বা ঙা ল না মা

বাঙালবৃত্তান্ত ঃ পর্ব এক

Posted by bangalnama on August 31, 2009


স্মৃতির কোলাজ – বড়পিসিমা

১৯২৫ সাল। ময়মনসিংহ জেলার মফঃস্বল শহর বাজিতপুরের উকিলবাবু সতীশচন্দ্র রায় মহাশয়ের জ্যেষ্ঠাকন্যা শিশিরকণার অথবা বকুলের বিবাহ ঐ জেলারই যশোদলনিবাসী সুরেশচন্দ্র পালের সঙ্গে দিলেন। পাত্র ভারতসরকারের অফিসের বাবু। অফিস্ শীতে দিল্লীতে, গ্রীষ্মে শিমলায়। বকুলের বয়স বারো, পাত্র চব্বিশ।

শৈলা গ্রামের ডঃ নীহার রঞ্জন রায় (পরবর্তীকালে প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ও ভারতবিদ্যাবিদ ) বকুলের মাতুলসম্পর্কীয়। তিনি কলিকাতার ব্রাহ্মসমাজ ও রাবীন্দ্রিক প্রগতিবাদের প্রভাবে এই বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করেন।

কিন্তু সতীশচন্দ্র অনঢ়। তাঁহার বিচারে পশ্চিমদেশে কর্মরত সরকারী চাকুরিয়া জামাতা অতি সুপাত্র। কারণ কিছুদিন পূর্বে তিনি স্বয়ং রাজধানী কলিকাতায় সেক্রেটারিয়েটে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হওয়ায় এবং পিতার আপত্তির কারণে সরকারীকর্ম হইতে পদত্যাগ করেন এবং ক্ষুণ্ণমনে আঠারোবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে ফিরিয়া আসেন। তৎপশ্চাৎ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের ভার তেজস্বিনী মাতাঠাকুরাণীর করকমলে সমর্পণ করিয়া বাজিতপুর শহরে মহকুমা আদালতে ওকালতিতে মনোনিবেশ করেন। অতএব—-।।

নয় পুত্র ও পঞ্চকন্যার মধ্যে প্রথমা বকুল। বিবাহে সতীশচন্দ্র কোন কার্পণ্য করেন নাই। নিকটবতী ইতনা গ্রামের মহেশ গুপ্ত (প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ও রাজ্যসভার সদস্য ভূপেশ গুপ্তের পিতা) মহাশয়ের বাড়ি হইতে দুইটি হাতি আসিল। হাতিতে চড়িয়া বর ও নিতবর আসিবেন। বরযাত্রীদের জন্য ঘোড়ার ব্যবস্থাও ছিল।

গ্রামের সীমানার বাহিরে রায় পরিবারের পাইক ঢাল-সড়কি সমভিব্যাহারে বরযাত্রীদের আক্রমণ করিল। বরপক্ষের পাইকরাও প্রস্তুত ছিল। কে না জানে নারী ও বসুন্ধরা কেবল বীরভোগ্যা! ঘন্টাখানেক নকল যুদ্ধের পর বরযাত্রীরা আঠারবাড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করিল।

সতীশচন্দ্রের ওকালতির আয় তেমন উল্লেখযোগ্য না হইলেও তালুকদারি ও পাটচাষ হইতে আয় মন্দ ছিল না। বকুলের বিবাহে যাহা কিছু ঋণ হইয়াছিল তাহা পাটের একটি ফসল হইতে অনায়াসে শোধ হইতে পারিবে — ইহা তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। কিন্তু বিধাতা অলক্ষ্যে হাসিলেন। বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার প্রভাব ইউরোপ হইতে এশিয়ায়, ভারতবর্ষের কলিকাতা মহানগরী হইয়া সুদূর ময়মনসিংহ জেলার কৃষিপণ্যের উপরও পড়িল। একবৎসর পূর্বে যে পাটের বিক্রয়মূল্য তিরিশটাকা মণ ছিলো তাহাই বকুলের বিবাহের পরবর্তী বৎসরে ছয় টাকারও নীচে — অর্থাৎ পাটের উৎপাদনমূল্যেরও নীচে, নামিয়া আসিল।

সতীশচন্দ্র দেনা শুধিতে অপারগ হইয়া ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও তাঁহার ন্যায়বিধানের প্রতি সন্দিহান হইলেন।

হবারই কথা। বিশ্ববাজার, আর্থিক মন্দা, কৃষিপণ্যের উপর প্রভাব, আয়-রোজগার-চাহিদার চক্র — এসব অর্থনীতির তত্ত্ব তখন ক’জনই বা বুঝেছে? কেইনস্ সাহেবের নাম তখন খোদ কলকাতাতেই বা ক’জন শুনেছে!

