বা ঙা ল না মা

ভানু বাঙালের কিস্স্যা!

Posted by bangalnama on October 8, 2008


মাসিমা, মালপো খামু!

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে যদি সেরা দশটি সংলাপের তালিকা কোনোদিন তৈরি করা হয়, তাহলে ওপরের সংলাপটি নিশ্চিতভাবে তারমধ্যে স্থান পাবে। কোন ছবি, সেটা আপামর বাঙালীর ঠোঁটের ডগায়। এই সেই ছবি, যেখান থেকে সূচনা হয়েছিল বাংলা ছবির এক সোনালী অধ্যায়। কিন্তু সে তো অন্য গল্প। আপাতত যাঁর মুখ দিয়ে এই সংলাপ বেরিয়েছিল, তাঁর কথা স্বল্প-পরিসরে বলা যাক। তিনি আমাদের সবার প্রিয় শ্রী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

পোষাকী নাম ছিল সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়, আর জন্মস্থান? এরকম চোস্ত বাঙাল ভাষা যিনি বলতেন, তিনি যে পূর্ববঙ্গেরই হবেন, সে নিয়েও কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। ভানু জন্মেছিলেন বিক্রমপুর জেলার মুন্সীগঞ্জে এই সেই বিক্রমপুর, যা কিনা বহু নামজাদা লেখক-শিল্পী-ডাক্তার-মোক্তার-আমলা-হাকিম, এমনকী পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরও জন্মস্থান। এইরকম একটি খ্যাতনামা অঞ্চল থেকেই উত্থান হয়েছিল ভানুর। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে হাস্যকৌতুকের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি।

ভানু জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ২৭শে অগাস্ট। সেন্ট গ্রেগরিস হাই স্কুল এবং জগন্নাথ কলেজে শিক্ষার পাট শেষ করে কলকাতায় আসেন ১৯৪১ সালে। এখানে এসে তিনি আয়রন এন্ড স্টীল কম্পানি নামে একটি সরকারি অফিসে যোগ দেন, এবং বালীগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে তাঁর দিদির কাছে দুবছর থাকার পর টালিগঞ্জের চারু অ্যাভিন্যু তে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।

ভানুর অভিনয়-জীবন শুরু হয় ১৯৪৭-এ, জাগরণ ছবির মাধ্যমে…দেশ স্বাধীন হওয়ার এই সময়টিকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিজের চাকরিজীবনের শৃংখলামুক্তির জন্যে। সেই বছরই অভিযোগ নামে অন্য একটি ছবি মুক্তি পায়। এরপর ধীরে ধীরে ছবির সংখ্যা বাড়তে থাকে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মন্ত্রমুগ্ধ(১৯৪৯), বরযাত্রী(১৯৫১) এবং পাশের বাড়ি(১৯৫২)। এরমধ্যে বরযাত্রী ছবিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যদিও সেখানে ভানুর উপস্থিতি সামান্যই ছিল।

১৯৫৩'র উলটোরথ পুরস্কার অনুষ্ঠানে - রাজেন সরকার, সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমারের সাথে।

১৯৫৫'র উলটোরথ পুরস্কার অনুষ্ঠানে - রাজেন সরকার, সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমারের সাথে।

১৯৫৩ সালে মুক্তি পেল সাড়ে চুয়াত্তর, এবং বলা যেতে পারে যে এই ছবির মাধ্যমেই ভানু দর্শকদের নিজের অভিনয়ের গুণে আকৃষ্ট করা শুরু করেন। এর পরের বছর মুক্তি পায় ওরা থাকে ওধারে…ঘটি-বাঙালের চিরন্তন বচসা নিয়ে এই ছবি, এবং এখানে ভানুর অভিনয় অনবদ্য। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে এই ছবিতে উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন থাকা সত্তেও কিন্তু ভানু তাঁদের পাশে সমানভাবে উজ্জ্বল ছিলেন, বাঙাল গৃহস্বামীর শ্যালক হিসাবে অভিনয় করেছিলেন তিনি।

জহর রায়

জহর রায় ও অজিত চ্যাটার্জির সাথে।

১৯৫৮ সালটি ভানুর জীবনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ওই বছরে মুক্তি পাওয়া অনেক ছবির মধ্যে দুটি ছিল ভানু পেল লটারি এবং যমালয়ে জীবন্ত মানুষ…এর মধ্যে প্রথম ছবিটি থেকে ভানু-জহরের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। গ্রাম্য ভানুর সেই জহুরে সম্বোধন এক কথায় অনবদ্য। জহর রায়ের সঙ্গে ভানুর একটা অসম্ভব রসায়ন ছিল, তাঁদের কমিক টাইমিং, সংলাপ বলার ধরন এবং দুজনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এতটাই ছিল যে সেইসব ছবি যারা না দেখেছেন তাদের পক্ষে অনুধাবন করা শক্ত। অবশ্য ভানু-জহর জুটির ছবি দেখেননি, এরকম বাঙালী মনে হয় খুব বেশি নেই।

