বা ঙা ল না মা

জীবনের ডায়েরির পাতা থেকে

Posted by bangalnama on December 22, 2010


– লিখেছেন মানব সেন

বিজয়া দশমী, ১৭ই অক্টোবর, ২০১০: আজ বিজয়া দশমী, মা দুগগা চলে যাচ্ছেন। চোখে তাঁর জল। বাপের বাড়ীকে ফেলে যেতে হচ্ছে। এ দিন আমাদেরও কান্না পায় – বাপের বাড়ী আর ছেলেবেলার কথা ভাবলে। বাংলাদেশে দুর্গাপুজো ছিল মিলনের উৎসব। প্রবাসীদের ঘরে ফেরার আনন্দ। নদীর ঘাটে এক এক করে বাড়ীর প্রতিমা আসছে। সঙ্গে ঢাকের বাদ্যি আর হ্যাজাকের আলো। এক এক করে প্রতিমা উঠবে নৌকায়। মাঝ গাঙে সারি সারি দাঁড়াবে। মা দুগগা চলে গেলেন। মা, মাটি আর জল মিশে গেল। আমাদের সকলের – জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে – সকলের মাথায় ছিটল শান্তির জল। সবাই যেন শান্তিতে থাকে!


মাটি, জলের দেশ বাংলাদেশ। নদীকে ঘিরে চলে জীবনের স্রোত। কেউ নদীতে মাছ ধরে, কেউ সাঁতার দেয় আর আমরা সংগ্রহ করতাম কচ্ছপের ডিম। প্রকৃতি তো অকৃপণভাবে দিয়েছে বাংলাদেশকে। ফুল, ফল, শস্য আর জীবন। নদী থেকে ইলিশ ওঠে রুপোর ঝিলিক দিয়ে। বর্ষার জল যখন এক পুকুর ছাপিয়ে যায় অন্য পুকুরে, স্রোতে এক টুকরো কাপড় ধরলেই চিক চিক করে উঠে পড়ে মাছ – পুঁটি, খলসে, কই। তারের জাল কেটে বঁড়শি তৈরি করে ভাত গেঁথে ফেলো পুকুরে। উঠে আসবে মাছ। ঐ কোন গাছ থেকে নারকেল পড়ল? জামরুল গাছটা যেন তারায় ভরা। যত ইচ্ছে নাও, যত ইচ্ছে খাও।


সেই দেশে ১৯৪২ সালে আমার বয়স যখন পাঁচ তখন সে দৃশ্য দেখলাম যা আজও আমাকে তাড়না করে। দুর্ভিক্ষ – ভিক্ষার অভাব! আবছা আবছা মনে পড়ে – হেঁচড়ে হেঁচড়ে আসছে কংকালসার মানুষ – হাতে সানকি। ভাত নয়, ফ্যান চাই, ফ্যান দাও। আচ্ছা, যে দেশে প্রকৃতিই মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে সে দেশে দুর্ভিক্ষ কেন হয়? পৃথিবীতে ১০ কোটি মানুষ নাকি ক্ষুধায় কষ্ট পায়। ছোটবেলা থেকে এই প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে চলেছি।


ঐ বছরই মা’র সাথে মামাবাড়ী এলাম কোলকাতায়। শহর ছেড়ে মানুষ তখন পালাচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে শহর থাকে নিষ্প্রদীপ। সাইরেনের আওয়াজ শুনলে ছুটে যাও নীচে। আশ্রয় নাও। জাপানীরা নাকি কোলকাতায় বোমা ফেলছে। আচ্ছা, যুদ্ধ কেন হয়? যুদ্ধ হলে মানুষ কেন ঘর ছাড়া হয়? ছোটবেলা থেকে এই জিজ্ঞাসার উত্তর আজও খুঁজে চলেছি। পৃথিবীতে এই দু’টো ভয়ের ছায়া যেন কোল শিশুকে পীড়া না দেয়।