এমনই এক আন্তর্জাতিক সংকটের কালোছায়ার পটভূমিতে বকুলের বিয়ে হয়ে গেল। বর সিমলায় কাজেকর্মে ব্যস্ত রইলেন। বধূ বকুল যশোদলে শাশুড়ী-জা’-ননদযুক্ত বাড়িতে বালিকা থেকে যুবতী হওয়ার পাঠ নিতে এবং গৃহকর্মে দক্ষতা অর্জন করতে লাগলেন। যশোদলের পালপরিবারের লোকেরা এমনিতে মন্দ ছিলেন না। কিন্তু ঘুম-পেলেই-ঘুমিয়ে-পড়া বকুল অল্পদিনেই নিজের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন — “ফুলের মালাগাছি, বিকাতে আসিয়াছি, পরখ করে সবে, করেনা স্নেহ”।

ইতিমধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে আর একটি ঘটনা ঘটলো। সিমলায় পাহাড়ীপথে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে সুরেশচন্দ্র শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সবরকম -প্যাথি, কোবরেজি, হাকিমি আর বকুলের সেবাযত্নে ধীরে ধীরে সেরে উঠে কাজে যোগ দিলেন। কলকাতায় বদলি হয়ে এলেন। কিন্তু, আর্থরাইটিস তাঁর চিরসঙ্গী হয়ে রইলো।

ময়মনসিংহ ছেড়ে বকুল হাজির কলকাতায়। কখনো উত্তর কলকাতায় জগন্নাথ সুরী লেনে, কখনো বা মধ্য কলকাতায় ডাক্তার লেন বা মহেন্দ্র সরকার স্ট্রীটের বাসাবাড়িতে। শেষে থিতু হলেন গোকুল বড়াল স্ট্রীটের ভাড়াবাড়িতে। একতলায় একখানা ঘর, বারোয়ারী কলঘর। কর্পোরেশনের জলের কলের নীচে মাথা পেতে চান করতে গিয়ে নদী-পুকুরে অভ্যস্ত বকুল যেন থৈ পাচ্ছিলেন না।

এইভাবে শুরু হল বকুল অথবা শিশিরকণার ধীরে ধীরে নানান কূল-অকূলের মধ্যে সঁাতার দিয়ে ক্রমশঃ বালিকা থকে কিশোরী, কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠা। এখানেই শেষ নয়, আস্তে আস্তে উনি হয়ে উঠলেন এক সামাজিক সর্বজনপ্রিয় মহিলা শিশিরদি–আমার বড়পিসিমা।

দেশভাগের ক’বছর আগে বকুলরা উঠে এলেন পার্কসার্কাসের এক তিন কামরার ফ্ল্যাটে। কড়েয়া রোড এবং সার্কাস মার্কেট প্লেস মিলে তৈরি সমকোণের একটি ফ্ল্যাটবাড়ি। সামনে ধাঙড়বাজার, সার্কাস হোটেলের বারান্দায় তৈরি হয় গরুর মাংসের শিককাবাব। মুসলিম ব্যাপারী, কারিগর, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান আর পরবর্তীকালে উদ্বাস্তু সমাগমে ধীরে ধীরে এলাকার চেহারা বদলাতে থাকে। শুনশান মাঠ এবং পাড়া নতুন তৈরী বাড়িতে ভরে যায়। বকুলের স্বামী – এক মেয়ে ও ছোটছেলেকে নিয়ে ছোট সংসার। সঙ্গে আছে সেজ ও তারপরের ভাইটি। জারগা যথেষ্ট। আর আছে ছাতে গিয়ে দেখা – আকাশ, কাক-চিলের ও ঘুড়ির ওড়াউড়ি। বকুল মানিয়ে নিলেন। ভাইয়েরা একের পর এক ময়মনসিংহ থেেক স্কুল পাশ করে কলকাতায় কলেগে ভর্তির জন্য এসে বকুলের সংসারেই উঠতে লাগলেন।

