বা ঙা ল না মা

সম্পাদকীয় – দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা

Posted by bangalnama on December 22, 2010


জনঘনত্বের বিচারে (প্রতি বর্গকিমি ভূখণ্ডে মানুষের সংখ্যা) পৃথিবীর প্রথম দশটি শহরের লিস্ট যদি দেখি তার মধ্যে ছ’টি ভারতবর্ষে; না, সুধী পাঠক, কলকাতা সেই প্রথম দশে নেই, একটি দিল্লি আর বাকিগুলি যথাক্রমেঃ টিটাগড়, বরানগর, শ্রীরামপুর, দক্ষিণ দমদম, কামারহাটি। কলকাতার র‍্যাংকিং এদের পরেই, এগারোয়, আর এর পরে পশ্চিমবঙ্গের বাকি শহরগুলি আসতে থাকবেঃ বালি, বালুরঘাট, হাওড়া, নৈহাটি। গঙ্গার বদ্বীপের অসামান্য ঊর্বরতা, সুজলাসুফলা বাংলার জল-হাওয়া বা ব্রিটিশদের প্রথম বন্দররাজধানীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব মাথায় রেখেও এই কৃষিবর্জিত বৃহৎশিল্পবিহীন জনপদগুলির বর্ধিষ্ণুতার সূত্রে একটা কারণই কি শুরুতেই মনে হচ্ছে না? এবার সমাজতাত্ত্বিক জার্নালগুলিতে ঢুঁ মারলে দেখব, ঠিক সেইটাই- ১৯৫০-এর আশেপাশের সময়ে ওপার বাংলা থেকে অসংখ্য উদ্বাস্তুর এপারে চলে আসা, নির্মাণ করে নেওয়া নিজেদের জীবন জীবিকা বসতি। চল্লিশের দশকের একদম গোড়ার থেকে শুরু হয় হোস্টাইল পূর্ববঙ্গ থেকে বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালির এপারে আসা। এঁদের সকলেই প্রায় শিক্ষিত, কর্মক্ষম, অস্থাবর সম্পত্তিও একদমই ছিল না এরকম নয়। ফলে নিজের ভিটেমাটি ছাড়তেই যখন হল, আশু গন্তব্য কলকাতা, আর তারপর প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই- যে লড়াইয়ের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল ‘বাঙাল’ আইডেন্টিটির নির্মাণের লক্ষ্য। এঁদের সম্বন্ধে স্যার যদুনাথ সরকার বলেনঃ “Those who are leaving East Bengal are the very best portion of the local population, in brain, wealth, organizing capacity and indomitable spirit, however crushed and benumbed they may look, when they are unloaded from their third class wagons on the Sealdah station yard.”


তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের বৈমাত্রেয় আচরণ সত্ত্বেও (একটা বড় সময় অবধি বাংলায় উদ্বাস্তু সমস্যাকে সরকার স্বীকারই করতে চায়নি, লক্ষণীয় পাঞ্জাবে কিন্তু এমনটা হয়নি) এপারের মানুষের কাছ থেকে একধরণের মিশ্র সহযোগিতা পেয়েছিলেন তাঁরা। বৈরিতার পাশাপাশি অনেকক্ষেত্রেই সহমর্মিতাও ছিল। এপারে প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় বন্ধুরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। ব্যক্তিগত বা সংগঠিত ভাবে পুনর্বাসন উদ্যোগগুলিও গড়ে ওঠে। যে কংগ্রেস সরকার উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে মোটের উপর উদাসীন ছিল, তার ভেতরকার অনেকেই উদ্বাস্তু-উন্নয়ন নিয়ে সক্রিয়ও হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ নিজেই ছিলেন পূর্ববাংলার সন্তান, এর পাশাপাশি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল বাস্তুহারা কল্যাণে। নিজেদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিণতিতে ওপার বাংলার ভিটেছাড়া শিক্ষিত বাঙালরা উদ্বাস্তু আন্দোলনকে বিভিন্ন ফর্মে বিকশিত করেন। কোথাও নিজেদের স্বল্প সামর্থ্যে অব্যবহৃত জমি কিনে, কোথাও পড়ে থাকা জমি জবরদখল করে কলোনিগুলি গড়ে ওঠে। কলোনির মধ্যে একভাবে সমবায় আন্দোলন বিকাশ লাভ করতে থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। রাজনৈতিক চেতনার ছাপ দেখা যায় কলোনিগুলির সংহতি, শহিদ, নেতাজী, সুভাষ, গান্ধী, বিধান প্রভৃতি নামকরণে। পরবর্তীকালে (৫০-এর পর) যখন কমিউনিস্ট পার্টি উদ্বাস্তু আন্দোলন সংগঠিত করছে, কলোনির নামে লেনিন, স্ট্যালিন, মুজফফর এমন কি হোচিমিন-এর নামও আসে। আরও পরে, নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুরা যখন কলোনি গড়ে তুলবেন, আমরা দেখতে পাব আম্বেদকর-হরিচাঁদ ঠাকুরের নাম। যাই হোক, কলোনি গড়ার পাশাপাশি এই পর্যায়ে একটি প্রায় অনুল্লিখিত ইতিহাসও আসে, সাম্প্রতিক কালের একটি বাংলা ছবির (স্থানীয় সংবাদ) ডায়লগ থেকে উদ্ধৃত করলে-


জলধর: আমরা একটু পরে আইলাম, ৫৬ সালে। এইখানে তখন সব পুকুর, ডোবা, পতিত জমি।
ক্ষিতীশ: কেউ থাকত না। মুসলমান চাষা আছিল কতগুলো, মার খাইয়া পালাইল।


অর্থাৎ শুধুমাত্র বড়লোকের জমি কেড়ে নেওয়া নয়, পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্রচাষীও পরোক্ষ শিকার হয়েছেন দেশভাগের। এখানে উল্লেখ্য, এই প্রথম পর্বের উদ্বাস্তুরা পেশাগতভাবে অনেকেই ওপারেও সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ফলতঃ তাঁদের পক্ষে শহর-মফঃস্বলে বসতি ও জীবিকা নির্মাণই খুব স্বাভাবিক ছিল। মহবুবার রহমান ও ভ্যান শ্যান্ডেল লিখেছেন –
“In the literature, the dominant image of the refugee is that of the Bengali Hindu fleeing from East Pakistan to Calcutta in West Bengal. We need to broaden this image to include many other groups, particularly Muslims fleeing from Assam, Tripura, West Bengal, Bihar and Uttar Pradesh and finding a new home in East Pakistan; and Hajongs, Chakmas, Garos, Bawms, Santhals and many other non-Bengali groups who left East Pakistan for India. … In the study of cross-border settlement, it is essential to recognize that there were different groups with different motives, different histories of settlement, and different experiences of integration into their new social environment. The dominant view of post-Partition population movement has been too restricted, privileging the experiences and sensibilities of a particular subset of refugees and omitting those of many others. This has contributed to the impression that the migration that really mattered was that of bhodrolok refugees from East Pakistan to West Bengal.”


