বা ঙা ল না মা

বাঙালনামা’র সঙ্গে আলাপচারিতায় সুকুমার সমাজপতি – শেষ পর্ব

Posted by bangalnama on September 13, 2010


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন – অনির্বাণ দাশগুপ্ত

(প্রথম পর্বের পর)


বাঙালনামা।। ওই ১৯৬১-তেই তো মারডেকাতে ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে যান। কেমন লেগেছিল প্রথমবার দেশের হয়ে মাঠে নামতে?


সুকুমার সমাজপতি।। সেটা সম্পূর্ণ অন্য একটা অভিজ্ঞতা। ক্লাবের হয়ে খেলা আর দেশের হয়ে খেলার মধ্যে একটা পার্থক্য তো আছেই। দেশের হয়ে খেলার সময়ে তুমি একটা গোটা দেশকে রিপ্রেজেন্ট করো। ১৯৬১-তে মারডেকা খেলার সময়ে আমাদের কোচ রহিম সাহেবের কাছে আমার নামে রটনা হ্য় যে আমি নাকি চোখে বল দেখতে পাইনা। মারডেকার ম্যাচগুলো সবই হত সন্ধ্যাবেলায় বা রাতে, ফ্লাডলাইটের আলোয়। এই রটনা আমার কেরিয়ারে পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৬২-তে যে কত ক্ষতি করে তা তুলনারহিত।


বাঙালনামা।। ১৯৬২-তে ভারতীয় ফুটবল দলের শেষ বড় অ্যাচিভমেন্ট জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সোনা জেতা। সেই দলে আপনার সুযোগ না পাওয়ার পেছনে কি এই ষড়যন্ত্র বা রটনার কোনো ভূমিকা ছিল?


সুকুমার সমাজপতি।। আমার জীবনে সবচেয়ে যন্ত্রণার এবং শকিং ঘটনা হল ১৯৬২-তে এশিয়ান গেমসে ভারতীয় দলে চান্স না পাওয়া। আমার বিরুদ্ধে হওয়া রটনা বা ষড়যন্ত্রের ইন্টেন্সিটি এত প্রবল ছিল যে তাতে রহিম সাহেবের মত মানুষও প্রভাবিত হয়েছিলেন। মনে আছে টীম থেকে বাদ পড়ার খবর পেয়ে অঝোরে কেঁদেছিলাম। অসম্ভব মন খারাপ হয়েছিল। ইনফ্যাক্ট, এই ঘটনার ক্ষত আমার জীবনে কোনোদিনই নিরাময় হবে না। এখনো যখন কোনো অনুষ্ঠানে বা আড্ডাতে ১৯৬২-এর এশিয়ান গেমসের কথা ওঠে, আমি মাথা নিচু করে সেখান থেকে সরে আসি। কিছু কিছু যন্ত্রণার স্থায়িত্ব আমৃত্যু রয়ে যায়, এটা সেরকম।

১৯৬২ রোভার্স ঃ দুরন্ত এক মুহূর্তে সমাজপতি


বাঙালনামা।। এর পরে তো আপনি ভারতীয় দলের হয়ে আবার খেলেছেন, তাই না?


সুকুমার সমাজপতি।। হ্যাঁ, ১৯৬৩-তে আমি পীক ফর্মে ছিলাম। ক্লাবের হয়ে রেগুলার গোল করতাম, করাতাম। সে বছর ভারতীয় দলের হয়ে প্রি-অলিম্পিক খেলি। আমাদের পার্ফর্ম্যান্স মোটেই ভাল ছিল না। ১৯৬৪-এ আবার মারডেকার দল থেকে বাদ পড়ি। তখন ভারতীয় দলে চান্স পাওয়া নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ক্লাবের খেলাতেই মনোনিবেশ করি।

অনুশীলনের মুহূর্তে ক্যামেরাবন্দী সমাজপতি, ১৯৬৩

অনুশীলনের মুহূর্তে ক্যামেরাবন্দী সমাজপতি, ১৯৬৩


বাঙালনামা।। ১৯৬৫-তে তো আপনি ইস্টবেঙ্গল ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন, কোনো আলাদা অনুভূতি হয়েছিল?


