই আদুর গায়ের মানুষের মহামিছিল থেকেই শুরু হল আমার নতুন জীবন – “বাঙাল”-এ রূপান্তর। ওই মিছিল থেকেই খালি গায়ে, খালি পায়ে আর খালি পেটে সেই বাঙাল ঘুরে দাঁড়াবার মন্ত্র শিখেছিল বেওয়ারিশ পাঠশালায়।


ধেয়ে আসা ছিন্নমূল জনগণের সামনে প্রথমেই দুটি বুনিয়াদি চাহিদা জরুরি হয়ে পড়ল – খাদ্য ও মাথা গোঁজার জায়গা। আমাদের মামা থাকতেন মধ্য কলকাতার ১৩ নম্বর জেলেপাড়া লেন-এ, দু’কামরার ভাড়াবাড়ির একটি ছেড়ে দিলেন আমাদের জন্যে। তাতেই ঠাকুরদা, ঠাকুমা-সহ বাকি আটটি প্রাণী থাকতাম – সুমন চ্যাটার্জ্জীর সেই “ঘেঁষাঘেঁষি আর ঠেসাঠেসি…” মনে হয় সেই কামরার জেরক্স কপি। হাগু-হিসু’র লম্বা লাইন পড়ত সকাল থেকেই, স্নান রাস্তার কর্পোর‌্যাশনের ট্যাপ কলে, সেখানেও লাইন। ভীড় বেশি হলে চাপা কলে যেতে হত, ওখানে জলের স্রোত বয়ে যেত হাইড্র্যান্টে। ভোরে ভিস্তি লাগিয়ে ওই জলে রাস্তা সাফাই হত, প্রয়োজনে আমরাও সাফ হয়ে নিতাম। কিন্তু সবার তো আর মামা ছিল না, তাদের ঠিকানা ছিল শিয়ালদা স্টেশনের সামনে বিশাল চত্বরে আর ওয়েলিংটন স্কোয়্যার, নেবুতলার মাঠ, শ্রদ্ধানন্দ পার্ক ও আরো সব খেলার মাঠের ঘেরা রেলিঙের দু’দিকে – বস্তার চট কিম্বা ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে পরিপাটি ঘেরা। খাদ্য আর আশ্রয়, এই দুটো বুনিয়াদি চাহিদার যোগানে তখনকার বাঙালদের কলকাতাবাসী আত্মীয়-পরিজন, গ্রামের মানুষ, বন্ধুবান্ধবরা যা করেছেন তার দৃষ্টান্ত পাওয়া ভার। সকলেরই পরিচয় উদ্বাস্তু, আগে আর পরে, কিন্তু ওই ঘোর দুর্দিনের কষ্টকে হাসিমুখে ভাগ করে নিয়েছেন আগে থেকে চলে আসা বিশাল মনের মানুষজন, দীর্ঘদিন ভাগ করে খেয়েছেন যতটুকু ছিল নিজেদের খাদ্যভাণ্ডারে। মামা দিয়েছিলেন মাথা গোঁজার ঠিকানা আর এক মাসি থাকতেন ২২ নম্বর জেলেপাড়া লেন-এ, তিনিও ভাগ করে পাঠাতেন রেশনে পাওয়া চাল আর গম, নতুন পুরনো জামাকাপড়, লজ্জা ঢাকার অন্যান্য আবরণ। অ্যামহার্স্ট স্ট্রীটে থাকতেন ডাক্তারজেঠু, বাবা’র খুড়তুতো দাদা – ঢাকা ইউনিভার্সিটির M.B. ডিগ্রি ছিল তাঁর। সদাশয় মানুষ, অসুখ-বিসুখ করলেই মা পাঠিয়ে দিতেন, ওষুধ নিয়ে আসতাম, মিক্সচার আর কালির দাগ দেওয়া পাউডারের পুরিয়া। আবার আসার আগে এক আনা চেয়ে নিতাম, কোনো লজ্জা বা সঙ্কোচ ছিল না। সেই পয়সায় বার দুয়েক সাঁটা বড়া হত পাড়ার তেলেভাজার দোকানে। ওড়িয়াদের তেলেভাজার শিল্পকলার খ্যাতি তখনও ছিল, স্বাদ ছিল সাঁটা বড়ার (বিউলি ডালের তৈরি)।


শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে যখনই ঘুরতে যেতাম, দেখতাম গৃহিণীদের কর্মব্যস্ততা। অগণিত মাটির হাঁড়িতে ভাত ফুটছে টগবগ করে তিনটে ইঁট দিয়ে তৈরি চুলোতে। ওই ফুটন্ত ভাতের গন্ধে আমার কি সুন্দর একটা খিদে পেয়ে যেত। ছ্যাঁকছোঁক শব্দ হত কড়াইতে, চোখের পলক পড়ত না নানা রঙের কাটা তরকারির ব্যস্ত ওঠানামার দৃশ্য থেকে, মা-কে মনে পড়ে যেত, আবার একদৌড়ে ১৩ নম্বরের ঠিকানায় পৌঁছে যেতাম। বিকালে দেখেছি একই দৃশ্য ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের অগণিত রান্নাঘরে; সূর্য্য যখন অস্ত যেত পশ্চিমে – বিধান রায়ের বাড়ির পেছনে, হিন্দ সিনেমা হলের বিশাল হোর্ডিংগুলোতে যখন হঠাৎ করে আলোর বন্যা বয়ে যেত – সাদা কিম্বা সবুজ কলাই-করা থালা হাতে নিয়ে তখন সব রান্নাঘরের সামনে বড় বড় চোখ নিয়ে ভুখা মানুষদের সারি দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গোনা।