বিভিন্ন লেখায় স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পুব-বাঙলার (বিষাদবৃক্ষ, খোয়াবনামা, বাঙালনামা প্রভৃতি) সমাজজীবনের যে ছবিগুলি পাওয়া যায়, সেখানে কিন্তু দেশ বিভাজনের একটা শ্রেণীভিত্তিও উঠে আসে, দরিদ্র মূলতঃ কৃষিজীবী নমঃশূদ্র সম্প্রদায় দেশভাগের কাছাকাছি সময়ে নিজেদের উৎখাত হতে হবে এধরণের ভয় খুব একটা পান নি, বরং এক স্বাধীন মর্যাদাসম্পন্ন বাংলার ছবি খুঁজে পাচ্ছিলেন। এই সম্প্রদায়ের খেতমজুর, বর্গাদাররা কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তানের শুরুর পর্যায়েও তেভাগা আন্দোলন করছেন মুসলিম প্রজার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এইসময় থেকেই পাকিস্তানি শাসক সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষ মদতে হিন্দুধর্মালম্বীদের ওপর আক্রমণ আসতে থাকে, স্বাধীনতার সময়ে যে খুলনা ছিল হিন্দুপ্রধান জেলা, সেখানেও ভয়াবহ দাঙ্গা হয় আর ক্রমশঃ নিম্নবর্ণের হিন্দুরা উপলব্ধি করতে থাকেন যে পূর্বপাকিস্তান তাঁদের বেঁচে থাকার অনুকূল পরিস্থিতি দেবেনা। নিম্নবর্ণের মানুষের এক্সোডাস শুরু হয় মূলতঃ ১৯৫০ পরবর্তী সময়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় অবধি সেই মহানিষ্ক্রমণ চলতে থাকে। এতদিন উদ্বাস্তু সমস্যা বলতে মূল ইস্যু ছিল বাসস্থানের, এবার পাশাপাশি এল জীবিকার প্রশ্ন অর্থাৎ জমির প্রশ্ন। নমঃশূদ্রের পক্ষে ভারতীয় মূলধারার রাজনীতি প্রায় সব সময়েই বিপ্রতীপ, ফলে উচ্চবর্ণের উদ্বাস্তুরা যে সহমর্মিতা পেয়েছিলেন, এখানে তার কিয়দংশও দেখা গেল না। আন্দামানে, দণ্ডকারণ্যে কলোনি বানিয়ে দায় মেটানোর কথা ভাবলেন সরকার। দণ্ডকারণ্যের ক্যাম্পজীবনের একটা ছবির সঙ্গে নারায়ণ সান্যালের লেখনীর কল্যাণে আমাদের পরিচয়। বর্তমান সংখ্যায় নির্মলেন্দু ঢালির প্রবন্ধে সেই কষ্টসংকুল জীবনের একটি বিশদ প্রত্যক্ষ বিবরণ আমরা দেখব। সুজলা-সুফলা বাংলার পরিবর্তে রুখাসুখা মালভূমীয় অরণ্য পরিষ্কার করে চাষাবাদ গড়ে তুলতে হবে তাঁদের, ঘর বানাতে হবে আদিবাসিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এবং সরকারি সাহায্য নিয়ম মতই অনিয়মিত। কমিউনিস্ট পার্টি দাবি করে বাঙালি প্রজার পুনর্বাসন যাতে বাংলাতেই হয়, ফলে কমিউনিস্টরা বাংলার রাজ্যশাসন পেতেই দণ্ডকারণ্যে পুনর্স্থাপিতরা ফিরে আসতে থাকেন এদিকে। কিন্তু, যথাযথ পুনর্বাসন কি তখনও জোটে? পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় এঁরা ছড়িয়ে পড়তে থাকেন, সংগঠিত আন্দোলনও আর গড়ে ওঠে না বরং ৪০-এর শেষার্ধের উদ্বাস্তু-লড়াই তখন অস্তপ্রায়। তবু, নতুন কলোনি গড়ে ওঠে, রেল লাইনের ধারে, খালপাড়ে, শহরের বাইরে বস্তি তৈরি হয়। আর, একটু অন্যরকম যাঁরা বাঁচতে চান তাঁদের ভাগ্যে জোটে মরিচঝাঁপির গণহত্যা। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এখনও এই অংশের উদ্বাস্তুদের কাছে স্বপ্নের অতীত। কলকাতা আর তার আশেপাশের নতুন উন্নয়নের জোগাড়ে এঁদেরই কেউ কেউ আবার উদ্বাস্তু হচ্ছেন। পুরোনো জায়গা-জমি, ছোট দোকান, ইস্কুল ফ্যাক্টরি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন নোনাডাঙা-সোনারপুর-গোবিন্দপুরে। কোথাও সেখানে গিয়ে নতুন করে গড়ে তুলছেন মহাশ্বেতাদেবী পাঠশালা, সেলাই-ইস্কুল, ছোট ছোট সারাই-ফ্যাক্টরি। কোথাও বা নতুন করে হাতে হাত মেলাচ্ছেন আসন্ন উচ্ছেদের বিরুদ্ধে।


