বা ঙা ল না মা

চান্দ্রদ্বীপি শোলোক শাস্তর পল্্কি কথা

Posted by bangalnama on December 22, 2010


– লিখেছেন মিহির সেনগুপ্ত

চন্দ্রদ্বৈপায়ন মনুষ্যেরা রোমন্থন বা জাবরকাটায় যে জবরদস্ত এলোমেলোবাগীশ এ-কথা রাঢ়ে বঙ্গে সবাই জানেন। বরিশাল নামক ভূভাগটিকে এই রচনায় চন্দ্রদ্বীপ বলে এবং তৎস্থানীয় ভূমিপুত্রদের চন্দ্রদ্বৈপায়ন অভিধায় ভূষিত করলে, আশা করি কেউ আপত্তি করবেন না। নামে কী আসে যায়?


দেশভাগ, দাঙ্গা, ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওন ইত্যাদি অজস্র কারণে জাবরকাটা স্বভাবটি এই উজানি দেশের মানুষদের যেন ষোলোআনা থেকে আঠারো আনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। যাঁরা সেই স্থান ত্যাগ করে এপারে এসেছেন তাঁরাও যেমন, আবার যাঁরা সেই স্থানে ছিটেফোঁটা এখনো আছেন তাঁরাও, সমান দড়। তা বলে কেউ ভাববেন না যেন, আমি শুধু ছিন্ন-শেকড় সংখ্যালঘুদের স্বভাবের কথাই এখানে বলছি। এ-স্বভাব সেখানকার সংখ্যাগুরুদের ক্ষেত্রেও ষোলো থেকে আঠারো আনা রয়েছে।


স্বভাবটি নিতান্ত গো-স্বভাব বটে, কিন্তু তাতে বিলক্ষণ আত্মমগ্নতা। ফলত, এই সব ছিন্ন-শিকড় দ্বৈপায়নেরা যখন কোথাও ‘দলামোচা’ হন, তখন ‘সকায় নিরুত্তিয়া’য় তাঁদের মুখে যে খই ফোটে, তার তুল্য রসবর্ষা এ পোড়া পরবাসে বড় সহজলভ্য নয়। তখন কখনও ‘নাইরকোল সুবারির’ বাগান-বিষয়ক, কখনও নদী, হাওড়, বাওড়, ‘বৃহৎ পুষ্করিণী’, খাল, বিলের অতিকায় স্বাদু মৎস্যাদির এবং এককথায় অতি সমৃদ্ধ এককালের গেরস্থালির পরণ-কথা, কখনও-বা সেই স্বর্গ থেকে উৎখাত হওয়ার বীভৎস এবং করুণ স্মৃতি রোমন্থনে উদ্বেল হয়ে ওঠা। সেই ক্ষণে, এপারে লব্ধ শীলিত ভাষা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে খাঁটি চান্দ্রদ্বীপি সকায় নিরুত্তিয়ায় মুখর হলে প্রতিবেশী ‘ঘটি’ পুঙ্গবদের হৃদয়হীন ‘ডিম্বকরণে’র পাত্র হয়ে থাকেন এঁরা। দেশভাগের পর থেকে এ কেত্তন অদ্যাবধি অব্যাহত। চন্দ্রদ্বৈপায়নী বা চান্দ্রদ্বীপি নিরুত্তিয়াটি একটু অতিপ্রাকৃত স্বভাববিশিষ্ট এবং ঘটি শ্রোতাদের ক্ষেত্রে পায়ুপ্রদাহী সন্দেহ নেই, কিন্তু সে-ফৈজত তো ঐতরেয় ব্রাহ্মণের যুগ থেকেই চলে আসছে দেবভাষাভাষিদের সঙ্গে প্রাচীন প্রাকৃতভাষীদের, তৎকালে সে-কারণেই না তামাম বঙ্গীয়কুল ‘ভাষাহীন পক্ষী’ বলে দেবভাষীদের দ্বারা আখ্যায়িত হয়েছিলেন। যথা- ইমাঃ প্রজস্তিস্ত্র অত্যায় মায়ং স্তানি মানি বয়াংসি বঙ্গ– বগধাশ্চেরঃ পাদ্যান্যনা অকর্মভিতো বিবিশ্র ইতি। এই মানসিকতাটিরই সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে ঘটি-বাঙাল সংলাপজনিত কাজিয়ায়।


যদিও এ আলেখ্য বঙাল বঙ্গীয় ভাষা বা শব্দ বিষয়ক নয়, তথাপি প্রসঙ্গটি এ কারণে তোলা হল যে, রোমন্থনের যে-বিষয় নিয়া বাকতাল্লা মারতে যাচ্ছি, তা একান্তভাবে অথবা প্রধানত চান্দ্রদ্বীপি শব্দজ বচন-বাচনে অাকীর্ণ।


প্রসঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে হঠাৎ করে, এমন আঁটঘাট বঁেধে রোমন্থন করা বা জাবর কাটতে বসার হেতু কী? তার উত্তরটিও সংক্ষেপে সেরে রাখাই ভাল। সবাই মানবেন যে কুল, মেল, শেকড়াদির সুলুক সন্ধান করা মানুষের প্রায় শাশ্বত এক স্বভাব। ঈদৃশ জাবরকাটায় সে-বস্তুর কিঞ্চিৎ খোঁজ-খবর অবশ্য পাওয়া যায়, এই আর কী। নইলে তো সবাই মহানগরের মহাসমুদ্রের জেলিফিস। কে কী বা কারা কোথা থেকে, তা আলাদা করে বোঝার সাধ্য থাকে না।


কিন্তু জাবরকাটার বিষয়টি কী? ‘নাইরকোল সুবারির’ বাগানের কথা বা গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর দুধ, ঘি, মাখনের গল্প আর কেউ এখন শুনতে চায় না। কিন্তু সেসবের পরেও তো অনেক কিছুই বলার থাকে। একদার সেই গ্রামীণ জীবনযাপন, যেখানে একদিন রকমারি কথাকার, পালাগায়ক, জারিয়াল-কবিয়াল, কামার-কুমোর, ধোপা-নাপিত মাগিমদ্দদের সঙ্গে সম্পৃক্তি ছিল, নিয়ত সাহচর্য ছিল অথবা রাখাল-বাগাল-হাতুয়া-বারমাস্যাদের সংযোগে অন্য এক জীবনপ্রবাহ, অন্য এক ছন্দ ছিল, তাদের কথা-কহবতের নির্যাসে যে-রোমন্থন, তার উৎসের যে অনন্ত পসরা নিয়ে আকুলি বিকুলি করতে করতে বেরোতে চায়; তার প্রবহন রুদ্ধ করে রাখলে এ উজানিরা বাঁচে কী করে?


সেই রোমন্থনে বসে একে একে সামনে এসে দাঁড়ায় হারিয়ে যাওয়া শেকড়-বাকড়। কেতাবি কথায় বললে তাদের নাম হয় কথাকাব্য, প্রবাদ-প্রবচন, হঁেয়ালি ইত্যাদি। আর চন্দ্রদ্বৈপায়নেরা তাদের সকায় নিরুত্তিয়ায় এ-সবের নামায়ন করেছে– শোলোক, শাস্তর, পল্্কি ইত্যাদি নামে।


বাল্যে, কৈশোরে এ-সবের ব্যাপক ব্যবহার প্রত্যক্ষ হয়েছে প্রতিবেশী লোকজীবনের সহস্র ধারায়। যারা কৃষি বা লোকায়ত শিল্পজীবনের কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত মানুষদের সংস্পর্শে থেকেছেন, তাদের কাছে শোলোক-শাস্তর-পল্্কির যে মহিমা ছিল, তা আজকের আত্যন্তিক ভোগবাদী বিশ্বায়নের উদ্দন্ড বিনোদনের প্রাচুর্যের দিনে ধারণায়ও আনা যাবে কি না সন্দেহ আছে। বর্তমান লেখকের বিশ্বাস যে, তাঁর প্রজন্মের অবলুপ্তির পর আলোচ্য সংস্কৃতির স্মৃতিমেদুরতা আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সেই কারণেই স্মৃতি থেকে যতটা লুপ্তোদ্ধার করে রাখা যায়, তাই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। সে যা-ই হোক, মূল কথায় যাবার আগে চন্দ্রদীপজ স্বভাবসম্মত একটু ভিন্ন কথায় পাকসাট মেরে মঙ্গলাচরণটির ইতি করব।


স্রোতের অনুকূলে চলাকে চন্দ্রদ্বীপে বলে গোণে চলা। প্রতিকূলে চলাটা উজান যাত্রা। যে-সব শোলোক-শাস্তর-পল্্কির পসরা পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাইছি, সেসব গোণের দিনের সপ্তডিঙার বা চৌদ্দ ডিঙার পসরা। সে-সব ডিঙাগুলি কবে কালীধে ডুবে গেছে তার ইতি-স্মৃতি তো কারুর স্মরণে নেই আজ। বিশেষ, গোণের দিন শেষ হয়ে ডিঙা চলেছে উজানে, গুণ টানাইয়ার কসরতে ডুবে যাওয়া ডিঙার ভেসে যাওয়া ঝরতি-পরতি খুদকুঁড়ো পসরার ডালি সাজিয়ে দিচ্ছি কোনোমতে। গ্রাহক মহাজন যদি হাতে তুলে নিয়ে পরখ করেন, ধন্য মানব এই অবেলার সওদাগরি। এখন তো আর ‘নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে’-র দিন নেই। গোণের গানের দিন শেষ। আমরা এখন ‘উজান গাঙের নাইয়া’। এখনও যে ভেসে আছি, তা কেবল গুণ টানাইয়ার গুণে। এমন অবস্থা যে গোণের গানের ধুয়াটি পর্যন্ত বিস্মরণে। শোলোকে আছেঃ


গোণ বুজইয়া নাও বায়
হ্যারে কয় নাইয়াডি
আসর বুজইয়া গান গায়
হ্যারে কয় গাইয়াডি
আর মন বুজইয়া কতা কয়
হ্যারে কয় মাইয়াডি


-এর ‘কোনোডিই’ হতে পারলাম না। এখন তো গোণের দিন গত। গোণ বুঝে নাও বাইতে পারি না। উজানের নাইয়া, গায়ের ঘাম ঝরিয়ে গুণ টেনেই যাচ্ছি। নাওয়ের পসরার কথা তো আগেই বলেছি ভেসে বত্তে থাকা চৌদ্দ ডিঙার ছিটেফোঁটা। তবে নাওয়ের পাছায় মূল নাইয়া একজন বসে আছে বটে, কিন্তু সে আমাদের দুখুমাঝি। সে বৈঠা একখানা হাতে নিয়ে গুণটানাইয়াদের দুঃখের গান গায়, কথা-কহবৎ, শোলোক-শাস্তর শোনায়। এগুলো হচ্ছে শেষেরও শেষে যে ‘তারপর’ থাকে, তার সম্বল। পাঠক, আসুন আমরা দুখু মাঝির কাছে সেই শোলোক, শাস্তর, পল্্কি পদ্য একটু শুনি আর স্মৃতিপথে পাড়ি দিই ধানাসিদ্ধি সুগন্ধা, কীর্তনখোলা বা আড়িয়ালখাঁর আশেপাশে। দগ্ধদেহ-প্রাণে যদি একটু ভিজে বাতাসের শীতল প্রলেপ লাগে। বর্তমানের স্বার্থাগ্নির নিয়ত দগ্ধতার দিনে তা হয়তো একটু ভিন্ন আস্বাদ এনে দেবে।


দুই


শোলোক কথাটির মায়ের নাম শ্লোক, সন্দেহ নেই। মা-মেয়ের মধ্যে বিরোধ নেই বটে, তবে তাদের চলার ধরণ ভিন্ন। হঁেয়ালি, ধাঁধা আর শোলোক বোধ করি মূলগতভাবে অভিন্ন। কালিদাসের নামে প্রচলিত ছড়াগুলোকে অন্যত্র কালিদাসের হঁেয়ালি বলা হলেও আমরা উজানিরা বলি কালিদাসের শোলোক। জানা নেই এই ভদ্রলোক কে। তবে তাঁর নামভণিতায় অন্যান্য স্থানের মতো অজস্র শোলোক চন্দ্রদ্বীপেও প্রচলিত। তবে সেখানে দ্বৈপায়নী সাংস্কৃতিক ভিন্নতা বর্তমান। যেমন–


কহেন কবি কালিদাস
শিশুকালের কথা
তিনশো তেত্তিরিশটা তঁেতুল গাছে
কয়ডা পাতা?


