বা ঙা ল না মা

পাবনা জেলার কথ্যভাষায় কিছু নমুনা

Posted by bangalnama on September 13, 2010


– লিখেছেন সন্তোষ কুমার রায়


বাঙালনামার কথায় পাবনা জেলার কথ্য ভাষায় কিছু লেখার জন্য রাজি হয়ে গিয়ে একটু বিপদই হল বলে মনে হচ্ছে, কেননা অর্দ্ধশতাব্দীর ওপর চর্চাবিহীন কাটাবার পর সে ভাষা স্মৃতি থেকে প্রায় বিদায় নিয়ে নিয়েছে। সে জায়গায় পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছে কলকাতার কথ্য ভাষা। চেনা পরিচিতেরা আমাকে পশ্চিমবঙ্গীয় বলেই ভাবেন। শৈশব কৈশোরের সুখস্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করার এ সুযোগ হারাতে চাইনি বলে রাজী হয়েছি। ভুলভ্রান্তি যাতে না হয় সে বিষয়টা দেখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। যাঁরা পাবনা জেলার বর্তমান বাসিন্দা বা যাঁরা সদ্য সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন তাঁদের কেউ লিখলেই ভাল হত, সেটা নিশ্চিত। কিন্তু ওই যে সুখস্মৃতি উপভোগের লোভ !


এ লেখায় কোন ভুলভ্রান্তি হলে অভিজ্ঞ কেউ সেটা ধরিয়ে দেবেন এই আশা রইল।


উচ্চারণবিধি নিয়ে দু’একটা কথা (আমার বিবেচনায়) –


কলকাতায় আমরা ‘হ’ত’ বললে ঢাকাতে সেটা বলা হয় ‘হইত’, আর পাবনায় বলা হয় ‘হ(ই)ত’। বন্ধনীর মধ্যে ই দিয়ে এটা বোঝাতে চেয়েছি যে, ই-এর উচ্চারণ কতকটা অ আর ই-এর মাঝামাঝি হবে। আর দুটো উপমা দিই–প্রথমটা, কলকাতার বলা কথা ‘তুমি করলে’ ঢাকায় হবে ‘তুমি কইরলা’ আর পাবনায় হবে ‘তুমি ক(ই)রল্যা’, ‘করল্যা’ বললে সঠিক হবে না – যেন ক আর র-এর মাঝে একটা ই-এর অভাব থেকে যাচ্ছে, আবার শুধু ই বসালেও ঢাকার কথাই হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। ল্যা-এর উচ্চারণ ‘কল্যান’-এর ‘ল্লা’ -এর মতো না হয়ে ল-এর সাথে কেবল অ্যা যুক্ত হবে, ক-এ য-ফলা যেমন ক্যা হয়।


দ্বিতীয়টা এরকম–যায়্যা, খায়্যা, আস্যা এমন সব কথাতে আপনা থেকেই মাঝে একটা ই-এর ছোঁয়া এসে যায়। আগে যে (ই)-এর কথা বলেছি সেটা এরকম ই। জ-এর আর একটা উচ্চারণ যেমন ‘জ়ানতি পার না’-র জ়-এর মত, পাবনাতে তেমনি ছ-এর উচ্চারনও দু’রকম। একটা হল সাধারন ভাবে যা বলি, আর অন্যটা একটু জোর দিয়ে। প্রথমটা যদি ch হয়, পরেরটা হবে chh । সম্ভব হলে পরের ক্ষেত্রটা উপযুক্ত স্থানে উল্লেখ করব।