বাঙালনামা এই সংখ্যায় বুঝতে চাইছে পুনর্বাসন ও উদ্বাস্তু আন্দোলনের বিভিন্ন খতিয়ান ও অভিজ্ঞতা-আলেখ্যগুলিকে। খুঁজে পেতে চাইছে সংস্কৃতির অন্য অঙ্গনগুলিতে, খেলায়, সিনেমায় বাস্তুচ্যুতির যন্ত্রণা, বাসা নির্মাণের লড়াইয়ের প্রতিফলন। এর পাশাপাশি আমরা আরেকটি বিভাগ শুরু করেছি (আগের সংখ্যায়) পূর্ববঙ্গের ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। সংসদীয় বাংলার চাপে যখন আমাদের ফেলে আসা ডায়ালেক্টগুলো আরও বেশি করে ইতিহাসে ঢুকে যাচ্ছে, না হয় ইতিহাসচর্চার মতন করেও ছুঁয়ে থাকা যাক সেগুলোকে! এর সঙ্গে থাকল বিগত দুটি সংখ্যায় চলতে থাকা তেভাগা আর্কাইভিং-এ আর কিছু সংযোজন। এখানে মনে রাখা দরকার যে এখন সবে শুরুর শুরু। সাক্ষাৎকার, লিখিত বয়ান ও মৌখিক বিবরণীর আকারে কাঁটাতার পেরনো, নতুন বসতি ও আত্মপরিচয় নির্মাণ, এবং বারবার উচ্ছেদ হতে থাকার নানাবিধ অাখ্যানগুলি খুঁজতে বাঙালনামা আগামী দিনে আরো বেশি সচেষ্ট হবে। পাঠকদের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকলো, এই কাজে যোগ দিন আপনারাও – বিশদে জানতে ইমেলে যোগাযোগ bangalnama@gmail.com-এ।


সূত্রঃ
*
http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_cities_proper_by_population_density
* যদুনাথ সরকার, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে, ইস্ট বেঙ্গল রিফিউজিদের কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণ
*
‘Dispersal’ and the Failure of Rehabilitation: Refugee Camp-dwellers and Squatters in West Bengal, Joya Chatterji, Modern Asian Studies, 2007, Vol. 41
* ‘‘I Am Not a Refugee’: Rethinking Partition Migration’, Md. Mahbubar Rahman & Willem Van Schendel, Modern Asian Studies, 2003, 37, 3: 551-584
* Divided Landscapes, Fragmented Identities: East Bengal Refugees and Their Rehabilitation in India, 1947-79, Gyanesh Kudaisy, Singapore Journal of Tropical Geography, 1996, Vol. 17
* Contesting Refugeehood: Squatting as Survival in post-partition Calcutta, Romola Sanyal, Social Identities, 2009, Vol. 15

4 Responses to “সম্পাদকীয় – দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা”

  1. lokendra sengupta said

    tothyo somridhyotaai o uposthaaponaar noipunye asaadhaaron!

  2. khub bhalo laglo pore.

  3. HASANUR MONDAL said

    APNADER EI SANGKHA TI PORE KHUB BHALO LEGECHE EBONG UPAKRITO HOYECHI. DOYA KORE JANABEN APNADER MAGAZIN ER CHAPANO SANGKHA BOI AKARE BER HOY KI NA EBONG AMRA KIBHABE PABO. AMI SANGGRAHA KORTE CHAI. DOYA KORE JODI E-MAIL ER MADHYOME JANAN UPAKRITO HOBO.

  4. Anusia said

    Another good post.

Leave a comment