গোটা শোলোকটি শীলিত ভাষায় বলা হলেও একটি শব্দে চন্দ্রদ্বৈপায়নী স্থানীয় উচ্চারণ-প্রভাব লক্ষণীয়। শোলোকটি স্থানীয় রচনা নয় এবং একরকম হলপ করেই বলা যায় যে এটি পশ্চিম থেকে পুবে এসেছে। সে-কারণেই ‘কয়টা পাতা’ না হয়ে ‘কয়ডা পাতা’ হয়েছে। এই উদাহরণটি প্রথমেই ব্যবহার করলাম এ-কারণে যে, নবোত্থিত এই ভূভাগের জনগোষ্ঠী ঘটির দেশ থেকেই মূলত ভাটির দেশে এসেছে। কিন্তু ক্রমে এক ভিন্ন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে বিক্রমশালী হয়ে নিজস্ব ঘরানার সৃষ্টি করেছে। অন্য অনেক কিছুর মতো শোলোক, শাস্তর, পল্্কি ইত্যাদির কায়দাগুলোও জীর্ণ করে নিজস্ব ঘরানা অনুযায়ী সৃজন-বর্ধনের পথে চলেছে। এই অনুসিদ্ধান্তে হয়তো সাংস্কৃতিক জগতের ভিক্টোরিয় বেম্মজ্ঞানীদের মস্তকে “ঠাডা” পড়তে পারে। কিন্তু তা পড়লেও কিছু করার নেই। প্রসঙ্গত সামান্য টীকা সংযোগ করি। ঠাডাপড়া কথাটির অর্থ বাজ পড়া। সম্ভবত Thunder শব্দটির চান্দ্রদ্বৈপায়নী উচ্চারণে এর জন্ম। অন্যথায় এর Etymological root খুঁজে পাচ্ছি না।


তা উদ্ধৃত শোলোকটিতে ঐ একটি শব্দের উচ্চারণ যদি ঘটিদের শীলিত ভাষার অহংকারের পায়ুপ্রদেশে প্রথম বেণুযষ্ঠি হয়, তবে তার সম্পূর্ণ বিকশিত রূপটি পরবর্তীকালে কী দাঁড়াতে পারে প্রত্যক্ষ করুন– ভিন্ন শোলোকে-


দুই ঠ্যাং ছড়াইয়া
দেলাম ভরইয়া
উপারে চাপ
নীচে চাপ
হ্যার পর খাপে খাপ
– যা ভাবছ, হেয়া না বাপ।


স্মৃতিনির্ভর এইসব উদ্ধৃতি। ইতর বিশেষের সম্ভাবনা আছে। (স্পর্শকাতর পাঠক/পাঠিকাদের কাছে সকাতর অনুরোধ হৃদয়-ঘটিত ব্যামো থাকলে এ রচনা পড়বেন না, পড়লেও উপযুক্ত dose-এ Aspirin খেয়ে পড়বেন।) প্রথমোক্ত শোলোকটিতে যে শীলিত ভাবটি আছে, দ্বিতীয়টিতে যে তার নিতান্তই অসদ্ভাব, এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাব্যগত বিশিষ্টতাও প্রথমটিতে বেশি আকর্ষণীয়, বিশেষত, ‘শিশুকালের কথা’ এই পদবন্ধটিতে। কিন্তু অর্থ, ব্যাখ্যায় পরে যাওয়া যাবে। আগে আর কয়েকটি নমুনা বলে নিই।


পেট টিন টিন রসিক নাগর
বিনা বৈডায় বায় সাগর
মরলে সগ্্গে যায়
বেয়াক মাইনসে কিন্্ইয়া খায়।


অপর একটিঃ


পাই পয়সাও জোডে যদি আষ্ট গোন্ডা মাগি
খবরদার কিনইও না কেউ মুসলমান ছাগী।


এবং অরেকটি ঃ যার মায়েরে বিয়া করলাম না ঘেন্নায়, হ্যার মাইয়ায় আইয়া কয়, তালৈমশায় তামুক খাইয়া যাও।


উদ্ধৃত ছন্দোবদ্ধ এবং গদ্য বচন-বাচনগুলির প্রথম তিনটি শোলোক এবং পল্্কি উভয়ই। চতুর্থটি ছন্দোবদ্ধ শোলোক এবং শাস্তর এবং পঞ্চমটি অছন্দোবদ্ধ শাস্তরের নমুনা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সব পল্্কিই শোলোক কিন্তু সব শোলোক পল্্কি নয়, তা শাস্তরও হতে পারে, শুধুমাত্র সাধারণ শোলোকও হতে পারে। শাস্তর গদ্য এবং পদ্য উভয় প্রকারেই হতে পারে।


এপারে পল্্কিকে হঁেয়ালি বলা হয় অথবা ধাঁধা। পল্্কির চন্দ্রদ্বীপি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার উত্তর পলকে চাই। যেমন বর্তমান যুগের ক্যুইজ। তবে ক্যুইজে যতটুকু সময় বরাদ্দ থাকে পল্্কিতে ততটাও থাকে না। সেখানে পলক মানে পলকই। পল্্কি বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা এবং নমুনা দেওয়া হবে। এখন উদ্ধৃত পল্্কিগুলির উত্তর জানিয়ে পাঠক-শ্রোতাদের কৌতূহল দূরীকরণ এবং নিজেকে অশ্লীলতা দায়মুক্ত করা আবশ্যক হয়। প্রথমটির উত্তর “শিশুকালের কথা” এই পদবন্ধটির মধ্যেই নিহিত। কিন্তু শিশুকাল ব্যাপারটি কবির নয়, তঁেতুলগাছের। অঙ্কুরিত তঁেতুলবীজ দ্বিপত্রযুক্ত হয়। সুতরাং পল্্কিটির উত্তর ৩৩৩ x ২ = ৬৬৬।


দ্বিতীয় পল্্কিটির আপাত অশ্লীলতা সরিয়ে অর্থ করলে দাঁড়াবে– জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটা। চন্দ্রদ্বীপি ভাষায় যেহেতু জাঁতি বলে না, তাই তাদের ভাষা অনুযায়ী বললে হবে– শরতা দিয়া গুয়া কাডা। এটির অর্থ নির্দোষ হলেও বাক্্রীতিটি যে অশ্লীল, এ-কথা অস্বীকার করা যাবে না। তবে চন্দ্রদ্বৈপায়নেরা অশ্লীলতার ভিন্ন ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী। কিন্তু সে আলোচনায় বিশদ হওয়ার স্থান এই আলেখ্য নয়। সব মানুষ সমান হয় না। কেউ তালের সুমিষ্ট তক্র পছন্দ করেন, কেউ বা তাকে গঁেজিয়ে নিয়ে পান করে ভূমানন্দ লাভ করেন। এ-সব নিয়ে বেকার ন্যাকামো করে লাভ নেই।


তৃতীয়টিও পল্্কি। অর্থ শামুক। শামুকের খোলা দিয়ে চুন হয় এবং পানের সঙ্গে তা অনুপান হিসেবে পান-আসক্তরা খেয়ে থাকেন। এটি জাতিগতভাবে চান্দ্রদ্বীপিয় হলেও অশ্লীলতা-প্রযুক্ত নয় বলে ঘটিপুত্ররা ভাটিপুত্রদের কাছে, বিশেষ করে এই কালিদাস মাশাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে পারেন। তবে অশ্লীল বা আপাত-অশ্লীল পল্্কির সংখ্যা নগণ্য। শোলোক-শাস্তরের ক্ষেত্রে সে-কথা খাটে না। এগুলো একসময় চূড়ান্ত ভাবেই গ্রামীণ জীবনের আড্ডা-বিলাসের বিষয় ছিল। নিস্তরঙ্গ পল্লীজীবনে এর উপযোগিতাও তুচ্ছ ছিল না। তবে তার অভ্যন্তরে লোকশিক্ষার যে দিকটি ছিল তাও উপেক্ষণীয় নয়। কারণ বহু সংখ্যক পল্্কি, শোলোক এবং শাস্তরের মধ্যেই দেখা যায় প্রাচীন গ্রাম-বৃদ্ধদের নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতার নির্যাস। পরে যখন আমরা ব্যাপক শোলোক-শাস্তরের নমুনা উল্লেখ করব, তখন অবশ্যি এ সত্য আমরা উপলব্ধি করব। পল্্কি এবং শোলোক উভয়ের মধ্যেই ছন্দোবদ্ধতা একটি সাধারণ ধর্ম। কিন্তু পল্্কি ক্রমবিকাশের যে নাগরিক কৌলিন্যে ক্যুইজ হল, সেখানে এই ছন্দ ব্যাপারটি আজ পরিত্যক্ত। মনে হয় ছন্দোবদ্ধতার সঙ্গে গ্রামীণ জীবনের কোনও নিকট সম্বন্ধ আছে। নাগরিকেরা বড় কেজো আর গদ্য-স্বভাবী। তারা হাসেও গদ্যে, কাঁদেও গদ্যে।


শুভঙ্করের আর্যা অথবা ভাস্করাচার্য লীলাবতীর পাটিগণিতিক ছড়ায় পল্্কি বা শোলোকের এই ছন্দপ্রবণতা দেখা যায়। যথা শুভঙ্করের–


“মণের দামের বামে ঈলেক মাত্র দিলে
আধ পোয়ার দাম শিশু নিমেষেতে মিলে।”


অথবা–


“কুড়োবা কুড়োবা কুড়োবা লিজ্জে
কাঠায় কুড়োবা কাঠায় লিজ্জে
কাঠায় কাঠায় ধুল পরিমাণ
বিশ ধুলে হয় কাঠার প্রমাণ।
ধুল বাকি থাকে যদি কাঠা নিলে পরে
ষোল দিয়ে পুরে তারে তত গন্ডা ধরে।”—ইত্যাদি।


অথবা লীলাবতী ‌উবাচ–


“একদিন চারি বুড়ি আহারে বসিয়া
বয়স গণনা করে হাসিয়া হাসিয়া–” ইত্যাদি।


অথবা–


“আসছি যত আসব তত
তার অর্ধেক তার পাই
তোমায় নিয়ে শতেক ভাই।” –ইত্যাদি।


লক্ষণীয় লীলাবতীর পাটিগণিতিক ছড়াগুলি সবই পল্্কি প্রকৃতির, অর্থাৎ প্রবলেম বা সমস্যা। আর শুভঙ্করবাবুর আর্যাগুলো সব শোলোকের পর্যায়ে পড়ে। সেখানে তার সবগুলোই তত্ত্ব বা থিয়োরেম। লীলাবতী যদি তাঁর পল্্কির মাধ্যমে একটা অঙ্ক কষতে দেন, শুভঙ্কর তাঁর শোলোকে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য তত্ত্ব বা রাস্তা বাতলে দেন। যদিও এগুলো বৃহদ্্বঙ্গীয় ব্যাপার-স্যাপার, তবু শেকড়ে গোত্তা মারতে গেলে তো ঢুঁটা সেখানেও লাগবে। তবে চান্দ্রদ্বীপি oral tradition বা মৌখিক পরম্পরার আলোচনায় তা ব্যাপকভাবে আনছি না। একটি কথা শুধু এর মধ্যে বলে নিই যে, লীলাবতীর ছড়ায় রয়েছে অঙ্কের জটিলতা আর পল্্কির ছড়ায় শব্দের। শোলোক আর পল্্কির তফাৎ বোঝার জন্য আর একটি উদাহরণ দিচ্ছি এবং তা সকায় নিরুত্তিয়াতেই, মানে কিনা আপনা বুলিতেই। যথা–


মাগির ঘরে পাতিল কাইত
লাঙের পিরিত হারা রাইত।


এটিকে যদি কেউ অশ্লীল বলতে চান বলুন, তবে মর্মগত করুণ দিকটির কথাও একটু মাথায় রাখবেন দয়া করে। সে যা হোক এটি কিন্তু পল্্কি নয়, শুধুই শোলোক। শাস্তরও নয়। এই ধরনের শোলোকগুলিকেই সম্ভবত হিন্দুস্থানিতে ‘কহাবত’ এবং বাংলায় সাধারণভাবে প্রবাদ-প্রবচন বলা হয়ে থাকে।


তিন


এতক্ষণ শোলোক, শাস্তর এবং পল্্কি– এর সব কটিরই একটা সাধারণ আলোচনা করা হল। এই অধ্যায়ে একান্তভাবেই পল্্কির বিষয়ে খানিকটা বিস্তারিত বলব। পুনরায় পাঠক-পাঠিকাদের চেতাবনি দিই, মহাশয়-মহাশয়াগণ, মূলাধারে চন্দ্রদ্বীপ এবং তত্রস্থ ভূমিপুত্রদের স্বাভাবিক নিরুত্তিয় মাধ্যমে যাবতীয় পসরা বিকোতে বসেছি। অতএব অগ্রপশ্চাৎ চিন্তায় রেখে সওদা করবেন, এমত প্রর্াথনা। শ্লীলাশ্লীলের গ্যারান্টি দিতে পারব না। যা হোক, বিষয়ে ফিরি।