আমার মামাদের বাড়ির কারোকে বা অন্য কোনও মানুষকেও স-কে হ, প-কে ফ, এমন কি ক, খ, থ’- কেও কখনও কখনও হ-এর মতো উচ্চারণ করতে শুনেছি। এখানে দু’রকমই ব্যবহার করেছি, যখন যেটা প্রযোজ্য বলে মনে হয়েছে – অবশ্যই খামখেয়ালিপনা করে নয়। আমার এক মামার কাছে মাঝে মাঝে পয়সার জন্য আমরা আবদার করতাম, আর উনি হট্টগোল বেশি পছন্দ করতেন না। আমাদের আবদারে বিরক্ত হয়ে প্রায়ই বলতেন,” তোমরা কহাও হোনো না, পহাও পাব্যা না।” অর্থাৎ “তোমরা কথাও শোন না, পয়সাও পাবে না”।


এছাড়া শহর এবং গ্রামাঞ্চলের কথ্য ভাষাতেও একটু ফারাক হবে। আমার বাড়ি পাবনা শহরের কথাবার্তা গ্রামের মামাবাড়ি থেকে কিছুটা তফাত লক্ষ্য করেছি কোন কোনও ক্ষেত্রে।


কোনো কথ্য ভাষাকেই বোধ হয় সেই জেলারই একমাত্র শুদ্ধ ভাষা বলা যাবে না। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রভাবও থাকে। এছাড়া অন্য কারণও থাকে। যেমন, আমাদের যৌবনে ‘বাঙ্গাল’ কথার প্রতীকই ছিলেন ভানু বন্দোপাধ্যায় আর সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। চলচ্চিত্রে ওঁরা যে প্রায়ই ঢাকার ভাষা ব্যবহার করতেন তা তো সকলেই জানেন। সে সময় আমরা নিজেদের ভাষা অব্যবহারে বা কম ব্যবহারে ক্রমশঃ ভুলছি আর ওঁদের ঢাকার কথ্য ভাষাকেই আমরা ‘বাঙ্গালভাষা’র একমাত্র প্রতিভূ বলে ভেবে নিচ্ছি। এ অবস্থায় আমাদের ঘরোয়া কথাবার্তায় ওঁদের কথা প্রভাব পড়তে বাধ্য বলেই আমার ধারণা।


আমার বর্তমান লেখার ক্ষেত্রেও সে কথা প্রযোজ্য। অনেক সাবধানতা নেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও তেমন প্রভাব পড়লে আমি নাচার, ‘ক্ষ্যামা ঘেন্নার’ দায় পাঠকের।)


* * * * *


ল্যাখতে’ত ব(ই)ল্যাম পাবনাজেলার মা(ই)নষে যে ভাষা কয়, হেই ভাষা, শ্যাষম্যাশ হব চ্যারাব্যারা ক(ই)র‌্যা না ফালাই।হেডাই চিন্তার কথা।


* * * * *


আমাগরে পূর্ববঙ্গের, মানে, এখনকার বাংলাদ্যাশের বর্ষার হাথে পশ্চিমবঙ্গের বর্ষার কোনও তুলনাই অয় না। অবিশ্যি পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলের কিছু জাগা আর গোটাকয় জেলার হাথে বাংলাদেশের বর্ষার মিল পাওয়া যা(ই)তেও পারে। ক(ই)তে পারি ন্যা।


আমার ছোটকালডা মামার বাড়ীর যে গেরামে কা(ই)টছে তার নাম জামিরতা-গুধিবারি। তাই এখন যা ক(ই)ত্যাছি তা হেইখানকারই কথা। আমাগরে গেরামের কাছাকাছির মধ্যেই খুব বড় একটা নদী আছিল, নাম আছিল বুঝি যমুনা – অনেক ছোটকালের কথা তো, তাই ভুলও হ(ই)তে পারে।


হেই নদী বর্ষাকালে ফুল্যা ফাঁপ্যা জলে এক্কেরে যাক কয় টইটম্বুর, তয় আমি দেহি নাই, হুনছি। নদী ছাপায়্যা বাড়তি জল গেরামে গঞ্জে ঢুক্যা প(ই)ড়ত। একটা জোলা বায়্যা আ(ই)সত আমাগরে গেরামে।


পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের লাল মাটির দ্যাশে যাক কয় জোর, জোলা কিছুডা তারই নাগাল। তা হেই জোলার জল আবার যায়্যা প(ই)রত পাগারে। পাগার কাক কয় কন দেহি ? তা’ত জানেন না। খারান, আমিই কয়্যা দেই।


বর্ষার জলে মাঠ-ঘাট, বাড়ি-ঘর ব্যাবাক ডুব্যা যায়। বাড়ি-ঘর যাতে না ডোবে তার জন্যে ভিটা উঁচা ক(ই)রতে হ(ই)ত। কিন্তু অত মাটি পাওয়া যা(ই)ব কোনে (অথবা ‘কোন হানে’)? তাই ভিটার কাছাকাছি জাগার মাটি কাট্যা নেওয়া হ(ই)ত। হেই জাগায় যে বড় গর্ত হ(ই)ত, হেইডাই হ(ই)ল পাগার। এরকম পাগার কাছা কাছি অনেক কয়ডাই থা(ই)কত। জোলার থিকা পাগার বেশী নিচা হ(ই)ত, তাই জোলার জল গরায়্যা প(ই)রত পাগারে। তার কি হব্দ, বাপরে!


পেরথম পেরথম ভয় ভয় ক(ই)রলেও পরে কানসওয়া হয়্যা যা(ই)ত, হ্যাষে হেই শব্দ কি মিঠাই যে লা(ই)গত কি কব। পাগার ভ(ই)র‌্যা জল আরও বা(ই)রতে বা(ই)রতে মাঠ-ঘাট ডুবায়্যা দিত। বন্ধুরা জলে খুব লাফালাফি ক(ই)রত। কিন্তু আমার জলে নামা নিষেধ আছিল। হাঁতার জা(ই)নত্যাম না কিন্যা! এখনও জানিন্যা। শোনলে মা(ই)নষে হাসে। বাঙ্গাল দ্যাশের ছাওয়ালের কিন্যা শ্যাষ-ম্যাষ এই হাল! কওয়ার কিছুই নাই।


কি কব কন ? দাদুর কাছে আমি হল্যাম পরের ছাওয়াল, হব হময় কড়া লজর। বর্ষার নতুন ঘোলা জল, যদি অসুখ-বিসুখ করে তহন “মে(ই)য়েডার কাছে প্যাচাল পা(ই)রব কেডা ?” তাই আমার উপুর দাদু ত দাদু, মামাগরেও লজর আছিল খুব, তাই জলে ঝাপাঝাপি করা এক্কেরে নিষেধ! হাঁতার না জানার আফশোষটা এখনও থাক্যা গ্যাছে। তবে ছাইকেল চড়াডা পরে ক(ই)লকাতা আহার পরে শিখছি।


হ, বর্ষার কথা ক(ই)ত্যাছিল্যাম। পাগার ভ(ই)র‌্যা জল মাঠে ঘাটে, খ্যাত খামারে উঠ্যা প(ই)রত। হর্বত্র হাঁটুজল, কোন কোনও জাগায় কোমর পর্যন্ত ডুব্যা যা(ই)ত। তহন যাতায়াতের ভারি অসুবিধা হ(ই)ত। নৌকা ছাড়া কারও গতি আছিল না। আমাগরে থা(ই)কলেও হগলের তনৌকা আছিল না, হেই মা(ই)নষেরা কলা গাছের ভ্যালা বানায়্যা নিত আর তাইতেই কাজ কাম সা(ই)রত।


