বা ঙা ল না মা

আমার ডায়েরির পাতা থেকে

Posted by bangalnama on October 25, 2009


“শাঁখারিবাজার বধ্যভূমির নাম শুনেছ?”


‘Reports from the Killing Fields of Bihar’ বইটা পড়ছিলাম; সম্ভবতঃ তার শিরোনামটা দেখেই সুদীপ্তর এই প্রশ্ন। একটু সময় নিলাম। রাজনীতিতে সুদীপ্তর ইন্টারেস্ট আছে, এমনটা ওর ঘোর শত্রু ও বলতে পারবে না। রাজনীতি করে করে দেশটা গোল্লায় যাচ্ছে, এইটাই ওর বিশ্বাস। তবে নন্দীগ্রামের পর থেকে এই অরাজনৈতিকরাও মাঝে সাঝে রাজনৈতিক কথা বলছে; মুড়ি-মুড়কির মত বাজারে বিকোচ্ছে killing fields, genocide, ইত্যাদি শব্দগুলো।


“নামটা বেশ চেনা চেনা…কিন্তু রিলেট করতে পারছি না। বাংলাদেশের কিছু?”


সুদীপ্ত মাথা নাড়ল। ৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশের) রাজাকার’রা পাক সামরিক বাহিনীর ভাড়াটে খুনিদের সাথে মিলে দেশের তামাম ইন্টেলেকচুয়াল-দের নির্মম ভাবে হত্যা করে বিভিন্ন জায়গায় গণকবর দিয়েছিল। এমনি একটি গণকবর ঢাকার শাঁখারিবাজার অঞ্চলে অবস্থিত। ১২ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যাবেলায় সোভিয়েত সমর্থনপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন ঢাকা শহরে ঢুকতে শুরু করেছে, তখন রাষ্ট্রপতি ভবনে আলোচনায় বসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাশেম এবং ক্যাপ্টেন আয়ুব। এদের সঙ্গে যোগদান করে পাকিস্তানপন্থী বা রাজাকার’রা, যাদের নেতা ছিল গোলাম আজম।


মিটিং-এ ২৫০ বুদ্ধিজীবির নামের তালিকা তৈরী করা হয়। শোনা যায়, তার দু’দিন পর, অর্থাৎ ১৪ই ডিসেম্বর থেকে ধরপাকড় শুরু হয়- একে একে হত্যা করা হয় পূর্ববাংলার উজ্জ্বল নক্ষত্রদের। শববাহী গাড়ির চালক মফিজুদ্দীন-এর জবানী থেকে জানা যায়, এই ঘটনার ঠিক আগেই পক সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের একটি মিটিং হয় মাদ্রাসা টিচার্স ইউনিয়ন-এর সভাপতি মৌলানা আবদুল মান্নান-এর বাড়িতে। এই বেদনাদায়ক ঘটনার বারো দিন পর,
The Times পত্রিকায় এই ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হয়ঃ


“… It is now known that on Sunday December 12, as the Indian columns were closing on Dacca…a group of senior Pak army officers and their civilian counterparts met in the city’s Presidential residence. They put together the names of 250 peoples to be arrested and killed, including the cream of Dacca’s professional circles not already liquidated during the civil war. Their arrests were made on Monday and Tuesday by marked bands of extreme right-wing Muslims belonging to an organization called the Al-Badar Razakar…Only hours before the official surrender was signed (on 16th), the victims were taken in groups to the outskirts of the city…where they were summarily executed…”


কথাগুলো মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি অবস্থা হ’ল দেশটার! এত রক্তের মূল্যে কি স্বাধীনতা কিনলেন ওরা? বাঘা সিদ্দিকীর মত দেশপ্রেমিক আজ নিজের মুলুকে থাকতে পারেন না, কিন্তু গোলাম আজমের মত একটা নোংরা রাজাকার এই সেদিন অবধি ছিল বাংলাদেশের সিয়াসত-এ সুপ্রতিষ্ঠিত। গণ-আদালতে ফাঁসির হুকুম হওয়া এই বিশ্বাসঘাতককে বাঁচানোর পরেও খালেদা জিয়া ভিটে জেতেন- প্রধানমন্ত্রী হন। বঙ্গদেশ যে রঙ্গে ভরা, এটা ওখানকার মানুষের স্মৃতির হাল টা একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। একটা গোটা জেনারেশন’কে যারা ধ্বংস করে দিল, আজ তাদের পেছনে ছুটে চলাই ওদের কাছে মোক্ষ লাভের সমান। ইয়োকাস্তা’র চুলের সোনার কাঁটা চোখে ফুটিয়ে অয়দিপাস আর্তনাদ জরে উঠেছিলেনঃ “তুমি অন্ধ হও, তুমি অন্ধ হও হে অয়দিপাস। যা তোমার দেখার প্রয়োজন ছিল না, তা তুমি অনেক দিন ধরে দেখেছ…” কে জানে, হয়তো মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে অনেক প্রবীণই অশক্ত দেহে বিড়বিড় করে এই কথাগুলোই বলেন- িনজেদের অভিযুক্ত করেন…