পূর্ববঙ্গ থেকে স্রোতের মত বয়ে আসা এই উদ্বাস্তুদের ন্যূনতম খাদ্য এবং আশ্রয়ের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের বিশেষ হেলদোল ছিল কিনা তা বোঝা যেত না। অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি (CPI) অবশ্য কিছু সময় অতিক্রান্ত হলে উদ্বাস্তুদের সংগঠনে টেনে এনে তাদেরই কন্ঠে স্লোগান তুলল, “পুনর্বাসন দাও,” “জমি দাও,” ইত্যাদি ইত্যাদি। কংগ্রেস পার্টি তখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসীন, এবার অশনি সংকেত বুঝে তাঁরাও সরব হলেন কিছুটা, সরকার চাপে পড়ে তখন তড়িঘড়ি এক কুখ্যাত আইন তৈরি করে ফেলল – Permanent Liability Act – যা PLA নামে সম্যক পরিচিত ছিল। প্রত্যন্ত কিছু জায়গায় PL ক্যাম্প খোলা হল, শিয়ালদা ও অন্যান্য জায়গা থেকে উদ্বাস্তুদের সেই অস্থায়ী ক্যাম্পে স্থানান্তরিত করা হল। পরিকল্পিত কোনো পরিকাঠামো না থাকায় সেইসব ক্যাম্পে মানুষের দুর্দশা ছিল অবর্ণনীয়, কিন্তু দু’বেলা অপরিমিত হলেও “খিচুড়ি” পাওয়া যেত। তখন সেই খিচুড়ি ছিল বাঙালদের কাছে আধমরা হয়ে বেঁচে থাকার এক জীবনদায়ী ওষুধের মত, কিন্তু দীর্ঘদিন একনাগাড়ে খিচুড়ি খেয়ে বেশ কিছু শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ল। অপুষ্টি তাদের কঙ্কালসার চেহারায় ফুটে উঠল, বহু শিশু মারা গেল রোগাক্রান্ত হয়ে, উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে ও ম্যালন্যুট্রিশনে ছোটবড় সকলেই ছিল হতশ্রী চেহারার। এদিকে আমার মামাবাড়িতে ঠাকুমা চিৎকার করতেন রাত-বেরাতে, “এ কোথায় আনছিস তোরা আমারে, খামু কি, মাছের মাথা কই?”, ঠাকুরদা সন্ধ্যা হলেই কর্তাল বাজিয়ে সুর করে গাইতেন, “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ…”। কীর্তনের জোরালো আওয়াজে ঠাকুমার মাছের মাথার নেশা কিছুটা কেটে যেত মনে হয়, ঘোর কাটলে মা’র কাছ থেকে খোঁজ নিতেন বাবা কাজ থেকে ফিরল কিনা। একদিন পাঁঠার মেটের পাতলা ঝোল খেয়ে আমাদের নেশা চেপে গেল। মাসি টাইফয়েড থেকে সেরে উঠে ডাক্তারের পরামর্শে পাঁঠার টেংরি কিম্বা মেটের ঝোল খেতেন, তখন ওই সূপের মহিমা কীর্তন খুব শোনা যেত। বাড়িতে এসে মা’র কাছে বায়না জুড়লাম, “মেটের ঝোল চাই।” এরপর খাসির মাংসের দরদাম ইত্যাদি গল্প জেনে ও বুঝে মা’কে বললাম, “ঠিক আছে, মেটে চাই না, শুধু মেটের ঝোল বানাও।” এখন মনে পড়লে নিজেরই হাসি পায় আর ভাবি – “হায় রে বাঙ্গাল পোলার অবুঝ শৈশব!” তখনকার দিনে এটা ওটা উপলক্ষে ‘দরিদ্র নারায়ণ সেবা’ হত প্রায়ই, সারি সারি মানুষদের বসিয়ে খাওয়ানো হত পূণ্য অর্জনের বাসনায়। সন্তর্পণে লুকিয়ে চলে যেতাম, বসে পড়ে হারিয়ে যেতাম পংক্তির ভীড়ে – আহ! কি স্বাদ ছিল সেই খিচুড়ির আর ছ্যাঁচড়ার, কোথাও কোথাও আবার চাটনিও থাকত। নারায়ণ কী ভাবতেন জানিনা, কিন্তু দরিদ্রের আত্মার তৃপ্তিতে নিশ্চয় আয়োজকের কল্যাণ হতই হত। পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দাদের কিছু মানুষ ভাবতেন উদ্বাস্তুরা তাঁদের বিপদে ফেলবে, ভাগ বসাবে সবকিছুতে, উড়ে এসে জুড়ে বসবে সর্বত্র। আবার বৈপরিত্যও ছিল চোখে পড়ার মত – পাড়ার বহু কাকিমা-মাসিমা এসে বালতি ভরে পুজোর প্রসাদ, ভোগের লুচি, ডাল, তরকারি মা’কে দিয়ে যেতেন, খবর নিতেন কে কেমন আছে, জানতে চাইতেন ঠাকুরদা কেন আর কীর্তন করেন না – এইসব। জেলেপাড়ার সরু গলিতে বাড়ির প্রশস্ত রকে গরমে সবাই এসে বসতেন, সেখানে আপামর জনগণ থাকতেন, দেদার তর্ক-বিতর্ক চলত, লড়াই হত ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে। অনেকদিন আমরা সেই রকেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম, বাড়ির কেউ এসে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের ছেড়ে উঠে যেতেন না বড়রা, পালা করে দেখতেন আমাদের, যেন পড়ে না যাই রকের ওপর থেকে। বিধান রায়ের কথা হামেশাই শুনতাম উদ্বাস্তু প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা হলেই, পরে জেনেছি, এই সমস্যার প্রতিকারের লক্ষ্যে স্থায়ী ও অস্থায়ী অনেক ব্যবস্থাই তিনি করেছেন। সেই ছোটবেলায় তাঁর মানুষ-দরদী হাবভাব, সুদূর দৃষ্টিভঙ্গী, চিকিৎসায় প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি ও সততার কথা শুনতে শুনতে একটা নির্মল ছবি আঁকা হয়ে আছে মনে। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে দেখেছি তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন, আজও পয়লা জুলাইয়ের সকালে আমার মন কেমন করে। আর ছিলেন আমাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ধীরেন ধর, ধনী বেনে পরিবারের শিক্ষিত সন্তান, সিপিআইয়ের সদস্য ছিলেন, সারাদিন ঘুরতেন এ বাড়ি ও বাড়ি, জানতেন অসুবিধে অভিযোগের কথা। তাঁর কাছে সবার ছিল অবারিত দ্বার, যা চাই তাই পাবে – বইখাতা, পেন্সিল নিয়ে এসেছি অনেকবার, তাঁর কাছে উদ্বাস্তুদের আলাদা কোনো পরিচয় ছিল না। আমার দাদা ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল একদিন বিকালে বাড়ি ফিরে, মা’র কাছে শুনেছিলাম ধীরেন ধর ট্রামগাড়ির সেকেণ্ড ক্লাসে ঝুলে যাচ্ছিলেন কোথাও, পিছলে রাস্তায় পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। মারা গেলেন আমার ঠাকুরদা, ঠাকুমাও অল্পদিনের ব্যবধানে, ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি-রোমন্থনে আমার মামাবাবু, মাসি, জেঠু, জেলেপাড়ার সেই মাসিমা-কাকিমারা, বিধান রায়, ধীরেন ধর…আমার শৈশবের দেবতারা – তোমাদের শতকোটি প্রণাম জানাই, বার্ধক্য তোমাদের ভোলাতে পারেনি। ভাল থেকো, যেখানেই থাকো।


