বা ঙা ল না মা

পদ্মাপারের কুটিরশিল্প।

Posted by bangalnama on October 24, 2008


ছোটবেলায় দাদি কে দেখতাম পুরোনো শাড়ি দিয়ে কাঁথা সেলাই করতেন প্রথমে শাড়িগুলোর পাড় ছিঁড়ে সূতা বের করে গুটুলি পাকিয়ে জমা করে রেখে দিতেন, তারপর দুতিনটা শাড়ি এক সাথে করে টুক টুক করে নকশা তুলে সেলাই করতেন আমি দাদির পাশে বসে বা শুয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, এখনও দিব্যি মনে আছে আমার দাদি প্রায়ই বর্ধমান থেকে চট্টগ্রামে বেড়াতে আসতেন (তাহলে, সে হিসেবে তিনি ঘটি)। 😦 মাঝে মাঝেই উল্টাপাল্টা রান্না করেও আমাদের খাওয়াতেন, পছন্দ নাহলেও আমরা সোনামুখ করে খেতাম নইলে গোপনে মায়ের মুখনাড়া খেতে হত মা দাদি কে বড্ড ভয় পে থাউক সেইসব পুরানো কেচ্ছাকাহিনী!

এখন এই একবিংশ শতকে দাদির তৈরি করা নকশিকাঁথার দাম ডলারে হিসেব করলে চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে হায়, তখন যদি ওই বিদ্যা একটু বুদ্ধি খরচ করে রপ্ত করে নিতাম! কেননা বাংলা লোকশিল্পের এখন অন্যতম হল এই নকশিকাঁথা! বিদেশের বাজারে যার দাম প্রায় আকাশ ছোঁয়া! বাঙালরা একে খেতা বা কান্থাও বলে থাকে আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালে মেয়েরা যখন ঘর থেকে বের হতে পারত না , তখন অবসরে ঘরে বসে দিনের পর দিন ধরে কাঁথা সেলাই করত সেলাই এর প্রতি ফোঁড়ে লুকিয়ে থাকত কত আনন্দ-বেদনা-হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ-ভালবাসার কাব্য কাহিনী

শোনা যায়, এই নকশিকাঁথানাম এসেছে বিখ্যাত পল্লীকবি জসিমুদ্দিন এর কাহিনীকাব্য নকশিকাঁথার মাঠথেকে, এটি একটি অবশ্যপাঠ্য প্রেমকাহিনী রূপা-সাজুর প্রেমকথায় কঠিনহ্রদয় পাঠকের চোখ ও অশ্রুসজল হয়ে উঠবে এই কাঁথা তৈরি হয় পুরনো কাপড় শাড়ি, লুঙ্গি-ধুতি দিয়ে, প্রয়োজন মত ৩-৭ শাড়ি এক সাথে করে ছোট ছোট ফোঁড় দিয়ে কাঁথা বানানো হয়ফোঁড়গুলি যেন ঢেউ দিতে দিতে এগিয়ে চলে ক্রমাগত ! প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই শিল্পীরা যেভাবে কাঁথার বিভিন্ন নকশা আঁকেন, তা সত্যিই অবাক করে দেবার মত! সুদক্ষ সূতার ফোঁড়ে তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটিয়ে তোলেন হাল্কা তরঙ্গ, রঙের ভুবন, বিচিত্র বর্ণের নকশাবিন্দু ও বুননভঙ্গি, যা দেখলে মনে হয় তাঁতে বোনা, হাতে সেলাই নয়! বহু বৈচিত্রের মাঝে অধিকাংশ কাঁথায় একটা মোটিফই সাধারণত প্রাধান্য পেয়ে থাকেতা হল পদ্মফুল এর মোটিফ, যার চারপাশে থাকে এককেন্দ্রিক কিছু বৃত্ত যা দেখতে তরঙ্গায়িত লতা বা শাড়ির পাড় এর মত এছাড়া স্বস্তিকা, কুলা, পাখি, নানাবিধ অলংকার, হাতি, বাঘ, ঘোড়া, ময়ূর, রাধাকৃষ্ণ, জগন্নাথের রথ ইত্যাদির নকশা আঁকা কাঁথার প্রভূত প্রচলন দেখা যায় ইদানিং যে কাঁথাপাড় শাড়ি নারীকূলের গোকূলে সাঁইসাঁই করে বাড়ছে তার জন্ম এই পুরান কাপড়ের তৈরি নকশিকাঁথাতেই

