বা ঙা ল না মা

ছঁেড়া খোয়াবের খাতা ঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা

Posted by bangalnama on June 1, 2010


লিখেছেন – সোহিনী


জোতদার মহাজনে মনে মনে উহাদের পিরীত ।
চাষার মুখের গেরাস খাওয়া দুইজনেরই রীত ।।
চাষার বড় দুশমন এই দুইজন যেমন পাখির দুশমন খাঁচা ।
চোরের দুশমন চান্দের পহর পোকের দুশমন প্যাঁচা ।। ..
বলি জমিদারি উচ্ছেদ করি এমন আইন চাই ।
জোতদার পাবে এক ভাগ ফসল চাষায় দুই ভাগ পাই ।।
(কেরামত আলির গান, খোয়াবনামা)


চল্লিশের দশক। দুর্ভিক্ষ, আধিয়ার বিদ্রোহ পেরিয়ে জোট বাঁধছে বাংলার কৃষক। যুদ্ধের বাজারে কাজ এবং মজুরি কমছে, বীজ কেনার টাকা নেই, গঁায়ের মানুষের আধপেটা খেয়ে দিন গুজরান, তারই মধ্যে স্লোগান উঠছে ‘নিজ খেলানে ধান তোলো’, ‘জোতদার মজুতদার হুঁশিয়ার’। এদিকে পাকিস্তান প্রস্তাব, ছেচল্লিশের ভোট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ইতিহাসের পট বদলাচ্ছে জোর লয়ে। দেশ ভাগ হচ্ছে। এসবেরই মাঝে কোন এক গঁায়ে, কোন এক সময়ে, ‘তমিজের বাপ’ বলে পরিচিত মূর্তিমান প্রেতাত্মা কিনা একহাঁটু কাদাজল ঠেলে বিলের ধারে পাকুড় গাছের ডালে দেড়শো বছর আগের গোরা-ঠ্যাঙানো ভবানী সন্ন্যাসীর পাঠান সেনাপতি ‘মুনসি’কে একঝলক দেখার আশায় দিনের পর দিন আসমানের মেঘ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে! তমিজের বাপ বড় বিচিত্র জীব। তার জন্ম-মৃত্যুর বিবরণ, এমনকি নামও জানা যায়না। অনন্ত ঘুম আর আধো-জাগার অবসরে মুখে মুখে শোলোক আউড়ে গাঁয়ের লোকের ব্যাখ্যাতীত স্বপ্নের বাখান করে বেড়ানো একটা অলৌকিক মানুষ। বাস্তবতা বলতে আছে তার ফকিরি, আকালের বছরগুলোর ভিক্ষাবৃত্তি, বিন-মজুরিতে বেগার খাটার বদভ্যাস, আর হাড্ডিসার শরীরের অপরিসীম, অপরিসীম খিদে। এহেন তমিজের বাপের হেফাজতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ – চেরাগ আলি ফকিরের আঁকিবুকি কাটা খাতা- যাতে পাওয়া যায় সমস্ত রকমের স্বপ্নের হদিশ। একভাবে দেখলে তমিজের বাপ নিজেই খানিকটা এই উপন্যাসের অবয়ব। ঘটমান বর্তমানের সঙ্গে যার নিবিড় যোগ থেকেও সেখানেই যে সীমাবদ্ধ নয়, যাবতীয় ভূত এমনকি অনাগত ভবিষ্যতের মধ্যে যে অতীন্দ্রিয় একটা যোগসূত্র। তেভাগা-দেশভাগের নেপথ্যের উপকথা লিখতে বসে স্মৃতির সঙ্গে বাস্তব, ইতিহাসের সাথে কিংবদন্তী, প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামের পাশাপাশি তাদের পূর্বজদের কথা পরতে পরতে মিশিয়ে দিয়ে ইলিয়াস নির্মাণ করেছেন আশ্চর্য জাদু-আখ্যান। এই কাহিনী ইতিহাস না হয়েও তাই ইতিহাসপাঠের অংশ বটেই।


“উত্তর থেকে পশ্চিম থেকে নতুন নতুন ঢেউ আসছে, বর্গাদাররা সব ধান নিজেদের ঘরে তোলার জন্য একজোট হচ্ছে।”