তখন আমি পড়ি পাঠশালায়। দাদু সরস্বতী পুজোর দিন হাতেখড়ি দিলেন। তালপাতার ওপর দোয়াত-কলম দিয়ে ‘অ’, ‘আ’ শেখালেন। স্লেট আর চক দিয়ে লেখাপড়া শুরু। ১৯৪৬ সাল। আমি তখন হাইস্কুলে। গ্রাম থেকে এক মাইল দূরে। মাটির রাস্তায় হেঁতে যেতে হয়। গ্রামের বড়রা শহরে থাকেন। কাজে-কর্মে। পড়শীদের আবদার – স্কুল থেকে ফেরার পথে নদীর পারের বাজার থেকে জিনিসপত্র এনে দিতে হবে। বাজার, বই, খাতা-পত্র – সব মিলিয়ে বর্ষার সময়ে একটা বাঁশের ওপর দিয়ে খাল-নালা পার হওয়া ব্যালান্সের খেলার মত। তবুও স্কুল ভাল লাগছিল। শুধু টিচারদের আন্তরিকতা আর নিষ্ঠার জন্যে গ্রামের স্কুলের ছাত্র নাকি ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উতরেছে। গ্রামের স্কুলে ইন্সপেক্টর আসছেন। একটা থমথমে আবহাওয়া। আমরা তটস্থ। হঠাৎ কখন হেডমাস্টার ইন্সপেক্টরকে নিয়ে ঢুকলেন আমাদের পঞ্চম শ্রেণীতে। বোর্ডে লেখা আছে – Swimming is a good exercise। ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করলেন সুইমিং কোন পার্ট অব স্পীচ। ভয়ে বুক দুর দুর করছে। চূনীবাবু ইশারা করেন উত্তর দিতে হবে। ‘জিরান্ড’ না ‘ভার্বাল নাউন’ – এই নিয়ে একটু কথা চালাচালি হল। হার মানতে হল ইন্সপেক্টরকে। নেসফিল্ড সাহেব আর চূনীবাবু তো ভিতটা বেশ শক্ত করে তৈরি করে দিয়েছেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে আর এক শিক্ষক – সালাম সাহেব – তার পকেট থেকে শখের নেফিল্ড পেনটা খুলে উপহার দিলেন। পরের দিন স্কুল ছুটি। চূনীবাবু আর সালাম সাহেব স্বর্গে থাকলেও আমাদের মত ছাত্ররা আপনাদের সালাম জানাই। আপনারা শক্তি দিয়েছেন জীবনে বেঁচে থাকার জন্যে লড়াই করতে।


সেই বছর থেকে যে গ্রামে অপার শান্তি বিরাজ করত, সব শিশুরা এক সঙ্গে হাত ধরে বাড়ী ফিরত, হিন্দু-মুসলমান কোনও বোধই ছিল না, সেখানে শুরু হল চাপা গুঞ্জন। দাঙ্গা লাগছে, ঘর পুড়ছে, মানুষ পালাচ্ছে। আতঙ্ক পাড়তে লাগল। গোপনে সবাই তৈরি হচ্ছে আত্মরক্ষার জন্যে। নোয়াখালি, বরিশাল থেকে লোটা-কম্বল নিয়ে কিছু পরিবার ‘বাস্তুচ্যুত’ হয়ে আমাদের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের গ্রামে দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু আতঙ্ক সবাইকে তাড়া করছে। ধীরে ধীরে রাতের নিশুতি অন্ধকারে আমাদের গ্রাম থেকেও এক এক করে সব ঘর ছাড়তে লাগল। আমার দাদু সরকারি চাকরি করতেন। জীবনের সব সঞ্চয় নিয়ে গ্রামে এসে শান্তির নীড় খুঁজে পেয়েছিলেন। নিজের চোদ্দ পুরুষের বাড়ী-ঘর ছেড়ে উনি কোথাও যাবেন না। উনি তো বিশ্বাসই করতে পারেন নি দেশটা ভাগ হবে।


১৯৪৭ সাল। ১৫ই আগষ্ট সকালে সবাই দেখল পাকিস্তানের পতাকা তুলে ষ্টিমার চলছে। তার পরই কেমন সাজ-সাজ রব। ভয়, আতঙ্ক, অবিশ্বাস। কখন নদীপথে এসে ভিন গাঁয়ের লোক দাঙ্গা লাগায়। নদীর ঘাটে রাত পাহারা। সড়কী, বর্শা, তরোয়াল নিয়ে। গ্রামের সবচেয়ে উঁচু বাড়ীটাকে বেছে নেওয়া হয়েছে সাময়িক আশ্রয়ের জন্যে। কখনও দাঙ্গা লাগলে মেয়েরা, শিশুরা, বৃদ্ধরা আশ্রয় নেবে ছাদে। বাড়ী পাহারা দেবে সশস্ত্র যুবকেরা। সবই কেমন পালটে যাচ্ছে। স্কুলে প্রবন্ধ রচনা, প্রতিযোগিতা। বিষয় – ‘পাকিস্তান একটি পবিত্র দেশ।’ তবুও দাদু ভিটে ছাড়বেন না। অন্য উপদ্রব বাড়তে লাগল। চোর-ডাকাতের। রাতের বেলায় ঘরের টিন খুলে নিয়ে গেল। চিৎকার-চেঁচামিচি। কিন্তু কেউ সাহস করে এগুচ্ছে না। নদীর পারে দাঁড়ালে – ওপারে দেখা যায় সারি সারি কালো মাথা হেঁটেই চলেছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে।