পল্্কি ব্যাপারটা মূলত মজা করার ব্যাপার। একটা বুদ্ধির খেলা। হঠাৎ বুদ্ধি বা ready wit-এর কসরৎ বলা যেতে পারে একে। সম বা অসমবয়সিদের মধ্যে আড্ডা দেওয়ার সময়, ছোটবেলায় দেখেছি পল্্কির প্রতিযোগিতা হত। আর হত বিয়ের আসরে বর বা বরযাত্রীদের ঠকানো বা কায়দা করার জন্য। সেকালের দিনগুলোতে ঠাকুমা, দিদিমা, ঠানদি বা গ্রাম সুবাদে ঠাট্টা সম্পর্কীয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা রসিক-রসিকা থাকতেন, তাঁরাই এর চর্চা বেশি করতেন। ব্যাপারটা অপবর্গ/বর্গীয় সমাজেই বেশি প্রচলিত ছিল। উচ্চবর্গ/বর্ণের মানুষদের মধ্যে ততটা ছিল না। সম্পন্ন গেরস্থ বা জমিদার, তালুকদার বাড়ির ঝি-চাকরদের মধ্যে অবসর বিনোদনের সময়ও পল্্কির খই ফুটতে দেখা যেত। তবে আমার স্মৃতিতে, পাড়ার আইবুড়ো মেয়েদের জটলায় এর ব্যাপক ব্যবহার দেখেছি।


সুস্থিত গ্রামীণ সমাজের সুদিনে ছিল এইসব আমোদপ্রমোদের সমারোহ। বর্ষার অলস মধ্যাহ্নে বা শরতে যখন দুর্গাঠাকুর বানাবার জন্য কুমোরেরা ‘ব্যানা’ বাঁধতে বসত, অথবা শীতের সন্ধ্যায় বা রাত্রে যখন বাঁশের খুঁটোয় হ্যারিকেন ঝুলিয়ে গেরস্থের হালিয়ারা গোরু দিয়ে ধান মাড়াই করত– তখন জটলা বসত পল্্কির। এ শুধু অবসর বিনোদন নয়, কাজের একঘেয়েমি কাটানোরও একটা উপায় ছিল এটা। অবশ্য শীতের রাতে আগুনের কুন্ডলীর চারদিকে ঘিরে বসা মানুষেরা কামলা-মাহিন্দরদের উদ্দীপনার জন্য পল্্কি ছাড়াও আরও অনেক কিছুর আয়োজন করত। কিস্্সা, পরণকথা, এটা-সেটা কত কী। তখন গ্রামীণ জগতে এসবই তো বিনোদনের উপায়।


আজ সমাজ বিবর্তিত হয়ে যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেখানে শহর, নগর, গ্রামের সর্বত্রই লোকরঞ্জনের রকমারি উপকরণ। নিত্য উৎসবের মত্ত আয়োজন। পল্্কি-টল্্কির মতো ঠান্ডা আমোদে এখন আর শানায় না। পল্্কির দিন আর নেই।


মাঝে মধ্যে পথচলতি, রেলের কামরায় কখনও চমকে উঠি ফেরিওয়ালার খদ্দের-আকর্ষণী রগুড়ে গলার আবৃত্তিতে–


সকালবেলায় দেখাশোনা
দুপুরবেলায় বিয়ে
সন্ধ্যেবেলায় এল বউ
ছেলে কোলে নিয়ে।


এবং তৎসহ মজাদার সব ব্যাখ্যান। তার রকমারি বেসাতির মধ্যে থেকে উঁকি দেয় বটতলার ছাঁদে দু-একটা চটি বই। তখন মনটা পিছন দিকে তাকায়, আর তার পর্দায় ভেসে ওঠে অতীতের নানারঙের ছবি। তখন মনটা বিষন্ন হয়ে গেলেও ভাবতে ভালো লাগে, এইসব পল্্কি-কথা, কালিদাসের হঁেয়ালি, ‘কী করলে কী হয়’ ইত্যাদি তা হলে আজও চলে কোথাও কোথাও? এখনও এর গ্রাহক আছে তবে? হয়তো আছে। কিন্তু তা যে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে তা-ও অস্বীকার করা যাবে না। কারণ পল্্কির বাস্তুভূমি ছিল পল্লী অঞ্চল। কিন্তু পল্লীগ্রাম বলে যে চিত্রটি আবহমান কাল ধরে আমাদের মনোজগৎ অধিকার করেছিল, তার সেই রূপ বা চরিত্র কী বর্তমানে আছে?


সে আলোচনা থাক। এখানে কয়েকটি চান্দ্রদ্বীপি ঘরানার পল্্কির নমুনা দিই। এর অনেক কিছুই হয়তো অনেক পাঠকের জানা। তবু জাবরকাটার সময় একটু মনে পড়িয়ে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না। দেখবেন বিগত কালের কত কথা, কত ছবি, আর কত স্মৃতিই না এরা বহন করে। এগুলো সবই চান্দ্রদ্বীপি পল্্কি। বৃহদ্্বঙ্গে নিশ্চয়ই এর সমতুল্য লক্ষ হাজার উদাহরণ খোঁজ করলে পাওয়া যাবে। নীচে পর পর পল্্কিগুলো এবং তার উত্তর দেওয়া হচ্ছে।


যা দেবা তাই খামু
জল দিলেই মরইয়া যামু। — আগুন।


তুই জলে মুই ডালে
দ্যাহা অইবে মরণ কালে। — মরিচ (লঙ্কা)।


ঘর করলে করতে অয়
হুইয়া পড়লে দিতে অয়। — ঘরের বা হুড়কো।


দ্যাখথে রাঙা গোড়ায় ফল
চাম ছাড়াইলে গোন্দে পাগল। — পঁিয়াজ।


কালকাসুন্দির জঙ্গলে
কালা হরিণ চড়ে
দশ পেয়াদায় ধরে
এক পেয়াদায় মারে। — উকুন।


ওই ছেমড়ি খাড়ইয়া
চৈদ্দ হাত বাড়াইয়া
নিত্য নিত্য কাপুড় ছাড়ে
ক্যাৎকুলিদ্দা পোলা বাইর করে। — কলাগাছ।


ফুডার মইদ্যে হান্দাইয়া
লাড়ালাড়ি করে।
কহন বোজে কহন খোলে
থাহে বেয়াক ঘরে। — তালাচাবি।


খাওনের দইব্য নয়
তমো খাইতে অয়
বুড়া ধুরায় খাইলে হ্যারগো জীবন সংশয়।
যুয়ান যুবতী খাইলে আড়ে ঠাড়ে চায়
পোলাপানে খাইলে কান্দ্ই‌য়া গড়াগড়ি যায়। — আছাড় খাওয়া।


জীব না জন্তু না বীক্ষ বনস্পতি
হাত নাই পা-ও নাই ক্ষিতি তলে স্থিতি।
হ্যার ধারে গ্যালে মোরা দ্যাহে শান্তি পাই
কওছেন দেহি হেন ধন কিবা আছে ভাই। — ছায়া।


নিরাকার প্রাণী এক জঠরে নিবাস
কখনও গোপনে চলে কখনও প্রকাশ
শব্দ মাত্রে হাসায় নাসায় প্রবেশে
জন্মিলে নারীর গর্ভে সর্ব্বলোকে হাসে। — বাতকর্ম।


এই রচনাটি কোনওমতে চান্দ্রদ্বৈপায়নী শিল্পকর্ম নয়। ভাবের দিক দিয়ে খানিকটা তৎস্থানীয় প্রসাদগুণ আছে বটে, ভাষায় আদৌ কোনও অভিজ্ঞান বহন করছে না। বস্তুত এই পল্্কিটির উত্তর যতই অস্বস্তিকর হোক, রচনা-রীতিটি আঙ্গিকের বিচারে যে উত্তম, সে বিষয়ে সন্দেহ কী? এতটা বাচিক শৈলী চন্দ্রদ্বীপস্থ অপবর্গী/বর্ণীয় মন্ডলে কদাচ মেলে কি না সন্দেহ।


হাত নাই পা-ও নাই বেয়াকেরে ধরে
আলো ঠেহে অন্ধকার মাথা নুইয়া পড়ে। — মাথাধরা।


শোলোকটি/পল্্কিটি উত্তম বুনোটের। ভাষাটি চান্দ্রদ্বীপি হলেও শীলিত ভাবটির রহস্যময়তা প্রায় প্রাকৃত কবিতার সমধর্মী। এ কারণে এর ঘরানা নির্ধারণ একটু কষ্টকর বটে।


তুলসীতলায় দিলাম সাড়া
রাও ছুড্্ইয়া যায় হগল পাড়া। — শঙ্খধ্বনি।


বেয়াকের হাতে আছে তমো কয় নাই
হাত বাড়াইয়া ধরতে গেলে লাগোল না পাই। — কনুই।


ঘরের মইদ্যে ঘর
তার মইদ্যে শুইয়া আছেন তাল বিদ্যাধর। — মশারি।


শোনোনের কতা না বোজোনের কতা
শুদ্দুরের আড়াইয়া বিচি বাওনইয়ার মাতা। — পাঁঠাবলি।

পুজোয় পাঁঠা বলি দিলে মাথাটি ব্রাহ্মণের প্রাপ্য হয় এবং অন্ডকোষ শূদ্রের, যে পাঁঠার ঠ্যাং টেনে ধরে তার।


তিন অক্ষরের নাম তার জলে বাস করে
মাঝের অক্ষর কাড্্ইয়া দিলে পাখনা মেলইয়া ওড়ে। — চিতল মাছ।


দুই অক্ষরে নাম মোর লম্বা গাছের ফল
মুই ছাড়া নাচে গানে হয় গন্ডগোল।
আগে পিছে কর যদি সাপ অইয়া যাই
আখেরে কইলাম কী, কওছেন দেহি ভাই। — তাল।

(উল্টোলে লতা। গ্রাম গাঁয়ে রাত্রে সাপকে লতা বলা হয়।)


একলহে থাহি মোরা পঞ্চজনা ভাই
এট্টাই প্যাট কিন্তু পঞ্চজনে খাই। — হাতের পাঁচটি আঙুল।


কাড্্লে যে মরে না, না কাড্্লে মরে
আঙুল ছোঁয়াইলেই মায়ের কথা মনে পড়ে। — নাড়ি/নাভিদেশ।


পল্্কির কথার এখানেই ইতি করছি, যদিও এর সংখ্যা অনুমান করাও দুঃসাধ্য। সে তুলনায় এটুকু গোস্পদে জলমাত্র।


চার


এতক্ষণ শোলোক আর পল্্কির বিষয়ে সামান্য দু-চার কথা বলার চেষ্টা করলাম বটে, তবে চান্দ্রদ্বীপি আসল রসের জায়গাটা নাড়াঘাটা করা হল না। পল্্কি বড় পলকা। বললাম, উত্তর দিলাম, হয়ে গেল। শোলোক ব্যাপারটা, আগেও যেমন আভাস দিয়েছি, সে সর্বঘটে কাঁঠালি কলা। সে ‘এ্যায়ও আছে অয়ও আছে।’ পদ্যে তো আছেই, কারণ সে যে শোলোক। আবার গদ্যেও যে নেই, তাই বা জোর করে বলি কী করে। এখন আসল রসের ভান্ড নিয়ে নাড়াঘাটা করার ইচ্ছে। তার নাম শাস্তর। সেখানেও সে পদ্যে-গদ্যে বিরাজমান। কিন্তু সে-গদ্য কী গদ্য? সে তো পদ্যের বাপের ঠাকুর।


শোলোক যখন শাস্তরে বিস্তার পায়, তখন বেদনার মতো প্রাণে এক নিরুদ্ধ নিঃশ্বাস জেগে ওঠে এবং পদ্য তখন অমনি এসে যায়। যেন কবেকার এক স্বপ্নের হরিণ মনের মধ্যে বাসা বঁেধে ছিল। সেই হরিণ এখন ছুটোছুটি করছে স্মৃতির তল্লাট জুড়ে। তাকে বুঝি কবে অবিশ্বাস করেছিলাম, এখন সেই অবিশ্বাসকে ভোলার জন্য এই আয়োজন সাজিয়ে বসেছি। কাব্য-কবিতার কথা থাক। বরং যেখানে সবাই নির্বাক, সেখানেই মুখ খুলি। ইচ্ছে হয় বলি, শোনহে শেষের দুই কলি।


এই গদ্য-পদ্য শাস্তর কথা এখন যা বলব, তার মধ্যেই চন্দ্রদ্বীপ তথা সর্বস্থানীয় গ্রামীণ তাবৎ প্রবাদ-প্রবচনাদি বিধৃত। তবে এই শাস্তর কথাটি শাস্ত্রশব্দজাত হলেও তা কোনও মনু, পরাশর অথবা কৃষ্ণানন্দ, রঘুনন্দনীয় শাস্ত্রের কচকচি নয়। এর সবটাই লোকজ শাস্ত্র। শাস্তর, শোলোক, পল্্কি, কথা, পরণকথা অথবা কিস্সা-কাহিনী — সবই একই সংস্কৃতির ধারা। সামান্য ইতর বিশেষে ভিন্ন। গোত্র একই। পরণকথা, কথা বা কিস্সা-কাহিনী একটু দীর্ঘ হয়। শোলোক-শাস্তর ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত। কিন্তু এরা সবাই ব্যবহারিক দিক দিয়ে নানান পথবাহী হয়ে থাকে। বিশেষ করে শাস্তর তো হাজার এক পথে বিচরণকারী। তবে পরণকথা বা কিস্সা শাস্তরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে না। শাস্তরের কিন্তু অবাধ গতি। সে জুতমতো পরণকথা ইত্যাদির মধ্যে দিব্য নিজের স্থানটি করে নেয়। পরণকথা, কিস্সা একটু ধীর গতি। এ কারণে চান্দ্রদ্বীপি রসিক পরণ-কথাকার বলেছেন,