মিলিটারিতে চাকুরিরত ভাইদের মধ্যে বড় সলিলকুমার বদলি হয়ে এলেন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে।

বকুলের সংসার – কথাটা ভুল নয়, যদিও ভাড়াবাড়ির এগ্রিমেন্ট সেজভাই খোকা অথবা বিনয়কুমারের নামে। বেশ চলছিলো। হঠাৎ শুরু হল দেশভাগের পরবর্তী দাঙ্গা।

ময়মনসিংহের বাজিতপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে বাবা-মা-ঠাকুরমা-ছোটভাই-ক’মাস আগে বিয়ে-হয়ে-আসা বড়ভাইবৌ—কারো কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বকুলের ঘুম আসে না। সলিল আর চতুর্থ ভাই গেছেন ওদের খুঁজেপেতে আনতে। তাদেরও দিন পনেরো হল কোন পাত্তা নেই। কলকাতা শহরে দাঙ্গার আাঁচ নিভেও নিভছে না।

হঠাৎ একদিন সামনের বাজারের কিছু গুন্ডাশ্রেণীর লোক রণধ্বনির সঙ্গে আক্রমণ করল বকুলদের ফ্ল্যাটটা। নীচের কোলাপ্সিবল লোহার গেট ভেতর থেকে তালা দেওয়া। গেটটা ভাঙার প্রয়াস চলছে। কঁাদছে বকুলের সদ্য কলেজ যাওয়া মেয়েটি। —“সোনামামা যদি এখন বাড়ি থাকতো!” ঘরের অল্পবয়েসি মামাদের কয়েকজন উত্তেজনায় প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। একজন মাছকাটার বঁটি হাতে পায়চারি করতে লাগলেন।—“ওরা দরজা ভাইঙ্গা ঢুকলে প্রথমে নিজেহাতে বাড়ির সব মেয়েদের গলা কাটবাম, তারপর হ্যাদের মহড়া লইয়াম।” পাশের ফ্ল্যাট থেকে আওয়াজ শোনা গেল—“ঘাবড়াইয়েন না। আমরা ঢাকার। লইড়া মরবাম”।

অবশেষে মিলিটারি লরি এল। সেজভাই খোকা ফ্ল্যাটবাড়ির জোড়ালাগা ছাদগুলো টপকে পেছনের বাড়ির সঁিড়ি দিয়ে নেমে কড়েয়া থানায় খবর দিয়েছিলেন। মিলিটারির সামনে সন্দেহের জেরে ধরা গুন্ডাদের প্যারেড, কিন্তু চিনিয়ে দেবে কে?

বকুল এগিয়ে এলেন, এক এক করে চেনালেন—এর হাতে মাংসকাটার দা’ ছিল, এর হাতে ছুরি, আর এর হাতে কাঠের মুগুর।

একদিন মাঝরাতে বাবা-মা-ঠাকুরমা, বড়ভাইবৌ ও ছোটভায়েদের নিয়ে সলিল পঁৌছালেন পার্কসার্কাসের বাড়ি। রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় আতঙ্ক ও বঁেচেথাকার সমস্যাই হল আসল কথা। কাজেই বকুলের হঁেসেলে হয় বাইশজনের রান্না। তিনটে কামরায়, বারান্দায়, ছাদের সঁিড়ির বাঁকে, চিলেকোঠায় পরিবার পরিজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে জায়গা করে নেয়।

ফলে বকুলের সংসার গুটিয়ে আসে একটি মাত্র ঘরে। অফিস করে অসুস্থ স্বামী বিশ্রাম করেন তক্তপোষে। কোণের টেবিলে বসে মেয়ে তৈরি করে কলেজের পড়া। ছোট্ট ছেলে তপনের মনটা উসখুস করে। তার মন মুক্তি পায় স্বপনকুমারের গোয়েন্দা উপন্যাসে, ফুটপাথে মাদারী-কা-খেল দেখায় আর ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোয়, বা পায়রার বাচ্চাপোষায়। আর পাশের ফ্ল্যাটের সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে স্বাভাবিক ঝগড়া-খুনসুটি তো লেগে আছেই।