বড় হড়ক (সড়ক) ক(ই)ল আগেই ডু(ই)বত না, একটু উঁচা আছিল।তাই হগলে তার উপুর দিয়্যা হাঁট্যাই যা(ই)ত যতদিন না ডুব্যা যা(ই)ত। কিন্তু হেই রাস্তার উপুরই ত জল আহনের জোলা, তাও আবার দুইখ্যান- একটা ছোট জোলা আর একটা বড়। জোলার তহন ক(ই)ল জলে থই থই অবস্থা, পার হওয়া খুব মোশকিল। পার হওয়ার লে(ই)গ্যা কেউ কেউ গামছা প(ই)র‌্যা এক হাতে কাপর উঁচা ক(ই)র‌্যা ধ(ই)র‌্যা হাঁতরায়্যা পার হ(ই)ত। কিন্তু হকলে ত আর সেডা পা(ই)রত না।


মামাগরে মুহে হু(ই)নছি, হেই কালে কেষ্টবাবু ব(ই)ল্যা একজন বড়লোক আছিল যে নাকি মা(ই)নষের কষ্ট দে(ই)খ্যা বর জোলার উপুর একখান পুল বানায়্যা দিবো ক’ছিল। মামারা নাকি হেই খুঁটি দেখছিল। আমি অবিশ্যি হেগুল্যা দেহি নাই। দ্যাখলেও স্মরনে নাই, আর থাকার কথাও না।


খানকয় খুটিও গারা হছিল, কিন্তু হেই পুল আর হয় নাই। হেই কারনে গেরামের জনকয় ফাজিল ছ্যারা একখান পোদ্য বানা(ই)ছিল যা এমনই আছিল–


‘কেষ্টবাবু পুল দিবো, থু(ই)ছে কাষ্ঠ গার‌্যা,
তাই দে(ই)খ্যা গাঁয়ের লোকে যায় হাঁতার পার‌্যা।


* * * * *


ফুলমামা আর সোনামামা খুব ডানপিট্যা আছিল। বর্ষা আ(ই)লেই মাছ ধরার হরেক কিসিমের ফন্দি বা(ই)র ক(ই)রত তারা। হব কয়ডা ত কওয়া যা(ই)ব না, একখান কই । ‘জেয়ালা’ দিয়া মাছ ধরার কথা হোনছেন কহনও?


জেয়ালা হ(ই)ল একখান ছিপই, কিন্তু মোটা কুঞ্চি আর না হয় বর বাঁশের আগা দিয়্যা বানান। ধরেন, হাত চারেকের কাছাকাছি লম্বা। সুতাও বেশ মোটা আর হক্ত। আর বরশিটাও বেশ বড়। গিলব ত বড় মাছেই, যাগরে হাঁ বড়, তাই বড় বরশি। জেয়ালা দিয়্যা মাছ ধরার লেগ্যা অল্প জলই দরকার। য্যামন ধানের খ্যাত, না হয় জংগল-টংগল আছে এমন মাঠ, মানে যেহানে হাঁটুজল বা তার এট্টু বেশি জল থাহে।


টোপ [তখন ক(ই)ল আমরা টোপ ক(ই)ত্যাম না, কি ক(ই)ত্যাম হেডা মনে নাই] ফেলা হ(ই)ত কি দিয়্যা জানেন ? জ়ীয়ন্ত ব্যাঙ, না হয় জ়ীয়ন্ত ছোড মাছ দিয়্যা। ব্যাঙ বা মাছের পিঠে বরশি গাঁথ্যা মোটা ছিপটা গারা হ(ই)ত জলের ম(ই)ধ্যে মাটিতে যাতে ব্যাঙ বা মাছ জলের ঠিক উপুরে হাঁতরা(ই)তে পারে আর খলরবলর করে।


জলের হব্দ পায়্যাই ত আ(ই)র, বোয়া(ই)ল, রিঠ্যা– এই হব বড় বড় মাছ আস্যা খপাত ক(ই)র‌্যা টোপ গিলত। হন্দ্যাকালেই জেয়ালা দেওয়ার হময়। ব্যাঙ বা মাছ গিল্যা আ(ই)টক্যা যাওয়া মাছটা হারা রা(ই)ত খলবল ক(ই)রত, ভোরে গিয়্যা মামারা হেইডা নিয়া আ(ই)সত।অ্যাকদিন একটা ধোড়াসাপ ধরা প(ই)রছিল জেয়ালায়, হাত চা(ই)রেক লম্বা।


