বাঙালির জাতিবিদ্বেষ ১৯০৫: গৌরব না লজ্জা
Posted by bangalnama on July 6, 2009
মধ্যমেধার অভিমানী খাচায় বাঙালিত্বের আহত বাঘ ফের গর্জে উঠেছে। ঢাকে ঢোলে, সেমিনারে, পদযাত্রায়, মায় দুর্গাপুজোর মণ্ডপকল্পনায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের শতবার্ষিকী আমোদ একেবারে থইথই। এই রাখিবন্ধনের পুনরাভিনয়, তো ওই প্রবন্ধপত্রের বিশেষ সংখ্যা। এই বামপন্থী কমিটির সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী পথসমাবেশ, তো ওই দক্ষিণপন্থী ক্লাবের দেশবন্দনামূলক নৃত্যনাট্য। সর্বরোগহর শতবার্ষিকী বটিকায় সব আছে— হিন্দু মুসলমান ঐক্য, মহিলামহলের সমর্থন, শিল্পের স্বদেশী জাগরণ, উপনিবেশবাদ বিরোধিতা, এমনকী রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত হাতে কলমে জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করার সুবর্ণসুযোগ। জাতিসত্ত্বার এমন আইকন-চর্চিত ও পলিটিকালি-করেক্ট ছায়াযুেদ্ধর দৃপ্ত মহড়া দেখতে দেখতে কোন পাষণ্ডের না চোখ ছলছল করবে?
এই মহাধামাকায় মিলনমেলায় বাদ সাধে, কার সাধ্যি! শুধু মনে করিয়ে দেওয়া যাক, বাঙালির অাত্মচেতনার এই বিশ্রুত অধ্যায়টির একটি প্রকট পরজাতিবিদ্বেষী মুখও ছিল, উৎসবের ঝলমলে ভঁাজে আজ যাকে সহজেই লুকিয়ে রাখা গেছে, অথচ দরকার পড়লেই আহ্লাদি হাসি গুটিয়ে যে মুখ বার করতে আমরা এখনও কুিণ্ঠত হই না। ২০০৫ কেবল ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালি মধ্যবিত্তের জ্বালাময়ী প্যামেফ্লটশিল্পের একশো বছর নয়, তার নিজস্ব প্রভুত্ববাদের বিস্তৃত বয়ানের একশো বছরও বটে। িব্রটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের ছায়ায় লতিয়ে-ওঠা যে প্রভুত্ববাদ আমাদের জাতিচেতনায় আষ্টেপৃষ্ঠে, যার বিরুদ্ধে কোনও কথা শোনার আগেই আমরা জানি সে-সব প্রতিক্রিয়াশীল, বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী প্ররোচনার শিকার।
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের আবেদনপত্র, সম্পাদকীয়, প্রচারপুিস্তকা ইত্যাদি পড়ে দেখার সময়-সুযোগ অনেকেরই নেই। দেখলে জাতীয়তাবাদী যুক্তিবিন্যাসের দুটো দিক খুব স্পষ্ট। এক, নেহাতই বঙ্গবিচ্ছেদের পরিকল্পনা নয়, অসমের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সংযুক্তির প্রস্তাবও সমান ভাবে আন্দোলনকারীদের বিভীষিকা উদ্রেক করেছিল। ভারতের উন্নততম জাতিটিকে শুধু প্রশাসনিক ভাবে বিভক্তই করা হচ্ছে না, তার দুর্ভাগা অংশটিকে বর্বরতম প্রদেশের সঙ্গে জুড়ে তার ঐতিহাসিক বিকাশের পথও রুদ্ধ করা হচ্ছে, এমনটিই ছিল বাঙালি বুিদ্ধজীবীদের অভিযোগ। কে সভ্য আর কে বর্বর, সেটা ঔপনিবেশিক নৃতত্ত্ব ঠিক করে দিতে পারে, কিন্তু জাতীয়তাবাদের কোঁচড়ে তাকে সযত্নে লালন করে সভ্যতার ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগের ধারণাটি সমাজমানসে দৃঢ় ভাবে েপ্রাথিত করার কৃতিত্ব অনেকটাই বুিদ্ধজীবী বাবুদের। উঠতে-বসতে উত্তর-পূর্ব সীমােন্তর জংলি উপজাতিদের গা-ঘেষাঘেষি করতে হবে, এই আশঙ্কা বাবুদের জাতীয়তাবাদকে আরও ক্ষিপ্ত, তীব্র করেছিল। ২৭ ডিসেম্বর ১৯০৩-এর ঢাকা প্রকাশ সম্পাদক যেমন লিখলেন, ‘‘ভাবলে শিউরে উঠতে হয় যে পূর্ববঙ্গের পাঁচটি জেলার উচ্চ সংস্কৃতির মানুষেরা অসমের নগ্ন বর্বরদের সঙ্গে সামাজিক ভাবে একাসনভুক্ত হবে এবং ৈস্বরাচারী অসম আধিকারিকদের শাসনাধীন হবে। কী অধঃপতন! কী দুর্ভাগ্য!’’ ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ আন্দোলনের নেতা সীতানাথ রায় সরকারকে জানালেন, ‘‘সভ্যতার অনেক নিচুর ধাপে থাকা মানুষদের সঙ্গে মিশে যেতে হলে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ভাইদের চোখে (বাঙালিদের) নেমে যেতে হবে।’’ (অনেক পত্রিকারই মূল বাংলা পাঠ দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় এ লেখায় তাদের সমকালীন ইংরেজি অনুবাদ থেকে ফের বাংলা করতে হবে। পাঠক চোখা চোখা নিন্দেমন্দ-র হাতে গরম স্বাদটি থেকে বঞ্চিত হবেন।)
িদ্বতীয়তঃ, বাঙালির একতার যে মহৎ আখ্যানটি এই আন্দোলনের ভঁাজে ভঁাজে বাবুরা নিরলস বুনে চলেছিলেন, সে ঐক্য অনেকটাই মহানগরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার ঐক্য। বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালিত্বের যে নির্মিত বিশ্বে জাতিসত্ত্বার সংহতি ও বিচ্ছেদ নিয়ে আবেগঘন আলোচনা, তার কলকাতা-কেন্দ্রিকতা আজকের উন্নয়নের রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দেবে। ১৮ মার্চ ১৯০৪-এর টাউন হলের মিটিংয়ে বা বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার্স অব কমার্স সভাপতির চিঠিতে, ‘মেেট্রাপলিস’ শব্দটি মুহুর্মুহু এসেছে। মেেট্রাপলিসের আওতা থেকে দূরে গেলে পূর্ববঙ্গের অবক্ষয় অনিবার্য, এ যুক্তি বারবার এসেছে। কলকাতা যদি ছড়ি ঘোরাতে না পারে, মফস্বলের বাঙালি যদি চেষ্টা-চরিত্তির করে কলকাত্তাই না হয়ে উঠতে পারে, তবে সে বাঙালিত্বে কার কী আসে যায়? ময়মনসিংহের অধিবাসীদের নামে পেশ করা স্মারকলিপিতে পরিষ্কারই বলা হল যে, কলকাতার ভাষাই প্রকৃত বাংলা ভাষা; যদি বা অনেক কষ্টে কলকাতার দাক্ষিণ্যে পূর্ববাংলার ভাষাকে ঘষেমেজে একটু উন্নত করা গেছে, বঙ্গবিভাগ হলে আবার বাঙালরা পুরোদমে বাঙালভাষায় কথা কইবে আর কলকাতার লোকের হ্যাটা খাবে।
কে বলে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়েছে? জাতিকল্পনার এই দু’টি সূত্র অদ্যাবধি আমাদের আত্মনির্ণয়ের রাজনীতির পিছু ছাড়েনি। আমরা সভ্য, আমাদের মধ্যে কলকাতা সভ্যতর, অতএব আমাদের প্রদেশে অসভ্যদের জায়গা নেই। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে কেউ কেউ এ কথাটা রুক্ষ ভাবে লিখেছিলেন, যেমন ২২ ডিসেম্বর ১৯০৩ ময়মনসিংহের চারু মিহির সম্পাদক, ‘‘অর্ধশিক্ষিত অসমিয়ারা হবে দেশের প্রশাসনের প্রভু, আর তারা করবে আমাদের বিচার। কী ভাগ্যবিপর্যয়!’’ কেউ কেউ যুক্তির দোহাই পাড়লেন, যেমন ২৬ জানুয়ারি ১৯০৪-এর ত্রিপুরা হিতৈষিণী, ‘‘কুলি, গারো, নাগা, অাকা এবং অন্যান্য অসভ্যদের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করতে করতে অসম আধিকারিকদের উচ্চমনোবৃত্তির অবনতি হয় এবং তঁারা উচ্চতর এবং সভ্যতার জাতির মধ্যে কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন।’’ কেউ কেউ চিত্রকল্পে মন দিয়েছিলেন বেশি। ২৮ জানুয়ারি ১৯০৪-এর সঞ্জীবনী -তে প্রকাশিত প্রার্থনাটি ছিল: ‘‘হে লর্ড কার্জন, হে স্যর অ্যাণ্ড্রু েফ্রজার, …. আমাদের উজ্জ্বল ও দীিপ্তময় বঙ্গভূমি থেকে অসমের অন্ধকার ও ভয়াবহ গুহার মধ্যে নিক্ষেপ করবেন না।’’ বলার কথা এইমাত্র যে, এই বিদ্বেষ আর বৈষম্যের ইতিহাস, হায়ারার্কি আর জেনোফোবিয়ার ইতিহাসও বাঙালি জাতীয়তাবাদী অভিজ্ঞানের সাহস, আত্মত্যাগ আর র্যাডিকালিজমের ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। আজ জল বাঁচিয়ে শুধু দুধটুকু খেতে চাইলে চলবে কেন?