“পশ্চিমে ধান কাটতে গিয়ে আধিয়ারদের কান্ডকারখানা তো তমিজ দেখে এসেছে নিজের চোখেই.. জমি হ’ল জোতদারের, ফসল কে কী পাবে সেটা তো থাকবে মালিকের এক্তিয়ারে। অথচ ফসলের বেশিরভাগ দখল করতে আধিয়াররা নেমে পড়ে হাতিয়ার হাতে।…. জোতদার নাকি পুলিসের সঙ্গেও কথা বলে রেখেছিলো। তা পুলিস যাবে আর কত জায়গায়?- সেদিন ভালো মজুরির চুক্তিতে আপখোরাকি কাজে নেমেছিলো তমিজ। ধুমসে কাজ করছে, যত তাড়াতাড়ি পারে ধান কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু দুপুর হতে না হতে এতগুলো মানুষের হৈ হৈ শুনে ভাগ্যিস সময় মতো দৌড় দিয়েছিলো। চাষাদের বউ-ঝিরা পর্যন্ত ঝাঁটা খুন্তি বঁটি নাকড়ি নিয়ে তাড়া করে। ধানখেতের ভেতর দিয়ে, কাটা ধানের আঁটি ডিঙিয়ে এবং কখনো সেগুলোর ওপর পা রেখে ছুটতে না পারলে ঝাঁটা কি খুন্তির দুই একটা ঘা কি তমিজের গায়ে পড়তো না! কয়েকটা বাড়ি যে পড়েনি তাই বা কে জানে বাপু! মেয়েমানুষের হাতে মার খেয়ে কেউ কি তা চাউর করে বেড়ায়।…আধিয়ারদের এরকম বাড়াবাড়ি তমিজের একেবারেই ভালো লাগেনি। জমি হ’ল লক্ষ্মী, লক্ষ্মীর বেটাবেটি হলো তার ফসল। সেই ফসল নিয়ে টানাটানি করলে জমির গায়ে লাগে না? ফসল হলো জমির মালিকের জানের জান। তাই নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করলে বেচারা বাঁচে কী করে?”


তমিজের বাপ রহস্যময় চরিত্র হলেও তমিজ খাঁটি রক্তমাংসের মানুষ। মাঝির বেটার অনেকদিনের হাউস, সে চাষী হবে। এদিকে গরু-লাঙল-জোয়াল-মই-বীজচারা কেনার পয়সা নেই। ফলে নিজের গ্রাম থেকে দূরে খিয়ারের পাঁচশ’ বিঘা জমির জোতদারদের ক্ষেতে কামলা খাটতে গিয়ে এইভাবেই তমিজের প্রথম মোলাকাত হচ্ছে বিদ্রোহী আধিয়ারদের সঙ্গে। এবং বলাই বাহুল্য সামন্তী সমাজের অভ্যস্ত নৈতিকতায় আধিয়ারদের দাপাদাপি তার কাছে অন্যায্য ঠেকছে। বাধ্য ভূমিহীন প্রজার মতই সে জমির ফসলের ওপর জমিদারের প্রশ্নাতীত অধিকারের পক্ষ নিয়ে নিচ্ছে। এবং বহু হাতে পায়ে ধরে যখন জোতদার শরাফত মন্ডলের ছেলে, লীগকর্মী, আবদুল কাদেরের সুপারিশে নিজের গাঁয়ে এক টুকরো জমি বর্গা করার সুযোগ পাচ্ছে, জোতদারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ছে তমিজ। ফসল দিতে অনিচ্ছুক বুড়া হুরমতুল্লার ওপর তার স্বাভাবিক রাগ ঝরে পড়ছে – “জমির মালিককে তার ভাগের ফসল দিতে বুড়ার বুক টনটন করে। নিমকহারাম!”