পরণকথার কতা
হ্যার আগে বাইর অয় হাও পাও
হ্যাষে বাইর অয় মাতা। (সব ‘ত’ গুলোই ‘থ’ হবে।) টীকা নিষ্প্রয়োজন।


শাস্তর কথাটি সংক্ষিপ্তাকারে আগেই বলেছি। ছোটবেলায় মা, ঠাকুমা, মাসিমা, পিসিমা অথবা গাঁয়ের নাপিত, বুড়ি, ধোপা বুড়ি ইত্যাদিদের মুখে শাস্তর-কথার খই ফুটতে দেখেছি। হিন্দু, মুসলমান অপবর্গী সমাজে এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। এ-ক্ষেত্রে কোনও সাম্প্রদায়িক নিষেধাজ্ঞা বা মার্গভেদ ছিল না। আচার-বিচারের বিধিনিষেধও নয়। শুধুমাত্র এর বাচিক ব্যবহার, শ্রোতা-গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে বক্তার শ্লেষ, ব্যঙ্গ, যা সাবধানবাণীর প্রয়োগের খাতিরেই ব্যবহৃত। এ-ক্ষেত্রে বক্তারা তাঁদের বক্তব্যের ঋজুতা, অকাট্যতা ইত্যাদি প্রমাণ করার জন্য মাঝে মাঝেই বলতেন, আরে, একথাডা মানবা না? এডাতো শাস্তরের কথা, তা সে কথাটি কো শাস্তরে আছে, বা সেই শাস্তরের স্বরূপটিই বা কী, তার উল্লেখ করা বক্তাও প্রয়োজন বোধ করেন না, শ্রোতাও জানতে চান না। “শাস্তরে আছে” বা “শাস্তরে কইছে”, “এডাতো শাস্তরের কথা”– এ রকম এক প্রাক্্-ঘোষণা সহ চন্দ্রদ্বৈপায়ন সাধারণজন এর প্রয়োগ করতেন। পরম্পরাগত সামাজিক বিধিনিষেধ জারি, ঠাট্টারসিকতা, অথবা শ্লেষ ইত্যাদির প্রয়োগই এর উদ্দেশ্য। এর সাহায্যে বক্তারা তাঁদের কোনও বিষয়ে বক্তব্যকে জোরদার করার প্রয়াস পেতেন। সম্ভবত একদার গ্রামীণ সমাজজীবনের সংহতি রক্ষার জন্য এ-সবের সৃষ্টি হয়ে থাকবে। আবার হিন্দু বা মুসলমান সমাজের পারস্পরিক ভেদাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উক্তিকরণও এর অন্যতম উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। ক্রমশ এগুলো বিভিন্ন ধারায় বিবর্তিত হয়েছে। যাঁরা এইসব শাস্তর একদা ব্যাপকভাবে বলতেন, তাঁদের বচনে প্রকৃত শাস্ত্রের বিধিনিষেধের মতো একটা ভারবত্তা নিশ্চয়ই কাজ করত এবং গ্রামীণ সামাজিক লোকশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যপারটি সবিশেষ উপযোগী ছিল বলেই মনে হয়। ক্রমশ স্থূল রসিকতা, অকারণ অশ্লীলতা ইত্যাদির প্রকোপ ঘটতে থাকলে শিক্ষিত সমাজে এর প্রচলন কমতে থাকে। বর্তমানে পরম্পরাগত গ্রামীণ জীবন একান্তভাবে নিস্তরঙ্গ হওয়ায়, বিশেষত নাগরিক বিমিশ্র সংস্কৃতির প্রভাবে অতীতের এই সংস্কৃতির ব্যাপক অবলুপ্তি ঘটেছে সর্বশ্রেণীর মধ্যেই। তবুও যেহেতু গ্রামীণ বিশ্বে কৃষিকর্ম মানুষের একটি প্রবল সংস্কার, সে কারণে এইসব শোলোক, শাস্তরাদির ব্যবহার এখনও একেবারে দেখা যায় না এমন নয়।


এইসব শাস্তরের কথার মধ্যে একটা বড় অংশ হচ্ছে ডাক বা খনার বচনের অনুরূপ বচন। ডাক ও খনার বচন একসময় লিখিত রূপ পাওয়ায়, তা সহজলভ্য। এখানে যে সব শাস্তরের উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে তা বেশির ভাগই অন্যান্য লোক-সংস্কৃতির মতোই শ্রুতিস্মৃতির কথন-পরম্পরা বা Oral tradition-এর সনাতন ধারা ধরেই চলেছে। ডাক, খনা কালিদাস ইত্যাদি নামভণিতায় লভ্য কোনও শাস্তর এখানে উদ্ধৃত করা হল না। উদাহরণ হিসেবে প্রথমে উল্লেখ করছি এমন কিছু শাস্তর, সেগুলো বাঙালি সমাজের বিভিন্ন জাতের চরিত্র-লক্ষণ প্রকট করার জন্য সৃষ্ট হয়েছিল। এগুলো যে শুধু চন্দ্রদ্বীপস্থ গ্রামগুলিতেই প্রচলিত এমন নয়। সারা বাংলায়ই এ-সবের ব্যবহার একদা ব্যাপকভাবে ছিল, তবে চান্দ্রদ্বীপিয় ব্যবহারের বিশেষতা হচ্ছে তার প্রয়োগশৈলীর তীব্রতা। অবশ্যই তা অন্যান্য স্থানের চাইতে অনেক ঝাঁজাল। আঞ্চলিক উচ্চারণের তীক্ষ্ণতা, শব্দ ব্যবহারের দুর্দম ক্ষাত্রতেজ, শব্দচয়নে অকুন্ঠ আঞ্চলিক সংকোচহীনতা এবং সর্বোপরি রচনাটির উপস্থাপনায় উৎকট শারীর বিক্ষেপ এই বিষয়টির অনন্যতা প্রকট করে বলে চান্দ্রদ্বীপিয় রীতিতেই বিষয়টিকে পেশ করা হচ্ছে। এখানে ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ, মুসলমান, ধোপা, নাপিত, কামার, তেলি ইত্যাদি জাতীয় মানুষদের বিষয়ে প্রচলিত কিছু শাস্তর প্রাথমিক ভাবে স্মৃতি থেকে উল্লেখ করা হচ্ছে। পরে অন্যান্য বিষয়ে সাধারণভাবে বিস্তারিত হওয়া যাবে। প্রথমে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের দিয়েই শুরু করা যাক।


বামুন বিষয়ক শাস্তর

বাওনার দুয়ারে বিলাইডার ল্যাহান। — অর্থাৎ বেড়াল যদি কোনও ব্রাহ্মণের দরকার কাছে অপেক্ষা করে তবে কোনও আমিষ আহারের সুযোগ অথবা নিহত হওয়ার ভীতি কোনওটাই তার থাকে না।


বাওনার উপাসের আগেই রাজার ট্যাঁক খালি। — অর্থাৎ ব্রাহ্মণের অভাব কেউ মেটাতে পারে না।


বাওনার লৌড় বড় লৌড়। পূজার কাম গুছান লাগে। — অর্থাৎ ব্রাহ্মণ দশবাড়ি পূজার কাজ সারবে, তাই সে আসার আগেই পূজার কাজ গুছিয়ে রাখতে হয়। লৌড় অর্থে দৌড়।


মায় করে উপাস। বাওইনয়ারে খাওয়ায় পায়াস। টীকা নিষ্প্রয়োজন।


বিচারে শাস্তর জ্ঞেয়ানী আচারে চন্ডাল। — ব্রাহ্মণ বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকমাত্রই শাস্তরটি মেনে নেবেন। বাওনা কই ক্যারে? না, য্যার গলায় কগাছ হুতা। হে কি সাধু, রান্ধনি না পাডা? — সাধু, রাঁধুনি বামুন এবং পাঁঠা ছাগল, প্রত্যেকেরই সুতো (বা দড়ির) প্রয়োজন।


মড়া বিচরায় বাওনে আর শহুনে। — শকুন মড়া খায় আর বামুন মৃত ব্যক্তির জীবিত আত্মজনের অর্থ দোহন করে। উপরোক্ত দুইটি শাস্তরই মনে হয়, অপবর্ণীয় সমাজের তৈরি এবং তীব্রভাবে ব্রাহ্মণ্য ধূর্তামির বিরুদ্ধে শ্লেষ।


বাওনারে নেমন্তন্ন, না শত্তুররে দুয়ার খুলইয়া দেওয়া। — ব্রাহ্মণকে একবার নেমন্তন্ন করলেই সে হাজার ফন্দি-ফিকিরে পুনঃ পুনঃ ব্রাহ্মণভোজনের কায়দা করতে থাকবে। কথাটি বোধ হয় আধুনিক বিশেষজ্ঞ একশ্রেণির চিকিৎসক এবং উকিল, মোক্তারদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে তুলনায় বামুনরা বোধ হয় এখন পড়তি। ডাক্তার, মোক্তার, উকিলদের শ্রীবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে হয়েই চলেছে।


মোরা যহন একোত্তর (একত্র) বাওনা মোগো পুরোইত। — ব্রাহ্মণ কখনোই কারুর সাথে সমানে সমানে সামাজিক বন্ধনে থাকে না। সবাই যখন মিলেমিশে একত্রে থাকে, সে থাকে সবার মাথার ওপর।


কুরুকুষ্টে মরইও, তমো বামনা যেন পড়শি না অয়। টীকা নিষ্প্রয়োজন।


ঘরে ভাই মরলেও বাওনাগো বুক টাডায় না। — বামুনদের কারুর জন্যই মায়া-মমতা থাকে না।


বিলাই মারলে পাঁচ সিহা, বাওনা মারলেও পাঁচ সিহা। — বেড়াল এবং ব্রাহ্মণের চরিত্রগত সাদৃশ্য এই যে, তারা উভয়েই উঞ্ছ এবং লোভী। এ কারণে যাকেই মারা হোক, প্রায়শ্চিত্ত একই।


বাওনা অতিথ নাতো খানকি মাগির বিয়া। — ব্রাহ্মণ ভোজন করানো এবং গণিকার বিবাহ, দুটি ব্যাপারেই আড়ম্বর অধিক, কিন্তু খরচ সামান্য। –তুলনীয়, অজাযুদ্ধে ঋষিশ্রাদ্ধে — ইত্যাদি।


এ-রকম প্রায় শ’দুতিন শাস্তর-বাক্য ব্রাহ্মণদের বিষয়ে প্রচলিত আছে। তবে তা সর্বভারতীয় বিচারে গ্রাহ্য নয়। বাঙালি সমাজে ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় অন্যান্য স্থানের ন্যায় মাহাত্ম্যপূর্ণ নয়। বাঙালির সমাজবিন্যাস ব্রাহ্মণ্য চাতুর্বাণ্য শৃঙ্খলাকে কোনওদিন পুরোপুরি মান্যতা দেয় নি। এখানে সামান্য নমুনা দিয়েই নিরস্ত হলাম। জানি না কোনও বিজ্ঞজন এ-বিষয়ে ব্যাপক সংগ্রহাদি করে রেখেছেন কি না। তবে অধিক উদাহরণ দিয়ে তাঁদের ব্যাপক অভিসম্পাত কুড়োতে চাই না। সবাই জানেন, সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের এখনও প্রবল প্রতাপ।


বৈদ্যদের বিষয়ে শাস্তর

বৈদ্যদের জাত ব্যাপারটি বেশ একটু গোলমেলে। এ নিয়ে গত শতকের প্রথম চার দশক ধরে নানা ধরনের আন্দোলন হয়েছে। গণনাথ সেন শাস্ত্রী ছিলেন বৈদ্যরা যে আসলে ব্রাহ্মণ, সেই তত্ত্বের পুরোধা। ফলে তঁারা উপনয়নের আধিকারিক এবং ব্রাহ্মণদের নিয়ম মতে অশৌচাদি পালন করে থাকেন। কিন্তু অপর একদল, যাঁরা বিরুদ্ধবাদী, তাঁরা শূদ্রাচারী হয়েও ব্রাহ্মণদের আধিপত্য মানেন না। সে-সব নিয়ে বিস্তর কথা। আজকের সমাজে তার উপযোগিতা যদিও থাকার কারণ নেই, তথাপি কিছু তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে নতুন করে যেন এইসব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কৌলীন্য ব্যাপারটা যেন মরেও মরে না। রবিবাসরীয় পাত্রপাত্রী-সংবাদে অথবা সম্বন্ধ করে বিবাহাদির প্রচেষ্টার সময় এর প্রকোপ বেশ ভালভাবেই দেখা যায়। তবে বৈদ্যদের বিষয়ে শাস্তরবাক্য খুব প্রচলিত দেখিনি। যেটুকু দেখি তাতে শ্লেষ-ব্যাঙ্গের তীব্রতা ততটা পাই না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা বিষয়ে তাঁদের সম্পর্কে তির্যক উক্তি এবং জন্ম-সংক্রান্ত সরস ইঙ্গিতই দেখা যায়। তবে যেহেতু একসময় চিকিৎসা ব্যবসাটি তাঁদের অধিকারভুক্ত ছিল, সে কারণেই সম্ভবত তাঁদের নিয়ে বেশি শ্লেষ-ব্যাঙ্গের সাহস কেউ দেখাত না। আজকের দিনেও ডাক্তারবাবুদের আমরা ঈশ্বরোপম বোধে বিশেষ চটাতে চাই না। সে যা হোক, উদাহরণগুলি বলছি।


