বা ঙা ল না মা

তেভাগা আন্দোলনের অ-লিখিত ইতিহাস

Posted by bangalnama on June 1, 2010


– লিখেছেন শঙ্কর রায়


তিরিশ চল্লিশের বাংলা – অবনী লাহিড়ী, সেরিবান, জানুয়ারী ১৯৯৯, ১৭৭ +২ পৃষ্ঠা, মূল্য ৬০ টাকা


“কে কোথায় যে সব ছিটকে গেল! আমাদের সামনের সারির কর্মী দিনাজপুরের স্পষ্টরাম অনশনে মারা গেলেন। তাঁর স্ত্রী জয়মনি – কমবয়সী মেয়েদের সংগঠিত করার কাজে যাঁকে আমরা পুরোভাগে দেখেছি। তিনি কোথায় গেলেন কেউ জানে না। শুনলাম নাকি দিনাজপুরের সীমানা পেরিয়ে ইসলামপুর না বিহারের কিষানগঞ্জ অঞ্চলে চলে গেছেন। ভবেন, কৃষক কর্মীদের উজ্জ্বলতমদের একজন – যিনি প্রথম ঠুমনিয়ায় গুলি চলার পরে কিছু যুবক কৃষককর্মীদের নিয়ে আমাদের পার্টিকেন্দ্রে এসে বলেছিলেন- আমাদের অস্ত্র দাও। আমরা লড়ব- সেই ভবেনের কোন খোঁজ আর পাওয়া গেলনা। এইরকম অনেক কর্মীদের একটার পর একটা পরিবার একস্থান থেকে আরেক স্থানে চলে যেতে লাগলেন…” স্মৃতিভারাক্রান্ত অবনী লাহিড়ী বলছিলেন রণজিত দাশগুপ্তকে । যখন তেভাগা আন্দোনন তুঙ্গে, ১৯৪০ দশকের শেষদিকে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গণ সংগঠন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার সম্পাদক বক্তা । শ্রোতা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতা ও বিশ্লেষক। আজ দুজনেই প্রয়াত। ঐ দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েই তিরিশ চল্লিশের বাংলা, তেভাগা আন্দোলনের বিরল ইতিহাস-বর্ণন। ইতিহাস রচনা- বিজ্ঞান( হিস্টোরিয়োগ্রাফি)এ মৌখিক পদ্ধতি প্রয়োগের এ এক অতি-বিরল দৃষ্টান্ত। রণজিতবাবু নিজে দেখে যেতে পারেন নি এই কাজ, তাঁর অনেক অসামান্য ও প্রতিভাদীপ্ত কাজের শেষটি যা পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাস-গবেষকদের কাছে অনুসরণযোগ্য । তিনি নিজেই ছিলেন এক বিরল প্রকৃতির বর্ণময় চরিত্র। আর যাঁর সাক্ষাতকার নিয়েছেন, তিনি সেই সময়কার কৃষক ও ভূমি সংস্কার আন্দোলনের এক চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া।


তেভাগা আন্দোলন্রে যে সব নির্ভীক কর্মী দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে পুলিশের বুলেট ও জোতদারদের সশস্ত্র লেঠেলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, দিনাজপুরে তাঁদেরই প্রথম সারির কর্মী জয়মনি সিং। যেমন উঠে এসেছিলেন দিনাজপুর জেলারই কম্পরাম সিং, অভরণ সিং, কালা বর্মণ, পদ্মলাল, ডোমারাম, কৃষ্ণদাস মোহান্ত, খবির শেখ প্রভৃতি। সবাই কৃষক পরিবার থেকে। জয়মনির মত মনে আসে মানুষ দশরথ লালের কথা, যাঁকে নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রায়শ আক্ষেপ করতেন। “ট্রামশ্রমিক দশরথ লাল আইপিটিএ যোগ দিয়ে হয়ে উঠলেন তখনকার ভারতে শ্রেষ্ঠ ড্রাম-বাদক। আই পি টি এ-র স্রস্টা ১৯৩৫-৪৭ সি পি আই-এর সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশীর প্রেরণায় এ সম্ভব হয়েছিল রণদিভে পিরিয়ডের পরে সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের অনুগত এক পেশীবলীয়ানের মাংসের দোকানে দশরথ লাল মাংস কেটে গ্রাচ্ছাদন করতেন”, হেমাঙ্গদা সখেদে বলতেন।“যাবতীয় বিচ্যুতির দায়ভাগ তো শুধু রণদিভের ছিল না, পার্টি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডঃ (গঙ্গাধর) অধিকারী,ছিলেন কৃষ্ণান,ছিলেন ভবানী সেন, সোমনাথ লাহিড়ী (এঁরা সবাই তখন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য), নৃপেন চক্রবর্তীরা (পৃ ১২৫)। ঠিকই বলেছিলেন, রণদিভের প্রায় সমস্ত অকাজে মদদ যুগিয়েছিলেন ভবানী সেন ও ডঃ অধিকারী।