একদিন তপন দেখল ছাদে রান্নার কয়লা ইঁটের ঘেরা দিয়ে দু’ভাগ করে রাখা। একটা একটু ছোট, আর একটা খানিক বড়। মাকে জিজ্ঞেস করে কোন সদুত্তর পেল না। বকুলের চোখে তখন “হাওরের পানি”। তপনের গলাতেও একটা দোমড়ানো-মোচড়ানো ব্যথা। তখন থেকেই সে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরের ডাক শুনতে লাগলো, একটু একটু করে।

ইতিমধ্যে বকুলের একজন মনের মত সঙ্গী জুটেছে–ভাইবৌ স্মৃতিকণা। বয়েসে প্রায় বারো বছরের পার্থক্য। হঁেসেল ভাগ হলেও মনের দেওয়ালে ফাটল ধরলো না। বকুল তাকে শোনান নিজের অনুভব, সংসারের অনেক কঠিন পরীক্ষার খবর– যা মধ্যবিত্ত ঘরে বৌ হয়ে আসা মেয়েদের পাশ করতেই হয়।

বকুলের মনের গঠন এবং মূল্যবোধ খানিকটা একান্নবর্তী পরিবারের ধাঁচে গড়া। তিনি অনায়াসে ভাইপোদের আদর বা শাসনের আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন। মুখের মধ্যে গুড়ের টুকরো পুরে ঘুরে বেড়ানো ভাইপোদের গাল টিপে আঙুল ঢুকিয়ে ডেলা বের করে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দেন, –কৃমি হবে যে! আবার ওদের নিয়ে স্কুলের ফাংশনে যাওয়া বা খোস-পঁাচড়ায় ভোগা বাচ্চাদের নিজের পাশে টেনে নিয়ে শোয়ানো–এ’সবই বকুলের কাছে সহজ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। তিনি অনায়াসে ঠিক করে দেন অসুস্থ অবস্থায় ভাইপোদের পথ্য কি হবে—কাঁচকলা বা হিঞ্চেশাকের ঝোল? নাকি বার্লির জল বা দুধ-সাবু।

আজকে অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুলের যুগে সেসব পথ্যের দিন গেছে। সময়ের সঙ্গে তাল দিয়ে পাল্টে গেছেন পিসিমারাও। কোন পিসিমা আজকে ভাইপোদের অসুখ-বিসুখে ওষুধ-পথ্য বাতলানোর অযাচিত দায়িত্ব নিয়ে অপ্রিয় হবার রিস্ক নেবেন? বদলে যাওয়া সময়ে হয়তো অণু পরিবারের ভাইপোরাই আজ এমন বড়পিসিমাকে interfering nagging old lady ভাববে। আর তাদের বাবারা নস্টালজিক হয়ে বলবে–grand old benevolent autocrat!

একথা ঠিক বকুলের আত্মবিশ্বাস অনেক সময় সেল্ফ রাইচাসনেসের রূপধারণ করতো।

সুরেশচন্দ্রের শরীর ভাঙতে লাগলো। অচিরে শয্যাশায়ী হলেন। কিন্তু হাসতে ভুললেন না। আটবছরের রঞ্জনকে বলতেন–দ্যাখ, বড় হয়ে যখন চাকরি করে দূরে দূরে থাকবি, মাঝে মধ্যে এ’বাড়ি আসবি–তখন দেখবি কি খাতির, কি আদর-যত্ন! রঞ্জনের জন্য এটা আন, সেটা আন। আর যদি ঘরেই থাকিস, তবে তোর দাম কমবে। রঞ্জন হবে রঞ্জইন্যা! যা বাজার যা। এটা নিয়ে আয়, সেটা নিয়ে আয়।

শুনে কেমন ঘোর লাগত। কিন্তু যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক হাসি আসতো না। উনি একদিন আর উঠলেন না। বকুলের চেয়েও শোক প্রকট হয়ে উঠলো মা সরযূবালার। চোখের সামনে ভরা পরিবারে বড়মেয়ের বিধবা হওয়া উনি ঠিক মেনে নিতে পারলেন না। বেশ ক’দিন বাড়ি ভরে রইলো তাঁর উচ্চকিত বিলাপে।