ওডাপড়া কপালের ল্যাহা, তমো যদি যাইত যাহে। বৈদ্যদের পারিবারিক পরিচিতি একদা নির্ভর করত কন্যাদের বিবাহের উপরে। ‘স্ত্রীরত্নম দুষ্কুলাদপি’ –এমত রীতি তঁাদের ক্ষেত্রেই ব্যাপক দেখা যেত। তাঁরা যে কোনও সমাজ থেকে কন্যাগ্রহণ বা দান করতে দ্বিধা করতেন না। ‘অম্বাকুলজ’ অপবাদটিও এক্ষেত্রে স্মরণীয়।


‘যেহানে বৈদ্য নাই। বসত করইও না।’ –চিকিৎসকবিহীন স্থানে বসবাস বিপজ্জনক। ‘নাড়ি টেপা বৈদ্য’ বৈদ্যদের বিষয়ে সাধারণ অভিধা। ‘নাড়ি বোজে না বৈদ্যের পো। রোগিরে নিয়া চিতায় থো।’ — সাধারণ মানুষ গ্রাম-গাঁয়ে তখনকার দিনে বৈদ্য কোবরেজদের বিষয়ে নানান কিংবদন্তীর জন্ম দিত, যেমন ধণ্বন্তরি, শিবের অবতার, অশ্বিনীকুমার (স্ববৈর্দ্য) ইত্যাদি, তেমনি বক্রোক্তিও করত বড় চমৎকারভাবে। ছোটবেলায় বাবার কাছে এমন একটি শুনেছি। রোগী আর কোবরেজের কথোপকথন–


রোগী : কবিরাজ মশায় পেরান তো যায়।
কোবরেজ : ওইডুক গ্যালেই হ্যানে সুস্থ হবা।
এ-রকম একটি অনবদ্য সংলাপ চান্দ্রদ্বীপি সংস্কৃতি ছাড়া ভাবা যায় না এবং কাজেকাজেই এটিও শাস্তর হিসেবেই গৃহীত।


দীনেশ সেন মশাইয়ের কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণে রেখে তাঁর সংগৃহীত একটি পদ্য আলেখ্য এখানে উদ্ধৃত করছি। সবাই জানেন সেন-মহাশয় সে-যুগের একজন বিখ্যাত বৈদ্য এবং বৈদ্যজাতির গুণপনা তথা গৌরব ঘোষণায় তাঁর তুল্য আর কেউই রাঢ়ে-বঙ্গে আবির্ভূত হননি। এমনকী এ কর্মে তিনি বল্লাল, লক্ষ্মণ সেন ইত্যাদিদের সঙ্গে পর্যন্ত বৈদ্যজাতির আত্মীয়তা খুঁজে পেয়েছেন, আর কায়স্থদের অনুরূপ দাবিকে নস্যাৎ করে তাঁদের নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছেন।


ফলাফল পরবর্তীকাল যা-ই হোক, সেই তিনিই যে বৈদ্যপুঙ্গবদের ইত্যাদি স্থানে বয়ড়া বাঁশের ব্যবস্থা করবেন এ-কথা কে ভেবেছিল? এই উদ্ধৃতিটি যদিও শোলোক-শাস্তরের পর্যায়ে পড়ে না, তথাপি পরণকথা, কিস্সা ইত্যাদি থেকেও যে শোলোক-শাস্তরের জন্ম হয়, এটি তার একটি উদাহরণ এবং সে-কারণেই পদ্যটি উল্লেখ করছি। পূর্বোক্ত কিছু শাস্তরের সঙ্গে এটির বিলক্ষণ সম্পর্ক আছে। পদ্যটি হল–


“পহর তিন হাটি বাসু যায় সে তাড়াতাড়ি।
তিনকড়ি সে মস্ত বৈদ্য পাইল তার বাড়ি।।
হাঁক ছাড়িয়া ডাকে বাসু কবিরাজ ম’শয়।
আমার মা যে এখন তখন তোমাকে যেতে হয়।।
তিনকড়ি কবিরাজ শুনি ধুতি চাদর লৈল।
চাদরের খুঁটের মধ্যে দাওয়াই বান্ধ্যা নিল।।
হাতে লইল বাঘা লাঠি, কান্ধে লৈল ছাতি।
তুলসীতলায় বৈদ্য ঠেকাইল তার মাথি।।
কিষ্ট বর্ণ শরীলখানি ত্যালাত্যালা তার গাও।
খুটা খুটা, নাফা গোফা, ফাটা ফাটা পাও।।
কুতকুতাইয়া চায় কবিরাজ গুরগুরাইয়া যায়।
পাছে পাছে বাসু নাপিত উল্টা হোঁচট খায়।।
বাসুর বাড়ি যাইয়া বইসে বৈদ্য তিনকড়ি।
তোমার মায়ে ভাল অইবে খাইলে তিন বড়ি।।
আইজকা দিন ব্যালের ছাল আর নিমের পাতার ঝোল।
কাইলকা দিবা গরম কইরা সজ ভিজাইনা জল।।
পরশু দিবা লাল বড়িটা কাঞ্জী দিয়া গুইলা।
তরশু দিবা নীল বড়িটা কুয়ার পানি তুইলা।।
শেষাশেষি দিবা বাসু এইনা ধলা বড়ি।
আরাম হইবে তোমার মা থাকবে না জ্বর জ্বারি।।
চাকুল ধানের ভাত খাওয়াইবা শরীলে ঢাইলো জল।
ধলা বড়ি খাওয়াইলে দিও তঁেতুলের অম্বল।।
কবিরাজের কথা শুইনা বাসু নিল বড়ি।
বিদায় হবার সময় হয়, সে কইল তিনকড়ি।।
এক কুলা চাইল দিল, ডাইল এক ডালা।
গাছের থনে তুইলা দিল বাগুন মরিচ কলা।।
হলদি দিল, লবণ দিল, পেটি ভইরা তেল।
বিদায় পাইয়া কবিরাজ ম’শয় হাসতে হাসতে গেল।।
সন্ধ্যাবেলা বাসুর মা যে চক্ষু মেইলা চাইল।
জন্মের মত বাসুকে থুইয়া সগ্যে চইলা গেল।।”


কবরেজি মহাপাচক বটিকা আকারে একটু অতিকায় হবেই। রোগীদের কষ্ট হলেও উপায় নেই। তা ছাড়া অনুপানগুলোও দেখতে হবে। তবে ‘গ্রেন্টি’ দিয়ে বলছি কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। এর পরের যে ভোজটা সাজাচ্ছি তা নবরস ছেড়ে নশো ন’রকমের হলেও কোনও শারীরিক রসাধিক্য ঘটবে না, দিব্য হজম হয়ে যাবে, দেখবেন। দুঃখের কথা শুধু একটাই, এমন একখানা রসেখাজা জিনিস চন্দ্রদ্বীপে না ফলে ফলল গিয়ে ময়মনসিংহে। চন্দ্রদ্বৈপায়ন হিসেবে এ দুঃখ ‘কহনে না যায়’।


কায়স্থ বিষয়ক

বামুন ঠাকুরদের মতো কায়স্থদের বিষয়েও শাস্তর-বাক্যের ছড়াছড়ি। রাহ্মণ বর্ণশ্রেষ্ঠ, অতএব সর্ববিষয়ে তাঁদের অগ্রাধিকার। তবে জাত হিসেবে কায়স্থও কম যায় না। বিশ্বাস না হয়, তাঁদের কুলপঞ্জিকা খুলে দেখতে পারেন। তাঁরা কখনো ক্ষত্রিয়ত্ব দাবি করছেন, কখনও নিজেদের বলছেন ব্রহ্মক্ষত্রিয়। বামুন এবং বৈদ্যেরা নেহাত ঈর্ষার জ্বালায় এঁদের শূদ্র বানিয়ে রেখে দিতে চেয়েছেন। তবে আসলে তাঁরা করণিক। জ্ঞানে, পান্ডিত্যে, বিষয়-বৈভবে তাঁদের খ্যাতি কারুর চাইতে কম তো নয়ই, বরং একটু বেশির দিকেই বলতে হবে। কিন্তু তাঁদের বিষয়ে শাস্তর বাক্যগুলো বড় বিটলেমি-ভরা। বলা হয়েছে, “কায়স্থ, কাউয়া আর লেঙ্গুর-কাডা সাপরে কেউ যেন বিশ্বাস না করে।” “উরাস (ছাড়পোকা) আর কায়েস্থেরে ছুঁইলেই মরে, তমো কামড়াইতে ছাড়ে না।” অর্থাৎ কিনা উভয়েই গোপনাচারি, কুটিল এবং রক্তশোষক কিন্তু শারীরিক শক্তিতে দুর্বল। “তিন কায়েস্থ যেহানে ঠাডা পড়বে হেহানে।” ঠাডা অর্থে বাজ, এ প্রসঙ্গটিও কুটিলতা সম্বন্ধীয়। এখানে তাঁদের ‘করণিক’ বৃত্তির বিষয়েও মনে হয় কটাক্ষ করা হয়েছে। “বাঘ নাই যেহানে, কায়েস্থ শিকারি হেহানে।” কায়স্থ অসি নয় মসিজীবি, সে-কারণেই বোধ হয় এই শাস্তর। “এগারো মাস মায়ের প্যাডে আছেলে, তমো কামড়ায় নায় ক্যান? না তহনতো হ্যার দাঁত ওডে নায়।” কায়স্থেরা নাকি মাতৃগর্ভে দশের পরিবর্তে এগারো মাস থাকে। এ কারণেই কি তাদের বুদ্ধি বেশি পাকা হয়? কথিত আছে, রাজার কায়ার উপর ভর করে থাকত বলে তাদের কায়স্থ বলা হয়। রাজার পেছনে দাঁড়িয়ে, বাঁধের উপর ভর দিয়ে তারা তার প্রতিপক্ষদের সঙ্গে দর কষাকষি চালাত– এজন্য তারা কায়স্থ।


তবে তাদের বিষয়ে ভাল কথার শাস্তরও আছে। যেমন, “কায়েস্থের পোলা, হয় জ্ঞেয়ানী, না হয় মড়া।” — বোকা হাবা সন্তান কায়স্থ-সমাজে জন্মায় না, এমত প্রসিদ্ধি। “কায়েস্থের বাড়ির বিলাইডারও দু-অক্ষর জ্ঞেয়ান আছে।” “ফ্যালাইয়া ছড়াইয়া কায়েস্থের পোলা।”


মুসলমান বিষয়ক শাস্তর

হিন্দু সমাজে জাতের অভাব নেই। সেই সব জাতের প্রায় প্রত্যেকেরই বৈশিষ্ট্য নিয়ে শাস্তর-কথারও অভাব নেই। সে-প্রসঙ্গে আমরা পরে আসছি। মুসলমান সমাজের মানুষেরা বলে থাকেন তাঁরা সবাই সমান, তাঁদের মধ্যে কোনও জাতপাতের ভেদ ভাব নেই। তাঁরা একটিই জাত। তাঁরা আসলে একটি জাত না সম্প্রদায়, এ নিয়ে বিস্তর বাকযুদ্ধ। তার মধ্যে না গিয়ে দেখা যাক প্রচলিত শাস্তর-কথায় তাঁদের মধ্যে জাতপাতের ভেদ ভাব দেখতে পাই কি না, প্রসঙ্গত বলা দরকার, যে-সব শাস্তর এখানে উদ্ধৃত হচ্ছে, তার প্রায় সবই মুসলমান সমাজের লোকেরাই বলে থাকেন এবং তাঁরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলোর রচয়িতা। শুধু যে-সব শাস্তর কথাগুলো গোটা মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে তির্যকভাবে ব্যবহার হয় সেগুলো যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিন্দুদের রচনা, সেটা শুনলেই বোঝা যায়। এর উভয় প্রকার রচনাই , অধিকাংশ পদ্যছন্দে। “আগে আল্্হে উল্লা তুল্লা, হ্যাষে অইছে উদ্দিন, যেয়ার যেয়ারে সৈয়দ মিঞা, পয়সা অইছে যদ্দিন।” — যে গ্রামে বনেদি বা বিত্তবান মুসলমান নেই, সেখানে ধুন্্করেরাও সৈয়দ, মিঞা ইত্যাদি উপাধি নিয়ে থাকে। শেখ, সৈয়দ, মির্জা, মিঞা ইত্যাদিরা মুসলমান সমাজে কৌলীন্যের দাবিদার। উল্লাতুল্লা, উদ্দিন প্রভৃতি উপাধিধারীরা আদপেই কুলীন বা খানদানি নয়। পয়সা না হলে কেউই প্রকৃত কুলীন হয় না। এদেশীয় মুসলমান সমাজের মধ্যেও যে ব্রাহ্মণ্য বর্ণপ্রথার প্রভাব ক্রিয়াশীল, এইরকম শাস্তর-বাক্যগুলি তার উদাহরণ। “নোমোর ব্যাডা, নোমোর নাতি, তমো গায় খানদানের খ্যাতি।” –নিম্নবঙ্গের নমঃশূদ্র সমাজের, বিশেষত, যারা অত্যন্ত দরিদ্র এবং উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের দ্বারা নিষ্পেষিত, তারা যে একসময় ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান সমাজে আশ্রয় নিয়েছিল, এ-কথা প্রায় সবাই জানে। পরবর্তী কালে তাদের কেউ কেউ অর্থশালী হয়ে উচ্চ খানদানের কথা প্রচার করত বলে এ-রকম শাস্তরের সৃষ্টি হয়েছে। “পয়সা অইলে মীর, গরীব অইলে ফকির।” “জোলার মাইয়া হাবু, মায়রে কয় আম্মাজান বুইনেরে ডাহে বুবু।” –উচ্চবর্ণের মুসলমানেরা মাকে আম্মাজান, বড় বোনদের আপা, বুবু এইসব বলে সম্বোধন করে। জোলারা তার অনুকরণ করেছে বলে এই কটাক্ষকরণ। “গত সালে আল্্হাম জোলা, এই সালে শ্যাখ, আল্লায় দেলে হামনের বছর সৈয়দ হমু দ্যাখ।” “জোলার পো ফতেখাঁ, সৈয়দ হেনার ভাতিজা।” “মোগল পাঠান গেল তল, জোলা বলে কত জল।” এইসব শাস্তর-কথার মধ্যে দিয়ে জাত বড় ব্যাপকভাবে উঁকি মারে। এ ছাড়া যে-সব শাস্তর সাধারণভাবে শোনা যায়, সে-সবেরও কিছু নমুনা দেওয়া গেল:


