‘আ মরি বাংলা ভাষা’ – কেন, মরতে যাবো কেন?
Posted by bangalnama on February 21, 2010
– লিখেছেন দেবী প্রসাদ সিংহ।
সেই কবে থেকে শুনে আসছি মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। ভাষা ছাড়া একটা জাতি বাঁচতে পারে না, তার রাগ, ঘৃণা, ক্রোধ, ভালোবাসা সবকিছুই জড়িয়ে আছে ভাষার সঙ্গে। শুধু আবেগই নয়, একটা জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বেড়ে ওঠা ভাষার সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। ভাষার জন্যে বাংলাদেশের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। ২১শে ফেব্রুয়ারির সেই দিনটি ডায়াস্পোরিক বাংলায় আড়ম্বর ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে এবং অনেক চিন্তাশীল প্রবন্ধ, উদ্দীপক গান ও ওজস্বিনী বক্তৃতার মাধ্যমে পালিত হয়ে থাকে। এরকমই তো হওয়া উচিত। আমাদের মধ্যে বাঙ্গালি যারা উত্তর-পূর্ব ভারতে থাকি, বিশেষ করে অসমে, তাদের জন্যে ১৯শে মে আরো একটি ভাষা শহীদ দিবস আছে। ১৯৬১ সালের সেই দিনটিতে ১১ জন মানুষ বাংলা ভাষার জন্যে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। শিলচর শহর ও তার আশেপাশে সেদিন পাড়ায় পাড়ায় মাইকে, বছরের অন্যদিনগুলোতে হিন্দি গান বাজলেও, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি কানের পর্দা ফাটিয়ে ব্রডকাস্ট হয়ে থাকে, তার সঙ্গে প্রবন্ধ, গান ও বক্তৃতাও সেদিন আমাদের যথেষ্ট মাত্রায় পড়া ও শোনার সুযোগ হয়। এসবই খুব ভালো ব্যাপার, নিজের মাতৃভাষাকে ভালো না বাসলে কী চলে? অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও তাদের ভাষাকে একই রকম ভালোবাসে, কেবল তাদের অনেকেরই ভাষাশহীদ না থাকার জন্যে প্রবন্ধ, গান ও বক্তৃতা সমান মাত্রায় উৎপাদিত হয় না।
কিন্তু ভাষা যে অনিয়ন্ত্রিত, আবেগতাড়িত প্যাশনের জন্ম দেয়, তার তো একটা হিংস্র, নরখাদক মুখও আছে। আমরা বেশির ভাগ মানুষই যেহেতু নিজস্ব ভাষা-সমাজে বসবাস করি, এই হিংস্র চেহারাটা আমাদের দেখার সুযোগ হয় না। বা, হলেও, যেহেতু সেই বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলে আমরা যে ভাষায় কথা বলি তার প্রাধান্য প্রশ্নাতীত, বন্দুকের নলের ভুল দিকটায় আমাদের দাঁড়াতে হয় না। সেই স্বস্তির অবস্থান থেকে, এবং যেহেতু ভাষাজড়িত আবেগ আমাদের সবার মধ্যেই কমবেশি সংক্রামিত, তাই বন্দুকের ট্রিগারে আমাদের আঙ্গুল শারীরিকভাবে না থাকলেও সেই হিংসাকে যৌক্তিক ভিত্তি দিয়ে গোষ্ঠীগত বিবেককে শান্ত করে রাখি।
ওপরের কথাগুলো ধর্মসংক্রান্ত হিংসার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু এখানে মৌলিক পার্থক্যটা হলো ধর্ম রাজনৈতিক, ভৌগোলিক বা জাতিগত সীমান্তে আবদ্ধ নয় বলে ধর্মীয় বিবাদের অনুরণন অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে সেই বিবাদের ওপর পর্যবেক্ষন ও পর্যালোচনার আলো পড়ে অনেক বেশি করে। আর বহু শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় এখন