সুরুজে বিদায় মাঙে শীতে সে কাতর ।
শীষের ভিতর ধান কাঁপে থরথর ।।
পশ্চিমে হইল রাঙা কালা পানি অচিন ডাঙা
ফকিরে করিবে মেলা রাত্রি দুই পহর ।
ধানের আঁটি তোলো চাষা মাঝি ফিরো ঘর ।।
(চেরাগ আলীর গান, খোয়াবনামা)


কিছুটা সময় কেটেছে। আসুন তমিজকে আবার খানিকক্ষণ অনুসরণ করি। এক ফালি বর্গা জমি পেয়ে অবধি তমিজের মধ্যে আসছে পরিবর্তন। শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে অদম্য উৎসাহে আমন চাষ করছে সে। দিন নেই রাত নেই পড়ে থাকছে ক্ষেতে। জান নিংড়ে দিয়ে মেহনতের ফসল তুলতে পাগল হয়ে উঠছে। হুরমতুল্লার ধমক খেয়ে শিখছে ধানচাষের কৌশল– “হাত দিয়া মাটি ছানা হয় না। জমি চায় নাঙলের ফলা, বুঝলু? জমি হলো শালার মাগীমানুষের অধম, শালী বড়ো লটিমাগী রে, ছিনালের একশ্যাষ। নাঙলের চোদন না খালে মাগীর সুখ হয় না। হাত দিয়া তুই উগলান কি করিস’? বলতে বলতে হুরমতুল্লা গম্ভীর হয়ে যায় এবং কাশির দমক অগ্রাহ্য করে সে জানায়, হাত দিয়ে ছানলে রোদ একটু চড়া হলেই মাটি শক্ত হয়ে যায়। ভেতরে শক্ত হলে সেই মাটিতে ধানের চারা আরাম পায় না।” মাটির ছোঁয়ায় তমিজের শরীর জেগে উঠছে। মাটি-কে ঘিরেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আরেকটু সচ্ছল চাষী হবে সে। এদিকে একটু একটু করে বড় হচ্ছে তার সাধের ধানচারারা – “দিঘি, এদিকে মাঠের পর মাঠ, ওপরে আকাশ পর্যন্ত কুয়াশা জড়ানো চঁাদের আলো। তমিজের জমিতে পাতলা কুয়াশা টাঙানো রয়েছে মশারির মতো, মশারির ভেতরে চুঁয়ে-পড়া-আলোয় তার ধানগাছগুলো ঘুমিয়ে রয়েছে মাথা ঝুঁকে। চাঁদের আলো এই ধানক্ষেতে ঢুকে আর বেরোয় না, ধানের শীষে গাল ঘষতে ঘষতে ধানের রঙ চোষে চুকচুক করে। আবার আলো পোয়াতে পোয়াতে ঘুমায় সারি সারি ধানগাছ।”


তমিজকে নজর করতে করতে আখ্যানও এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। কিছু কাল পরে দেখছি ভর দুপুরবেলায় বর্গাজমিতে কাজ করতে করতে আচ্ছন্ন হয়ে খোয়াব দেখছে তমিজ। খিয়ারের ক্ষেতে সাঁওতালি আধিয়ার আর জোতদার-পুলিশের সেই যে ফসলের লড়াই দিয়ে তার প্রথম তেভাগা-দর্শন, সেই লড়াই-এর স্মৃতি নতুন নতুন অভূতপুর্ব আকারে দিবাস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসছে।


‘আধিয়ারদের তাড়া খেয়ে কাটা ধান ফেলে সে দৌড় দিলো। দৌড় দৌড় দৌড়। তার গায়ে তীর বঁিধছিলো একটার পর একটা। … সঁাওতাল চাষারা জোতদারদের মারে তীর দিয়ে। তা তীরের খোঁচায় টিকতে না পেরে ….. উপায় না দেখে তমিজ তখন কাঁটাওয়ালা বাবলাডাল ভেঙে ভেঙে ছুঁড়ে মারতে লাগলো ঐ চাষাদের দিকে। কিন্তু কোন শালা কি মন্ত্র পড়ে দিয়েছে, বাবলাডাল একটার পর একটা গিয়ে লাগে জোতদারের গায়ে। শরাফত মন্ডলের গলার ঠিক নিচে বাবলাকাঁটা লেগে রক্ত বেরুচ্ছে। বাপের পেছনে দাঁড়িয়ে আবদুল আজিজ আবদুল কাদের দুই ভাই। অন্ততঃ আবদুল আজিজের মুখ বরাবর কাঁটাওয়ালা মোটা একটা বাবলাডাল লাগাবার জন্য তমিজ নানাভাবে চেষ্টা করে, কিন্তু জুত করতে পারেনা। তমিজ আরো ডাল ভাঙতে লাগলো। জোতদার শালা ঝাড়েবংশে হারামজাদা। শালার একোটা মাক্কুচোষা। তমিজের এত কষ্ট, এত মেহনত, এত কষ্টের মেহনতের ফসল সব নিয়ে তুলতে হবে শালাদের মোটা মোটা গোলায়।”