“আসমান আর মুসলমান।” –অর্থাৎ উভয়ের কারুরই ভাব আগাম বোঝা যায় না। তুলনীয়, “দেব চরিত্তির, নারী চরিত্তির, আর পুটকি চরিত্তির। এ্যার কিছুই আগেভাগে বোঝা যায় না।” ‘পুটকি’ শব্দটি ‘পায়ু’ শব্দের লোকায়ত সমার্থক শব্দ। “যে দ্যাশে কাউয়া নাই হে দ্যাশে শ্যাখও নাই।” কাক চরিত্রের সঙ্গে মুসলমান চরিত্রের তুলনা করার প্রকৃত কারণ কী, অভিজ্ঞতায় নেই। তবে ইঙ্গিতটি কুৎসিত। ইতিপূর্বে দেওয়া একটি শাস্তরের পুনরুল্লেখ করছি। “পাই পয়সাও জোডে যদি আষ্ট গন্ডা মাগি, খবরদার কিনওনা কেউ মুছলমানী ছাগী।” এরকম একটি কুৎসিত শাস্তরের টীকা দেওয়াও কুরুচিকর। শব্দার্থেই পুরোটা বোধ্য। উৎকট সাম্প্রদায়িক তথা বর্ণবিদ্বেষের মানসিকতার অধিকারী কোনও হিন্দু নামধারীর দ্বারাই যে এটি রচিত হয়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ-রকমই সব শাস্তর আমাদের তদানীন্তন হিন্দুদের অনেক কদর্য মানসিকতার পরিচয় দেয়। এ-রকম আরেকটি ইঙ্গিতপূর্ণ কদর্য শাস্তর হচ্ছে, “হুগাইলে হাত, মেয়া মেলে পাত।” সাধারণ গরীব মুসলমানদের এ-ক্ষেত্রে কটাক্ষ করার আগে ভাবা হল না যে-আহারাদির ব্যাপারে শিক্ষিত ভদ্র মুসলমানেরা যে আদবকায়দা এবং রুচির অধিকারী, তা অন্য অনেক সম্প্রদায়ের শিক্ষিত ভদ্রদের মধ্যেও খুব একটা সহজলভ্য নয়। দরিদ্রদের ব্যাপারটা সব সমাজে একই রকম। আরেকটি শাস্তর বলি, তবে এটি সাধারণ মুসলমান সমাজের মেয়েদেরও কারুর রচনা হতে পারে। তালাক প্রথার যথেচ্ছ ব্যবহার এবং সে-কারণে সেইসব মেয়েদের সমস্যা বিষয়ে যাঁরা সম্যক অবহিত, তাঁরা বিষয়টি নিশ্চয় বুঝবেন। “বিয়া করাইয়া তালাক দে হ্যার নাম মিঞা, দেনমোহর ফেরৎ নেয় সাদীর সোমায় দিয়া।”


আর দু-একটা আশপাশ শাস্তর-কথা বলে মুসলমানদের বিষয়টির এখানে ইতি করছি। “হিন্দু মুসলমান হইলে গরু খাওয়াব যোম।” “মিঞা-বিবি রাজি তো—ছেরেগা কাজী (পাঠ্যান্তর ক্যা করেগা কাজী)।” এটি চান্দ্রদ্বীপি নিজস্ব শাস্তর নয়। শুধুমাত্র একটি শব্দ পরিবর্তিত করে তাঁরা বোধহয় স্ব-স্বভাব বজায় রেখেছেন।


বস্তুত মুসলমানদের বিষয়ে শ’য়ে শ’য়ে শাস্তর বর্ণহিন্দুদের সমাজে প্রচলিত ছিল একদা। তাদের অধিক বিবাহকরণ, অধিক সন্তানপ্রজনন, গোমাংস-ভক্ষণ, একদার কাজীদের বিচারপ্রণালী, ছুন্নৎ, ঐশী গ্রন্থের প্রতি অপরিসীম বিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে কত যে শাস্তর ছিল তার হিসেব হয় না। কিন্তু তা নিয়ে বিশদে যাব না। যদিও আমি মুসলমান নই তবু এই শাস্তরটি আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য–‘য্যার যা কামনা শ্যাহে বেচে প্যাল।’–ওডা আমার কামনা।


পাঁচ


এ অধ্যায়ে প্রথমে হিন্দু সমাজের পেশাভিত্তিক জাতগুলির বিষয়ে কিছু শাস্তর-বচন উল্লেখ করে, স্মৃতির পসরায় যে-সব শোলোক-শাস্তর জমা আছে, তার একটা তালিকা দেব। পাঠকদের ধরতাইয়ের জন্য শুধু কিছু কিছু চান্দ্রদ্বীপি বিশেষ বিশেষ শব্দের শীলিত প্রতিশব্দ দেব। এর মধ্যে শুদ্ধ শোলোক এবং শাস্তর উভয়ই থাকবে। ইতিপূর্বের আলোচনার প্রেক্ষিতে, আশা করা যায় পাঠক উভয়ের তফাৎ বুঝতে কোনও অসুবিধের সম্মুখীন হবেন না।


প্রথমে তেলি-কলুদের নিয়ে আরম্ভ করাই বিধেয়। তেল বলে কথা। তা সে যে-তেলই হোক না কেন।


তেল ছাড়া কি চলে? রান্নায়, গায়, মাথায়, সাহেবের পায়, পাড়ার মস্তানদের পায়, বউ ছেলেমেয়েদের পায়, গাড়িতে, অর্থাৎ তেল না হলে সব অচল। সব কেরেদ্দানি, তুর্কীনাচন, তেল নিয়ে, তেলের জন্য। সেজন্যেই শাস্তরে বলেছে, “আইতল বাইতল, তেলি মাগির ইয়ের তল।” আবার লাখ কথার এক কথা–“কলু/তেলি ক্যারো বন্দু অয় না, ট্যাহারে কয় আষ্ট আনা।” বলা হয়েছে, “কলু/তেলির যে করবে খেতি (ক্ষতি), হ্যার পোতায় জ্বলবে না বাতি।” ভোজ্য তেল হোক আর খনিজ তেল, তেল নিয়ে যাদের কারবার, তারা সবাই তেলি, সবাই কলু। সাগরপারের সাহেবরা তেলের জন্য যে বাগদাদি লড়াইটা করে বোগদামিটা করল, তার ফল সবাই দেখতে পাচ্ছেন। শাস্তর না মানলে যা হয় আর কী। ঘরে তো ভাল, বংশে বাতি দিতে কেউ থাকবে কিনা দেখুন। মূল কাজিয়াটার সাথেও বোধহয় ‘ট্যাহারে’ ‘আষ্ট আনা’ ধরার একটা যোগসূত্র আছে।


যা হোক, এদের বিষয়ে আর দু-একটি শাস্তর বলে এ প্রসঙ্গ পালটাই। অন্যেরা আবার লাইন দিয়ে বসে আছেন কিনা। “তেলি যদি চালায় তাঁত, সাতজন্মে জোড়ে না ভাত।” যার যা কাজ, সেটা না করলে চলবে কেন? এর সাথে তুলনীয় আরেকটি আপ্তবাক্য আছে: “বাওনের বাড়ির চাকর আর লকুর ঘাইনের বলদ, বুদ্দি থাকলে জানবা এ্যার বেয়াকটাই গলদ।” “মাপে কম দিয়ে তেলেনি মনে মনে হাসে। ত্যালের হাড়ি ভাঙ্গে যহন খোদায় এট্টু কাশে।”


ধোপাদের বিষয়েও ঢের শাস্তর আছে। ব্যাখ্যায় না গিয়ে সরাসরি বলি। “বেয়াক মাইনষের কাপড় ধুইয়া, নিজে থাহে ময়লা, মাসিকের ত্যানা কাচ্্ইয়া গায়ে মাহে ময়লা।”


“পয়সার লাইগ্যা চিক্ষইর পাড়ইয়া পাড়া করে মাত, ছিড়া কাফুর লইয়া মুনিব কপালে দে হাত।” “ধোপার প্যাডে নাই ভাত, কাফুর পেন্দে চৈদ্দ হাত।” “ধুপুরইয়ার বাড়ি চুরি, তো পড়শির মাথায় বাড়ি।” “পাডাও (পাটা/পাট) যদি হইতা, ধোপার কামে লাগতা।” ধোপাদের বিষয়ে শাস্তর আরও অনেক আছে। তবে সবগুলো ছন্দে নয়। যেমন, “রাজার পাগ ধোপার ল্যাঙ্গট।” “ধুপুরইয়ার ল্যাহান কাফুর বদল।” “ধুপুরইয়ার বিয়ায় বেয়াকে কাফুরের উপার দিয়া হাডে।” — ধোপা অন্যের কাপড় কাচতে নিয়ে নিজের সব কাজ মেটায়।


জুতো, বস্ত্রাদি ব্যাপারে আরেক দল লোক আছে যাদের বিষয়ে এই জাতভিত্তিক শাস্তরকথা কিছু-কিঞ্চিৎ আছে। তারা হচ্ছে মুচি, জোলা, তাঁতি এবং দরজি বা খলিফা। মুচি এবং খলিফা (দরজি) কখনওই গ্রাহকের কাছে কথা রাখতে পারে না। আজ না কাল বলে টালবাহানা করা তাদের স্বভাব। তাই বলা হয়েছে, –খলিফার ‘আইজ সয়েন্দা’ আর ঋষইয়ার (মুচির) ‘কাইল বেয়ান, একথায় যে পেত্যয় যায়, সে ব্যাডা একছের অজ্ঞেয়ান।’ ‘খলিফা ক্যারে কয়? যে ব্যাডা গাহেকের কাফুর মারইয়া সিলাইয়ের পয়সা লয়।’


জোলা বা তাঁতিরা চাষের কাজের কিছুই বোঝে না। সমাজ যখন পেশাভিত্তিক ছিল পুরোপুরি, তখন একের পেশায় অন্যজন নাক গলাত না। তার প্রয়োজনও হত না। কৃষিকর্ম যাদের পেশা, তারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। শস্য উৎপাদন এবং বন্টনের সামাজিক দায়িত্ব তারাই বহন করত। এ কারণে, মনে হয় তার অন্য পেশাদারীদের একটু হেয় মনে করত। “জোলা তাঁতি করলে চাষ, দ্যাশের জানইও সব্বনাশ।”, “অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, হালবলদ কিন্্ইয়া ইষ্ট ভষ্ট” –ইত্যাদি শাস্তরে তাদের এই মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। তবে এদের যেহেতু পরস্পরের উপর নির্ভরশীল থাকতে হত, তাই এ-ধরনের শাস্তরের খুব বেশি প্রচলন দেখিনি। মুসলমানদের বিষয়ে বলার সময় কিছু শাস্তর এ-সম্পর্কে বলা হয়েছে।


