বা ঙা ল না মা

বাঙাল : শব্দার্থের সন্ধানে

Posted by bangalnama on October 25, 2009


কিছু কিছু শব্দ থাকে যাকে ব্যবহার তো করি কিন্তু যার অর্থটার সুলুকসন্ধান পাই না। বাঙাল শব্দটা আমার কাছে তেমন একটা শব্দ। ন্যায়শাস্ত্রে বলে শব্দের অর্থদান করেন ঈশ্বর। এই ক্ষেত্রে তিনি আমার প্রতি সদয় ছিলেন না। তবে বাঙাল না হলেও আমি ইস্টবেঙ্গল। আর এই শব্দের অর্থ আমি বিলক্ষণ জানি। কারণ, আমার দিদির সাথে আমার ছিল নিদারুণ চুলোচুলি। আর দিদি ছিল মোহনবাগানি। আর ঠিক সেই কারণেই আমি ছিলাম ইস্টবেঙ্গল। আমার ইস্টবেঙ্গল হওয়ার পেছনে যে রকম অন্য একটি ক্লাবের পরোক্ষ অবদান ছিল, তেমনি আমার মনে হয় বাঙাল শব্দটার অর্থ খুঁজতে গেলে তার প্রতিপক্ষকে খুঁজতে হবে। এই কথার সুতো টেনে আরো কিছু প্রশ্ন-ও তোলা যায়, যেমন ‘বাঙাল’ কি স্বতন্ত্র বর্গ? না কি তা তার কোনো ‘প্রতিপক্ষ’ শব্দের ওপর নির্ভরশীল? যদি তা হয়, তবে শব্দটির অর্থ অচল কিছু? না প্রতিপক্ষের সাথে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকার জন্য তার অর্থ-ও সময়ের সাথে পালটে গেছে? যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে শব্দের অর্থ নির্মাণ করেন, তারা যে অর্থে শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন আর যারা কেন্দ্রে ছিলেন না তারা কি শব্দর অর্থ নিজের মত করেই পালটে নিয়েছিলেন? এই রকম কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজবারই চেষ্টা করবো আমাদের আলোচনায়।


‘বাঙাল’ শব্দের উৎস কি? বাঙাল বা বাঙ্গাল শব্দের সম্ভাব্য ভৌগোলিক উৎপত্তি ‘বঙ্গাল’ থেকে। নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত ‘বাঙালির ইতিহাস’, আদিপর্ব, থেকে জানতে পাই, একাদশ শতকে প্রাচীন বঙ্গদেশের একটি বিভাগ হিসেবে বঙ্গাল প্রদেশের নাম প্রথম পাওয়া যায় কিছু দক্ষিণী শিলালিপিতে। শিলালিপির বিবরণ বিশ্লেষণ করে বলা যায়, একাদশ শতকে বঙ্গ ও বঙ্গাল দু’টি আলাদা জনপদ ছিল। ‘বঙ্গালদেশ বলিতে প্রায় সমস্ত পূর্ব-বঙ্গ এবং দক্ষিণ-বঙ্গের সমুদ্রতটশায়ী সমস্ত দেশখন্ডকে বুঝাইত। … মানিকচন্দ্র রাজার গানের “ভাটি হইতে আইল বাঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ি” পদে অনুমান হয়, ভাটি ও বঙ্গাল বা বাঙ্গালদেশ এক সময়ে প্রায় সমার্থকই ছিল। কিন্তু বঙ্গাল বা বাঙ্গালদেশের কেন্দ্রস্থান বোধহয় ছিল পূর্ব-বঙ্গে।’ শ্রীধর দাস সংকলিত সন ১২০৬-এর সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে এক অজ্ঞাতনামা বঙ্গাল কবির একটি গঙ্গাস্তোত্র পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ সংস্কৃত সাহিত্যে বঙ্গাল/বাঙ্গাল শব্দটির প্রাচীনতম নিদর্শনের একটি —
“ঘনরসময়ী গভীরা বক্রিম-সুভগোপজীবিত । কবিভিঃ
অবগাঢ়া চ পুনীতে গঙ্গা বঙ্গাল-বাণী চ । –বঙ্গালস্য ।”
ষোলোশ’ খ্রীষ্টাব্দের একটি প্রামাণ্য নকশায় উল্লিখিত
Bengala বন্দরটির অবস্থানও পূর্ববঙ্গে- এটি মতভেদে অধুনা চট্টগ্রাম বা প্রাচীন ঢাকার বন্দর ছিল।