কিন্তু এ কোন তমিজ! তিন মাস আগের সেই কামলা-খাটা নিরীহ মাঝির বেটা এখন দু’বিঘের বর্গাজমির ভূমিপুত্র হয়ে কিনা খোয়াবের মধ্যে জোতদার প্যাঁদাচ্ছে! তমিজের মনে তবু পাপবোধের দোলাচল জাগে। একবার শরাফতের প্রতি প্রজাসুলভ কৃতজ্ঞতা আর একবার নিজের পরিবর্তিত অবচেতনের ছায়া দেখে নিজের বেইমানিতে হয়তো খানিকটা অনুশোচনা বোধ করে।


মাদারি নামিল জঙ্গে হস্তে তলোয়ার।
কোম্পানি সিপাহি মরে কাতারে কাতার ।।
গোরা টেলর হস্তে ধরে কামান বন্দুক ।
মাদারিরে দেখি তার সিনা ধুকধুক ।।
মজনু হাঁকিয়া কয় ভবানী সন্ন্যাসী ।
গোরাগণে দরো আর দাও সবে ফাঁসি ।।
গিরিবৃন্দ অসি ধরে ভবানী হুংকারে ।
গোরাগণে পাঠাইয়া দেয় যমদ্বারে ।।
(মুনসির শোলোক, খোয়াবনামা)


কিন্তু ইলিয়াস তো তেভাগা-দেশভাগকে পারম্পর্যহীন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দ্যাখেননা। তাই খোয়াবনামায় দেড়শো বছরের পুরোনো ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে – শোলোকে, গানে ছড়ায়, মজনু শাহের মেলা আর কাৎলাহার বিলের লোকজ ইতিহাসে। মানুষের বিদ্রোহ আর লড়াইয়ের উত্তরাধিকার, নৈতিকতা আর লোকজ বিশ্বাস এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে চলকে পড়ে, থেকে যায় অবচেতনের পরতে। খোয়াবের ভেতর। হিসেব মেলাতে না পারলে তমিজের বাপেরা তার মানে বাতলে দেয় ঠিকঠাক।


তমিজের মত শরাফতের চরিত্রটিও জীবন থেকে উঠে আসা। তার বাপচাচাকে হিন্দু জমিদারের নায়েব তুইতোকারি করলেও এখন জমির মালিক হওয়ার সুবাদে সে ন্যূনতম সম্মান অর্থাৎ ‘তুমি’ সম্বোধন পায়। শরাফত এবং তার ছোট ছেলে, মুসলিম লীগের উৎসাহী কর্মী, আবদুল কাদেরের মধ্যে দিয়ে একদিকে লীগের নেতা ও পৃষ্ঠপোষকদের শ্রেণীচরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আরেক দিকে সতীশ মোক্তার-ইসমাইল হোসেন-রা ‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বা শ্যামাপ্রসাদের জিগির তুলে কীভাবে সুকৌশলে তেভাগার দাবিগুলোকে অধিকার করে নিচ্ছে – এই ব্যাপারগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠেছে।


আবদুল কাদের বলছে, “পাকিস্তানে জমিদারি সিস্টেম উচ্ছেদ করা হবে। বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ করা হবে। পাকিস্তানে নিয়ম হবে জমি তার লাঙল যার। পাকিস্তানে আমিরে গরীবে ফারাক থাকবে না। ইসলাম তো সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছে। ইসলামে কোনো কাস্ট সিস্টেম নাই। আমাদের নবী এই কথা বলে গেছেন কত আগে। কম্যুনিস্টরাই এসব ধার করেছে ইসলামের কাছ থেকে। ” অর্থাৎ ইসলামি রাষ্ট্রই সব শ্রেণীসমস্যার সমাধান।


প্রত্যুত্তরে ছোটমিয়া বলে –


“তোমাদের লীগের বড় বড় হোমরাচোমরা তো সবই জমিদার আর বড়োলোক। তাদের উচ্ছেদ করলে তোমাদের পার্টি টঁিকবে কী করে?”