এর পরে আসে বানিয়া বা বেনেদের কথা। একটা ব্যাপার শাস্তর আলোচনা প্রসঙ্গে লক্ষণীয় যে, যে-সব পেশাধারীরা তাদের বৃত্তির দ্বারা সাধারণ মানুষকে শোষণ, বঞ্চনা অথবা লুন্ঠন করে, তাদের বিষয়ে শাস্তর-বাক্যের আধিক্য ঘটে থাকে। এ-কারণেই ব্রাহ্মণ, কায়স্থ-বেনে, সাধুসন্ন্যাসী প্রভৃতিদের সম্বন্ধে শাস্তর রচিত হয়েছে অসংখ্য এবং তার মধ্যে শ্লেষ, ব্যাঙ্গের প্রয়োগও বেশি।


বানিয়াদের বিষয়েও শাস্তর-কথা বিস্তর। সাধারণ গ্রামীণ মানুষদের বিশ্বাস বেনেরা অসৎ, কপট এবং হৃদয়হীন। খরিদ্দার ঠকানো যেন তাদের ব্যবসায়ের মূলধন। তাই তাদের বিষয়ে প্রচলিত শাস্তর বা প্রবাদ-প্রবচনে, তাদের কোনও গুণকীর্তন প্রায় দেখাই যায় না। তাদের হৃদয় নিতান্ত ক্ষুদ্র। তাই বলা হয়েছে, “বান্্ইয়ার কইলজা ধনইয়ার ল্যাহান।” আবার কোথাও থাকে অসম্ভব ক্রোধের প্রকাশ। যেমন–“আগে পিডাও বানইয়ারে, হ্যাষে পিডাইও চোর। বানইয়া যদি কিরা কাডে, আরও পিডাইও জোর।”


বেনেদের সম্বন্ধে সাধারণের মনে এমন বদ্ধমূল এক ধারণা, সে যদি তারা নিজেদের সংসারেও কোনও দ্রব্য পাঠায়, সেখান থেকেও একটু চুরি করে। যেমন বলা হয়েছে– “যদি পাডায় নিজের বাড়ি গুড়, বানইয়ার জেব্বা করে সুড়সুড়।” নিজের বাড়িতে পাঠানো গুড়েও একটু চাটা না দিয়ে পারে না। তার চিন্তা, কী করে সে তার উশুল ওঠাবে। তাতে হোক না পাঁচ টাকার উশুল তুলতে পঞ্চাশ টাকা খরচ। “পাঁচ ট্যাহার লইগ্যা বানইয়া করে হায় হায়, পঞ্চাশ ট্যাহা খরচ করাইয়া উশুল উডায়।” ইংরেজি কহবতের Penny wise Pound foolish-এর মতো। বেনে যদি পড়শি হয়, সে এক বিড়ম্বনা। পড়শিসুলভ কোনও ব্যবহারই তার কাছ থেকে পাওয়া যায় না। উলটে নানান বিপত্তির কারণ হয় সে। “বানইয়া পড়শি নাতো ক্যাৎকুলিতে ফোঁড়া, অসোময় হাত পাতলে হাত করে জোড়া।” “বানইয়ার খাতা আল্লায় বোজে, মোমেন ইন্্সান রাস্তা খোঁজে।” “বানইয়ার ধারে অচল পয়সা” বলে একটি কহবৎ আছে। সে প্রতিটি পয়সা টঙ্কারে গুনে নেয়। লাভ ছাড়া সে অন্য কিছু বোঝে না। শাস্তর বলছে, “যদি বানইয়া কেনে চিনি, দাম পড়লে বেচতে রাজি– বউ, বুইন, জননী।” বেনে ব্যবসা ছাড়া অন্য কর্মে নেই। তাই কথায় বলে, “বাঁশের যদি ফুল হয় বাঁশ মরইয়া যায়, বানইয়ার যদি লাঙল চয় নিব্বইংশা হয়।”


নাপিতদের সম্পর্কে শাস্তর-বাক্য বেশ মজার। সংস্কৃত প্রবচনেই আছে নরানাং নাপিতঃ ধূর্তঃ। নাপিতদের বিষয়ে যত শাস্তর সবই তাদের ধূর্তামি বিষয়ক। কথায় বলে– “নাপতের বুদ্ধি ষোলো চুঙ্গা।” নাপিতদের মেয়েরাও খুব সেয়ানা হয়–


“চোহে মুহে কথা কয়
কে অই মাইয়াডি?
কিরা খাইয়া কইতে পারি
ছেম্্ড়ি নাপতের বেডি।”


নাপিতেরা তাদের রোজগারের পয়সা তামাদি হতে দেয় না। শাস্তর বলে–


“খান্্কি, বৈদ্য, মোক্তার নাপতা
হয় রোজেরডা রোজ
নাইলে হপ্তা হপ্তা।”


শাস্তরকার বলছেন, নাপিতকে গালাগালি করা বেশ বিপজ্জনক। নাপিতই একমাত্র সর্বশ্রেণীর মানুষের অন্দরমহলে প্রবেশ করার অধিকারী। বিশেষ করে হিন্দুদের তো বটেই। শুধুই ক্ষৌরকর্ম নয়, নানান মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে, ফোঁড়া কাটার ব্যাপারে, এবং দশবিধ সংস্কারকর্মে তাদের একদা অনায়াস গতি ছিল অন্দরে। সে-কারণে কোত্থেকে কী তথ্য বেরিয়ে পড়বে বলা যায় না। তাই শাস্তরকার বলছেন,–


“নাপতেরে খামার দিয়া মাথায় পর চূড়া
চাইর পুরুষ পাউছাইয়া দ্যাখফা নাপতা তোমার খুড়া।”


এর সঙ্গে আরেকটি শাস্তর উদ্ধৃত করে আমরা কিঞ্চিৎ অপ্রিয় সত্য কথা বলতে চাই। মনে হয়, সেই কথাগুলো শুধুমাত্র লোকবিশ্বাস নয়। সে যা হোক, আগে শাস্তরটি বলি–


নাপ্্তা যদি রইস্্ অয়
অকুমারীরে বিয়া করতে চায়।


চার পুরুষ আগে অপবর্ণীয়-নাপিত কোনও উচ্চবর্ণীয় ব্যক্তির রক্ত সম্বন্ধে সম্পর্কিত হতে পারে এবং সে যদি ‘রইস্্’ হয় তবে ‘অকুমারী’ বিয়ে করার সাধ তার হতেই পারে। শরৎচন্দ্র কিন্তু তার ‘বামুনের মেয়ে’ উপন্যাসে এ রহস্য চমৎকার ভাবেই ভেদ করেছেন। মনে হয়, নাপিতের অকুমারী বিয়ে করার সাধ, বা বৈদ্যদের ‘ওডাপড়া কপালের ল্যাহা, তমো যদি জাইত থাহে’ এইসব প্রবচনের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ণ যোগ আছে। চিকিৎসা কর্মের শল্যপর্বে নাপিতদের ভূমিকা কিন্তু বৈদ্যদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের ইঙ্গিতবাহী। আবার নাপিতদের একটি উপাধি রাঢ় অঞ্চলে ‘বেজ’। অনেকে বেজ-বৈজ-বৈদ-বৈদ্য এ-রকম ভাবেও শব্দমূলীয় বিশ্লেষণ করেছেন। তবে এ শুধু বামুন বা বৈদ্যের বৃত্তান্ত নয়। জাতপাত গঠনের আদিকাল থেকে বিভিন্ন পর্বে, কে কার বাপ, কে কার খুড়া বা জেঠা, তার হদিস কে-ই বা জানে। নাপিতদের ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্রিয়াকর্মে হয়তো অন্দরমহলের ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি ছিল বলে বিষয়টি এককালে অধিক পুষ্পিত হয়েছে। নচেৎ কে কার খোঁজ রাখে? এমন যে নন্দরাজের মহিষী মুরা, তাঁরও নাকি একজন নাপিত প্রেমিক ছিল, আর তারই পুত্র নাকি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। রইস হওয়ার পর সে-কথা কেউ কি মনে রেখেছে, না তাঁর ‘অকুমারী’র অভাব ঘটেছে?


‘নদী এবং ঋষির আদি খুঁজতে নেই’ (‘নদী চৈ পাঁহ নহে মুচ্চ অপি ঋষিচঁ পুসুং নয়ে কুচ্চ’) বলে একটি মারাঠি প্রবাদ আছে। ব্যাসদেব ধীবর-কন্যার সন্তান, তাঁর ঠাকুমা চন্ডাল-কন্যা, স্বয়ং বশিষ্ঠ বেশ্যা পুত্র। (ভান্ডারকার)। মানুষ আদিমতম কাল থেকেই মিশ্র। একটি ইংরেজি প্রবাদ উদ্ধৃত করে এই প্রসঙ্গ শেষ করি–


“When Adam delved and Eve span
Who was then the gentleman?”


এ একেবারেই ধান ভানতে শিবের গীত হচ্ছে। কথা হচ্ছিল নাপিত সম্পর্কীয় শাস্তরের তা কোথায় এসে ঠেকল। যা হোক, তাদের বিষয় আর দু-একটা শাস্তর-বচন বলে ক্ষান্ত দিই।


“যে নাপ্্তের যজমান নাই
হেই নাপ্্্তা ক্যামন?
না, পেরজা ছাড়া রাজা
আর একলা পাডা য্যামন।”


“নাপতের দরজায় হাতির পারা।” “বোগ্্দা কামাইয়া নাপ্্তা জ্ঞেয়ানী।” “টাউক্কা মিন্্সা নাপতার মায়ের ধার ধারে না।” এইরকম বহু শাস্তর ছোটবেলায় শুনেছি।


কামার বা কর্মকারদের বিষয়েও শাস্তর খুব কম নেই, তবে শোলোক মাত্র একটি মনে আছে। সাধারণ কহবতে বলে, ‘স্যাকরার ঠুক্ঠাক্, কামারের এক ঘা।’ ‘কামারপাড়ায় হুইজ বেচতে যাওয়া।’ ‘কামারইয়ার ঠ্যাঙ্গের কপালে খালি ফুল্্কি জোডে।’ ‘কামারইয়ার দোকান নাতো গাধার আথাল।’ এর সবগুলোর গোত্র চান্দ্রদ্বীপি নয়। এগুলো বাইরের মাল। শুধু একটু রং পাল্টেছে।


যে শোলোকটির কথা বলতে যাচ্ছি, সেটি শাস্তর নয়, পল্্কি জাতীয়। তবে খুবই উপভোগ্য এবং ষোল আনা নিখাদ চন্দ্রদ্বৈপায়নী। শোলোকটি বলি,–


“কামারইয়ার মারইয়া মারইয়া
পাডার মারইয়া পা
আর লবঙ্গের বঙ্গ মারইয়া
দুধে মিশাইয়া খা।”


যাঁরা ব্যাপারটি ধরতে পারলেন না, একটু খোলসা করে বলে দিলে দেখবেন, এটি শুনতেও মধুর, বলতেও মধুর, এবং খেতেও। এ অনেকটা দৈনিক কাগজের শব্দজব্দের মতো। ‘কামারইয়া’ শব্দটির ‘মারইয়া’ অংশটি বাদ দিলে থাকে ‘কা’। ‘পাডা’ (পাঁঠা)র ‘পা’ অংশটি বাদ দিলে থাকবে ‘ডা’ (ঠা) এবং ‘লবঙ্গে’র ‘বঙ্গ’ অংশটি বাদ দিলে থাকবে ‘ল’। একত্রে যে শব্দটি তৈরি হল, তা হচ্ছে ‘কাডাল’, শীলিত ভাষায় কাঁঠাল। চন্দ্রদ্বৈপায়নরা চন্দ্রবিন্দু উচ্চারণ পছন্দ করেন না– তাই কাঁঠাল কাডাল হল। এবার তাকে দুধে মিশিয়ে খেয়ে দেখুনতো, কেমন সোয়াদ লাগে।


এরপর একটু সাধুসন্ত-বিষয়ক শাস্তর-কথা না বললে পাঠকেরা হয়তো ভাববেন যে চন্দ্রদ্বৈপায়নেরা পাষন্ড, নাস্তিক। তাদের সাধু-সন্ন্যেসী, দেব-দ্বিজে ভক্তিছেদ্দা নেই। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। তারা যথেষ্ট পরিমাণে সাধুসেবা এককালে অবশ্য করতেন। তবে কিনা তাদের ভক্তিভাবটাকে ঠিক গোপালভাব বলা যায় না। তাদের অন্য সব কিছুর মতো এ-ব্যাপারটিও বেশ ভিন্ন ধরনের। অন্যদের সাথে আদৌ মেলে না। তা আসুন আমরা একটুখানি চেখে দেখি কেমন ধারা তাদের শাস্তর-পদ্য সে ক্ষেত্রে।


“ধম্মকতা হোনতে মুই সাদুর ধারে যাই
হে হালার পো হালায় মোরে চিরইয়া ফারইয়া খায়।”


সাধু-সন্ন্যেসীরা একটু সেবাযত্ন শিষ্যবর্গের কাছে চাইতেই পারেন। সে-কারণেই না বিষয়-বিষ ছেড়ে সুখ, শান্তি, সংসার-ধর্ম ত্যাগ করে তাঁদের এই কঠোর সাধনা। কিন্তু তার নেপথ্যে এই মনোভাব? ঈদৃশ সাধুভক্তি বোধহয় চন্দ্রদ্বীপেই সম্ভব। আবার বলে,–


যতই পর কপ্্নি ধ্বজা
ছাইচাপা থাকপে না পাপের মজা।


এ তত্ত্ব, যতদিন যাচ্ছে ততই ব্যাপ্তি পাচ্ছে। তবে মানতে হবে What Chandradwip thought in the remote past, Bengal-nay, India has started thinking today. যা হোক– Better late than never.