বাংলা সংস্কৃতিতে আধুনিক আসবাবপত্র চালু হবার আগে নকশিপাটির ব্যবহার ছিল পর্যাপ্ত দৈনন্দিন প্রয়োজন বা নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে পাটির ব্যবহার ছিল অপরিহার্য্যএই যুগেও বিয়ে ইত্যাদতে অন্যান্য উপহার সামগ্রীর সাথে নকশিপাটিও দেওয়া হয়ে থাকে নকশিকাঁথার মত পাটিতেও গাছ, লতাপাতা, পশুপাখির অবয়ব, পাল্কি, নৌকা, জ্যামিতিক নকশার মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয় পাটির নকশাতে সূতা, নলখাগড়া,তালপাতা, বাঁশ, বেত ও হাতির দাঁতের ব্যবহার করা হয় সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালির মুর্তা’ গাছের মসৃণ বেত দিয়ে তৈরি পাটির নাম শীতলপাটি, ফরিদপুর ও পাবনা জেলার নলখাগড়া দিয়ে তৈরি পাটির নাম ‘তালুইপাটি‘।

হাতির দাঁতের পাটি বাংলাদেশের এক উন্নতমানের লোকশিল্প সিলেটে হাতির দাঁতের অন্যান্য দ্রব্যের সাথে পাটিও তৈরি হতঢাকার নবাব পরিবার বিয়ের আসরে ব্যবহারের জন্যে সিলেট থেকে এইরকম এক পাটি সংগ্রহ করা হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে এমন একটি পাটি সংরক্ষিত আছে

এই ধরণের নকশা করা কাঁথা বা পাটি তৈরির কাজে সাধারনতঃ মহিলারা জড়িত ঘরের কাজ সাঙ্গ করে তাঁরা নকশি পাটি তৈরি করে স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করছেন

লোকজীবনের খুব কম দিকই আছে যেখানে বাঁশের বানান সামগ্রী ব্যবহার হয় না বাঁশের তৈরি এই শিল্প দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি ছাড়াও আদিবাসিদের জীবনচারণ ও অনুভূতির প্রতীক উপজাতীয়দের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত বাঁশের বানানো ঘরগৃহস্থালীর পাত্র সামগ্রী অতি আকর্ষণীয় এই সব পাত্র বা ঝুড়িতে বুননের মাধ্যমে নানা ধরণের নকশা তলা হয়

বিভিন্ন লোকজবিশ্বাস থেকে মানুষ তৈরি করে বাঁশের খেলনা ও পুতুল আসবাব হিসাবে মোড়া ও চাটাই বহুল ভাবে ব্যবহৃত ইদানিং নগরজীবনে বাঁশের তৈরি আসবাব, ছাইদানি, ফুলদানি, প্রসাধনী বাক্স, ছবির ফ্রেম, আয়নার ফ্রেম, কলম ইত্যাদির কদর ক্রমেই বেড়ে চলেছে বাঙালদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের মাঝে মিশে গেছে বাঁশ তার অন্যতম

নকশী করা হাতপাখা বাঙাল লোকশিল্পের এক অন্যতম অংশ। হাতপাখার ব্যাবহার বাঙালদেশে বহুযুগ ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে এই হাতপাখাই যখন দৃষ্টিনন্দন করে নানা নকশায় শোভিত করা হয় তখন তাকে ‘নকশিপাখা’ নাম দেওয়া যায়

এই ধরণের পাখা বানাতে দরকার হয় সূতা, বাঁশ, খেজুরপাতা, শোলা, তালপাতা ও শময়ূরের পালক ও চন্দন কাঠের পাখারও প্রচলন আছে, তবে ময়ূরের পালকের পাখায় বাড়তি কোন নকশার দরকার হয় না। পাখায় যে সব ছবি বা চিত্র আঁকা হয় তার উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়, যেমন ভালবাসা, মনবিলাসী, মনবাহার, কাঞ্চনমালা, যুগল হাঁস ও ময়ুরের উল্লেখ পাওয়া যায় কিশোরগঞ্জের একটি মেয়েলি গীতে-

সেই পাংখাত লেখ্যা গো থইস্যে আঁসাআঁসির জোড়া গো,

সেই না পাংখাত লেখ্যা গো থইস্যে মউর-মউরীর জোড়া গো

বুটিবিন্যাসের উপর ভিত্তি করে পাখায় মোটিফ তোলা হয়, পাখায় রঙের ব্যবহার শিল্পী মনের অনুভুতির উপর নির্ভর করে অনেক সময় এই ধরনের পাখায় বুননের মাধ্যমে ছড়া বা প্রবাদ ফুটিয়ে তোলা হয় –

যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে

দিন যায় কথা থাকে, সময় যায় ফাঁকে ফাঁকে

পটশিল্প –  পটে আঁকা শিল্পসংস্কৃত পট্ট(কাপড়) থেকে এই শব্দটি এসেছে, এই পটে আঁকা চিত্রই হছে পটশিল্প! প্রাচীন বাঙালদেশে যখন কোন দরবারি শিল্পের ধারা গড়ে ওঠেনি তখন এই পটচিত্রই ছিল বাঙালের গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক! এই চিত্রশিল্পীদের বলা হয় পটুয়া