সংস্কৃত স্তোত্রে উৎস মিললেও, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ‘বাঙাল’ শব্দটার ব্যবহার আছে কি? আমার অন্ততঃ চোখে পড়েনি। চৈতন্যভাগবতে দুই বাংলায় যাতায়াতের বিবরণ বেশ পাই। কিন্তু ওই বাংলা তখনও (অ)পর হয়ে ওঠেনি। তাই ‘বাঙাল’ শব্দের ব্যবহার বিশেষ ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশে নাগরিক সভ্যতা চোলাই হয়ে আসার সাথে সাথে গদ্য সাহিত্য যেমন এলো তেমনি এই শব্দটাও সাথে সাথে এলো। কলকাতা শহর হয়ে উঠলো। হিন্দু কলেজ খুললো। আমাদের মহান অতীত বোঝবার জন্য এসিয়াটিক সোসাইটি খুললো। রামমোহন বিদ্যাসাগর এলেন। যে বাবুরা সাহিত্য-সংস্কৃতির ফোয়ারা ছোটাবেন তাদের পিতা ঠাকুররা তখন মুৎসুদ্দিগিরি করতে বা জমিদারি কিনতে ব্যস্ত। কিন্তু এসব কিছু হওয়ার সাথে সাথে তারা খুব স্পষ্টভাবে নিজেদের নবলব্ধ কালচার এবং ‘প্রগ্রেসিভনেস’ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠলেন। তার বাইরে যারা– তারা গ্রাম্য, পশ্চাৎপদ এবং ‘বাঙাল’। বিদ্যাসাগরের ভাই-এর বিদ্যাসাগর জীবনী থেকে তাই জানতে পারি, মেদিনীপুরের ছেলে ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘যশুরে কই’ আর ‘কশুরে যই’ বলা হতো। লক্ষ্য করার বিষয়, ‘বাঙাল’ এখানে শুধু স্থানবাচক নয়। এক বিশেষ আচরণকারী মানুষজনকে বোঝাতে ব্যবহার হচ্ছে। বাংলা সাধুগদ্যের জনকের লেখায় সরাসরি ‘বাঙাল’ শব্দটা পাইনা, কিন্তু চলিত বাংলার শুরুর দিকের আরেক যুগান্তকারী বই ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’য় বাঙাল জমিদারের বিবরণ থেকে স্পষ্ট, ‘বাঙালের ভূত’ নাগরিক জীবনে নেহাতই বেমানান। বাংলার অসংখ্য ডায়ালেক্টের মধ্যে এক বিশেষ ডায়ালেক্ট যে প্রাধান্যকারী জায়গায় এলো, তার প্রেক্ষিতেই যদি কিছু বিশেষ ভাষাগোষ্টি ‘বাঙাল’ হয়ে উঠলো, তবে সেই প্রাধান্যকারী ডায়ালেক্ট কলকাত্তাইয়া ভাষার হয়ে সওয়াল করেছেন আরেক ‘মনীষী’ স্বামী বিবেকানন্দ। উদ্ধৃতিটা দীর্ঘ, কিন্তু ভাষার রাজনীতি নিজের অজান্তেই লেখক স্পস্ট করে দিয়েছেন ‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে।