বকুল কি মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন। ওঁর শোক বাইরে প্রকট হোলো না। সামান্য পেনশন সম্বল, বড়মেয়ে বি টি পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে।

এমন সময় সেজভাই খোকার বিয়ে হল। ক’দিন পরে নববিবাহিত বধূকে নিয়ে উনি গেলেন গড়িয়ার কাছে কামডহরিতে ভাড়াবাড়িতে। সঙ্গে গেলেন বকুল ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে করে। কিন্তু কোথায় যে ভেতরে ভেতরে সুর কেটে যাচ্ছে তা বকুল ধরতে পারলেন না।

যা হোক, ইতিমধ্যে মেয়ে গৌরী চাকরি পেল, শিক্ষাবিভাগে পরিদর্শকের চাকরি। কর্মস্থল হুগলী জেলা।

বকুল কলকাতা ছাড়লেন, উঠলেন হুগলীর বারদুয়ারীর সাতাশ টাকার ভাড়াবাড়িতে।

এবার শুরু হল বকুলের দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনের এক অধ্যায়। এক পরিণত মহিলা যাঁর কাছে দুনিয়াটা একান্নবর্তী পরিবারেরই এক বৃহৎ রাজ-সংস্করণ মাত্র। উনি যেখানেই যান, ওঁর চারপাশে গড়ে তোলেন রক্তের সম্পর্কহীন আপাত অনাত্মীয়দের এক পরমাত্মীয় পরিমন্ডল। ফলে পাড়ার দাদাবাবুর স্বাস্থ্য বা ছেলের বন্ধু ভোম্বলের বাবা-মা’র অমতে বিয়ের দায়িত্ব– সবই অনায়াসে বকুলের পারিবারিক সমস্যা হয়ে ওঠে। রায়দের বড়মেয়ে বকুল হয়ে ওঠেন সকলের শিশির’দি।

এই সময় কলকাতা ও বঙ্গদেশের রাজনীতি দিক বদলাতে লাগলো। স্বাধীনতার পরে জেগে ওঠা স্বপ্নগুলো ক্রমশঃ উৎসব শেষে দড়িতে টাঙানো আমপাতার মত শুকিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ভাবনাচিন্তার সুরগুলো অন্যরকম। একদিকে মেয়ের ট্যুরের চাকরি আরেক দিকে ছেলে তপনের কলেজের শুকনো বইপত্তর ছেড়ে বাম-রাজনীতির বইয়ের দিকে ক্রমশঃ ঝোঁকা বকুলকে কিছুটা অসোয়াস্তিতে ফেলতো ঠিকই, কিন্তু কখনো হতাশ বা আতঙ্কিত করেনি। কারণ ওঁর মনে ছিলো মানুষের শুভবোধের ওপর এক উনিশশতকীয় বিশ্বাস— আগামী দিনগুলো বর্তমানের চেয়ে উজ্জ্বল হবে। আস্থা ছিল এক কল্যাণময় বিধাতার ন্যায়বুদ্ধির ওপর, — মেলাবেন, তিনি মেলাবেন।

ধর্মের কল্যাণকারী দিকটি তাঁর মনে এক অভয়ারণ্যের দিশানির্দেশ দিল। “আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে”– এই মঙ্গলকামনা ক্রমশঃ নিজের ছেলেমেয়ে, ভাইপো-ভাইঝি ছাড়িয়ে ছেলেমেয়ের বন্ধুবান্ধব এবং পাড়াপড়শিদের জন্য আকুতিতে বিস্তৃত হল। তবে কখনও কখনও ওঁর নিজস্ব মডেলে ধাক্কা লাগতো। একদিন বামপন্থী রাজনীতির উত্তাল জোয়ারে বিভ্রান্ত হয়ে ছোটভাইকে জিজ্ঞেস করলেন—“হ্যাঁরে, তোদের রাজত্ব হলে কি ভগবান বলে কিচ্ছু থাকবে না? তোরা নিজেরাই ভগবান হবি?”

