বা ঙা ল না মা

বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে

Posted by bangalnama on September 13, 2010


– লিখেছেন ইন্দ্রনাথ মুখার্জী


কবীর সুমন লিখেছিলেন, “অসম্ভব”। শচীনকর্তার গান (এবং সুকুমার রায়ের লেখা) সুমনকে নিরঙ্কুশভাবে অসম্ভবের স্বাদ দেয়। আনন্দ বক্সী বলেছিলেন, “Sachin da is simply the best”। এখানেও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শব্দটা বোধহয় ‘simply’। সুরে এবং গায়কীতে ঐশ্বরিক সারল্যের যে মাধুর্য্য-স্বাদ শচীনকর্তা রেখে গেছেন তার নজির মেলা ভার। কিন্তু এমন জোয়ারিতে ভরপুর তীক্ষ্ণ কন্ঠ তিনি পেলেন কোথা থেকে?


কথা ছিলো রাজা হওয়ার, রাজার ছেলে কিনা। ত্রিপুরার রাজা ঈশানচন্দ্রমাণিক্যর মৃত্যুর সময়ে নাবালক ছিলেন তাঁর দুই পুত্র ব্রজেন্দ্র এবং নবদ্বীপচন্দ্র – তাই রাজা হিসাবে মনোনীত হন ঈশানচন্দ্রের ভাই বীরচন্দ্র। সেই নিয়ে মামলা হয় এবং তাতে জিতলেন বীরচন্দ্র। এরপর নবদ্বীপচন্দ্র মা কে সঙ্গে নিয়ে কুমিল্লা চলে আসেন।


শচীনকর্তার জন্ম কুমিল্লাতে, ১৯০৬ সনের পয়লা অক্টোবর। নবদ্বীপচন্দ্র এবং নিরুপমা দেবীর পাঁচ পুত্র এবং চার কন্যার কনিষ্ঠতম ছিলেন শচীন দেব। নবদ্বীপচন্দ্র নিজে খুব সুন্দর গাইতেন এবং তাঁর সেতারের হাতও ছিল চমৎকার। বাবার সঙ্গে মার্গসংগীতের চর্চা করেই সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি।


সেই সময় থেকেই লোক সংগীতের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ। শচীন কর্তার নিজের কথায়, “লোক সংগীতের আমার প্রথম দুই গুরু- মাধব আনোয়ার।” মাধব ছিলেন বাড়ির বৃদ্ধ এক কর্মচারী। রবিবার দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মাধব সুর করে রামায়ণ শোনাতেন বাড়ির ছেলে মেয়েদের। “তখন তার তান খটকা ছাড়া, সরল সোজা গানের ধরন আমাকে পাগল করে দিত।” আর আনোয়ার মূলতঃ ছিলেন মাছধরা জেলে। কিন্তু তাঁর গলায় গান লেগেই থাকত। “আনোয়ার রাত্রে যখন তার দোতারা বাজিয়ে ভাটিয়ালি গান করতো, তখন আমার ব্যাকরণ মুখস্থ করার দফারফা হয়ে যেত। এবং পরদিন স্কুলে মাস্টারমশাই-এর কাছে বকুনিও খেতাম। কিন্তু রাত্রে আবার ব্যাকরণ মুখস্থ, অঙ্ক কষা ছেড়ে আনোয়ারের কোল ঘঁেষে তার ভাটিয়ালি সুরে ও কথায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম।”


কুমিল্লার ‘ইয়ংমেনস ক্লাব’-এ সংগীতের একটা বাতাবরণ ছিল। শচীন কর্তা কৈশোর থেকেই সেখানে যাতায়াত শুরু করেন। সেখানে নজরুল ইসলামের সঙ্গেও বেশ কিছুদিন সাংগীতিক আদান প্রদান ঘটে তাঁর। ফলস্বরূপ পরবর্তীকালে আমরা কিছু গান পাই যার কথা নজরুলের, সুর শচীন কর্তা এবং নজরুল দু’জনে মিলে করেছিলেনঃ কুহু কুহু কোয়েলিয়া, মেঘলা নিশি ভোরে, চোখ গেলো, পদ্মার ঢেউ রে।