“এক সন্ন্যেসী হাজার বাওন
কেডা খাওয়াইবে হে হালার খাওন?”


আমার মনে হয়, চন্দ্রদ্বীপবাসীগণ অতীতেও কোনওদিন সাধু-সন্তদের আশীর্বাদ পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না। তাদের ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার কেউ নেই। আবার এটাও বোঝা মুশকিল যে, তারা ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি চান, না সাধু-সন্তদের কাছ থেকে। দেখে শুনে মনে হয় তাদের কপালে ‘নিয্যস’ রৌরব নচেৎ হাবিয়া দোজখ অপেক্ষা করে আছে। নাহলে এমন বলে?–


“যে হালার জোডে না কপালে মাগি
হেই হালায় হয় মস্ত যোগী।”


পাঠক অস্যার্থ স্বয়ং বিচার করে নিন। দিনকাল খারাপ। বর্তমানে ত্রিশূলাদি বন্টনসহ সাধু, সন্ন্যেসী, পরমহংসদের লীলাচাপলা যে-হারে চলছে তাতে স্বয়ং টীকাকার হতে ভরসা পাচ্ছি না। উদ্ধৃতিগুলোর জন্য blasphemy-র দায়ে পড়তে হয় কি না, তা-ও চিন্তায় রইল।


রাজা, যোগী, বেম্মা (আগুন) আর জল,
এই চাইর জানবা অসাইদ্য খল।


এ-কথা সকলেই জানেন যে, চন্দ্রদ্বীপ-পুত্ররা জাতধর্ম খুব একটা মানে গণে না। এ-কারণে তারা অতিমাত্রায় গৌর-নিতাই ভক্ত। শাস্তরকার শোলোকে জানাচ্ছেন,–


সাধুগোও দেহি আবার জাইত জম্ম আছে,
খালি মোর গৌর নিতাই চাড়াল লইয়া নাচে।


গৌর-নিতাইয়ের ‘আদ্বিজ চন্ডালে কোল, বল সবে হরিবোল’ স্মর্তব্য। নিত্যানন্দ ‘অবধূত’ ছিলেন। অবধূতদের জাত মানার বাধকতা নেই। চৈতন্য অর্থাৎ গৌর বাল্যাবধি বেদ-বিরোধী। সন্ন্যাসীদের মধ্যে কিন্তু পুরি, গিরি, ভারতী, দশনামী ইত্যাদি সম্প্রদায়ভেদ ভীষণভাবে বর্তমান।


এ-ক্ষেত্রে ফকিরদের প্রসঙ্গ আনলাম না। কারণ সাধারণ মানুষেরা, বিশেষ করে, চন্দ্রদ্বীপবাসী সাধারণ মনুষ্য ফকিরদের বড় ভালবাসেন। তাঁরা জানেন,


“রাইত তামাইত যদ্দুর গতি
ফকিরের তথায় স্থিতি।”


এ-সব ছাড়াও সাধু, সন্ন্যেসী, পীর-ফকিরের বিষয়ে কথা-কহবত, শোলোক-শাস্তরের শেষ নেই। যেমন, ‘রাইতে নিদ্্ নাই যোগীর, ভোগীর আর রুগীর।’ ‘অধিক সন্ন্যেসীতে গাজন নষ্ট।’ ‘আইলে মীর, পলায় পীর’, ‘খালধারে মরে কেডি (কুক্কুরী), সাধু কয় কইছেলাম খাডি।’ ‘ঝড়ে কাক মরে ফকিরের ক্যারামতি বাড়ে,’ ইত্যাদি ইত্যাদি।


ছয়


এবার একটি সাধারণ তালিকা দেওয়া হচ্ছে মিশ্র চরিত্রের। সেগুলিও শোলোক বটে, তবে তার মধ্যে কিছু কিছু শাস্তর-কথা হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন ঃ-


(১) ধন বাইর কর ধন বাইর কর ফুডা এক কড়ি
জন বাইর কর জন বাইর কর এক বিডি বুড়ি।


(২) এখন ঠেহ, ফুল ফুলানি,–
আইতে আছে গোপাল গাদানি।


শোলোকটি নববিবাহিত দম্পতিদের উদ্দেশ্যে বলা হয়ে থাকে। নারী প্রগতির যুগে, বিশেষ করে নারীবাদের এই দিগ্বিজয়ের প্রাক্কালে, তাঁদের শত্রু পক্ষের প্রতি যত কামারাদারিই বোধ করি না কেন, কোনোমতেই উক্ত শোলোকের টীকা রচনা করতে সাহসী নই। লেখক বৃদ্ধ, ব্যক্তিক এবং পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞানে “গোপাল গাদানি”র মর্ম বিষয়ে প্রাজ্ঞ পুরুষ। তাই খামোকা ‘নখরা’ করতে গিয়ে পাঁকে ডুবতে রাজি নন। যা করতে বসা হয়েছে, তা-ই করা যাক।


(৩) আম খাবি আমসি
মাগি রাখবি ধুমসি।


(৪) কিষ্ণ কালা কড্্ কড্্ইয়া
গোপী মাগিগো মন ভুলাইছে
বয়ড়া বাঁশে খাপ কাড্্ইয়া।


(৫) গোণ বুজইয়া বাওন
আসর বুজইয়া গাওন।


(৬) প্যাডে নাই ভাত
ল্যাঙ্গে নাই কাপড়
মোরা সাদিন দ্যাশের সাদিন নাগর।

– গত শতকের পঞ্চাশের দশকে পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নিম্নবর্গী মুসলমান সমাজে প্রচলিত হয় এই শোলোকটি।


কতকগুলো শোলোক আছে, যা প্রকৃত অর্থেই ছাপার অযোগ্য। সঙ্গত কারণেই তালিকার মধ্যে সেগুলোর স্থান হল না। তাও দু-একটা যে এর মধ্যে ঢুকে পড়েনি এমন নয়। নাগরিক জীবনের শ্লীলতায় হয়তো উদ্ধৃত অনেকগুলোই অশ্লীল বা ‘অসোইব্য’ বলে বোধ হবে, কিন্তু যে কোনো দেশের গ্রামীণ বিশ্বে এর সবকিছুই প্রত্যক্ষলব্ধ, অভিজ্ঞতাপ্রসূত এবং ব্যবহারে স্বচ্ছ ও সাবলীল। পল্লীজীবনের এমন কোনও দিক নেই, যা এই শোলোক-শাস্তরে ব্যবহৃত হয়নি। যা হোক, যতটা সম্ভব সতর্ক হয়ে আমরা উদ্ধৃতি দিয়ে যাই–


(৭) সাত জন্মে নাই চাষ
ধানেরে কয় তাল গাছ।


(৮) মায় মরে ঝি ঝি করইয়া
ঝি মরে লাঙ লাঙ করইয়া।


(৯) কোথায় রানি রাসমণি
আর কোথায় মাগি বউখনা মারানি।


(১০) মায়ের পোড়ে না পোড়ে মাসির
তাইথ্যা পোড়ে পাড়া-পড়শির।


(১১) ভাত খাওয়ার নাই পাত
কাপুড় পরে চৈদ্দ হাত।


(১২) ঘরে নাই খুদের জাউ
খাইতে চায় গোস্তো পোলাউ।


(১৩) পয়সা দিয়া কিন্্মু দই
গোয়ালিনী মোর কীসের সই?


(১৪) গাঙের পারে বাস
ভাবনা বারোমাস।


(১৫) ঘর নাইতো দুয়ার বান্দে
মাউগ নাইতো পোলা কান্দে।


(১৬) আদাহিলার হইছে নাতি
নাম রাখছে কচুর লতি।


(১৭) য্যার লগে য্যার মজে মন
কিবা হাড়ি কিবা ডোম।


(১৮) মায় রান্দে যেমন তেমন
বুইনে রান্দে পানি
ওই আবাগীর হাতের রান্দন
যেন চিনির পানাখানি।


(১৯) যা না অয় ত্যালে জলে
হেয়া অয় বেম্মার জালে


(২০) ধীরে রান্দে সুস্থে খায়
তয়গ্যা হেয়ার সোয়াদ পায়।


(২১) উলি ওলো উলি
রাগ জ্বালে চিতই পিডা
নিবা জ্বালে পুলি।


(২২) দাদায় কইছে পুঙ্গির ভাই
আনন্দের আর সীমা নাই।


(২৩) শাগের মইদ্যে পুই
মাছের মইদ্যে রুই
ডালের মইদ্যে মুসুরি
কুটুম্বের মইদ্যে শাশুড়ি।


(২৪) যে মাগির কপাল ফাডা
হ্যার মাইয়ায়ও করে সতীনইয়া ঘাডা।


(২৫) দিনে করে সাউগারি
রাত্তিরে করে গরু চুরি।


(২৬) সোনার মাপন একবার
মানুষ মাপন লক্ষবার।


(২৭) বাপ রাজা রাজার ঝি
ভাই রাজা আমার কী?


(২৮) বাঁচতে দেনা ভাত কাপড়
মরলে করবে দানসাগর।


(২৯) হদ্দ করছে প্যাডের পোলায়
বাল ছেড়বে নাতি।


(৩০) মায় বিয়াইলেনা বিয়াইলে মাসি
ঝাল খাইয়া গেল পাড়া-পিরতিবেশি।


(৩১) মানলে তালগাছ
না মানলে বালগাছ।


(৩২) মামার হালা পিসার ভাই
হ্যার লগে কোনো সম্পক্ক নাই।


(৩৩) অরান্ধনীর হাতে পড়ইয়া
কই মাছ কান্দে
না জানি রান্ধনী মোরে কী দিয়া রান্ধে।


(৩৪) শ্যাহের লগে করবা দোস্তি
মুগইর রাখফা মইদ্যস্থি
যদি শ্যাখ রোহে (রুখে ওঠে)
মুগইর মারবা কোহে। (-কুক্ষিতে)


(৩৫) আল্লায় যদি বাঁচায়
কদু থুমু মাচায়
হেই কদু বেচইয়া
বিবি আনমু নাচইয়া।


(৩৬) মাইয়া হ্যালায় (ফেলে) খাইয়া
আরও থাহে চাইয়া।


এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে। যে স্থানের সাংস্কৃতিক পসরা এই সব, তার অন্দর-কন্দর, প্রান্ত-প্রত্যন্তে আরও কত অনুরূপ ঐশ্বর্য আছে, তার সীমা সংখ্যা নেই। জাবর কাটতে বসে তার সামান্য অনুকণা নিয়ে নাড়াচাড়া। এর সবটাই উজানযাত্রার কড়চা। শুধু ব্যক্তিক নিষ্পন্নে নয়, সামাজিক প্রেক্ষায়ও এর ঢের প্রয়োজন আছে বোধ হয়।


উজানযাত্রায় নৌকো সবসময় একই খাতে চলে না। চলতে চলতে পথে কতরকম বাঁক, কতরকম উপ/শাখা নদী খাল, আওড়-বাওড়, আর তাদের আশপাশের মনোমোহন আয়োজন। জাবর কাটতে গিয়ে, তাই এলোমেলো কথন-কথাও এসে যায় এন্তার। তবুও তার মধ্য থেকে যখন কিছু শেকড়-বাকড় উঁকি দেয় তখন বুকের মধ্যে ওই শেকড়-বাকড়ের আশ্রয় হয়ে জেগে ওঠে এক টুকরো জমিন। সেই জমিনটুকুই একমাত্র নিজের।


চন্দ্রদ্বীপ বলেই কিছু কথা নয়, ব্যক্তিক রোমন্থনও নয় কিছু চূড়ান্ততা। এর প্রাসঙ্গিকতা বিধৃত হয়তো গোটা গ্রামীণ বিশ্বেরই যাপিত জীবনের প্রেক্ষাপটে। শোলোক, শাস্তর, পল্্কি-কথার জগৎ থেকে উৎক্ষিপ্ত আমরা, যে-নৈরাজ্যের জগতে আজকে উপনিবেশি, সেখানে “যে রজনী” গেছে “ফিরাইব তায় কেমনে?” প্রশ্নটা অবশ্য ফেরানোর নয়, বিকাশের। কিন্তু হায়! এ পোড়া দেশে বিকাশ কোনও স্বাভাবিক ক্রম যে নয়, তা তো আমরা জানিই।


__________________________
এই দীর্ঘ প্রবন্ধটি ‘উজানি খালের সোঁতা’ (প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স) বইটির অন্তর্গত। লেখক মিহির সেনগুপ্তের অনুমতি নিয়ে বাঙালনামায় পুনঃপ্রকাশিত হল। মিহির সেনগুপ্ত ও আনন্দ পাবলিশার্স কে আমরা ধন্যবাদ জানাই। – সম্পাদক।

Leave a comment