‘যদি বলো ও-কথা বেশ; বাঙ্গালাদেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোনটা গ্রহণ করবো? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা। পূর্ব পশ্চিম, যেদিক থেকেই লোক আসুক না, একবার কলকাতার হাওয়া খেলেই দেখেছি সেই ভাষাই লোকে কয়। তখন প্রকৃতি আপনিই দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, কোন ভাষা লিখতে হবে। যত রেল এবং গতাগতির সুবিধে হবে, তত পূর্ব পশ্চিমী ভেদ উঠে যাবে, এবং চট্টগ্রাম হতে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ঐ কলকেতার ভাষাই চলবে।… যখন দেখতে পাচ্ছি যে, কলকেতার ভাষাই অল্পদিনে সমস্ত বাঙ্গালা দেশের ভাষা হয়ে যাবে, তখন যদি পুস্তকের ভাষা এবং ঘরে কওয়া ভাষা এক করতে হয় তো বুদ্ধিমান অবশ্যই কলকেতার ভাষাকে ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করবেন। এথায় গ্রাম্য ঈর্ষাটিকেও জলে ভাসান দিতে হবে। সমস্ত দেশের যাতে কল্যাণ, সেথা তোমার জেলা ও গ্রামের প্রাধান্যটি ভুলে যেতে হবে।’


যাকে লেখক প্রাকৃতিক নিয়ম বলছেন তা ‘প্রাকৃতিক’ বটে তবে দোসরা কিসিম কা। আর নগরের কল্যাণেই যে গ্রামের কল্যাণ সে কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেন নি। (এখানে নেট চ্যাটের ইউস করা “;)” এই স্মাইলিটি না দিলেই নয়)।


শব্দের মানে যখন খোঁজা হচ্ছে তখন অভিধানে কি বলছে তাও দেখা যাক। শৈলেন্দ্র বিশ্বাস সম্পাদিত সংসদ ইংরাজি-বাংলা অভিধান– যা এখন নেটেই পাওয়া যায়, তাতে লিখছে: “বাঙাল
[ bāṅāla ] n. a native of East Bengal; (iron.) an unrefined rustic.” অর্থাৎ সেই কালীপ্রসন্ন সিংহ মশায়ের গঁেয়ো ভূত। চলন্তিকা কেবল বলছে “পূর্ববঙ্গবাসী (বর্তমান বাংলাদেশ), তৎসম্বন্ধীয়”। চলন্তিকার ‘মানে’তে সাবকালচারের প্রসঙ্গটা শব্দের মানে থেকে বাদ পড়েছে– অথচ স্রেফ ভৌগোলিক অর্থটি বল্লে ‘বাঙাল’ শব্দের বহু প্রচলিত নিহিতার্থ যে অধরা থাকে তা বুঝতে কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক।


বাঙাল নিয়ে দুইখান ছড়া আমরা ছোটবেলায় মুখে মুখে শুনতাম।
“বাঙাল মনুষ্য নয়, উড়ে এক জন্তু/ লম্ফ দিয়া গাছে ওঠে ল্যাজ নাই কিন্তু”…বা “বাঙাল/ চিংড়ি মাছের কাঙাল/ পুঁটি মাছের ঝোল/ বাঙালের টিকি ধরে তোল”। ছড়াগুলোর উৎস জানা নেই, তবে লক্ষ্যণীয়, প্রথমটায় ‘বাঙাল’ নামধারী ল্যাজবিহীন হনুমান সদৃশ ‘জন্তু’ যে (বাঙালি নামধারী) দু’পেয়ে মানুষের থেকে আলাদা ও জীববিবর্তনের নিরিখে পিছিয়ে থাকা, সে ব্যাপারটা কোনোরকম ধোঁয়াশা না করেই বলা আছে। দ্বিতীয় ছড়াটাতেও হ্যাটা’র চিহ্ন স্পষ্ট। বাঙালির অপভ্রংশ হিসেবে বাঙাল, অর্থাৎ পুরোপুরি বাঙালি নয়, এই শব্দের মধ্যে তাই বাঙালের অপরত্বই মুখ্য হয়ে ওঠে।