পড়াশুনা চলতে থাকে কিন্তু তাঁর আসল নেশা ছিলো গান, মাছ ধরা আর খেলাধুলো। নিজে ভালো টেননিস খেলতেন এবং কুমিল্লা টাউন হল টুনামেন্ট-এ একাধিক বার চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন। ফুটবলও খেলতেন চুটিয়ে, সেন্টার ফরোয়ার্ড বা লেফ্ট আউট। ইস্টবেঙ্গল দলের অন্ধ সমর্থক ছিলেন। পরে তিনি যখন বম্বে-তে, রোভার্স কাপ খেলতে গিয়ে পুরো ইস্টবেঙ্গল দল শচীন কর্তার বাড়িতেও থেকেছে।


১৯২৪-এ বি.এ. পাস করে ইংলিশ এম.এ. তে ভর্তি হলেন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে। সহজ সরল মানুষটা প্রথমে কলকাতা এসে কিছুটা হকচকিয়ে গেছিলেন কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও তাঁর সহজাত ছিলো। কলকাতায় প্রথম সংগীত শিক্ষা শুরু কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে। তাঁর কথায় খেলা ছেড়ে সম্পূর্ণ ভাবে সংগীতে মনোনিবেশ করেন। এই সময়ে বাবার সঙ্গে কিঞ্চিৎ মনোমালিন্য হয় পড়াশুনা নিয়ে। কিন্তু ততদিনে শচীন কর্তা সংগীত-নিবেদিত প্রাণ। কৃষ্ণচন্দ্রর অনুমতি নিয়ে গানের তালিম নিতে শুরু করলেন তাঁর গুরু বাদল খানের কাছে। ঠুমরিও শিখেছিলেন শ্যামলাল ক্ষেত্রীর কাছে।


১৯২৫/২৬ সাল নাগাদ প্রথম আকাশবাণীতে গান করেন শচীন কর্তা।


১৯৩০ সালে বাবার মৃত্যু একটা বড় ধাক্কা হয়ে আসে। মাসোহারার টাকাও বন্ধ হয়ে যায়। রাজবাড়ির থেকে ডাক এসেছিল ফিরে আসার জন্য কিন্তু তিনি ত্রিপুরা প্যালেস ছেড়ে এক কামরার ঘর ভাড়া করে টিউশন করে গানের চর্চা করে যেতে থাকেন।


HMV-র কাছে যান রেকর্ডের জন্য। কিন্তু অনুনাসিক বলে HMV তাঁকে বাদ দিয়ে দেয়। ১৯৩২-এ প্রথম রেকর্ড বেরোয় ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডস’ থেকে। রেকর্ডের একদিকে গীতিকার হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ডাকলে কোকিল রোজ বিহনে (লোক গান) আর অন্যদিকে শৈলেন রায়ের লেখা এ পথে আজ এসো প্রিয় (রাগপ্রধান)। শিল্পীর জয়যাত্রা শুরু সেই থেকে। পথে বাধা এসেছে অনেক, কিন্তু কখনো ফিরে তাকাতে হয়নি।


এই সময়ে তাঁর গানের গুরু ছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। গুরুর থেকে বয়সে বছর ২-৩ ছোটো ছিলেন শচীন কর্তা। সেখানেই পরিচয় ভীষ্মদেবের আর এক কৃতী ছাত্রী মীরা দাশগুপ্তর সঙ্গে। শোনা যায় যে তাঁদের প্রেম ভীষ্মদেব খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি। এবং তার ঠিক পরেই আরো দু’একটা ঘটনা নিয়ে শচীন কর্তা এবং ভীষ্মদেবের সম্পর্কের মধ্যে একটা শীতলতা এসে পড়ে। ভীষ্মদেব সব ছেড়েছুড়ে পন্ডিচেরী চলে যান। শচীন কর্তা বরাবর তাঁকে গুরু মেনে এসেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর ভীষ্মদেবও লিখেছিলেন, “I was charmed with his dedication to music, which continued throughout his life. At the height of one’s career people tend to forget their gurus – but not Sachin Deb who until his last days acknowledged me as his guru. Today I am extremely grieved at the passing away of one of my favourite students.”


