বা ঙা ল না মা

কুপার্স ক্যাম্প – ‘বাংলার চম্বল’ থেকে শান্ত আবাস

Posted by bangalnama on December 22, 2010


– লিখেছেন শঙ্কর রায়

প্রায় তিন দশক আগের কথা। পূর্ব পাকিস্তান (এখন বাংলা দেশ) থেকে উচ্ছিন্ন শরণার্থীদের বহু ঠিকানার একটি রাণাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প-এ একজন রাজ্য সরকারী অফিসার হঠাত্ হাজির হলেন, সম্ভবত ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি নিজের পরিচয় দিতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন কুপার্স ক্যাম্প-এর অবহেলা-প্রতারণার শিকার মানুষেরা। কেউ কেউ অশ্রাব্য ভাষায় হুঁশিয়ারি দিলেন, প্রাণনাশের হুমকিও দিলেন। কিন্তু অফিসারটি একটুও রাগ দেখালেন না। তর্ক করতে চেষ্টা করলেন না। শুধু বললেন, “আপনাদের প্রতি অবিচার, অন্যায় করা হয়েছে, আমি তা জানি। কিন্তু আমাকে একবার সুযোগ দিন, কিছু না করতে পারলে আমি মাথা নীচু করে চলে যাব”।


তাঁরা কিছুটা নরম হলেন। সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি না দিলেও নীরবে যেন বললেন, “আচ্ছা, দেখা যাক।”


তার পরে যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য। মাত্র সাত মাসে। ৭০০-র কিছু বেশী পরিবারের পুনর্বাসন হয়ে গেল। প্রতেক পরিবারের প্রধানের নামে ৭০০০ টাকার ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলা হ’ল আর আড়াই কাঠা জমি পেলেন। তখন অফিসারটি হয়ে উঠলেন, সকলেরই প্রিয়জন। কেশব সেন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের ডেপুটি
ডাইরেক্টর।


তিনি যেদিন মহাকরণে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে বদলি হয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরে গেলেন, সেদিনই জানতে চান, তাঁর কি কাজ। বলা হ’ল শরণার্থী শিবিরগুলির পুনর্বাসন। মন্ত্রী অমৃতেন্দু মুখার্জি। নদীয়া জেলার সিপি আই (এম) নেতা ও পার্টির পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য। ডেকে পাঠালেন কেশববাবুকে। বললেন, বর্ধমানের ও অনুরূপ নির্ঝঞ্ঝাট শিবির। কেশববাবু জিগ্যেস করেছিলেন, সবচেয়ে জটিল ও সমস্যাকীর্ণ কোন শিবির। মন্ত্রীমশাই বললেন,’ কুপার্স ক্যাম্প’। কেশববাবু বললেন ওখানেই যাবেন ও সেখানেই পুনর্বাসনের প্রকল্প রূপায়ন করবেন। অমৃতেন্দুবাবু প্রায় শিউরে উঠলেন, “না না। ওটা বাংলার চম্বল। প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেন না”। কেশববাবু অনড়। “ওখানেই যাব এবং পুলিশ-নিরাপত্তা কর্মী ছাড়াই”। এবার অমৃতেন্দুবাবু ভীষণ রেগে বললেন যে, তিনি মন্ত্রী এবং তাঁর কথাই শেষ কথা। উত্তর – ঠিকই, কিন্তু তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, কারণ পুনর্বাসন তাঁর কাজ। তা যদি না করতে দেওয়া হয়, তাঁকে যেন হোম(পার্সোনেল)-এ ফেরত্ পাঠানো হয়, যাতে তাঁর অন্য দপ্তরে বদলি হয়। অনেকটা নাচার হয়ে নিমরাজি হলেন কমরেড মন্ত্রী। তার পরের দিনই গেলেন রাণাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে। যা ঘটেছিল, তা তো আগেই বলেছি।