বড় মামা আর ছোটমামা অবিশ্যি ছিপেই মাছ ধরা পছন্দ ক(ই)রত। আমার লেগ্যাও একখান বরাদ্দ আছিল। বরশিতে গাঁথার কেঁছ্যা আমাকই যোগার ক(ই)রতে হ(ই)ত। গরুর খ্যার খাওয়ার চারির নিচে লাল কেঁছ্যা কিলবিল ক(ই)রত। ঘাঁটা ঘাঁটি ক(ই)রতে ঘেন্না লা(ই)গত, ঘন ঘন ছ্যাপ ফ্যালাত্যাম। বরমামা কিছু না ক(ই)লেও ছোটমামা বকা ঝকা ক(ই)রত, ‘ অত ছ্যাপ ফালাস ক্যা ? ম্যাল্লোচ কোনেকার। অত ঘেন্না ক(ই)রলে কাম চলে ?’


* * * * *


বর্ষা বেহিদিন থা(ই)কলে নানান কিসিমের অসুখবিসুখ হ(ই)ত। উয়্যার মধ্যে প্যাট খারাপ আর জ্বরই হ(ই)ত বেশি। অ্যাতে অরোচি হয়্যা কিছু খা(ই)তে ইচ্ছা ক(ই)রত না।


দিদিমার এমন হ(ই)লে ব(ই)লতেন, ‘তরকারিগুলা কেমন জানি ঘষি ঘষি লা(ই)গতেছে’। ঘষি মানে কি হেডা জানেন ? ঘু(ই)ট্যা। তয় আমাগরে ওহানে ঘু(ই)ট্যা এইখানকার নাগাল আছিল না, অ(ই)ন্যরকম আছিল।


তাঁর কথাগুল্যা এমনই আছিল। কেউ কিছু নিয়্যা ঘ্যানর ঘ্যানর ক(ই)রলে ক(ই)তেন, ‘এই, তুই ভুতল্যাম ভুতল্যাম করত্যাছাস ক্যান রে ছ্যারা ?’ কোন উলটাপালটা কাম দে(ই)খলে ব(ই)লতেন,


‘হা(ই)গতে নাচন খা(ই)তে গীত
যা দ্যাখ তাই বিপরীত।’


আর আদে(ই)খল্যা পানা দে(ই)খলে ক(ই)তেন, ‘ আদে(ই)খলার হ(ই)ল ব্যাটা নাম থু(ই)ল তার কি।’


দিদিমার কওয়া এই রকম কথা আরও খানকয় কই–
‘যার ঘোড়া তার ঘোড়া না, চ্যারাকদারের ঘোড়া’।
‘যার শিল যার নোরা, তারই ভাঙ্গি দাঁতের গোরা’।
‘অত নালি তিন পোয়া না’।
‘আগেতে দর্শনধারি, পরেতে গুন বিচারি’।
‘আগের ব্যাজার ভাল ত’ পাছের ব্যাজার ভাল না’। (এই কথাগুল্যা খুবই খাঁটি, শ্যাষের খান এক্কেরে হেরা)।
এমনি আরও অনেক কথা আছিল, হব মনে নাই।


বাড়িতে সত্যনারায়ণের পূজা , পুরুতঠাকুরেক খবর দ্যাওয়া লাগে, দিদিমা ফুলমামাক ক(ই)লেন সেকথা, ‘ভ্যানাপ্যাচাল্যা শ্যামা ঠাকুরেক একখান খবর দ্যাওয়া লাগে। তার’ত আবার শাটর অনেক, আগের থিক্যা না ক(ই)লে কোন উস্টুম্ভ খাড়া ক(ই)রব কেডা জানে। উয়্যাক দিয়্যা কিছু কাম করানও মোশকিল, ভারি বেন্ন্যা, কখন কি চা(ই)ব কওয়া যায় না। উপায়ও নাই।’