জলপাইগুড়িতে বড় হয়ে ওঠা রণজিত দাশগুপ্ত ১৯৪০ দশকের শেষ দিকে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)তে যোগ দেন। তার আগে সিপিআই-এর গণসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের অগ্রণী কর্মী হিশেবে কলকাতার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সুপরিচিত। পরে অধ্যাপনা করেন একাধিক কলেজে; সেন্টার ফর দি স্টাডি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস, ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অফ ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিষ্ঠা ও কৃতিত্বের সাথে অধ্যাপনা- গবেষণা চালিয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে পার্টির কাজে সারাক্ষণ নিয়োজিত দেখেছেন, নতুন অভিজ্ঞতা আহরণ করেছেন, গবেষণা ও পার্টি/ গণ-সংগঠনের কাজে প্রয়োগ করতে প্রয়াসী হয়েছেন । এ সমস্তের মধ্যেই তাঁর দুর্বার অন্বেষা তাঁকে ঠেলে নিয়ে গেছে ওই মৌখিক ইতিহাস-প্রণয়নের কাজে। তিরিশ চল্লিশের বাংলা’র ছত্রে ছত্রে সেই অন্বেষার প্রতিভাস। তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস, দর্শন ও পার্টি- গণ সংগঠনের দ্বান্দ্বিক সমপর্ক এবং কৃষক আন্দোলনের সামাজিক- নৃতাত্বিক দিকগুলির বিচিত্র প্রক্ষেপণ এই গ্রন্থটিকে বিশিষ্ট মাত্রা দিয়েছে। রণজিতবাবুর অকস্মাৎ দুরারোগ্য মেনিঞ্জাইটিস রোগে জীবনাবসানে শোকাভিভূত অবনীবাবু প্রায় এক বছর ধরে খেপে খেপে-নেওয়া সাক্ষাতকার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন –“আগে কেউ আমায় এসব প্রশ্ন করে নাই। অসংখ্য প্রশ্নের তীক্ষ্ণ ফলকে বিস্মৃতির পর্দা ছিন্ন হয়েছে বারে বারে। যা বলবো না ভেবেছিলাম, রণজিত তাই টেনে বের করল। পরে বুঝলাম মুখের কথার ইতিহাস এমন করেই লেখা হয় ।… রণজিতের মত একাগ্রচিত্ত প্রশ্নকর্তা না হলে সত্যিই এ বই কোনদিনই আলোর মুখ দেখতো না (সত্তায় ও স্মৃতিতে রণজিত দাশগুপ্ত সেরিবান, ২০০২, পৃ ১৭৮-৭৯)। স্নেহসিক্ত, আবেগাপ্লুত প্রতিভাত হ’লেও এই উক্তি অতিরঞ্জনের কলুষ-মুক্ত।