এবার ভারতের স্বাধীনতার সময়ের ও তৎপরবর্তী লেখার কিছু নিদর্শন দেখা যাক, বিশেষতঃ বাঙাল (ও স্থানবিশেষে প্রতিপক্ষ ‘ঘটি’) শব্দের ব্যবহারের নিরিখে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘ভীমে ডাকাতের বট’ গল্পে দুই বন্ধু ঝগড়া করতে করতে একে অপরকে ‘বাঙাল’ ও ‘ঘটিচোর’ বলে সম্বোধন করে। ঘটিচোর থেকে ঘটি? বাংলা অভিধানে ‘ঘটি’ শব্দের মানে খুঁজলে “লোটা, জলের পাত্র…” পেলেও ‘পশ্চিমবঙ্গবাসী’ পাওয়া যায় না। প্রচলিত অর্থ ধরলে জলাভূমি অধ্যুষিত পুববাংলার চেয়ে অপেক্ষাকৃত শুকনো রুক্ষ মাটির পশ্চিমবাংলায় প্রাতঃকালীন কৃত্যের জন্য ঘটির আবশ্যিক ব্যবহার, আর সেই থেকে এখানকার মানুষের ঘটি নামের চল হয়। আর বাঙাল? শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক ছোটগল্প ‘তন্দ্রাহরণ’-এ প্রাগজ্যোতিষপুরের বাঙাল যুবরাজ চন্দ্রাননমাণিক্য পুন্ড্রবর্ধনের বাঙালি রাজকুমারীর পাণিপ্রার্থী। নানা পুরুষোচিত গুণাবলী সত্ত্বেও রাজকন্যার কাছে তিনি “বর্বর”, ভাষার আপাতদুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধানে স্বামী হিসেবে কাম্য নন। এ সকলই হরণের আগের ঘটনা- “নন্দা (সখী) আসিয়া সংবাদ দিয়াছে- যুবরাজ দেখিতে শুনিতে ভালই, চাল-চলনও অতি চমৎকার, কিন্তু তাঁহার ভাষা একেবারে অশ্রাব্য। ‘ইসে’ এবং ‘কচু’ এই দুই-টি শব্দের বহুল প্রয়োগ সহযোগে তিনি যা বলেন তাহা কাহারো বোধগম্য হয় না।” (প্রসঙ্গতঃ, শরদিন্দুর গল্পটি অবলম্বনে ইদানীংকালে ‘তন্দ্রাহরণ’ নামে একটি শ্রুতিনাটক রচিত ও পঠিত হয়েছে, সেখানে সেই বাঙাল যুবরাজ চন্দ্রাননমাণিক্যই আবার তন্দ্রার সখীর দক্ষিণবঙ্গীয় ডায়ালেক্টের প্রতি বিদ্রূপ করে বলে ওঠেন “এলুম গেলুম খালুম….হালুম! বিলাইয়ের আপন তালুই বাঘের ভাষায় কথা কও ক্যান কচু!…” শরদিন্দুর গল্পে এই সংলাপ ছিল না। এটি জুড়ে ভাষাগত অভিমানকে স্পষ্টতই দ্বিমুখী রূপ দেওয়া ভাষার রাজনীতির দিক থেকে কতটা অর্থবহ, পাঠক নিজেই বিচার করবেন)। এই প্রসঙ্গে আরেকটি বাঙ্ময় উদাহরণ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, পপ-কালচার ও সিনেমায় বাঙাল আইকন। তাঁর এক স্মরণীয় ডায়লগ – “বাঙাল পুংলিঙ্গ আর বাঙালি স্ত্রীলিঙ্গ।” ‘বাঙালি’ অর্থে পশ্চিমবঙ্গের লোক। এখানে পিতৃতান্ত্রিক ভাষ্যটি গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্ব দাখিলে ব্যবহৃত হয়ে সমবেত বাঙালের হাততালি কুড়োল। এ জাতীয় উদাহরণ দেখে মনে হয়, বাস্তবিকই, ক্ষমতার কাঠামোর ধাপগুলো যেন এক ফ্র্যাকটাল! কলোনীর প্রভু পশ্চিমী সভ্যতার গর্বে কলকাত্তাইয়া বাবুকে যেমন নিচুনজরে দেখবে, একই ভাবে কলকাতার বাঙালি ময়মনসিংহের ‘বাঙাল’কে, এবং ময়মনসিংহের বাঙাল অহমিয়া ‘বর্বর’ বা ‘অসভ্য’ কুলি, গারো, নাগা, অাকা-দের ওপর সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব করবে। সঙ্গে এটাও দ্রষ্টব্য যে, ক্ষমতার মার্জিনে যারা রয়েছে তাদের যৎসামান্য রিটালিয়েশনটাও যখন হয়, তা হয়ে থাকে ‘ক্ষমতা’র ভাষা ধার করেই। এক একটি গোষ্ঠীকে বিশেষ বিশেষ শব্দে সম্বোধিত করার মধ্যে একইভাবে (অ)পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের ‘প্রাকৃতিক’ প্রবণতা-টাই সার সত্য, যা সেই শব্দগুলোর ব্যবহারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