* * * * *


ফুলমামার থিক্যা হোনা চুটকি কই একখান।


ছাওয়াল খা(ই)তে ব(ই)ছে, সামনে মা ব(ই)স্যা পাখার বাতাস ক(ই)রতেছে। তরকারিডা ছাওয়ালের পছন্দ অয় নাই। হ্যা জিজ্ঞ্যাস ক(ই)রল, ‘এইডা রানছে কেডা ?’ মা ক(ই)ল, ‘বউমা রানছে।’ এই উত্তরডাও ছাওয়ালের পছন্দ অয় নাই, হ্যা ক(ই)ল, ‘ কু(ই)টছে কেডা ?’
– ‘আমি।’
– ‘হ। তাই কও। কুট্যাই কাম সারছ্যাও!’


* * * * *


গেরামের একটা ছাওয়ালরে ক আর হ-এর তফাত বুঝানের লে(ই)গ্যা দাদু জিজ্ঞ্যাস ক(ই)রলেন, ‘ ক’ক হ কস ক্যা ? ক ক(ই)ব্যার পারস না। আচ্ছা, ক দেহি ট- এ আকারে কি অয়?
ছাওয়াল ক(ই)ল, ‘টা’।
– ‘আর ক-আকারে ?’
– ‘কা’।
– ‘তা(ই)লে কি হ(ই)ল’ ?
ছাওয়ালের ঝটিতি উত্তর ‘ট্যাহা’।


* * * * *


ক(ই)লকাতায় কাম করা গেরামের ছাওয়াল অমর দ্যাশে আস্যা বর বর কথা ক(ই)তে হুরু করলে গণিচাচা ধমুক দিলেন, ‘ ক্যারে ছ্যারা, ব্যাজারব্যাশকম কথা কস ক্যা, খুব মারাক্কুল হ(ই)ছ্যাস নাহি। ওজন হারা(ই)স ন্যা, বুঝলি। ঠিক ক(ই)র‌্যা কথা ক। শ্যাষে (হ্যাষে) যে দেহি কাছি হারাবি!’


পরে অমর তার বাবাক ক(ই)ল, ‘বর ঘরের ডোয়াখান সিমেন্ট দিয়্যা বাঁধা(ই)লে একখান কাম হ(ই)ত, চোর ডাকা(ই)ত,বিস্টির থিক্যা রেহাই পাওয়া যা(ই)ত। বাবা ক(ই)লেন, ‘ কয় কি দ্যাখ ! সিমেন্ট দিয়্যা বাঁধা(ই)ব ! এই হব আজ্যা(ই)র‌্যা কথা কস ক্যা, ক দেহি ? ক(ই)লকাতা থিক্যা শিখ্যা আছ্যাস এই হব কথা! এইহানে এই কাম করা অত সহজ ? খরচের কথা ভা(ই)বছ্যাস ? আফারাম্ম্যা একখান কথা আলটপকা ক(ই)লেই হ(ই)ল।’


* * * * *


ক(ই)লকাতায় আপনেরা যাক কন ঘুড়ি, পাবনায় তাক কয় ঘুড্ডি। কেউ কেউ আবার গুড্ডিও ক(ই)ত। কত কিসিমের ঘুড্ডি যে আছিল! বেশ বড় বড় ঘুড্ডি, মোটা মোটা সুতা দিয়্যা উড়া(ই)তে হ(ই)ত। খুব টানত, পাতলা হুতা যদি ছির‌্যা যায়, তাই। খানকয় ঘুড্ডির নাম কই– কোঁয়ার‌্যা (উড়বার হময় কোঁ কোঁ হব্দ হ(ই)ত), চিল্যা (চিলের নাগাল দে(ই)খতে) আর ফে(ই)স্ক্যা (ফে(ই)স্ক্যা পাখির নাগাল দে(ই)খতে)। আপনেরা যাক কন ফিঙে পাখী, হেইডা হ(ই)ল ফে(ই)স্ক্যা]।