তেভাগা আন্দোলন নিয়ে দেশে-বিদেশে বাংলা, ইংরিজী ও অন্যান্য ভাষায় অনেক বই ও গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তার অনেক গুলিই উচ্চ মানের। সুনীল সেনের Agrarian Struggle in Bengal (1946-47), অড্রিয়েন কুপারের Share-cropping and Share-croppers’ struggle in Bengal (1930-50), পার্থ চট্টোপাধ্যারের The Land Question and Present History of West Bengal, রণজিত দাশগিপ্তের Economy, Society and Politics :Jalpaiguri 1869-1947, সুগত বসুর Peasant Labour and Colonial Capital : Rural Bengal Since 1770 , ডি পি ধাঙ্গারের Peasant Protest and Politics- the Tebhaga Movement in Bengal গবেষণাপত্র (Journal of Peasant Studiesএ প্রকাশিত) মহাশ্বেতা দেবী ও মৈত্রেয় ঘটক সম্পাদিত ‘বর্তিকা’ পত্রিকার কাকদ্বীপ তেভাগা, দিবারাত্রির কাব্য সাময়িকীর তেভাগা আন্দোলন ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সংখ্যা, সূর্য্যাপুর বার্তা, ধৃতি এবং আরো কিছু পত্রিকা। অবনীবাবুও এই গ্রন্থ ও পত্রিকাগুলিকে ‘মূল্যবান প্রকাশনা’ মনে করতেন।‘বর্তিকা’র বিশেষ সংখ্যা দুটি অসাধারন কাজ এবং তার ৭০ শতাংশ কৃতিত্ব প্রয়াত মৈত্রেয়- র। তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুদিন কাজ করে দেখেছি অবিশ্বাস্য কৌতূহলী মননের অবিশ্রান্ত এক বিরল চরিত্র।


তথাচ তিরিশ চল্লিশের বাংলা যেন এ সবের থেকে আলাদা, আর এজন্যে মূল কৃতিত্ব রণজিত দাশগুপ্তের।কারণ গোটা পরিকল্পনাটাই তাঁর। প্রশ্নমালার মধ্যেই পাওয়া যায় এক তন্নিষ্ঠ গবেষক যিনি নিজেকে প্রধানত একজন সমাজ পরিবর্তন-কামী কর্মী মনে করতেন। আর এই ভাবনা মার্ক্সীয় মননে চর্চিত হ’ত তাঁর লেখায়, বাচনে। প্রায় ১৪০ জন শহীদ হয়েছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে এঁদের অর্ধেকের বেশী স্বাধীনতা লাভের আগে শহীদত্ব বরণ করেন। পাঁচ হাজারেরও বেশী কৃষক ও কৃষক-কর্মী গ্রেপ্তার হন। অবিভক্ত বাংলার সিপি আই-এর রাজ্য সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য খোকা রায়ের (পরে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও তারও পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা) মতে ৬০ লক্ষ কৃষক ও ভাগচাষী তেভাগা আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।


শুধূ দিনাজপুরেই ১৯৪৭ এ ৩১ জন কৃষক জোতদার-পুলিশ আক্রমনে প্রাণ দিয়েছিলেন। জানুয়ারী মাসের ৪ তারিখে চিরির বন্দরে কৃষক-কর্মী শিবরাম ও সমিরুদ্দিন ও খাঁপুরে ২০ ফেব্রুয়ারী ২২ জন কৃষক নিহত হন। উনিশশো ছেচল্লিশের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া তেভাগা আন্দোলনে এক দিনে এতজন শহীদ হন নি আর কোথাও। অবনীবাবু তার অল্প কথায় খাঁপুরে প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছেন- “ ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় জোতদারের একজন ছিল অসিত সিংহ রায়- তার সিংহবাহিনীর কাছারিটা ছিল খাঁপুরে। সেইখানেও তেভাগা আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে পৌঁছয়। কাছারির আশেপাশের ভাগচাষী ছাড়াও সিংহরায়দুয়ারের দূরের জমির ভাগচাশীরা ধান কেটে কাছারির খোলানে নিয়ে এল না। নিজেদের বাড়িতেই খোলান বানালো। এই রকম সময়ে সংঘর্ষ বাঁধল-ওদের সাথে। আশেপাশের কৃষকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যে সিংহ রায়রা কৃষকদের ৮/৯টা গরু মাঠ থেকে ধরে এনে বরকন্দাজদের খোঁয়াড়ে পাঠিয়ে দিল। খবরটা ততখনাত কৃষকদের কাছে পৌঁছে গেল- কারণ ঐ অঞ্চলের কৃষক নেতা চিয়ার কাই শেখ ছিলেন সিংহবাহিনীর একজন পেয়াদা। দেখতে দেখতে কৃষকদের দল জড়ো হয়ে রাস্তার মাঝখানে গরুগুলো বরকন্দাজদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। কাছারির তরফ থেকে থানায় এজাহার দায়ের করা হ’ল যে কৃষকরা মারপিট করে গরু ছিনিয়ে নিয়েছে আর কাছারি লুঠ করেছে। সেদিন সেষ রাত্রে দু’লরি বোঝাই সশস্ত্র পুলিশ বালুরঘাট থেকে এসে খাঁপুরের এলাকা ঘেরাও করল। ফলে যে সংঘর্ষ হল সশস্ত্র পুলিশের সাথে তাতে চিয়ার কাই শেখ সহ ২২ জন নিহত হল” (পৃ ৯২)।