অসম কালাজ্বর, ইন্দ্রজাল আর কুহকিনির দেশ। সেই দেশের সঙ্গে আমাদের দেশ জুড়ে গেলে চাষিদের ধরে ধরে চা-বাগানের কুলি বানিয়ে দেওয়া হবে, বর্ণহিন্দুদের ঘরে বিয়ে দেওয়া যাবে না, জাত নষ্ট হবে, উচ্চশিক্ষার বারোটা বেজে যাবে, জংলিদের হাতে প্রাণ যাওয়া আশ্চর্যের নয়— হাজারো কথা ভাসছিল বাতাসে। বছর তিরিশ আগেই যারা অসমে বাংলার পরিবর্তে অসমিয়া সরকারি ভাষা রূপে গৃহীত হওয়ায় রে রে করে উঠেছিলেন অসমিয়া তো বাংলারই উপভাষা মাত্র বলে, সেই সব বাঙালি বুিদ্ধজীবী পরের পর নিবন্ধে লিখতে থাকেন মেঘনার ওপারকে চিরকালই বর্বরদের দেশ বলে মনে করি আমরা, ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই, সম্ভবও নয়। টাউনহলের মিটিংয়ে দেশপ্রেমিক নেতারা বলে দিয়েছিলেন: বাঙালির পয়সায় অসমকে আমরা ধনী হতে দেব না। কলকাতার আলোকপ্রাপ্ত মহল যে চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে হেসে লুটোপুটি, সেখানকার বাবুসমাজ যুক্তি দিলেন, আমরা ১৭৬৫-তে িব্রটিশ শাসনাধীন হয়েছি, অসম ১৮২৬-এ, আমরা ওদের থেকে বেশিদিন সভ্যতার সংস্পর্শে নেই?
একে রেসিজম বললে গায়ে লাগবে? কিন্তু এই বড়াইকে সমকালীন অসমিয়াদের পক্ষে অন্য ভাবে দেখা মুশকিল ছিল। ‘‘এর থেকে বেশি স্বার্থপর, বেশি সঙ্কীর্ণমনা, বেশি অসম্মানজনক বা বেশি অসৎ কোনও যুক্তির কথা ভাবা অসম্ভব,’’ লিখেছিলেন অসমিয়া নেতা মানিক বড়ুয়া। কলকাতার কাগজে নিয়মিত অসম-বিদ্বেষ প্রচারের প্রতিবাদে অসমে কংগ্রেস আন্দোলনের ভবিষ্যৎ স্থপতি তরুণরাম ফুকন কলকাতা হাইকোর্টের প্র্যািক্টস ছাড়তে বাধ্য হন। জোড়হাট সর্বজনীন সভা জেনে আহত হয়েছিল যে প্রস্তাবিত সংযুক্ত প্রদেশের নামে ‘অসম’ শব্দটিই বাঙালির মানহানিকর, তাই সরকার বাবুদের তুষ্ট করতে প্রদেশের নাম বদলের কথা ভাবছেন। সুমিত সরকার লিখেছেন, জাতিবিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে সুরেন্দ্রনাথকে সহযোদ্ধাদের অসম বিষয়ে ভাষাপ্রয়োগে সংযত হতে আবেদন করতে হয়েছিল।
ইতিহাসের এ এক বিচ্ছিরি বেয়াড়াপনা যে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের শতবর্ষেই বাবুদের সভ্য কলকাতা হঠাৎ কামতাপুর আর বৃহত্তর কোচবিহারে আলফার ছায়া দেখে হকচকিয়ে উঠেছে। আমাদের জাতিকল্পনায় তো তাচ্ছিল্য আর বিদ্বেষের কোনও স্থান নেই। শুধু মিলন আর ঐক্য, সম্প্রীতি আর সংহতি, ফঁাকে ফঁাকে দু’-একটি রবীন্দ্রসংগীত আর চা-বিস্কুট।
লিখেছেন – বোধিসত্ত্ব কর
(প্রথম প্রকাশ- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ অক্টোবর, ২০০৫। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।)
Related
This entry was posted on July 6, 2009 at 8:59 am and is filed under ইস্টবেঙ্গল, কলকাতা, বঙ্গভঙ্গ, রাজনীতি, সিলেট. Tagged: 1905, আসাম, কলকাতা, বঙ্গভঙ্গ, সিলেট, Bengali nationalism, centenary of the partition of Bengal, Charu Mihir, Coochbehar, Kamtapur, Lord Curzon, Manik Barua, Sanjibani, Sumit Sarkar, Tarunram Phookan, Tripura Hitaishini, xenophobia of Bengalees. You can follow any responses to this entry through the RSS 2.0 feed. You can leave a response, or trackback from your own site.
Leave a comment