অসুখ-বিসুখ হলে জেঠু ছাড়াও যেতাম অজিত ডাক্তারের চেম্বারে। পোষাকী নাম ছিল ডাঃ অজিত কুমার মিত্র, খ্যাতিমান চিকিৎসক ও ব্যক্তিত্ববান পুরুষ ছিলেন তিনি। ভিজিট ছিল চেম্বারে দু’টাকা, এক টাকা দিলেও হত, না দিলেও হত, বাড়িতে এলে চার টাকা। চেহারাটা আজও চোখে ভাসে, অজিত ডাক্তারের নামে জ্বর-জ্বালা এমনিতেই পালিয়ে যেত মনে হয়। টাইফয়েড, স্মল-পক্স, কলেরা তখন আকছার হত, কলেরা হলে রোগীকে নিয়ে সবাই মেডিকেল কলেজে ছুটে যেত, এসব রোগে মারা যেতেনও বহু মানুষ। নীলরতন কলেজ হাসপাতাল বা ক্যাম্পবেল, লেডি ডাফরিন ও মেডিকেল কলেজের আউটডোরেও গেছি অনেকবার। খুব যত্ন নিয়ে দেখতেন জুনিয়ার ডাক্তারের দল, তাঁদের উৎসাহ ছিল দেখার মত। বড় ডাক্তার সবাই পাশেই থাকতেন, আলোচনা করে ওষুধ দেওয়া হত – একদম বিনামূল্যে মিক্সচার, ট্যাবলেট, মলম সব পাওয়া যেত। গড়ের মাঠ থেকে ফেরার সময়ে চাঁদনির গলি ঘুরে, বিধান রায়ের বাড়ি বাঁয়ে রেখে আসতাম ওয়েলিংটনের মুখে। চাঁদনির ওই গলিতে ছিল কোনো দাতব্য চিকিৎসালয়, বিকালে ডাক্তার রোগী দেখতেন, ওষুধ দিতেন। ঘা-পাঁচড়ার দরুণ একটা মলম রাখা থাকত কাগজের ছোট ছোট প্যাকেট করে, প্রায়দিন একটা করে মলমের প্যাকেট নিয়ে আসতাম কারো না কারো জন্য। আমাদের নিজেদের এবং খুড়তুতো, মাসতুতো, মামাতো ভাইবোন সকলেরই জন্ম হয়েছিল ওই হাসপাতালগুলোতে, কর্পোর‌্যাশনের লোক এসে আমাদের টিকে দিয়ে যেত ছুরি দিয়ে চিরে হাতের মাসলে। কলেরার প্রকোপ বৃদ্ধি হলে ইঞ্জেকশন নিতে হত ঘরে বসেই, খুব ব্যাথা হত ওই ইঞ্জেকশন নিলে। কর্পোর‌্যাশনের সমস্ত প্রাইমারি স্কুলেও নিয়মিত ‘স্বাস্থ্য পরীক্ষা’ হত, আগের দিন সবাইকে বলে দেওয়া হত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আসতে। একবার আমার ছোট ভাই গন্ধ শুঁকতে গিয়ে গিলে ফেলেছিল কেরোসিন তেল – সোজা মেডিকেল কলেজে, পাইপ ঢুকিয়ে বার করা হল সেই তেল পৌঁছানোর সাথে সাথে। এখন বুঝতে পারি হাসপাতালে ‘এমার্জেন্সি’ লেখা বোর্ডটার মাহাত্ম্য তখনকার স্মৃতিচারণে।