হবগুল্যা গুড্ডিরই কোঁ কোঁ হব্দ হ(ই)ত। কুনু লতার পাতলা ছাল পাতলা বাঁশের ছোট বাতার হাতে ধনুকের মত ক(ই)র‌্যা বানায়্যা ঘুড্ডির হাতে বাঁধা হ(ই)ত। পাতলা ছাল হাওয়ায় কাঁপ্যা কোঁ কোঁ আওয়াজ তু(ই)লত। দূর থিক্যা জানা যা(ই)ত যে কুনু জাগায় ঘুড্ডি উ(ই)ড়ত্যাছে।


* * * * *


(পাবনা শহরে আমাদের বাড়ির কথাবার্তা কিছুটা অন্যরকম ছিল, তার অল্প নমুনা দেবার চেষ্টা করি। কলকাতা আসার পরেও বাড়িতে পাবনার কথাই বেশী বলা হত। তবে ক্রমশঃ কলকাতার ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে। দেখি কতটা মনে করে বলা যায়।)


* * * * *


বড় পিসিমা গত হ(ই)লে বড় পিস্যামশায় তিন ছেলে নিয়্যা আমাগরে বাড়িতেই থা(ই)কতেন, আর দাদুর (ঠাকুরদা) মত আদালত যা(ই)তেন। প্রায় রোজই কোর্ট থিক্যা ফির‌্যাই দাদু জিজ্ঞ্যাস ক(ই)রতেন, ‘যোগেশ ফেরে নাই? জলটল খাওয়া হ(ই)লে একটু পাঠায়্যা দিও দেখি।’ ইয়্যার পর হাতমুখ ধুয়্যা জলখাবার খায়্যা পিস্যামশায়ের সাথে কাজের কথা সার‌্যা কোন নাতির হাত ধ(ই)র‌্যা হাঁ(ই)টতে বা(ই)র হ(ই)তেন। আমিও কোন কোনও দিন গেছি।


কাছেই একটা ‘রূপকথা’ নামে সিনেমা হল আছিল, আশপাশে অনেক কয়টা তেল্যাভাজা, মিষ্টি–এই সবের দোকান ছিল, মনে আছে। তার পরেই বড় রাস্তা, যার উপুর দিয়্যা ঈশ্বরদী যাওয়ার বাস যা(ই)ত। ওই পথ দিয়্যা কয়েকবার যাতায়াত করছি মামার বাড়ি যাওয়ার সময়। আমাগরে বাড়ির বাগানের নীচেই ব(ই)য়্যা যা(ই)ত ইছামতী নদী, যার উপুরে একটা পুল আছিল। উয়্যার উপুর দিয়্যাই যা(ই)ত ঈশ্বরদীর বাস। বারান্দায় খাড়ালেই দেখা যা(ই)ত। হাঁ ক(ই)রা তাকায়্যা থাকত্যাম। মামার বাড়ির দিকেই যা(ই)ত কিনা !


কেউ পড়াশুনায় ফাঁকি দিলে বড়পিস্যামশায়ের মুখ দিয়্যা বা(ই)র হ(ই)ত, ‘বুঝলি না লো ফেলি, বুঝবি দিন গেলি’। আর রাঙাকাকা প্রায়ই ব(ই)লতেন, ‘কল্লার শাস্তি আল্লায় দেয়’।


(এ রকম আরও হয়ত লেখা যায়, তবে তাতে ভুল হওয়ার বেশী সুযোগ থেকে যায়। তাই এখানে শেষ করাই শ্রেয় বোধ হয়।)

One Response to “পাবনা জেলার কথ্যভাষায় কিছু নমুনা”

  1. তিতাস said

    পাবনা থেকে বলছি, ভাল লাগল লেখাটা পড়ে।

Leave a comment