দিনের পর দিন পড়ে থেকে জয় করতে পেরেছিলেন কেশববাবু। তার আগে কংগ্রেস, দু-দুটি যুক্ত ফ্রন্ট সরকার ও প্রথম বাম ফ্রন্ট সরকার কিছু করেন নি, কেবল জনগণের, খেটে-খাওয়া মানুষের সরকার আওয়াজ তুলে বিপ্লবী বুলি আওড়ে গেছেন। কেশববাবু নিজের মাইনে থেকে টাকা দিয়ে অনেকের ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলে দিয়েছেন, বিশেষত যাঁরা হত-দরিদ্র তাঁদের। সে কাজটাও সহজ ছিল না। প্রায় ৮০ জন অথর্ব, অথবা রোগজীর্ণ ছিলেন। নিয়ম অনুসারে এদের পি এল ( পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি) ক্যাম্পে পাঠাতে হয়। কেশববাবু তাই সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী মশাই ক্ষেপে গেলেন, অনুমোদন করতে চাইলেন না, কারণটা কাপুরুষোচিত। পুনর্বাসনের পুরো টাকা দিত কেন্দ্রীয় সরকার, পি এল ক্যাম্পের খরচ/পরিব্যয় রাজ্য সরকারের। তিনি প্রথমে বললেন, অনুমোদন করবেন না। বিনম্র অথচ ঋজু ভাষায় কেশববাবু উত্তর দিয়েছিলেন, “তাহলে আমি বলতে বাধ্য হব, যে আপনি অনুমোদন করেন নি।” নাচার মন্ত্রী মশাইকে শেষে অনুমোদন দিতেই হ’ল।


আত্ম-প্রচার শুধু নয়, এই অভিজ্ঞতাগুলি (যাদবপুর-বিজয়গড় ও কলকাতা বা তার পরিপার্শ্বে উদ্বাস্তু কলোনীগুলির পাট্টার কাজ ও ওঁরই সুপরিকল্পনায় সুসম্পন্ন হয়েছিল) লেখার প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। যে কথাগুলি লিখলাম, সেগুলিও বলতে চান নি। সখেদে বলেছিলেন, “জানেন, কুপার্স ক্যাম্প-এর মানুষেরা কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ট সমর্থক ছিলেন। তাদের সমিতির সম্পাদক, সভাপতি মাখন সরকার সবাই।”


কেশববাবু অবিভক্ত বাংলার সিপি আই-এর প্রার্থী সদস্য ছিলেন। তেভাগা আন্দোলনের সময় (১৯৪৫-৪৭) দিনাজপুর জেলার ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক। তেভাগা আন্দোলন সবথেকে বিস্তৃত হয়েছিল ওই জেলায়। তাঁর ভগ্নীপতি (মেজদির স্বামী) ছিলেন সুশীল সেন। জেলা সিপি আই-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সম্পাদক। কেশববাবুও জড়িয়ে পড়েছিলেন। বেশ কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তানে কারারুদ্ধ ছিলেন। কথাচ্ছলে বলেছিলেন, “দিনাজপুর কলেজে বি-এ ক্লাসে ইংরিজী পড়াতেন সুনীতি কুমার ঘোষ, পরবর্তীকালে বিখ্যাত নকশাল নেতা ও তাত্বিক। সেই সময় তিনি ছিলেন ঘোর কংগ্রেসী এবং কমিউনিস্ট-বিরোধী। জেলা ছাত্র ফেডারেশনের দপ্তর উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করলে বলেছিলেন, ওটা কমিউনিস্টদের ব্যাপার। তাই তিনি যাবেন না।”


কুপার্স ক্যাম্পের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের পর মাখনবাবু ও খগেনবাবু কেশব সেনকে নির্বাচনে দাঁড়াতে বলেছিলেন। বিধায়ক আসনে দাঁড়ালে জিততেনই। তখন কেশব বাবু ‘রাম গরুড়ের ছানা/ হাসতে তাদের মানা/হাসির কথা শুনলে বলে হাসব না না না না’ গোছের আমলা নন, ততদিনে তিনি ‘আমি তোমাদেরি লোক’।

One Response to “কুপার্স ক্যাম্প – ‘বাংলার চম্বল’ থেকে শান্ত আবাস”

  1. lokendra sengupta said

    Keshab sen ke chiniye debaar janya shankar babuke abhinondon!
    hridoygraahee lekhaa.

Leave a comment