তাহলে বাঙাল শব্দটার জন্মলগ্নে এর এক মানে ছিল বটে। উদাহরণ হয়তো আরো বাড়ানো যেত, কিন্তু থাক। লেখার শুরুতে জিজ্ঞাসা ছিলো, এটাই কি এর একমাত্র অর্থ ? আদিপর্বের শিলালিপি-বর্ণিত ভৌগোলিক অর্থটি বাদ দিয়ে বললেও, উনিশ শতকের কলকাতার বাবুরা যে অর্থে বাঙাল শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন তা কি সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় নি? যাদের জন্য শব্দটা ব্যবহার হয়েছিল তারা এই শব্দটার মানে কি করে বদলে দিলেন সেটাই দেখা যেতে পারে। কলকাতা শহর তৈরি হবার সময় বাংলাদেশের বাঙালিদের যা দশা ছিল তা খুব তাড়াতাড়ি বদলে যায়। সেখানে এক সম্পন্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি গড়ে ওঠে। তারা ‘কালচার’ জানে। ইংরেজি জানে। কবিতা লেখে। এখানকার কলেজে পড়তে আসে। তারা বাড়িতে বাঙাল ভাষা বললেও বাইরে কলকাত্তাইয়া ভাষা বলতে পারে। তারা বাঙাল শব্দের মানে অনেকটা বদলে দিলেন।