১৯৫০ সাল। পাড়া পড়শীরা এক এক করে ঘর ছাড়ছেন। দাদুর মনোবল ভেঙে পড়ল। বাবা কোলকাতায় কাজ করতেন। খবর দেওয়া হল – আমরা চলেই যাব। রাতের অন্ধকারেই তো যেতে হবে। বাবা এলেন। আমাদের এক ঠাকুমা চাইলেন যেতে আমাদেরই সাথে। প্রতিবেশীর গৃহদেবতার পুজো করতেন যে পুরুষ ঠাকুর তিনিও সপরিবারে আমাদের সঙ্গে যেতে চাইলেন। এত লোক। বাবা গোপনে একটা গয়নার নৌকা ভাড়া করলেন। গভীর রাতে নদীপথে রওনা দেব খুলনার দিকে। রাতে ডাকা হল আমাদের তিন পুরুষের মুসলমান চাষীকে। তার হাতে সব সঁপে দিয়ে নিরুদ্দেশের যাত্রা। গভীর রাতে নদীর পার ধরে দৌড়ুচ্ছে আমাদের পালিত কুকুর। কান্নার সুরে। তাকে তো কেউ নিয়ে গেল না। তার তো আশ্রয় নেই।


আমি তখন কিশোর। নতুন দেশ দেখার মজা লাগছে। সকালে নৌকা ভিড়ল খুলনার এক ফেলে আসা গ্রামের ঘাটে। এখানেই সারা দিনের খাওয়া-দাওয়া সারতে হবে। একটি শূন্য ঘরে আমরা সাময়িক আশ্রয় নিলাম। বাড়ীটি যেন জীবন্ত। বাড়ী, ঘর, ফুল আর ফলের বাগান সবই অক্ষত অবস্থায় আছে। সবই আছে সাজানো, শুধু মানুষ নেই। গোধূলি লগ্নে যখন আমরা খুলনা স্টেশনে পৌঁছুলাম, তখন দেখি কাতারে কাতারে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনের অপেক্ষায়। যে ট্রেন তাদের নিয়ে যাবে অন্য এক অজানা দেশে। বাবাকে অনেক টাকা দিয়ে কুলি ভাড়া করতে হল। আমাদের জানালা দিয়ে গলিয়ে দিতে। অন্যভাবে তো ওঠাই যাবে না।


সীমান্ত স্টেশন – পেট্রাপোল। যখন ট্রেনটা দাঁড়াল – সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা! ট্রেনের যাত্রীদের নামাচ্ছে পাকিস্তানি পুলিশ। তার সাথে আনসার বাহিনী। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জুড়ে সার্চ। বাক্স-প্যাঁটরা ভাঙল। অনেক জিনিস চলে গেল। ট্রেনটা পেট্রাপোল ছেড়ে যখন সীমান্তের কাছে তখন শাঁখ বাজছে সব কামরা থেকে। নতুন দেশ যেন স্বপ্নের রাজ্য! সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল বনগাঁ স্টেশনে পৌঁছে। মানুষের পর মানুষ খোলা আকাশের নীচে পেয়েছে তাদের শেষ আশ্রয়। সেই নদী এখনও বাংলাদেশে বয়ে চলেছে। নদীর পারে আমার বন্ধুরা যারা থাকে তাদের আমি আজও ভুলিনি। নদীকে বোলো – যেন আমরা একই ধারা হয়ে বয়ে চলি। মানচিত্রে একটা দাগ দিয়ে দেশ ভাগ হয়। মানুষকে ভাগ করা যায়নি কোনও দিন।


(চলবে)

4 Responses to “জীবনের ডায়েরির পাতা থেকে”

  1. lokendra sengupta said

    asaadhaaron smrichaaron, hridoy chhnuye gelo, aaro chaai emon lekhaa.

  2. Saloka said

    jethumoni khub bhalo laaglo lekha……..

  3. Sutapa Sen said

    Asambhab sundar lekha.dadar mukhe galopo sunechi anekbar..aj lekha parlam.aro jante chai.

  4. pranab barman said

    darun apni ekta sakhatkar deben, ami khub upkrit hobo., apnar thikana soho email- ” talktopranab@gmail.com
    pranab barman

Leave a comment