বা ঙা ল না মা

বই সমালোচনা – আমার ফাঁসি চাইঃ মতিয়ুর রহমান রেন্টু

Posted by bangalnama on July 6, 2009


amar fnashi chaiবইটি মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি ব্যক্তিগত জবানী এবং আবশ্যিকভাবে সমালোচনামূলক, যে সমালোচনার তীর থেকে লেখক স্বয়ং নিজেকেও বাদ রাখেন নি। উপসংহারে তিনজনের ফাঁসি চাওয়া হয়েছেঃ লেখকের নিজের, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, লেখক নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের দীর্ঘসময়ের ওপরতলার নেতা, শেখ হাসিনার একদা ঘনিষ্ঠ সহচর এবং বর্তমানে (বইটি প্রকাশের সময় ১৯৯৯) শেখ হাসিনা কর্তৃক বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অবাঞ্ছিত ঘোষিত।

সামগ্রিক ভাবে বইটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণের চেষ্টা করলেও, সম্ভবত লেখকের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানের ফলশ্রুতি হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োজনের থেকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জীবনের কাঁটাছেড়া করেছে, অবশ্য লেখকের মতে নিজের পাশের লোকের প্রতি কেউ বিশ্বস্ত না হ’লে দেশের প্রতিও হয় না। শেষ পর্বে লেখকের আওয়ামী লীগ বিরোধিতার রূপান্তর ঘটেছে হিন্দু-বিরোধিতায়, বাংলাদেশের হিন্দু মানেই বাংলাদেশকে ভারতে ফিরিয়ে আনতে চায়, এ জাতীয় বক্তব্যগুলি ভারতের সংখ্যাগুরুর বয়ানের সঙ্গে যে সামঞ্জস্য রাখে সেটাও কম আকর্ষণীয় নয়। কিন্তু, এইসবের বাইরেও বইটি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের রাজনীতির একটি ব্যাক্তিগত ভার্সন হয়ে উঠেছে, লেখকের রাজনৈতিক ভূমিকার জন্যেই যা প্রধানতঃ ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক থেকে অবশ্যপাঠ্য, বিশেষতঃ সমগ্র বাঙালীজাতি ইতিহাসের অন্য ভার্সনগুলিকে একান্তভাবে বিশ্বাস ক’রে যখন প্রায় সমস্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে রেখে শেখ মুজিবকে শতাব্দীশ্রেষ্ঠ বাঙালীদের একজন বলে মেনে নিয়ে থাকে।

মুজিবের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ আসে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে, ৭১-এর মার্চ মাসের ঘটনাগুলি সন্দেহ জাগায় যে বাংলাদেশের মুক্তির তুলনায় দুই পাকিস্তানের একচ্ছত্র প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দিকেই মুজিবের ঝোঁক ছিলো বেশী (অবশ্য সাংবিধানিক ভাবে সেই অধিকার তাঁর ছিলো, কিন্তু তাঁকে যারা নির্বাচিত করেছেন, তাঁদের স্বপ্ন যে স্বাধীন বাংলাদেশের-ই ছিলো, রক্ত দিয়েই তাঁরা তা প্রমাণ করে দিয়েছেন)। এ কথা অনস্বীকার্য যে মুজিব ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রতীক এবং তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া গোটা বাংলাদেশ এক হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেও পারতো না, কিন্তু ৭১-এর সাতই মার্চ পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্তরকম সহযোগিতা বন্ধ করার ডাক দিয়ে তিনি নিজে ক্ষমতার বোঝাপড়া করতে পাকিস্তান গেলেন। আর ২৩-শে মার্চ অবধি পাকিস্তান পূর্ববাংলায় ঢাকা এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে নিজেদের সৈন্য বৃদ্ধি করতে লাগলো। ২৫শে মার্চ রাতে, আয়ুব শাহী মুজিবের প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবী অস্বীকার করলে মুজিব টেলিগ্রামে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, আর তার আগে প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে ব্যাপকহারে পাকিস্তানী সৈন্য বাংলাদেশে চলে আসার ফলে, বাংলাদেশের অগণিত মানুষকে হত্যার সুযোগ পায় পাকিস্তান। লেখকের মতে, মুজিব যদি নিজের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের স্বপ্ন না দেখে সাতই মার্চ-ই স্বাধীনতার ডাক দিতেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দুর্গতি অনেক কম হতো, অনেক কম রক্তপাতে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো।