আমরা ধর্মকে এথনিসিটি ও সুশীল সামাজিক সংগঠন থেকে আলাদা করে দেখতে শিখেছি, ফলে ধর্মীয় হিংসার একটা সেকুলার, উদারনৈতিক বিরোধী প্রতিক্রিয়ার জায়গা তৈরি হয়েছে। এই জায়গাটা আছে ধর্মীয় সমাজগুলোর ভেতরে। এবং বাইরে। ফলে দুটো জিনিষ হয়েছে। ধর্মীয় হিংসা যেভাবে হেডলাইন খবর হয়, ভাষিক হিংসা সেভাবে হয় না। কাঠকয়লার মতো চোখের আড়ালে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে, হিংসার শিকারের কাছে সেটা অনেক বেশি বিপজ্জনক। দ্বিতীয়ত, ভাষাগত বিবাদের সঙ্গে যেহেতু জাতিসত্বার সমস্যা, অভিপ্রয়ান বা শরণার্থী সমস্যা, এবং কখনো কখনো কোন ক্ষুদ্রতর ভাষানির্ভর গোষ্ঠীর টিঁকে থাকার বা সংরক্ষণের সমস্যা জড়িয়ে থাকে, সুশীল সমাজ-এর পক্ষে এর প্রতিক্রিয়া ধর্মীয় বিবাদের মতো চওড়া, সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে করা মুশকিল হয়ে পড়ে, ফলে সেই অস্পষ্ট বা ধর্ম ও জিরাফ দুটোকেই ধরে রাখা প্রতিক্রিয়া শিকার ও শিকারী উভয়ের কাছেই অপ্রাসঙ্গিক ও অনর্থক হয়ে ওঠে।
উদাহরণ হিসেবে বলকান দেশগুলোর কথা ধরা যেতে পারে। সেখানকার জাতিগত হিংসার ধর্মীয় ও এথনিক উপাদানের চুলচেরা বিশ্লেষন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যেমন ভাবে করা হয়েছে, ভাষা নিয়ে এই দেশগুলোর ভেতর যে কামড়াকামড়ি তা কী একই গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত? কী আশ্চর্য, সেখানে এতদিন একটাই ভাষা ছিলো, কিন্তু সেই ভাষাকে নাকচ করে দিয়ে চারটি দেশ নিজস্ব জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এক একটি কিম্ভুত, জগাখিচুড়ি ভাষা তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে, যে ভাষায় বা ভাষাগুলোতে ওই চারটি দেশের কোন মানুষই কথা বলে না। ইউক্রেনে রুশরা জনসংখ্যার ২২%, রুশকে দ্বিতীয় সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবী অনেকদিন ধরেই করা হয়ে আসছে, এখনো কেউ কানে তোলে নি। আমার দৃঢ় ধারণা এই ইসুতে একটা বড়োসড়ো দাঙ্গা অদূরভবিষ্যতে ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু এই নিয়ে কী রাশিয়া বা ইউক্রেনের বাইরে কোথাও কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে? কিন্তু এখানে যদি বিবাদটা হতো, ধরা যাক, ক্যাথলিক বনাম ইহুদি, তাহলে সেটা অনেকদিন আগেই ফ্রন্টপেজ খবর হতো। মহারাষ্টে মারাঠি ভাষা নিয়ে, কর্নাটকে কন্নড় ভাষা নিয়ে যে গন্ডগোলগুলো মাঝেমাঝেই বাঁধে, আমরা যারা ওই দুটো রাজ্যের বাইরে থাকি সেগুলো নিয়ে কী কখনো সিরিয়াসলি ভেবেছি বা ভাবি? যদি এটা হিন্দু মুসলমান সমস্যা হতো তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়া হতো তাৎক্ষণিক ও যথার্থ। এটাই হচ্ছে, আমাদের মাননীয়া রেলমন্ত্রীর ভাষায়, ‘পোবলেম’। ভাষাকে আমরা আবেগিক স্তরে অবলোকন ও ব্যবহার করি বলে তার কুশ্রী রূপটাকে সামাজিক অবচেতন থেকে মুছে দিতে চাই। কিন্তু চাইলেই কী আর মোছা যায়?