চিয়ার কাই শেখ কেমন করে পেয়াদার কাজ ছেড়ে ভাগচাষিদের পাশে দাঁড়ালেন, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যে সময় একজন পেয়াদার ক্ষমতা সাধারণ গরীব মধ্যবিত্ত/কৃষিজীবির কাছে ত্রাস-সঞ্চারী ছিল? অবনীবাবুর ব্যাখ্যা সহজ, আন্তরিক অথচ বাস্তবিক – “যুগ যুগ ধরে শোষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার যে ক্রোধ, যে সংগ্রামী চেতনা তা অনেকের মধ্যে প্রকাশ পায়, সমবেত হবার প্রবণতা আসে। তখন সেও তার সাথে একাত্ন হয়ে যায়” (পৃ ৮৯)। সিঙ্গুরে নন্দীগ্রামে এর প্রতিভাস প্রতীকিত হয়েছিল। (পরিতাপকর হলেও সত্য, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে শোষিতদের প্রতিনিধিরা শোষকের অবস্থান নিয়েছিল। ভাগচাষী, ছোট ও মাঝারি কৃষকদের স্বার্থ অভিন্ন হয়ে পড়েছিল)। ঐ ম্যারাথন সাক্ষাতকারে বার বার দিনাজপুর ও উত্তরবঙ্গকে এনেছেন। দার্জিলিং বাদে সব জেলাতেই (অবিভক্ত বাংলার মোট ১৯টি জেলায় তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল) ব্যাপ্ত হয়েছিল। ব্যাপকতা সর্বাধিক ছিল দিনাজপুরেই। সংগ্রামী চেতনা সঞ্জাত হয়েছিল ভিতর থেকে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে, কেতাবী শ্রেনী সংগ্রামের বুকনি দিয়ে নয়। অবনীবাবু বলেছেন-“১৯৪৭ সালে দিনাজপুরের ৩৭০০ পার্টি সদস্যের মধ্যে শতকরা ৯৮ জন ছিল নিরক্ষর”(পৃ ৯৭)।


দিনাজপুরের ১৯৩৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কালী সরকার (অন্যেরা সুশীল সেন ও বিভূতি গুহ- ঐ তিনজনেই প্রথম সিপিআই জেলা সাংগঠনিক কমিটির সদস্য ) রাজশাহী জেলে বসে খাঁপুরের লড়াই নিয়ে গান লেখেন মহরমের সুরে- “খাঁপুর যুদ্ধের কথা করিব বর্ণন/১৩৫৩ সাল মাঘের শেষে/তেভাগার রণে কৃষক কুদ্দিল সাহসে।/ভালকা বাঁশের ধনুক নিল হস্তেতে তুলিয়া/চোখা চোখা তীর নিল পৃষ্ঠেতে বাঁধিয়া।/…… ছুটিল চিয়ারসাই হস্তে মোটা লাঠি/জোয়ান মর্দ বাপের বেটা ৩৮ ইঞ্চি ছাতি”।অবনীবাবু জানিয়েছেন, নিম্ন মধ্যবিত্ত কালী সরকার ‘ম্যাট্রিক পাশ করার পর পড়াশুনা করতে পারেনি সন্ত্রাসবাদে যুক্ত হয়ে দীর্ঘ কারাবাসের পর মার্ক্সবাদ গ্রহণ করেন (পৃ ৬৮)।