কাদেরের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর থাকে না।


অথচ এ শুধুই কল্পিত কাহিনী নয়। ১৯৪৫-এর মুসলিম লীগের ইস্তেহারে এমনকি তেভাগার থেকে একধাপ এগিয়ে গিয়ে পাকিস্তান নামক বেহেস্তে কৃষককে সম্পূর্ণ ফসল অর্থাৎ চৌভাগার অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। তাজ-উল ইসলাম হাশমী লিখছেন– ‘Ghiasuddin Pathan, a prominent Muslim League leader of the district (Mymensingh) is said to have told the Muslim sharecroppers who were with the Communists that they should not waste time and energy for Tebhaga since Pakistan was in the office and they would get all lands or Choubhaga after the mass expropriation of all Hindu landlords.”


এবং এর পর আসে দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতা। বছর গড়িয়ে যায়। স্বার্থসিদ্ধি, ক্ষমতার বাঁটোয়ারা হয়ে গেলে পরে তমিজদের হাতে রাখার প্রয়োজন ফুরায়। অাখ্যানেও দেখতে পাচ্ছি শরাফত হোসেনের মেহেরবানির মেয়াদ শেষ। তমিজের বাপের বিল-দখল নেওয়ার জঙ্গি প্রচেষ্টার শাস্তি হিসেবে তমিজের বর্গা করার সাধ ঘুচে গেছে। আবার সে কামলা খাটবে এখন। এতদিনের পরিশ্রম, স্বপ্নের দাম মাটিতেই মিলিয়ে গ্যাছে তার। উপরন্তু নাম উঠেছে পুলিশের খাতায়। এমন পরিস্থিতিতে–


তমিজটা একেবারে নাছোড়বান্দা। “আপনেরা না কছিলেন জমির উপরে বর্গাদারের হর কায়েম করার আইন জারি হবি? ফুলজানের বাপেক আপনের বাপজান জমি থ্যাকা উঠায় ক্যাংকা কর্যা?”


আবদুল কাদের হো হো করে হেসে বলছে- “তোর বাপু এত কথাও মনে থাকে? … দুই বছর আগে অ্যাসেম্বলিতে জমিদারি উচ্ছেদের বিল উঠলে বর্গাদারদের সম্বন্ধে ঐ ধরনের একটা কথা ছিলো। ঐ বিল তো আবার উঠিছে, এই তো কয়দিন আগেই উঠলো। এবার বর্গাদারদের কথা বাদ দিছে।”


– “বাদ দিছে” ? তমিজের হাত থেকে মিহি করে সার মেশানো মাটি পড়ে যায় ঘাসের ওপর। এক আইন আবার দুইবার দুইরকম হয় কী করে? হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না – ভদ্দরলোকদের এই বচন কি ভদ্দরলোকরাই খারিজ করে দিচ্ছে !


এহেন বিশ্বাসভঙ্গে তমিজে চুপসে যায়। তবু আশার তলানিটুকু নিংড়ে জানতে চাইছে- “তেভাগা হলেও কাম হয়। তেভাগা তো হচ্ছেই, না? ….. জয়পুরেত তো যখন ধান কাটিচ্ছিলাম তখনি তো ওটি জোতদাররা সব দৌড়াচ্ছিলো পাছার কাপড় তুল্যা।”


– “এ কথা সে কথা, দে বুড়ি আলাপাতা”। কাদের তমিজের একটি ব্যাপারেই লেগে থাকা নিয়ে হাসে। “তোর খালি এক কথা। উগলান তো সব শ্যাষ হয়ে গেছে বাপু। নাচোলের দিকে এখনো মাথা গরম কিছু চ্যাংড়া–।”