তবে আমার বড়পিসিমার একটি অবসেশন ছিল—বিয়ে হয়ে আসা ভাইবৌদের উনি নিজের মত করে একটি নাম দিতেন যা এই পরিবারের মধ্যে মহিলাটির নতুন পরিচয় হবে। বড় বৌ পিতৃদত্ত ‘স্মৃতিকণা’ ছেড়ে হয়ে উঠলেন ‘শক্তি’। অন্যের উমা, অসীমা, অপর্ণা ইত্যাদি। বিরক্ত ভাই সলিলকুমার বলতেন—যেমন দেশের বাড়িতে গাই কেনা হলে সঁিদুর লাগিয়ে, গা’ ধুইয়ে কালী, ধবলী নাম দেওয়া হয়।

আমার চোখে এটি আদিম জনগোষ্ঠীর সদস্যপদে ইনিসিয়েশন বা আজকের রাজনৈতিক দলের সদস্যদের পার্টিকার্ড দেওয়ার মত, — আজ থেকে তুমি আমাদের হলে।

আসলে বকুল ছিলেন ভালোবাসায়, স্নেহে অত্যন্ত possessive — সবাইকে জড়িয়ে ধরে, স্নেহের শাসনে বঁেধে জড়াজড়ি করে বাঁচতে চাইতেন। তাঁর ঘরে কখনই জায়গার অভাব হত না। সে বারদুয়ারীর সাহাদের বাড়িই হোক অথবা মোগলটুলির এক কামরার ভাড়াবাড়িই হোক। গরমভাতে ঘি, আলুসেদ্ধ আর মুগ-মুসুরীর ডাল–এর জোগান ছিল অফুরান। একাত্তরের পুলিশি আতঙ্কের সময়ও উনি ঘনিষ্ঠ সন্তানতুল্যদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন — “লোকে কুকুর-বেড়ালকেও ঘরছাড়া করে না – এরা তো মানুষের বাচ্চা।”

স্মৃতির কোলাজে ফুটে উঠছে এমন একটা সময় — যখন সূর্যের আলো একটু নরম আর মায়াবী ছিলো, দুধে মাখন ছিলো, তরকারিতে স্বাদ ছিলো। গাছেরা ফল দিত আর নারীরা মহিলা হলেই স্নেহশীলা হতো। সমস্ত আত্মীয়দের গায়ে একই রকম চেনা গন্ধ ছিল। এটাইতো আমার ছেলেবেলা। বড়পিসিমা চলে যাওয়ায় আমার সেই ছেলেবেলা হারিয়ে গেলো।

(চলবে)

লিখেছেন – রঞ্জন রায়

3 Responses to “বাঙালবৃত্তান্ত ঃ পর্ব এক”

  1. Somnath said

    অদ্ভুত ছুঁয়ে যাওয়া লেখা; ঠাকুমা-দাদুর কাছে শোনা গল্পগুলো মনে পড়িয়ে দিলো

  2. brishti said

    ছায়াছবির মত লেখা…।
    চোখের সামনে বকুলকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি !
    আসছে মাস আসতে যে আরো কত্তো দেরি 😦

  3. Dhrubajyoti said

    অনবদ্য, যেন মনে হচ্ছে রূপকথা আর বাস্তব মিশে গেছে…প্রচুর শুনেছি এইরকম গল্প, বাবার বড় পিসি আর নন্দা পিসি কে দেখেছি (এই নামটাও বড়দাদার বউ এর দেওয়া, ননদ থেকে নন্দা)…বাবার কথা বাদই দিলাম, আমি নাতি হয়ে যা স্নেহ পেয়েছি তা ভোলা অসম্ভব, এরা একেকটি বটগাছ, অবশ্য দুজনার মধ্যে কেউই এই দুনিয়াতে আর নেই, একজন বটগাছ এখনও আছে আমার বাড়িতে, কিন্তু সে তাঁর ডালপালা ঝুড়ির ভারে নুয়ে পড়েছে… সে লঙ্কাও নেই রাবণও নেই, আমরা আধুনিক হয়েছি তাই এদের প্রয়োজন আর নেই! আজকের পিসিমারা (মেয়েরাও) আর তেমন সুযোগ পাননা (আসলে দরকারই হয় না) বটগাছ হয়ে ওঠার…

Leave a comment