সকলের জানা আছে, তেভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল কৃষকসভার মৌভোগ সম্মেলনের(মে,১৯৪৬) পরে সেপ্টেম্বরে কৃষক সভার প্রাদেশিক কাউন্সিল সভায়। কিন্তু আন্দোলনের মেজাজ গড়ে উঠছিল তার আগে থেকেই, ১৯৪০ সালে ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পরেই, কারণ বর্গাদারের আইনী স্বীকৃতি এবং রায়তী স্বত্ব দেবার কথা সেখানেই বলা হয়েছিল এবং স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউড নিজেই এর পক্ষে ছিলেন।


তেভাগা নিয়ে প্রায় ৫০টি গবেষণা গ্রন্থ, সংকলন, পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের কথা, দিনাজপুর যেন উপেক্ষিত, বিশেষ করে সুশীল সেন, যিনি কমিউনিস্ট পার্টির জেলার প্রধান হিশেবে কৃষক সভার কাজে ঐ সময় যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা প্রায় অনুল্লেখিত, যদিও আলোচ্য গ্রন্থ তার ব্যতিক্রম। এজন্যে অবনী লাহিড়ী নিশ্চয়ই ধন্যবাদার্হ। কিন্তু মহাশ্বেতা দেবী ও মৈত্রেয় ঘটক সুশীলবাবুকে উপেক্ষাই করেছেন। তাঁর সাক্ষাতকার নেই ‘বর্তিকা’র কোন সংখ্যাতেই নয় । জলপাইগুড়ির কমিউনিস্ট নেতা মাধব দত্তের ২৮-পৃষ্ঠা সাক্ষাৎকার, কিন্তু সুশীল সেন বাদ, রাণী দাশগুপ্ত, ইলা মিত্র অবহেলিত কেন? এমনকি মনিকুন্তলা সেনও বাদ। মাধব বাবু ডাঃ শচীন দাশগুপ্ত ও গুরুদাস রায়ের সঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের বুনিয়াদ তৈরি করেন। তারপরে আসেন নরেশ চক্রবর্তী। মাধব দত্তই চারু মজুমদারকে সিপিআইতে এনেছিলেন। চারুবাবুর তীক্ষ্ণ মেধা তাঁর নজর কেড়েছিল। কিন্তু চারু বাবু তেভাগার কোন স্তরেই নেতা ছিলেন না, তবে খুবই ভালো কর্মী ছিলেন। তিনি বোদা, পচাগঞ্জ ও দেবীপুরে কৃষকদের মধ্যে কাজ করতেন। সুনামও অর্জন করেছিলেন। জলপাইগুড়ির গয়াবাড়ি খেলানে ছ’জন ভাগ চাষী জোতদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে শহীদ হয়েছিলেন। রংপুর ও দিনাজপুর জেলার সীমান্তে জলপাইগুড়ি সদর থেকে ৩০ মাইল দূরে বোদা। ওই দুই জেলাতেই কৃষক আন্দোলন দানা বাঁধছিল। তেভাগা আন্দোলন সে কারণে জোরদার হয়েছিল (রণজিত দাশগুপ্তঃ কৃষক ও রাজনীতি ১৯৩৮-৪০,পরিচয় ১৩৯০)। জলপাইগুড়িতে চা-বাগিচা শ্রমিকেরা তেভাগার কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, শালবাড়ি মঙ্গলবাড়ি হাটের কাছে ১৩ জন শ্রমিক তেভাগা আন্দোলনের সময় বা তার আগে শহীদ হয়ে কৃষকদের প্রতি সক্রিয় সহমর্মিতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সেই চা বাগিচা শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেবপ্রসাদ ঘোষ ও পরিমল মিত্র। সিদ্ধেশ্বর সেনের কবিতাংশ মনে পড়ে – ‘ধান চমকানো মাঠে/ কাস্তে শানাও কে?/লোহা ঝলসানো আঁচে/হাতুড়ী হাঁকাও কে?’