“কি গো…হ’ল কি তোমার? কিছু ভাবছ?”


সুদীপ্তর আচমকা প্রশ্নে আমার সম্বিত ফিরল। বললাম, “না…কিছু না…অনেককেই মেরেছিল। আমরা হারালাম রায়হানের মত চিত্রনির্মাতাকে। বলতো শহীদুল্লাহ কায়সারের মত একজন সাংবাদিকও কি এই যুগে তৈরী হবে? দুই ভাই-ই তো এক ইসলামি আলেম-এর সন্তান। তার পরেও তো ওরা নতুন চোখে সমাজকে দেখতে শিখিয়েছিল। ধর্ম নামক আফিম-টা পরিহার করেই তো এগিয়েছিল ওরা…আসলে বাম আন্দোলনের সংস্পর্শে এসেই দুই ভাইয়ের চেতনার আমূল পরিবর্তন ঘটে…তবে বাঙালি মুসলিমদের শেকল ভাঙার সূত্রপাত ঘটে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে…”


সুদীপ্ত এইবার চুপ। ‘বাম’ শব্দটা শুনলেই বাকি আইটি-য়ান’দের মতই ওর গা চিড়বিড় করে। তবে যাদের কাছে বাম অর্থে বামফ্রন্ট, তাদের কি করেই বা দোষ দিই…খানিকক্ষন চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, “শহীদুল্লাহ কায়সার কি ভাবে মারা গেছিলেন জানো?”


সুদীপ্তর এই খোঁচানো ব্যাপারটায় এইবার বেশ রাগ হল- রেস্টলেস লাগছিল। সিগারেট খাওয়ার অছিলায় ঘরের বাইরে এলাম। মুখাগ্নি প্রক্রিয়া সেরে চোখ বুজে বইয়ের পাতায় পড়া ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। এক এক করে ফুটে উঠল অনেক ছবি- এমন ছবি যা আমি কখনো বইয়ের ইলাস্ট্রেশনেও দেখিনি। ভেসে উঠল ঢাকা শহর কমিটির তৎকালীন জামাত সম্পাদক খালেক মজুমদারের নির্মমতার চিত্র ঃ


মুক্তিযুদ্ধ চলছে জোরকদমে। দৈনিক সংবাদের প্রধান সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার বুকের রক্তে ভরে দিচ্ছেন সম্পাদকীয় স্তম্ভ। যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে তাঁর বেশিরভাগ আত্মীয়ই আশ্রয় নিয়েছে তাঁর ঢাকার বাড়িতে। ১৪ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যাবেলায় যখন শহীদুল্লাহ’র ছোটো ভাই জাকারিয়া হাবিব এবং আরো অনেকে বসে ‘স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র’র খবর শোনার চেষ্টা করছেন, ঠিক সেই সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল- একবার, দু’বার, বার বার…দোতলার ঘর থেকে দ্রুতপায়ে নেমে এলেন জাকারিয়া। একতলার ঘরে তখন সবে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছেন শহীদুল্লাহ। পাশে বসে আছে নীলা, জাকারিয়ার স্ত্রী। দরজা ধাক্কার আওয়াজে সকলেই ভীত-সন্ত্রস্ত। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ফোন করতে উঠলেন কায়সার- ব্যাপারটা জানানো দরকার। হঠাৎ দেখলেন তার সামনে পড়ে আছেন ওবাইদুল্লাহ, তাঁর ছোটো ভাই। উদ্ধত রাইফেল হাতে ঘরে ঢুকে পড়ল কয়েকজন মানুষ। অবিচলিত সাংবাদিক জানতে চাইলেন তাদের আসার কারণ। কোনো উত্তর না দিয়ে উর্দুভাষী সৈনিক বলে উঠলেনঃ “মিল গয়া!” মুখ ঢাকা জনৈক রাজাকার (খালেক মজুমদার) এগিয়ে এসে চুলের মুঠি চেকে ঢরে পাটিতে ফেলে দিলেন কায়সার-কে। স্বামীকে বাঁচাতে ছুটে এলেন পান্না কায়সার এবং শহীদুল্লাহের বোন সাহানা বেগম….রাইফেলের গুড়ুম সীসে ভেদ করে গেল আজীবন বামপন্থী শহীদুল্লাহ কায়সারের দেহ। ‘সারেং বৌ’-এর কথাকারের কলম থেমে গেল চিরদিনের জন্য। তার কয়েকদিন পরে দাদার মতই ‘হারিয়ে গেলেন’ জহির রায়হান। ‘আমি বঁেচে থাকব আর বড়দা নেই- এ হতে পারে না’, বলে কায়সারের খঁোজে যাত্রা করেছিলেন জহির। আর ফেরেন নি। মীরপুরের বাতাসে আজও বারুদের গন্ধ…