দেশভাগের আগে পরে এপার-ওপার ঢালাও মিশেলের ফলে ভাষা, সংস্কৃতির আদান-প্রদান হল। এ-সবই হল আধিপত্য-অধীনতার অসম সমীকরণ মেনেই। বিউলির ডাল বা ভারালি খুঁজলে কলকাতার বাজারে এখন মিলতে পারে, কিন্তু ‘গাউচ্ছা মাইয়া’ গেছো মেয়ের সমান স্ট্যাটাস পেল না; ফুফু, দাদী, খালা, আব্বুরা দূরসম্পর্ক হয়েই রইল; ইসে আর কচু নিয়ে বিদ্রুপের উত্তরে এপারের
rustic-দের ডায়ালেক্টের নুচি-নেবু-নঙ্কা-এলুম-গেলুম নিয়ে পালটা খোঁচা চলল– ওই পর্যন্তই। পশ্চিম থেকে যারা পুবে কাঁটাতার পেরোলেন, তারাও পরিধেয়র মত সঙ্গে নিয়ে গেলেন উন্নত সংস্কৃতির অভিমান। কলকাতার উত্তর ঔপনিবেশিক কবি-লেখকরা ওপারে যত ব্যাপক হারে আদৃত হলেন, উল্টোটা ততটা চোখে পড়ল কি? ওপার থেকে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী লোটাকম্বল আর কালচার আশ্রয় করে এপারে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন, তারা এক প্রজন্মের জীবনসংগ্রামের পর কোনো না কোনো ভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন। দেশভাগের আগে আর পরের অনেক লেখায়, সিনেমায়, মধ্যবিত্তের ‘বাঙাল’ হওয়াটা গর্বের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু বাঙালদের মধ্যে যারা বাঙাল মানে যাকে বলে unrefined rustic তারা কি বাঙাল হওয়া নিয়ে এই নবোদ্ভুত জাত্যাভিমানে ভুগতো? সে ছবিটা পশ্চিমের মত পুবেও এক। (সে’জন্যই কি কমলকুমার বলেছিলেন “বাঙালদের হিস্ট্রি আছে, জিওগ্রাফি নেই”?) অধিকাংশ মুসলমান চাষা আর হিন্দু জমিদার আর মধ্যবিত্তের বাংলাদেশে বাঙাল হওয়া যখন গর্বের হলো, তখনও আসল ‘বাঙাল’রা বাঙালই থেকে গেলো। মাতৃভাষার লড়াইয়ে বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি পরিচয়টা মুখ্য হয়ে উঠলে তাই বাঙাল পরিচয়টা সামনে আসলো না। হয়তো সেই জন্যই।


আমাদের এই ফেলাছড়ার আলোচনায় দেখলাম যে শব্দটা নাগরিক মানুষদের থেকে আরো কিছু মানুষদের আলাদা করার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল তা সেই মানুষদের আত্মঘোষণায় পরিবর্তিত হয়ে গেলো। তবে এই শব্দের অর্থ নির্মাণের পেছনে আরো একটা বিষয় আছে যাকে নজরআন্দাজ করা যায় না; বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব আর বাংলাভাগের মত ঘটনায় আত্মপরিচিতি নির্মানের দায় তো ছিলই, কিন্তু সেই আত্মপরিচিতি নির্মাণ কোনো সহজ সাদা ছকের মধ্যে ফেলা যায় না। শব্দের অর্থ সন্ধান করতে বসে এখানে এসে থামলাম তাহলে? না কি পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে গিয়ে নতুন কোনো অর্থের সন্ধান অধরা রয়ে গেলো?


লিখেছেন – আকাশ ও সোহিনী (কথোপকথন থেকে অনুলিখিত)

সাহিত্যের উদাহরণ সংক্রান্ত তথ্যপ্রদান ও প্রমাদ-সংশোধনের জন্য অভীক কুমার মৈত্রকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।

5 Responses to “বাঙাল : শব্দার্থের সন্ধানে”

  1. Caesar said

    Bidyasagar-er “Joshure Koi” naam-koron hobaar kaaron, joddur jaani, onaar shorir-er tulonaay boro matha. Joshor-er koi maachher matha boro hoy. Ekhaane onyo kono subtext bodhoy nei.

  2. Akash said

    reference gulo pray sob i smriti theke deya. joshure koi ba pore koshure joi bolar pechone bidyasagar moshai er saririk boishityo karon chilo nischoi, kintu lekha ta porle dekha jay sohure ba adha sohure porua der thatta r mul karon chilo tar ‘geyopona ‘ .

    oboshyo ami bhul o hote pari .

  3. Somnath said

    বোঙ্গা থেকে বঙ্গ এই থিওরীটাও রাখলে হতো

  4. Mahasweta said

    তথ্যপূর্ণ লেখা। ভালো লাগলো। তবে এই বিষয়ে আরো তথ্য পেলে খুশি হব।

  5. Muhammad Saifullah said

    প্রাণবন্ত, তথ্যবহুল ও বাস্তব ধর্মী লেখার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a comment