কাকদ্বীপের কিংবদন্তীপ্রতিম অশোক বসুকে পাঠক-গবেষকদের সামনে তুলে ধরে মহাশ্বেতা দেবী ও মৈত্রেয় ঘটক আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। কংসারী হালদার, প্রভাস রায়, ডাঃ পূর্ণেন্দু ঘোষ (তেভাগার সংগ্রামী কৃষকদের রাঙা ডাক্তার) প্রভৃতির সাক্ষাতকার, কংসারী হালদার বনাম ভারত সরকার মামলার যাবতীয় তথ্য, অশোক বোসের দলিল (নিকুঞ্জ ছদ্মনামে) ইত্যাদি এক জায়গায় এনে দারুণ প্রশংসাযোগ্য কাজ করেছেন। বর্তিকা পড়তে পড়তে মনে হ’ত, যেদিন থেকে অবিভক্ত সিপিআই-এর বর্ধমান গোষ্ঠী কৃষক সভার নেতৃত্বে এলেন আর অশোক বোস (যার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হয়েছিল এবং ধরা পড়লে হয়ত ফাঁসি হয়ে যেত, যেজন্যে তিনি প্রকাশ রায় নামে কাজ করতেন মধ্য প্রদেশের (এখন ছত্তিশগড়) আত্মগোপন করে রাজনন্দগাঁওএ চলে গেলেন, কৃষক আন্দোলনে ভূমিহীন খেতমজুর/ ভাগচাষীদের গুরুত্ব কমে এল। অশোক বোস বাকি জীবন সি পি আই ও এ আই টি ইউ সি-তে কাজ করেছেন, প্রকাশ রায় নামে। সি পি আই-এর জাতীয় পরিষদ সদস্যও ছিলেন, নির্বাচনেও একাধিকবার লড়েছেন। অশোক বোস-এর চলে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছেন অবনীবাবু। ইতিহাস বড় বিচিত্র, অশোক বোস অর্থাৎ প্রকাশ রায় ১৯৭৮ সালে পাঞ্জাবের ভাতিন্ডায় সিপিআই এর ১০ম কংগ্রেসে অজয় দাশগুপ্তের সঙ্গে যৌথ ভাবে খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবের (যাতে ১৯৭৫-৭৭ এর জরূরী অবস্থা সমর্থন ভুল হয়েছিল, এই মর্মে স্বীকারোক্তি ছিল) বিরোধিতা করেছিলেন। বিষয়গতভাবে ডাঙ্গে লাইনের পক্ষে ছিলেন। তাই বলে নিম্নবর্গীয়দের ইতিহাসে কাকদ্বীপের নিকুঞ্জ ( আরেকটি গোপন নাম ছিল বিদ্যুত) মলিন হয়ে যান নি, বর্তিকা-য় এই সত্য উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাসিত। ঠিক তেমনই নিম্নবর্গীয়দের ইতিহাসে ভাস্বর চন্দনপিঁড়ি-বুধাখালি এব ং সেই সঙ্গে শহীদ গৃহবধু অহল্যা, গজেন মালী প্রভৃতি বিপ্লবী দৃঢতায় উদ্ভাসিত চরিত্র (অনিবার্যভাবে ম নে পড়ে যায় রাম বসুর গজেন মালীকে নিয়ে অবিস্মরণীয় ক বিতার পঙক্তি- ‘পীর গাজিদের গান থেকে এলে গজেন মালী/তোমার নামেই বনবন্ধনে চেরাগ জ্বালি’)।