সিগারেটটা শেষ করে ঘরে ঢুকলাম। সুদীপ্ত চুপচাপ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ইজিচেয়ারে বসতে না বসতেই আমার দিকে এগিয়ে দিল একটা বই- “একুশে ফেব্রুয়ারী”। লেখকের নাম জহির রায়হান। বইয়ের শেষে রায়হান লিখেছিলেন ইউক্যালিকটাসের পাতা ঝরার কথা…মানুষের মনে সেই আদি-অকৃত্রিম কৃষ্ণচূড়ার চিহ্নের কথা… “ঝরে। প্রতি বছর ঝরে। তবু ফুরোয় না…” আজ মনে হয় পাতা ঝরে যাওয়ার মতই বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের মন থেকে ঝরে গেছে সংগ্রামী মানুষগুলোর স্মৃতি। শাঁখারিবাজার বধ্যভূমির স্মৃতিফলক আজ একটা সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। যে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বলি হলেন শহীদরা, আজ সেই মৌলবাদীই ক্রমশঃ মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। জনতা উদাসীন…


লিখেছেন – বাসু আচার্য্য

3 Responses to “আমার ডায়েরির পাতা থেকে”

  1. brishti aamaye said

    বাসু আচার্য্য এর ডায়েরির পাতা থেকে জানলাম,শহীদুল্লাহ কায়সারকে তাঁর বাড়িতে গুলি করা হয়েছে, এই তথ্য তিনি কোথা থেকে পেয়েছেন,তা জানা যাবে কি ?

    আমার জানা মতে প্রকৃত তথ্য, ১৯৭১ এর ১৪ই ডিসেম্বর,রাজাকাররা তাঁকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর কখনোই তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি !
    ১৯৭২ এর ৩০শে জানুয়ারী্‌ , এক উড়ো ফোন পেয়ে জহির রায়হান, বড়ভাই কায়সারের খোঁজে মীরপুরে যান এবং তিনিও আর কখনো ফিরে আসেন নি !
    বাংলাদেশীদের কাছে এই বুদ্ধিজীবি হত্যাসহ পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর এক বিষয় আর বাসু আচার্য্য আমার অতি প্রিয় লেখক,তাই কোন ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না রাখার জন্যে এই মন্তব্য 🙂

    • basu acharya said

      @ brishti aamaye: apni ja likhechhen ta ekdom thik. 🙂 amar lekhateo dekhben ghotona ta lerkhar agey koekta dot (“….”) diye rekhechhi. majher ghotonagulo jate na likhte hoy. bolte paren diary’r feel ta anar cheshta korechhi. tobe prakashito rachanaye kichhu banan’er pramad chokhe porlo, jemon kasier banan, ebong aro onek kichhu. jaihok, ei bhool bhojha-bujhir janye amar lekhar dharantai daiyee, tai apnar kachhe ebong anyanya pathok’der kachhe ami khomaprarthi. ei lekhate hoyto aro khanikta gobhire jawa jeto, kintu mushkil holo ami jehetu kichhu bishesh kaje baire achhi, tai smritir opor nirbhar korei likhlam.

  2. Debjani Modak said

    eta Shakharibazar noy, Rayerbazar hobe.

Leave a comment