এরপরে আসে মুজিব জমানার অপশাসনের কথা, স্বাধীন বাংলাদেশে; জেনারেল জিয়া, তাজউদ্দিন প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতাদের উপেক্ষা করে মুজিব শাসনকালে পাশে ডেকে নেন এমন সব লোককে যাঁরা পাকিস্তানের শাসনকালেও জো-হুজুর ক’রে গ্যাছে। সমস্ত ধরণের বিরোধী মতকে দমন করে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে নিজের একচ্ছত্র ক্ষমতা বিকাশ করাই মুজিবের উদ্দেশ্য হয়। সরকার-বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকে জেলবন্দী হন, খুন হন বামপন্থী ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সেনানী সিরাজ সিকদার, মুজিব পার্লামেন্টে দর্পভরে সিরাজ সিকদারের মৃত্যু সংবাদ দেন। এবং এই সবকিছুর ফলে যে বিশাল গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হ’লো তার মূল শরিকরাই মুজিবের শাসন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করতে থাকেন। ফলে মুজিব খুন হওয়ার পরে মানুষ কিন্তু বিক্ষোভে ফেটে পড়েন নি, বরং প্রচ্ছন্ন সমর্থন-ই করেছেন নতুন সরকারকে। এখানে লেখক নিজের অভিজ্ঞতার কথা সুন্দর ভাবে লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে ট্রেনিং নেন, ফিরে এসে বাংলাদেশের যুবকদের সামরিক শিক্ষা দেন ও সার্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছিলো মুষ্টিমেয় কিছু যুবক, কিন্তু আপামর বাংলাদেশী খেয়ে না-খেয়ে তাঁদের আশ্রয় দিয়ে গিয়েছেন, নিজেরা অত্যাচারিত হয়ে সৈন্যদের হাত থেকে তাঁদের লুকিয়ে রেখেছেন। এককথায় তাঁরাও সেনানী হয়ে উঠেছেন সেই লড়াই-এর। একই পথ ধরে লেখক মুজিব হত্যার পর ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে গেরিলা যুদ্ধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ‘বীর উত্তম’ কাদের সিদ্দিকি তাঁদের সমর্থন জানান, কিন্তু সাধারণ মানুষের সহযোগিতা তাঁরা পান নি। বরং গ্রামবাসীরা তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখেছেন, পুলিশের কাছে তাঁদের খবর দিয়েছেন। মুজিব-হত্যার বিরুদ্ধে কোনওভাবেই গোটা বাংলাদেশ রুখে দাঁড়ায় নি- আর, সেই পরিস্থিতির জন্য দায়ী স্বয়ং শেখ মুজিবই। এবং আজ অবধি জিয়া-হাসিনা-এরশাদ-খালেদা শাসন পর্যায় জুড়ে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর যার ফলশ্রুতি অবর্ণনীয় দারিদ্র, সেই সামগ্রিক দুর্গতির বীজ বোনা মুজিব জমানাতেই, যখন বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ গণতন্ত্রে পর্যবসিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবহত্যা-পরবর্তী পর্যায়ে লেখকের লড়ে ওঠা কিছু যুদ্ধের বিবরণ আছে, মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ লিখিত বিবরণ খুব সহজলভ্য নয়। সে হিসেবে বইটির একটি অনন্যতা ওই গেরিলা লড়াইয়ের বিবরণও।

যাই হোক, পরবর্তী পর্যায়ে আসে শেখ হাসিনা পর্ব, বাংলাদেশের রাজনীতির ক্লেদাক্ত অধ্যায়গুলির একটি। মুজিবের একমাত্র উত্তরসুরী হিসেবে মুজিব-অনুরাগী গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের ভরসা হিসেবে শেখ হাসিনার রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ, কিন্তু তিনিও নিজের ক্ষমতার মোহ বাদ দিয়ে আর কোনও উদ্দেশ্যই সাধন করেন নি। লেখক জানাচ্ছেন কিভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মেটাতে পূর্বপরিকল্পিত ভাবে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয়। কিভাবে ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মিছিল করানো হয় যাতে পুলিশ তার উপর গুলি চালায়। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ দেখিয়ে দেয় যে, যথাযথ দিশার অভাবে ক্ষমতালোভী নেতৃত্বের হাতে পড়ে একটি বিশাল গণআন্দোলন কিভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মহান ঐতিহ্য ও স্পিরিট বহন করেও বাংলাদেশের সমাজকে গণতন্ত্রহীনতার সংকটের সম্মুখীন হতে হয়।

বইটির প্রকাশকঃ স্বর্ণলতা ও বনলতা, প্রকাশকাল ১৯৯৯।

বইটি ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে, ইস্নিপ্সে

লিখেছেন – সোমনাথ রায়

3 Responses to “বই সমালোচনা – আমার ফাঁসি চাইঃ মতিয়ুর রহমান রেন্টু”

  1. brishti said

    বহু বিতর্কিত এই বইটি সোমনাথ রায় যে পড়েছেন আর তার সমালোচনা করার প্রয়াস নিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছে যে বিতর্ক ব্যাপারটাই অঁর কাছে বেশ প্রিয়!
    তবে, তিনি খুব যত্নের সাথে লেখার মূল মজাগুলো এড়িয়ে গিয়েছেন !
    ক্যানো সোমনাথ ?
    আপনি কি আওয়ামীপন্থী?
    আর কেউ যদি আওয়ামী-বিরোধী হয় ,তাহলে সে, বি।এন।পি বা জামাত!!!

  2. Somnath said

    বৃষ্টিদি,
    আমি মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধের জায়গাটায় কন্সেন্ট্রেট করতে চেয়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ-পারে বাঙাল(ি)দের মধ্যে আবেগ-এর কমতি নেই। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কি করে ক্রমশঃ সামরিক শাসন, স্বৈরতন্ত্র ও মৌলবাদে জর্জরিত হয়ে পড়ে, সেই নির্যাসটুকুতে জোর দিয়েছি বেশি।

  3. brishti said

    সোমনাথ কে অজস্র ধন্যবাদ বিষয়টা খোলাসা করে দেবার জন্যে 🙂

Leave a comment