১৯৭৫-এ কংসারি হালদারকে লেখা প্রকাশ রায় (অশোক বসু)-র চিঠি।


কিন্তু রণদিভে পর্য্যায়ের শেষ দিক থেকেই কংসারী হালদার, সুশীল সেন প্রভৃতি উপেক্ষিত হ’তে থাকলেন। উঠে এলো বর্ধমান গোষ্ঠী। বর্ধমানের কৃষক নেতারা জেনে-বুঝেই তেভাগা সংগ্রাম থেকে দূরে ছিলেন, অবনীবাবুও কবুল করেছেন (পৃ ১৮)। বর্ধমানে কৃষক নেতারা ভাগ চাষিদের চেয়ে রায়ত চাষিদের উপর নজর দিতেন। বিখ্যাত ক্যানাল কর-বিরোধী আন্দোলন (যার মধ্যে থেকে উঠে এসেছিলেন হরেকৃষ্ণ কোনার, বিনয় চৌধুরী, অশ্বিনী রায়, ফকির রায় প্রভৃতি কৃষক নেতারা) রায়ত চাষিদের সমস্যা-কেন্দ্রিক ছিল, ভূমিহীন ক্ষেতমজদূর বা ভাগচাষিদের সমস্যা নয়। কিন্তু রণদিভে-পর্বের পরে যখন সি পি আই, এ আই টি ইউ সি, কৃষক সভা ছত্রভঙ্গ, তখন কৃষক সভা পুনর্সংগঠনে অবণী বাবুকে বর্ধমানের হরেকৃষ্ণ কোনার ও সুবোধ চৌধুরীর সঙ্গেও আলোচনা করে কৃষক আন্দোলনের সমস্যা ও আশূ কর্তব্য দলিল তৈরি করতে হয়েছিল।(পৃ ১২৭-২৮)। প্রভাস রায়, ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য, রাসবিহারী ঘোষ, ভূপাল পান্ডা, দেবেন দাস প্রভৃতি তেভাগার নেতারাও ছিলেন যদিও। কিন্তূ নেতৃত্বে এলেন হরেকৃষ্ণ কোনার এবং পরে বিশ্বনাথ মুখার্জি, যিনি তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।


এই প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য পেশ করছি। সম্ভবত একথা কোথাও লেখা হয় নি। সেটা হ’ল ফুলবাড়ী-দিনাজপুর আসন থেকে সিপি আই প্রার্থী রূপ নারায়ন রায়ের কংগ্রেস প্রার্থী ভবেশ রায়কে ৩৬,০০০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ। অবনীবাবু, সুশীলবাবু , বিভূতি গুহ ও কালী সরকার আলোচনা করে ঠিক করলেন দুই-আসন বিশিষ্ট আসনে অন্য প্রার্থী গুরুদাস তালুকদারকে প্রত্যাহার করে নিলেন। কারণ কংগ্রেসের হয়ে প্রচারে এসেছিলেন জওহরলাল নেহেরূ। সে সময়কার ছাত্র ফেডারেশনের জেলা সম্পাদক কেশব সেন (সুশীল সেনের শ্যালক; পূর্ব পাকিস্তানে জেল খেটেছিলেন) এই লেখককে বলেছেন, “এক জন প্রার্থী দিয়ে জয় সুনিশ্চিত করার আইডিয়াটা সুশীলদারই। ত বে অবনী লাহিড়ীর সম্মতি তো ছিলই। সেবার সারা ভারতে মোট ৮ টি আসনে সি পি আই জিতেছিল। আর ৭ টা ছিল ইলেক্টোরাল কলেজ সীট। এটি ছিল জেনারেল সীট। বিপুল ভোটে জয়লাভ পার্টী ও কৃষক সভার কর্মীদের প্রবল প্রেরণা যুগিয়েছিল।“ অতীতের কথা বলতে তীব্র অনীহ কেশব বাবু পরবর্তী জীবনে পার্টী ও তার গণ সংগঠন থেকে সরে এসেছিলেন। ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরে কৃতী অফিসার হিসেবে ছাপ রেখেছেন। কে সি সেনকে সবাই এক ডাকে চেনেন বা চিনতেন।