সুকুমার সমাজপতি।। আসলে ১৯৬৪-তে ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়কত্ব বকলমে আমিই সামলাতাম। আর, আলাদা অনুভূতি? না ভাই, সেরকম আলাদা কোনো অনুভূতি হয়নি। আমরা মিলেমিশে খেলতাম, মিলেমিশে দল চালাতাম।


বাঙালনামা।। সেই সময়ের ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অফিশিয়ালদের নিয়ে কিছু বলবেন?


সুকুমার সমাজপতি।। আমি যখন প্রথম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলতে ঢুকি তখন মন্টুদা-রা ছিলেন। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর জ্যোতিষ গুহ আসেন। জ্যোতিষবাবু অসম্ভব ভালো প্রশাসক ছিলেন, কিন্তু ওঁর একই সঙ্গে ছিল একটা ডিক্টেটোরিয়াল মানসিকতা, মানে উনি যা বলবেন সেটাই নিয়ম। আমার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক এই কারণেই মোটেই ভালো ছিল না। আমার নিজের আত্মসম্মান বোধ ছিল প্রবল। জ্যোতিষদার সঙ্গে প্রায়ই লাগত।


ইনফ্যাক্ট ১৯৬৫-তে আমি যখন ইস্টবেঙ্গলের ক্যাপ্টেন ছিলাম তখন দল নির্বাচনী বৈঠকে আমার ডাক পড়ত না।


তবে এই কথা আমি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করব যে জ্যোতিষদার চেয়ে দক্ষ প্রশাসক আমি আর দেখিনি। একটা ঘটনা বলি। একদিন খেলার শেষে ক্লাবের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি জ্যোতিষদাকে বলেন, “সমাজপতি খেলতে পারছে না। এই টীমে নতুন কোনো প্লেয়ারের প্রয়োজন আছে।” আমার সঙ্গে জ্যোতিষদার তখন সাপে নেউলে সম্পর্ক। তা সত্তেও জ্যোতিষদা সেই লোকটির কলার ধরে বলেছিলেন, “You are a first rate scoundrel. তুমি খেলার কিসসু বোঝো না।” আমি জ্যোতিষদাকে এই জন্যেই সারাজীবন মনে রাখব।


বাঙালনামা।। ১৯৬৬-তে আপনার আবার মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার পেছনে কি এই ঝামেলার কোনো প্রতিফলন ছিল?


সুকুমার সমাজপতি।। তা খানিকটা ছিলই, ভাই। তখন আমি সবে SBI-এ চাকরিতে ঢুকেছি। টাকাপয়সা নিয়ে ক্লাবের সঙ্গে মতান্তর হচ্ছিল, প্রায় অকারণেই। আমার টাকাপয়সার তেমন দরকার ছিল না, সম্মানের ছিল। টাকাপয়সার নাম করে আসলে সেই সম্মান নিয়েই টানাটানি হচ্ছিল।


মান্না-দা কে ফোন করে বলেছিলাম মোহনবাগানে খেলব। শুনে মোহনবাগান অবাক হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬২-তে ওদের অসম্ভব লোভনীয় অফার সত্তেও আমি ইস্টবেঙ্গল ছাড়িনি। বলতে পারো, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই একরাশ মনখারাপ নিয়ে ইস্টবেঙ্গল ছাড়লাম।


মোহনবাগানে গিয়ে খুব বেশি সুবিধে হয়নি। ওখানে খেলার সময়ে যে বিশেষ গোষ্ঠী আমার পেছনে লেগেছিল তারা আবার সক্রিয় হয়। ওখানেও থাকতে পারিনি। ১৯৬৮-তে আবার ইস্টবেঙ্গলে ফিরে আসি। ঠিক করেছিলাম, এখান থেকেই অবসর নেব। সেই সময়ে হাঁটুতেও একটা চোট পাই, যেটা আমার অবসর নেওয়াকে ত্বরান্বিত করে।


১৯৭০-এ আমি অফিসের হয়ে খুব ভালো ফর্মে ফুটবল খেলেছি। তাই দেখে ডাঃ নৃপেন দাস আমাকে ইস্টবেঙ্গলের ট্রায়ালে আসতে অনুরোধ করেন। এসে দেখি ক্লাবের পরিবেশ খানিকটা পাল্টেছে। আমারই যাঁরা সহ-খেলোয়াড় ছিলেন, তাঁরা কেউ কেউ কোচ বা আধা-কর্মকর্তার ভূমিকায়। আমার ওপর তাঁদের ছড়ি-ঘোরানো অন্তত ফুটবলের প্রাথমিক পাঠের ক্ষেত্রে মেনে নিতে পারব না বলে ট্রায়াল থেকে বেরিয়ে আসি, ক্লাব-ফুটবলকে কুর্ণিশ করে। সেই শেষ।