১৯৩৪ সালে এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক পান অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে এবং সেখানে তাঁর গাওয়া বাংলা ঠুমরির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং আবদুল করিম খান (কিরানা ঘরানা)।


১৯৩৮-এ মীরা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়। মীরা দেবী নিজে অসম্ভব ভালো শিল্পী ছিলেন। অমিতা সেনের কাছে নাচও শিখেছিলেন। ১৯৩৯-এ জন্ম হয় পঞ্চমের। প্রথমে স্বামী এবং পরে ছেলেকে সবার সামনে রেখে মীরা দেবী নিজে বরাবর আড়ালেই থেকে গেছেন।


এর মধ্যে হিন্দুস্থান থেকে রেকর্ড বেরোয় অনেকগুলো। বেশ কিছু বাংলা নাটকেও সুর দেন তিনি। তিন-চারটে বাংলা সিনেমাতেও সুর করেছিলেন কিন্তু প্রত্যাশামত সুযোগ পাচ্ছিলেন না বাংলা ছবিতে। এই উপলক্ষে তিনি কিঞ্চিৎ মনঃক্ষুন্ন নিশ্চয়ই হয়েছিলেন। তবু বম্বে থেকে ডাক এলে প্রত্যাখ্যান করেন। যোগ দেন নাট্য আন্দোলনে। ১৯৩৯-৪০ লোকসংগীত শাখার সভাপতি হিসাবে কাজ করেন।


১৯৪৪-এ যখন শশধর মুখার্জী (ফিল্মিস্তান) আবার বম্বে আসার অনুরোধ করেন, সেই ডাকে সারা না দিয়ে পারেননি। অশোক কুমার অভিনীত ‘শিকারী’ এবং ‘আট দিন’ ছবিতে সুর করলেন। প্রথম বড় সাফল্য আসে ‘দো ভাই’ (১৯৪৭) ছবিতে। ‘মেরা সুন্দর সপ্্না বীত গয়া’ – এই গানটির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দী ছবির গানের জগতে দু’টো নাম স্পষ্ট অক্ষরে লেখা হয়ে যায় – গীতা দত্ত আর এস. ডি. বর্মন।


কিন্তু বম্বের জীবন শচীন কর্তার ভালো লাগছিলো না, মনস্থির করে ফেলেন কলকাতা ফিরবেন। ‘মশাল’ (১৯৫০) ছবির কাজ অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসছিলেন প্রায়। কিন্তু অশোক কুমারের পীড়াপীড়িতে ছবির কাজ শেষ করেন। আর সেই ছবির গান ‘উপর গগন বিশাল’ গানটি এতই জনপ্রিয় হয় যে শচীন কর্তার পক্ষে আর ফেরা সম্ভব হয়নি। হিন্দী প্লেব্যাক গায়ক হিসাবে মান্না দে’রও সেই প্রথম বড় সাফল্য।


এরপরে আড়াই দশক ধরে হিন্দী ছবির জগতে একের পর এক অসাধরণ সুর করে গেছেন শচীন কর্তা। এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক তার কিছু নমুনাঃ দেব আনন্দ-এর নবকেতন প্রোডাকশন-এর ‘আফসর’, ‘বাজ়ী’, ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘মুনিমজী’, ‘পেয়িং গেস্ট’, ‘নউ দো গ্যারা’, ‘কালাপানি’, ‘বম্বই কা বাবু’, ‘তেরে ঘর কে সামনে’, ‘তিন দেবীয়া’, ‘গাইড’, ‘জুয়েল থীফ’, বিমল রায়ের ‘সুজাতা’, ‘বন্দিনী’, গুরু দত্তের ‘প্যাসা’, ‘কাগজ় কে ফুল’ – কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব!


পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে গাঙ্গুলী ভাইদের ছবি ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ (১৯৫৮) এর প্রত্যেকটা গান অত্যন্ত লোকপ্রিয় হয়েছিল। এবং তার প্রায় এক দশক পরে ‘আরাধনা’ (১৯৬৯) ছবিতে গায়ক কিশোর কুমারের নবজন্ম হয় শচীনদা’র হাত ধরেই।


সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুর, সাংগীতিক অনুষঙ্গ- সব কিছুকে বদলেছেন শচীন কর্তা। সত্তর দশকের ছবিগুলোতে তার প্রমাণ মেলে- ‘তেরে মেরে সপ্্নে’, ‘শর্মিলি’, ‘অভিমান’, ‘গ্যাম্বলার’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘মিলি’। ‘মিলি’ ছবির ‘বড়ি সুনী সুনী হ্যায়’ গানটি রেকর্ডিং হওয়ার ঠিক আগেই শচীন কর্তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ১৯৭৫-এর ৩১শে অক্টোবর তাঁর জীবনাবসান ঘটে। ত্রিপুরার রাজপরিবার একসময় শচীন কর্তার সিনেমায় কাজ করাকে ভালো চোখে দেখেনি। আর আজ যে লোকে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের কথা জানেন, তার কারণ মূলতঃ শচীন কর্তাই।


শচীন দেবের সুরের জাদু ছিলো তার সারল্যে- সহজ মেলডি এবং যন্ত্রানুষঙ্গ। নিজে অসম্ভব ভালো গাইয়ে ছিলেন বলেই গায়ক-গায়িকাদের সীমাবদ্ধতাটা খুব ভালো বুঝতেন এবং সেই ভাবে গাওয়াতেন তাঁদের দিয়ে। লতা মঙ্গেশকরের প্রতি কিঞ্চিৎ পক্ষপাতিত্ব ছিল। ইনি বলতেন, “Lata is my first serve”। কিশোর কুমার ছিলেন খুব প্রিয়পাত্র, শচীনদা কিশোরকে বলতেন, “ফীল করকে গা, এক্সপ্রেশন কে সাথ, জ্যাদা মুর্কিয়া তান মারনে সে কুছ নহী হোতা”।


শচীন কর্তার অনেক হিন্দী গানেরই মূল সুর ছিল তাঁর নিজের গাওয়া বাংলা আধুনিক গান অবলম্বনে। ‘আলোছায়া দোলা’, ‘শোনো গো দখিন হাওয়া’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ ইত্যাদি। এর মধ্যে বেশ কিছু গানের গীতিকার ছিলেন মীরা দেব বর্মণ। সুপুত্র রাহুল দেব বর্মণও বাবার বেশ কিছু বাংলা গানের সুর নিয়ে হিন্দিতে প্রয়োগ করেছিলেনঃ ‘আমি ছিনু একা’, ‘কাঁদিবনা ফাগুন গেলে’, ‘আমি সইতে পারি না বলা’ ইত্যাদি। এই ‘সইতে পারি না’ গানটিতে এক জায়গায় অন্তরা যেখানে এসে স্থায়ীতে মিলিত হচ্ছে সেখানে শচীন কর্তা শুধু একটা ধ্বনির প্রয়োগে যে ভাবের সৃষ্টি করেছিলেন তা না অন্তস্থ করলে বলে বোঝানো যায় নাঃ ‘আহ! – সইতে পারি/ না বলা/ মন নিয়ে ছিনিমিনি সইবো না’। ‘আহ!’ -এই একটি ধ্বনিকে যেভাবে গেয়েছিলেন শচীন কর্তা তার জুড়ি মেলা ভার। মানব চরিত্রে তো মিনমিনে ভাবটাই বেশী, তাই আমরা গুরুগম্ভীর গলাকেই বেশী পছন্দ করি। তাই হয়তো গায়ক শচীন দেবের সঠিক মূল্যায়ন কোনোদিনও হবে না। তাঁর নিজের কথায়, “গায়ক শচীন দেবের পাশে সিনেমা মিউজিক ডিরেক্টর এস. ডি. বর্মণ – কিছু নয়, কেউ নয়।”

One Response to “বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে”

  1. Hummel said

    চমৎকার তথ্যবহুল পোষ্ট।

Leave a comment