আমি এতক্ষণ ধানাইপানাই করলাম আসলে এই কথাটা বলার জন্যে যে আমি যে রাজ্যের বাসিন্দা সেখানে ভাষা একশো বছরেরও ওপর ধরে খুব স্পর্শকাতর একটা ইসু। ১৮২৬ সালে ইয়ান্ডাবুর সন্ধির মাধ্যমে অসম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে আসে। অসমে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল, সাহেবরা তাই প্রশাসন চালাবার জন্যে বাংলা থেকে কেরাণী আমদানি করত। নতুন খোলা স্কুল কলেজে বাঙ্গালি শিক্ষক, রেলে চা-বাগানে বাঙ্গালি বাবু, মানে শাসক ও শাসিতের মাঝখানে বাফার হয়ে ছিল বাঙ্গালি হোয়াইট কলার শ্রমিক সম্প্রদায়। বাঙ্গালি বিদ্বেষের সেখান থেকে শুরু। এক সময় ইংরেজরা অসমে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করে। বেশির ভাগ অসমিয়া এখনো বিশ্বাস করে যে এটা ঘটেছিল বাঙ্গালি কেরাণীকুলের উসকানিতে। অসমিয়া ভাষিক জাতীয়তাবাদের উত্থান সেই সময় থেকে। তারপর ব্রহ্মপুত্র দিয়ে এতো বছর অনেক জল, এবং অনেক রক্ত বয়ে গিয়েছে – দাঙ্গা হয়েছে বেশ কয়েকটি, বহু মানুষ মারা গিয়েছেন, বহু ঘরছাড়া হয়েছেন। ৭০ ও ৮০র দশকে বিদেশী তাড়াও আন্দোলনের মূল রাজনীতিটা ভাষার। অবশ্যম্ভাবীরূপে, দু’তরফই ভাষার জন্যে বেশ কিছু শহীদ অর্জন করেছে। এবং অবশ্যম্ভাবীরূপেই, দু’তরফেই শহীদের পুণ্যস্মৃতিতে অনেক কবিতা, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচিত হয়েছে। তাতে শিল্প ও সাহিত্যের কতোটা উন্নতি হয়েছে বলা মুশকিল, কিন্তু দু’তরফের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্রম অবনতিই ঘটেছে। আমার মনে আছে বিদেশী বিতাড়ন আন্দোলনের সময় দেয়ালে বড়ো বড়ো রক্তাক্ষরে লেখা ‘চিরচেনেহি মোর ভাষাজননী’ (একটা বিখ্যাত স্কুলপাঠ্য অসমিয়া কবিতার লাইন, যার অর্থ অতি আদরের আমাদের ভাষাজননী) দেখলে আমাদের বুক দুরুদুরু করত।
অসমিয়া-বাঙ্গালি বিসম্বাদের গভীরে আমি এখানে যেতে চাইছি না, সেটা অন্য কখনো করা যাবে। আমার বক্তব্য হলো আমরা যারা ভাষা নামক বন্দুকের নলের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম বা আছি, যারা দেখেছি ভাষার দাঁত দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, তারা চাই ভাষা নিয়ে আদেখলেপনা বন্ধ হোক। ভাষা নিয়ে যখন বাস থেকে নামিয়ে পেটানো হয়েছে, একটি বিশেষ ভাষার নাটক যাত্রা সিনেমা চলতে দেয়া হয় নি, খেলার মাঠে নিজের দলকে সমর্থন করতে না পেরে চোরের মতো বসে থাকতে হয়েছে, তখন ভাষা, যে কোন ভাষা, নিয়ে আমি কেন আবেগপ্রবণ হতে যাবো? আমি তো জানি যে কাল যদি বন্দুকের নিরাপদ পাশটায় থাকি, সেই একই উন্মত্ততায় আমিও মেতে উঠতে পারি, বাস থেকে নামিয়ে হয়তো নিজে পেটাবো না, কিন্তু একটা কবিতা লিখে নৈতিক সমর্থন যুগিয়ে যাবো।
ভাষাকে ভালোবাসা ভালো, কিন্তু আবেগ নয়, যুক্তি দিয়ে। শহীদদের স্মরণ করা ভালো, কিন্তু ন্যাকামো বাদ দিয়ে।
Related
This entry was posted on February 21, 2010 at 10:00 am and is filed under ইতিহাস, একুশে, ধর্ম, পূর্ব পাকিস্তান, বাংলা, বাংলাদেশ, ভাষা, Language Movement, Religious Fundamentalism. Tagged: 19th May 1961, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আসাম, একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশ, Bangla language movement, Barak valley, Ekushe February, linguistic identity. You can follow any responses to this entry through the RSS 2.0 feed. You can leave a response, or trackback from your own site.
বৃষ্টি said
“শহীদদের স্মরণ করা ভালো, কিন্তু ন্যাকামো বাদ দিয়ে”—
একদম !
তবে,ইদানীং ভাষাদিবসের ভাব-গম্ভীরতা(ন্যাকামি!) তেমন একটা চোখে পড়ে না।
বরং বেশ একটা ছুটির হাওয়া খেলতে থাকে চারপাশে…
বাড়িতে-বাটিতে ‘ইম্প্রুভড ডায়েট’ এর ব্যবস্থা…
নববর্ষ-ঈদ-পূজা ইত্যাদির মতই আর একটা উত্সব !
এর ওপর বাড়তি পাওনা শহীদদিবস উপলক্ষে’একুশের বইমেলা’র বিশেষ আকর্ষণ 🙂
আকাশ said
ভালো লাগলো।
deviprasad said
বৃষ্টি
ওই বিপজ্জনক ‘ভাব-গম্ভীরতা’টা সাবলিমিন্যালি আসে তো। ওই ‘ছুটির হাওয়া’র মধ্যেই ‘মাতৃভাষাকে বুকের রক্ত দিয়ে প্রয়োজনে রক্ষা করতে হবে’ এই সেন্টিমেন্টটা আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায়! ভাষা দিবসের বিশেষ অবদান ওইটি- ভাষা প্যারানোইয়ার সৃষ্টি।
আকাশ
ধন্যবাদ।