বাঙালনামা।। আপনি তো কলামনিস্ট হিসেবে নিয়মিত কলকাতা ফুটবল এবং বিদেশি ফুটবল ফলো করেন। আপনাদের সময় থেকে এখনকার ভারতীয় ফুটবলের তফাত বা ফারাকটা কোথায়?


সুকুমার সমাজপতি।। কোনো তুলনাই হয় না। এখন ভারতীয় ফুটবলের হাল দেখলে আত্মগ্লানি জাগে। খেলার মান আশির দশক থেকেই নিম্নগামী। তবু তো আশির দশকে কৃশানু দে’র মত কিছু খেলোয়াড় ছিলেন। এখনকার ছেলেদের খেলা দেখলে, বেসিকের ভুলভ্রান্তি দেখলে wasteland ছাড়া কিছুই মনে আসে না। ফুটবলে ফার্স্ট টাচ এবং রিসিভিং ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট। ছোটবেলায় টেনিস বল দেওয়ালে ছুঁড়ে সেটাকে বুকে আর পায়ে নিয়ে বল রিসিভিং প্র্যাক্টিস করেছি। এখনকার দুর্দশা দেখলে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়।


বাঙালনামা।। কলকাতা ফুটবলে এই মুহূর্তে কোনো উইঙ্গারের নাম অনেক ভেবেও মাথায় আসছে না। উইং-এ খেলার মত একটা বিশেষ আর্টের এই দুর্দশার কারণগুলো সম্পর্কে আপনার কি মনে হয়?


সুকুমার সমাজপতি।। দেখো, বিদেশি ফুটবলে এখন প্লেয়াররা অনবরত জায়গা বদল করে ফেলায় উইঙ্গারের কোনো নির্দিষ্ট পোজিশান নেই। সেই হিসেবে খেলা এখন অনেক বেশি ফ্লেক্সিবল। নজর করলে দেখতে পাবে, যে আক্রমণগুলো বিপক্ষের গোল-মুখে উঠে আসে তার সবই হয় মাঠের দু’প্রান্তে গিয়ে, অর্থাৎ উইঙ-প্লে ফুটবল খেলায় মাঠটাকে বড় করতে সাহায্য করে। এর এক শতাংশও ভারতীয় ফুটবলে দেখা যায় না।


ভারতীয় ফুটবলের এই নিম্নগামীতার পেছনে বোধহয় আরেকটা কারণও আছে। নতুন ছেলেরা, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা আর ফুটবলে আকৃষ্ট হয় না, কলকাতা ফুটবলে তো না-ই। ফুটবলে টাকা এবং প্রতিষ্ঠা ভারতবর্ষে খুব কম। তাই আমরা ছোটবেলায় যেভাবে মাঠে দাপিয়ে বেড়াতাম, তার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই এখনকার ছেলেমেয়েদের নেই। তারা হয় কাঁধে ব্যাগভর্তি বই নিয়ে ট্যুইশনে ছোটে, অথবা ক্রিকেট-কিট নিয়ে কোচিং-ক্যাম্পে যায়।


বাঙালনামা।। কলকাতা ফুটবলে আপনার দেখা কিছু পছন্দের খেলোয়াড়ের নাম করুন।


সুকুমার সমাজপতি।। অনেকের নামই তোমরা জানো। আমি বরং কয়েকজনের কথা বলি যাঁরা unsung হিরো হিসেবে রয়ে গেছেন, লোকে যাঁদের নাম যে কারণেই হোক তেমন মনে রাখেননি, যাঁরা প্রচারবিমুখ বলে তেমন নামও শোনা যায় না।


যেমন ধরো অসীম মৌলিক দুর্দান্ত প্লেয়ার ছিল। আমি দেখেছি বিপক্ষ দলে ডিফেন্ডার ওর জার্সি টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে, অসীম খালি গায়ে গিয়ে গোল করে এসেছে। এই জিনিস কলকাতা ফুটবল খুব কমই দেখেছে। এমনকি পরবর্তীকালে নাম-করা ফুটবলার সুভাষ ভৌমিক অসীমের ধারেকাছে যায় না।