পটে নানাধরনের দেশজ রং ব্যবহার করা হয় ইঁটের গুঁড়া, কাজল, আলতা, সিঁদুর, কাঠকয়লা, সাদাখড়ি রঙ হিসাবে কাজে লাগানো হয়। পটে বিষয়বস্তু সাধারনভাবে সামাজিক, ধর্মীয় ও কাল্পনিক হয়ে থাকেবাঙালদেশে একসময় গাজীর পট খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল

মুনশীগঞ্জের সুধীর আচায্য চ্ছিলেন নামকরা পটুয়া তিনি গামছার উপরে ইঁটের গুঁড়া ও তেঁতুলের বিচির আঠায় তৈরি জমিনে লাল-কালো-হলুদ-সবুজ প্রভৃতি রঙে একটি প্যানেলে বাঘের পিঠে চড়া গাজি ও চব্বিশটি ছোট খোপের ছবি আঁকেন

লোকধর্মী বিশ্বাসী মানুষ ঘরে পটশিল্প সংরক্ষণ করাকে কল্যাণ ও দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষার উপায় মনে থাকে

জামদানি মসলিন ললনা কূলের জানের জান, প্রাণের প্রা্ণ জামদানি শাড়ির নামকরণের ইতিহাস পাওয়া গেল না! তবে মুসলিম সমাজের অন্যতম অভিজাত ভাষা ফার্সি থেকেই জামদানির উৎপত্তি বলে অনুমান করা হয়, ফার্সি শব্দে জামা মানে কাপড় আর দানি মানে বুটি; সেই অর্থে জামদানি মানে বুটিদার কাপড়!

উল্লেখ্য, ইরাকের বিখ্যাত ব্যবস্যাকেন্দ্র মুসলে যে সূক্ষবস্ত্র তৈরি হত, তাকেই মুসুলি বা মসলিন বলা হত। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম দশক থেকেই মিহিবস্ত্র সমাদৃত হয়ে আসছিল ঢাকা জেলার সব গ্রামেই মসলিন তৈরি হতউৎকৃষ্ট ধরণের তৈরির জন্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁও, তিতাবাড়ি, ধামরাই, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রসিদ্ধ ছিল সূক্ষ্মবস্ত্রের মসলিন ও জামদানি শিল্প পূর্ণতা পায় মুঘল আমলে মুঘল হারেমের মহিলাদের জন্যে বেলোয়ারি নামের সোনা-রূপার চাকচিক্যপূর্ণ জরির সূতায় জড়া্নো মসলিন বুনা হত!

কথিত আছে এক একটা মসলিন শাড়ি এমনই সূক্ষ্ম হত যে তা একটা আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে ঢুকিয়ে দেয়া যেত, এবং মসলিন শাড়ি তৈরির পর কারিগরের বুড়ো আঙ্গুল কেটে ফেলা হত যাতে কিনা তারা একই ধরনের কাপড় আর দ্বিতীয়বার তৈরি করতে না পারে 😦

এ তো গেল অতীতের কেচ্ছা!

এই কালে গলাকাটা দাম এর মসলিন বা জামদানি শাড়ি কিনার জন্যে কম কিছু গাঁট কাটা যায় না! হক না তা আড়ং বা টাঙ্গাইল শাড়িকুটির এর জামদানি! শোনা কথা, ‘দেবদাসতৈরির সময় সঞ্জয়লীলা বনসালি লাখ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকা থেকে এই সব ধরনের শাড়ি কিনে নিয়ে গেছেন!

বাঙালদেশের বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় এই হস্তশিল্প সৃষ্টি হয়েছে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও কারুশিল্পীর কর্ম থেকে যাদের মূলত কোন প্রশিক্ষণই থাকে নাশিল্পীরা সাধারণ মানুষের প্রয়োজন মেটানোর পর ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতায় কারুশিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন

তবে দিন বদলের পালা শুরু হয়ে গেছেআড়ং, বিবি রাসেল, মাহিন খান, রুবি গাজনবী প্রমুখ বাঙালদেশের এই প্রাচীনশিল্পকে আধুনিকায়ন করে বিশ্ববাজারে তুলে ধরার অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন

রচনা বৃষ্টি সৈয়দ

সূত্র

১। বাঙলাপিডিয়া ডট কম (http://www.banglapedia.com)

২। দ্যা ডেইলি স্টার (http://thedailystar.net)

One Response to “পদ্মাপারের কুটিরশিল্প।”

  1. Arijit said

    durdanto lekha…..khub tothyobohul, ebong upobhogyo 🙂

Leave a comment