তেভাগা আন্দোলন নিয়ে প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হয় নি। তিরিশ চল্লিশের বাংলায় আত্ম-সমালোচনায় তা ফুটে উঠেছে অবনীবাবুর সুলিখিত ও সুচিন্তিত ভূমিকায়। কৃষক সভা বোধ হয় এই কাজটা করেন নি। যদি তাই হয়, এই বিচ্যুতি ক্ষমার অযোগ্য। নতুন ধরণের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ( জাতীয় বা জন উভয় ক্ষেত্রেই) চালিকাশক্তি শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী। এখানে কৃষক বলতে লেনিন বলেছিলেন ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিকের কথা, যাদের তিনি সংজ্ঞায়িত করেছিলেন গ্রামীন বা আধা-সর্বহারা। কৃষক সভার নেতৃত্বে যাঁরা এলেন পশ্চিম বঙ্গে, বোধ হয় তাঁদের শ্রেণীগত পিছুটান রয়ে গিয়েছিল। [ আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও বলা দরকার যে সিপিআই(এম) ১৯৮২ সালে কৃষক সভা থেকে খেতমজুরদের আলাদা গণ সংগঠন অল ইন্ডিয়া এগ্রিকালচারাল লেবার ইউনিয়ন (এ আই এ এল ইউ) গড়ে তুললেও পশ্চিম বঙ্গে এ আই এ এল ইউর রাজ্য শাখা গড়া হয় নি, যদিও ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিকের সংখা প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে। ম্যাড্রাস ইন্সটিট্যুটের প্রাক্তন ফেলো অর্থশাস্ত্রবিদ ডঃ সরজিত মজুমদার হিসেব করে দেখিয়েছেন যে এ রাজ্যে ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ছাপিয়ে গেছে। এই কঠিন ও বাস্তব প্রেক্ষাপটে তেভাগা সংগ্রামের মূল্যায়ন-এর কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়া কৃষক আন্দোলনের প্রতি দায়ব্দধতা থেকে বিচ্যুতির লক্ষণ।] অবনীবাবু বলেছেন যে দরিদ্র মুসলমান কৃষক ও ক্ষেত মজুরদের একটা বড় অংশ কেন দেরীতে এল ও সশস্ত্র আক্রমনের মুখে বিছিন্ন হয়ে গেল, এই প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেল। অথচ সেই সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আঁচ লাগে নি তেভাগা আন্দোলনে। পরন্তু, তরুণ কৃষক কমরেড আওয়াজ তুলেছিলেন – “ দাড়ি টিকি ভাই ভাই/লড়াইয়ের ময়দানে জাতিভেদ নাই (তেভাগা রজত জয়ন্তী সংকলনে মণিকৃষ্ণ সেনের লেখা থেকে জেনেছি)। অবনীবাবুর মতে, তেভাগার প্রতি ভ্রাতৃত্বমূলক সহানুভূতিঅ অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ তেলেঙ্গানার মত তেভাগা “কোন জাতীয় চেতনার সঙ্গে যুক্ত ছিল না” , যদিও এ আন্দোলন ছিল ‘ জোতদার-জমিদারদের বিরুদ্ধে ভাগচাষী ও গরীব কৃষকের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ”।


কিন্তু কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায়। ফ্লাউড কমিশনে কৃষক সভা যে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন ( স্বাক্ষর করেছিলেন বঙ্কিম মুখার্জি, ভবানী সেন, আবদুল্লাহ রসুল ও রেবতী বর্মণ; খসড়া করে ছিলেন রেবতী বাবু এবং খসড়া চূড়ান্ত করণে নিয়ামক ভূমিকা নিয়েছিলেন রজনী পাম দত্ত), তা এক অসামান্য দলিল। কিন্তু কৃষক সভার পক্ষে সাক্ষ্য দানের সময় বর্গাদারদের স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মালিকানা দিতে হবে , বঙ্কিমবাবু এই দাবী করেন নি। তিরিশ চল্লিশের বাংলায় এই বিষয়টি অনুল্লেখিত, অনালোচিত। সাধে কি রায়ত কৃষক-ঘেঁষা বর্ধমান গোষ্ঠী কৃষক সভা-ই নিয়ামক হয়ে উঠেছিল।

'স্বাধীনতা' পাঠরত। শিল্পী ঃ সোমনাথ হোর। বড়গাছা। ২০শে ডিসেম্বর, ১৯৪৬। Tebhaga: An Artist's Diary and Sketchbook

One Response to “তেভাগা আন্দোলনের অ-লিখিত ইতিহাস”

  1. waliur rahman said

    বোদা,পচাগঞ্জ,দেবীপুর কোন অঞ্চল বলেনতো।

Leave a comment