বলরামের কথাই ধরো, প্রচারবিমুখ এই মানুষটিকে আমরা ভুলেই গেছি। ওঁর মত ফুটবলারও এই দেশে খুব কমই জন্মেছেন।


আমার দেখা সেরা ভারতীয় ফুটবলার বললে আমি ভেঙ্কটেশের নাম করব। ওঁর মত কমপ্লীট ফুটবলার আমি দেখিনি।


এখনকার ফুটবলারদের মধ্যে ভাইচুং আমাদের সময়ে প্রথম একাদশে জায়গা পেত না। যদিও ভাইচুং খুবই ভাল এবং পেশাদার প্লেয়ার। তবে একজন ফুটবলার, যার কথা না বললে অন্যায় হবে, সে হল আই.এম.বিজয়ন। ও যেকোনো সময়ে যে কোনো ফুটবল দলে ঢোকার যোগ্যতা রাখে।


বাঙালনামা।। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সঙ্গে পদ্মাপারের রিফিউজিদের সম্পর্ক তো আপনি খুব ভালোভাবে দেখেছেন। দেশভাগের অব্যবহিত আগে থেকে সত্তরের মাঝামাঝি পর্যন্ত হাজারে হাজারে রিফিউজি এপারে এসেছেন। একজন প্লেয়ার হিসেবে এই আঁচটা আপনি কিভাবে টের পেয়েছেন?


সুকুমার সমাজপতি।। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি শোনো। ১৯৫৮-এ গিরিজাপ্রসন্ন শিল্ডে অফিস ক্লাবের হয়ে আমি খেলতে গেছিলাম। খেলা হয়েছিল শ্যামনগর জুটমিলের মাঠে। খেলা পড়েছিল জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে। ওদের হয়ে মান্না-দা লেফট-ব্যাকে খেলেছিলেন, আমি নিজে রাইট-উইঙে খেলেছিলাম। বলতে বাধা নেই সে ম্যাচে আমি মান্নাদাকে বহুবার বীট করেছিলাম এবং দুর্দান্ত খেলেছিলাম। তাতে অবশ্য আত্মশ্লাঘা বোধ করিনি বিশেষ, কারণ আমি তখন নেহাতই বাচ্চা ছেলে আর মান্না-দা বর্ষীয়ান। স্বভাবতই সেই বয়সে আমার স্পীড আর এজিলিটি অনেক বেশি ছিল। ম্যাচটা আমরা এক গোলে হেরে গেছিলাম।


কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় লেভেল-ক্রসিং আটকে দিল ঘরমুখো জনতা। গাড়ি থেকে নেমে দেখি তারা সবাই বাঙাল। ম্যাচ জেতা-হারার থেকেও তাদের সেই উল্লাস আমাকে ঘিরে, কারণ আমি সেদিন মান্না-দাকে নাচিয়েছি। তারা কেউ আমায় মালা পরাবে, কেউ বা মিষ্টি খাওয়াবে। খেলোয়াড় জীবনে সেই আমার প্রথম বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্ব টের পাওয়া।


বাঙালনামা।। আপনার জীবনের কিছু স্মরণীয় ঘটনা যদি আমাদের সাথে শেয়ার করেন।


সুকুমার সমাজপতি।। ১৯৬২-তে এশিয়ান গেমসে টীম থেকে বাদ পড়ে আমি তখন খুব হতাশ। তখন বসুশ্রী-তে আড্ডা মারতে যেতাম। সেখানে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র – এঁদের মত লোকেরাও আড্ডা মারতে আসতেন। টালিগঞ্জ ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই আসতেন।


বসুশ্রী-তে মন্টু-দার উদ্যোগে তখন বাৎসরিক একটা অনুষ্ঠান হত। তাতে সঙ্গীত এবং সিনেমা জগতের রথী-মহারথীরা অংশ নিতেন। খুব ভীড় হত, রাস্তায় লাউডস্পীকার দিয়ে দেওয়া হত, ট্র্যাফিক আটকে যেত, তিলধারণের জায়গা থাকত না। সে বছর অনুষ্ঠানের দু’দিন আগে আড্ডা মারতে মারতে একজন মানবেন্দ্র-দাকে বলল, “শুনেছেন, সুকুমার তো ভাল গানও করে।” শুনেই উনি আমায় বললেন, “একটা গান হয়ে যাক তাহলে।” তখন বয়স কম, জানি গলায় সুর আছে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটা গান গেয়ে দিলাম। শুনে উনি বললেন দু’দিন পর বসুশ্রীর অ্যানুয়াল ফাংশানে আমায় গাইতে হবে, কোনো ওজর-আপত্তি শুনলেন না।