তমিজের সরল বিশ্বাস দেখে আবদুল কাদের দাঁত বের করে হাসে। তার ভেতর যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিল তেভাগা, সেই সব সাধ ব্যর্থ হয়ে গ্যাছে, এটা জেনে কী অবিশ্বাস্য ট্রাজেডি আছড়ে পড়ছে তমিজের বুকে, আবদুল কাদের তার লেশমাত্র টের পায়না। এবং এই চরম বেইমানির আঘাতের ফলেই যখন আমরা শেষবারের মতো তমিজকে দেখছি, একটা স্থির সংকল্প দেখতে পাচ্ছি তার আচরণে। সে যাচ্ছিলো ঢাকা শহর, পুলিশি মামলা থেকে বাঁচতে, কয়েকদিনের নিরাপদ আশ্রয়ে গা-ঢাকা দিতে। ঢাকার ট্রেনে উঠে পড়েছে। এমন সময়ে ভারি গোলমাল। পাশের লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে শান্তাহারের ট্রেন। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ স্টেশন।


-তমিজ জিগ্যেস করে “ঐ গাড়ি কুটি যাবি ?”


-“শান্তাহার”।


-“শান্তাহার। শান্তাহারের গাড়ি! শান্তাহারের গাড়ির ইঞ্জিনের হুশহুশ ধ্বনি বলতে থাকে, ‘শান্তাহার’! ঐ গাড়ির ইঞ্জিনের ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে লিখে দেয়, ‘শান্তাহার’! অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও তমিজ এই লেখাটাই জীবনে প্রথম পড়তে পারে। শান্তাহার যাওয়া মানে সেখান থেকে যাও জয়পুর, যাও আক্কেলপুর, যাও হিলি। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, আবার অন্য লাইন ধরে নাটোর কিংবা নবাবগঞ্জ। এত পুলিশ যাচ্ছে, মানে চাষারা দুই ভাগ ফসল তুলছে নিজেদের গোলায়, জোতদারদের গোয়ার কাপড় খুলে গেছে, শালারা দৌড় দিচ্ছে, লুকাচ্ছে পুলিশের গোয়ার মধ্যে। আবার এর মধ্যেই আমনের জন্যে একদিকে চলছে জমি তৈরি, পাট কেটে সেই জমিতে একটা দুইটা তিনটা লাঙল চাষ দেওয়া হলো, এখন বীজতলায় কলাপাতা রঙের ধানের চারা বিছানো। জমি তৈরি হলে সেখান থেকে চারা এনে ধান রোপার ধুম পড়ে যাবে। আহা, কাল সারা রাত বৃষ্টি হলো, জমি হয়ে আছে মাখনের মতো, লাঙল ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতে ঢুকে যাচ্ছে দুনিয়ার অনেক ভেতরে, তমিজ সেখান থেকে পানি পর্যন্ত টেনে আনতে পারে। শান্তাহারের গাড়ির ধোঁয়ায় আসমানে এখন আবার লেখা হয় ধানজমির ছবি। কী জমি গো! ধানচারা রুইতে না রুইতে ধানের শীষ বড়ো হয়, ধানের শীষ দুধের ভারে নুয়ে পড়ে নিচের দিকে। মোটা মোটা গোছার ধান কাটতে নেমে গেছে কত কত মানুষ তার লেখাজোকা নাই। জোতদাররা এসেছে পুলিশ নিয়ে। রেলগাড়ি ভরা পুলিশ স্টেশনে স্টেশনে নেমে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। তারা সব কলেরার মতো নামে, গুটিবসন্তের মতো নামে। চাষারা তাদের তাড়া করেছে কাস্তে নিয়ে, শালারা ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাবার আর পথ পাচ্ছে না।”


সেই আমন ক্ষেতে শুয়ে বাবলাডাল ছুঁড়ে জোতদার মারার দিবাস্বপ্ন-দ্যাখা তমিজকে ফিরে পাচ্ছি আমরা। এই তার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। এরপর সে সত্যি সত্যিই মিলিয়ে যাবে জনসমুদ্রে। স্ত্রী-কন্যা-সংসার-পুলিশের-খাতায়-নামের তোয়াক্কা না করে ‌ তমিজ চলে যাচ্ছে শান্তাহার। আর ফিরবে কি? এখন তো আর ফেরার জো নাই! ফিরে কাজ নাই!