যমালয়ে জীবন্ত মানুষ বাংলা ফিল্ম ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন। কাহিনীর বিশদ বর্ণনায় যাচ্ছি না, কিন্তু স্বর্গে গিয়ে ভানু যখন সব দেবতাদের সঙ্গে কথা চালাচ্ছিলেন, এবং তাঁদের যারপরনাই নাজেহাল করছিলেন, সেই দৃশ্যগুলি একদম সাজিয়ে রাখার মতন। এরমধ্যে চিত্রগুপ্তরূপী জহর রায়ের সঙ্গে ভানুর কথোপকথনগুলি দুর্ধর্ষ। দুএকটি নমুনা পেশ করা যাক –

নমুনা একঃ

ভানুঃ অকালমৃত্যুই যদি হবে, তবে জন্মালো কেন?

জহরঃ আজ্ঞে, ঠিকই তো, আমার সব কিরকম গুলিয়ে যাচ্ছে!

নমুনা দুইঃ

জহরঃ আজ্ঞে, সে আপনি ঠিক বলেছেন, দেবতারা যত না খাচ্ছেন, তার থেকে বেশি ছড়াচ্ছেন।

ভানুঃ ছড়াচ্ছেন! ছড়ানো বের করছি, একবার ফিরে যাই, কন্ট্রোলের লাইনে চালের জন্য যারা গুঁতোগুতি করছে, তাদের কাছে ব্যাপারটা ফাঁস করে দিচ্ছি; এরপর তারা যখন স্বর্গরাজ্যে এসে হামলা চালাবেন, তখন কত্তারা বুঝবেন ফুড ক্রাইসিস কাকে বলে!

জহরঃ হেঁ হেঁ হেঁ…তা তো বটেই!

ওখানেই নারদরূপী পাহাড়ি সান্যাল যখন সবে গান ধরার আগে গলা সাধছেন, ভানুর বক্তব্যঃ না না, চলবে না, আধুনিক জানা আছে? না জানলেও ক্ষতি নেই, আমি শিখিয়ে নেবখন, গলা কাঁপাতে পারেন তো?

যমালয়ে জীবন্ত মানুষ-এর আরেকটি অসামান্য মুহূর্ত ছিল হাম-হাম-গুড়ি-গুড়ি নাচ, যেটা ভানু ঊর্বশী কে শেখাচ্ছিলেন!! বাংলা কমেডি ছবির ইতিহাসে এই দৃশ্যটি অমর হয়ে থাকবে।

১৯৫৯-এ মুক্তি পায় পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট…এই ছবিতে ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, বিপরীতে ছিলেন রুমা গুহঠাকুরতা। শুধুমাত্র কৌতুক-অভিনেতাই যে তিনি নন, সেটা তিনি এই ছবিতেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাঁর লিপে দুটি গানও ছিল এই ছবিতে, এবং সেইসঙ্গে ছিল কিছু সোনায়-বাঁধানো সংলাপ, যেমনঃ আজ্ঞে আমার আসল নাম রমাপদ, কিন্তু বন্ধুরা পদ-ছাড়া করেছে!

এই ছবিতেই ছিল পিয়ানোকে টাইপরাইটার ভেবে ভানুর শিক্ষাদান এরকম হাসির মুহূর্ত বাংলা ছবিতে খুব বেশি নেই।

 

১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘৮০তে আসিও না ছবিটিতেও ভানু নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেন, এবং এখানেও ওনার বিপরীতে ছিলেন রুমা দেবী। এই ছবিতে মান্না দের কন্ঠে তাঁর লিপে তুমি আকাশ কখনো যদি হতে, আমি বলাকার মত পাখা মেলতাম, পাখা মেলতাম… গানটি খুবই রোম্যান্টিক এবং সেই সঙ্গে মজারও বটে। এই ছবিতেও প্রচুর দমফাটা হাসির মুহূর্ত আছে, পুকুরে ডুব দিয়ে পুনর্যৌবন-প্রাপ্ত হওয়া নিয়ে লোকজনের মধ্যে বিভ্রাট এবং বিতন্ডা খুবই উপভোগ্য। এখানে জহরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় ছিলেন।

 

মিস

'মিস প্রিয়ংবদা'র সেটে - লিলি চক্রবর্তী ও প্রেমাংশু বোসের সাথে।

১৯৬৭ সালে ভানুর আরো একটি ছবি মুক্তি পায়, মিস প্রিয়ংবদা যেখানে উনি চরিত্রের প্রয়োজনে মহিলা

সেজে অতুলনীয় অভিনয় করেন। এখানে ওনার বিপরীতে ছিলেন লিলি চক্রবর্তী।

 