উদ্বাস্তু পরিবারের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে কিনা জানিনা, র‌্যাশনের দোকান থেকে সস্তায় বিক্রি হত শাড়ি, জামাকাপড়ের ছিট, মার্কিনের থান – এইসব। পুজোতে ভাইবোনেরা যখন একসাথে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম, পাঁচকড়ি জেঠু বলতেন, “বাহ! ভাল হয়েছে রে তোদের জার্সি।” একই রঙ খেলা করত হাফপ্যান্ট, শার্ট ও ফ্রকে, খুব খুশি হতাম সবাই। পায়ে অবশ্য কিছু থাকত না, ওটা ভাবাও ছিল বিলাসিতা। দাদা যখন মেট্রোপলিটানের উঁচু ক্লাসে উঠল, বাবা তখন একজোড়া রাবার সোল দেওয়া চটি কিনে দিয়েছিলেন শুনেছি। আরো অনেক পরে বাবা পুজোতে সব ভাইদের চীনাপট্টি থেকে কাবলি জুতো কিনে দিতেন। বোনরা তখনও খুদে, ওদের জুতোর দরকার হত না, কাবলি পায়ে দিয়ে নিজেকে রাজপুত্র মনে হত। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, ক্লাব থেকে পুজোতে বস্ত্র-বিতরণ করা হত। অনেক সময় ক্যাম্প, পাড়া ঘুরে কাপড়চোপড় নেবার স্লিপ দিয়ে যাওয়া হত দিনক্ষণ জানিয়ে, লিখে নেওয়া হত নামধাম। মনে হয় শাড়ি, ধুতি ইত্যাদির সঠিক হিসাব রাখতে আয়োজক সংগঠন এই ব্যবস্থা করতেন। বস্তুত, পরিধানের ব্যাপারটা মনে হয় ছিন্নমূল লোকজনদের সেকেণ্ডারি ছিল সেই সময়ে। তখন, “মা, একটু ফ্যান হবে?” – এই কাতর প্রার্থনা বহুকাল শোনা গেছে, কিন্তু এইভাবে কখনো কাউকে বস্ত্র-ভিক্ষা করতে দেখিনি বা শুনিনি।


*আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত ‘নবগঙ্গা’ নদী; ভৈরব থেকে যাত্রা শুরু, শেষ হত মধুমতী-তে মিশে।


(চলবে)

10 Responses to “নবগঙ্গা থেকে আদিগঙ্গা, ভুঁইফোঁড়দের সুলুক-সন্ধান*”

  1. Basu Acharya said

    khub bhalo lekha. khubiiiii bhalo lekha. aajo emon lekhok achhen dekhe bhalo lage. robi babu, satti bhishon bhalo likhechhen. eto jantranateo rashobodh haran ni apni. apnake selam janai. apnar kolom ke selam janai. selam janai bangalnama ke onek din por ekta bhalo lekha prakash korar janye.

  2. Saloka Sengupta said

    osadharon!!!!!!!!!!! chhotobela theke jesab galpo sune aschhi,taar e ekta bistrito chitro pelam…………..likhe jao……… 🙂

  3. Tithi said

    Apurbo…lekha pore mone hai chhotobelay sona galpo gulo chokher samne murto hoye uthhlo…
    aro onek onek lekho tumi kaku…tomar kalomer jadu te mugdho hote chai aro aro..

  4. brishti said

    সত্যি ভীষণ ভালো লাগল। বাসু আমার কথাগুলোই লিখে দেয়ায় বেশ একটু রাগ হয়েছিলো প্রথমে…পরে ভেবে দেখলাম,আমি হয়ত ওর মত করে মনের ভাবটা জানাতে পারতাম না……রবিবাবু,আমিও এদের সাথে গলা মিলিয়ে বলি,আপনি চালিয়ে যান।একদম থামবেন না,প্লীজ 🙂

  5. Tanaji said

    khub bhalo laglo

  6. Trisha said

    Rabida Trishar maddhyame apnar ei osadharon lekha porte pelam. kI jhorjhore lekha mone hoy porei jai. Thanx rabida amon ekta lekha poranor jonno. Aro porte chai. Balaka

  7. খুব ভাল লাগলো। সত্যিই ভালো লিখেছেন।

  8. সজল said

    কাকু লেখাটা পড়ে চোখের সামনে ছবির মত সব দেখতে পেলাম মনে হল । চলতে থাকুন।

  9. বাঙালনামার পক্ষ থেকে দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা oral history সংগ্রহ করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আপনাদের অনুরোধ, আপনারা এতে অংশ নিন। আপনাদের পরিবার পরিজনদের জবানবন্দী লিখিত ভাবে, মৌখিক ভাবে, তথ্যচিত্রের আকারে আমরা সংরক্ষণ করতে চাই। বিস্তারিত জানতে দয়া করে ইমেলে যোগাযোগ করুন – bangalnama@gmail.com

  10. Shalmaly Mukherjee said

    Ai website ti osadharon! Robi babur lekha mon k chhua gelo! Ami Bangal identity er itihas er opore research korchhi….ai registration certificate er chhobi khani ki byebohar korte pari amar thesis a, aapnader anumoti somet? citation a obbosoi aapnader details thakbe. Onek dhnyobad.

Leave a reply to সজল Cancel reply