বানেতে ভাসিল ধান না ভাঙিও মন ।
পঁেয়াজরসুনে হইবে দ্বিগুণ ফলন ।।
(চেরাগ আলীর শোলোক, খোয়াবনামা)


শেষ দৃশ্যে তমিজের গুলিবঁেধা দেহ পূর্ণিমার গোলালো চাঁদের গায়ে রক্তের ছোপ ফেলে মিশে যাচ্ছে আবহমান কালের লোককথার শরীরে। ভবানী পাঠকদের পাশে কোথাও জায়গা করে নিচ্ছে তেভাগার শহীদ। ফুলজানের আঁচল টেনে তার একরত্তি মেয়ে অভুক্ত রুখা গলায় একটানা জিগির তুলছে ‘মা বাড়িত চল … ভাত খামো। ভাত রান্ধিচ্ছে, মা ভাত খামো’। জখম চাঁদের নিচে অসংখ্য জোনাকি পোড়ে, জোনাকির মিলিত আগুনে দাউ দাউ জ্বলছে ফুলজানের হঁেসেল। এ দৃশ্য কি স্বপ্নের, না বাস্তবের? এ প্রশ্নের কী দরকার পড়ে আর? এমন দৃশ্যে বাংলার কৃষকের ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যত সমস্তটা একাকার হয়ে যায়, রংপুর-নাচোল-কাকদ্বীপ-এর মানুষের ঐতিহাসিক বিদ্রোহে মিশে যায় কল্পিত অাখ্যানের আধিয়ার-কামলাদের ফসলের অধিকারের লড়াই। এর চেয়েও আরো বেশি কিছু হয়- স্থান ও কালের ব্যবধান মুছে যায়। সীমাহীন কাল সীমাহীন স্থান জুড়ে, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ভবানী পাঠক-মজনু শাহ থেকে শুরু করে চেরাগ আলি ফকির, তমিজ, তমিজের বাপ, ফুলজান, কুলসুম, হুরুমতুল্লা, কেরামত আলি, দুধের শিশু সখিনাও সামিল হয় একটাই স্রোতে, তারই সাথে সামিল হয় আগামীর যত নিরন্ন মানুষও। যাদের সবার চোখে ধানের খোয়াব, হঁেসেলে আঁচ-নেভা উনুন, পেটে ভুখ, নাকে ভাতের গন্ধ। মাটি আঁকড়ে লড়াই করে বাঁচাই যাদের একমাত্র অপরিবর্তনশীল বাস্তব। যতদূর ইতিহাসের দৃষ্টি যায়, এই বিশাল মিছিলের কোনো শুরু অথবা শেষ থাকেনা। শেষ থাকেনা তমিজের মাথা তোলপাড় করা কুলসুমের সেই সাদামাটা প্রশ্নটারও- ‘ক্যা গো, মানষের জমির ধান কাটো, তোমার লিজের ধান তুলবা কুনদিন’ ?


আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির-আকাশে
কারা যেন আজো ভাত রাঁধে
ভাত বাড়ে, ভাত খায়।
আর আমরা সারারাত জেগে থাকি
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে,
প্রার্থনায়, সারারাত।
(‘আশ্চর্য ভাতের গন্ধ’, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়)


সূত্র ঃ
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, খোয়াবনামা। প্রকাশক – নয়া উদ্যোগ। প্রথম প্রকাশ – এপ্রিল ১৯৯৬। মূল্য – ১৫০ টাকা।
শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, ‘History’s Creative Counterpart – Partition in Akhtaruzzaman Elias’ Khowabnama’, যশোধরা বাগচী ও শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত The Trauma and The Triumph, প্রকাশক – স্ত্রী, জানুয়ারী ২০০৬।

Leave a comment