ভানুর সম্পর্কে আলোচনা ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট ছবির উল্লেখ ছাড়া অসমাপ্ত রয়ে যাবে। এই ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে, এবং ভানু-জহর জুটির শ্রেষ্ঠ ছবি বলা যেতে পারে। এই ছবির প্রথম দৃশ্যে যখন এনাদের আবির্ভাব হয়, সেই প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শককে মাতিয়ে রাখে এই জুটি।

কমলা দুধ দেয়!!! গোয়ালিনী বুঝি? এবং এরপর, গোরুর কেস আমরা করি না, গোরু খুঁজতে হলে বৃন্দাবনে কেষ্টঠাকুরের গোয়ালে যান!…সেইসঙ্গে যথাযথ মুখভঙ্গী এ একমাত্র ভানুর পক্ষেই সম্ভব। ওনার মুখাবয়বের মধ্যেই এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে দর্শকরা না হেসে, মজা না পেয়ে থাকতে পারতেন না।

ভানুর শেষ ছবি শোরগোল মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৪-তে। এর কিছুদিন পরেই উনি পরলোকগমন করেন। আজীবন আপামর বাঙালী জাতিকে হাসিয়ে নিজের শেষযাত্রায় উনি সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেন। হাস্যকৌতুকের অভিনয় করলেও, ব্যক্তিগত জীবনে উনি খুবই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, যদিও রসবোধ ছিল ষোলআনা। সেইজন্যেই হয়তো মানুষকে আনন্দ দেওয়ার একটা সহজাত প্রচেষ্টা তাঁর ছিল।

বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন থাকবে, ততদিন ভানুও থাকবেন স্বমহিমায়। সিনেমা ছাড়াও কিছু হাস্যকৌতুক রেকর্ডেও তিনি নিজের দক্ষতার ছাপ রেখে গেছেন। এখনো যখন বাঙালী শুধুই হাসতে চায়, তার কানে বাজে সেই মাসিমা, মালপো খামু!

রচনা অরিজিৎ ব্যানার্জি

[বাংলা হরফে প্রতিলিখন প্রিয়াঙ্কা রায়]

তথ্য ও ছবি সংগ্রহ

১। http://bhanubandyopadhyay.googlepages.com/

২। http://www.munshigonj.com/MgonjSection/History1.htm

10 Responses to “ভানু বাঙালের কিস্স্যা!”

  1. Andromeda said

    Awshadaron lekha…koto ki drishyo mone pore gyalo! Bhanu Bandopadhyay ba Jahar Roy er maton character-actor chhara post-independence Tollywood just dnarato na! Aro ekbar seTa sundorbhabe mone korie debar jonyo Arijit ke dhonyobad. Tomar theke bhobishyote aro lekha porar jonyo unmukh hoe roilam 🙂

  2. Caesar said

    Daarun lekha, daarun chhobi! 🙂 Just ekta kotha: prothom diker “uni”-guloke “tini” likhle bodhoy better laagbe.

  3. bangalnama said

    @ Caesar, prostabTir jonyo dhonyobad 🙂

  4. madhurima said

    Onoboddyo.

  5. You are too good… Great post…

    Its not always you find a Bengali blog with Bengali write up… !! Book marked !!!

  6. bangalnama said

    @Choto Cheeta

    We are glad to have you as a reader! 🙂

  7. ambarish goswami said

    Thanks for the article.
    You can see Bhanu Bandopadhyay’s autograph
    http://www.ambarish.com/autograph/Artists_Performers/bhanu_bandopadhyay.html
    Hope you enjoy.

  8. mahasweta said

    খুব ভাল লাগল পড়ে। ভানু বন্দোপাধ্যায়ের ত অনেকগুলি জনপ্রিয় কৌতুক নক্সার সংগ্রহ আছে, যেগুলি অডিও ক্যাসেট এ পাওয়া যায়। সেগুলী সম্বন্ধেও কিছু কথা এখানে লেখা যেত। সেই হাস্যকৌতুক গুলির মধ্যেও কতগুলি অবিস্মরণীয় One-liner আছে, যেমন –
    ‘টিনের বাক্সে বারো টাকা’ – এই নক্সায় ভানু সবাইকে নানা বিষয়ে জ্ঞান দেন, আর তার আগে ১২ টাকা চান
    ‘ভয় কি, আমি তো আছি…’ – এটিও খুব সম্ভবতঃ ওই একই নক্সার।

  9. Anirban said

    দারুন লাগলো লেখাটা পড়ে –
    গত সপ্তাহেই দাদাঠাকুর-এ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়-কে (এবং বাকিদের) দেখে আবারও মনে হচ্ছিলো এ জিনিস আর হবার নয়!

  10. Bhanur audio book gulor ullekh na korle lekha ta osompurno theke jai…sei osamanyo “Bresh Bresh..drimu jrokhon trokhon srob krothatei drimu”, kotta-ginnir songlap, bhanur deshbhromon, bhanur kolkata gomon sob koti osadharon …

    seshe arijit ke oshesh dhonyobad.

Leave a comment