অ্যানুয়াল ফাংশানের দিন প্রথমে মানব-দার গান ছিল। গানের শেষে উনি আমার নাম অ্যানাউন্স করলেন। স্টেজে উঠেছি সবে, দেখি দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন। ভাবলাম নতুন শিল্পী বলে আওয়াজ দিচ্ছে নাকি! তারপরে দেখি, গুঞ্জনের আসল কারণ ধুতি-পাঞ্জাবী পরা উত্তমকুমার। উনি এসে সামনের সারিতে বসলেন। আমার সঙ্গে তবলায় ছিলেন শ্যামল মিত্র। ওনাকে বললাম, “শ্যামল-দা, আমি কিন্তু কোনোদিন তবলার সাথে গান গাইনি। পারব তো?” শ্যামল-দা বলেছিলেন, “তুই নিজের মত করে গেয়ে যা, আমি ম্যানেজ করে নেব।” সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।


বাঙালনামা।। সঙ্গীতপ্রেমী এবং সঙ্গীতশিল্পী বলে আপনার সুনাম রয়েছে। কি করে সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হলেন?


সুকুমার সমাজপতি।। বাড়িতে বরাবরই গান-বাজনার পরিবেশ ছিল। সঙ্গীতার্য শ্রী তারাপদ চক্রবর্তী আমার বাবার বাল্যবন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে ছোটবেলা থেকেই গান-বাজনার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল। ১৯৬৮-তে আমি তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে গান শিখতে গেলে উনি আমাকে ওঁর ছেলে মানস চক্রবর্তীর কাছে গান শিখতে বলেন। সেই আমার সঙ্গীতশিক্ষার শুরু। প্রথম অনুষ্ঠান করি ১৯৮১ সালে।


বাঙালনামা।। আপনার প্রিয় সঙ্গীতশিল্পীর নাম যদি বলেন।


সুকুমার সমাজপতি।। হিন্দুস্থানী ধ্রুপদী সঙ্গীতে আব্দুল করিম খান, ফৈজ খান, ভীমসেন যোশী – এঁরা তো ইশ্বর! কিন্তু সঙ্গীতার্য তারাপদ চক্রবর্তীর গায়কী আমার কাছে শ্রেষ্ঠ। আমি নিজের চোখে দেখেছি ওঁর গান শুনে গোটা হল কিভাবে কাঁদছে।


আর আধুনিক গান যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে ধনঞ্জয়-বাবুকে আমার অতুলনীয় মনে হত। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামল-দাকে আরো বড় গায়ক বলে মনে হয়। হেমন্ত-বাবু, মান্না-বাবু – এঁরা তো আছেনই। এখনকার গায়কদের মধ্যে রূপঙ্করের গান খুব ভালো লাগে। আর শুভমিতা তো অনবদ্য।


বাঙালনামা।। বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনি তো রেডিওতে ধারাভাষ্যও দিয়েছেন।


সুকুমার সমাজপতি।। ১৯৭২ সালে আমি প্রথম ধারাভাষ্য দি, সঙ্গে ছিলেন অজয় বসু। অজয়-দা আমাকে ম্যাচের ধারা-বিবরণী শুরু করতে বলেন। এটা আমার কাছে এক বিরাট সম্মান।


একবার একটি ব্লাইন্ড-স্কুলের ছেলেরা আমাকে বলে আমার ধারা-বিবরণী শুনে তারা নাকি চোখের সামনে ফুটবল খেলা দেখতে পায়। এরচেয়ে বড় প্রশংসা আমার নিজের খেলোয়াড় জীবনেও পাইনি।


বাঙালনামা।। শেষ প্রশ্ন। ফুটবল না সঙ্গীত? নতুন করে শুরু করতে হলে কোনটা বাছবেন?


সুকুমার সমাজপতি।। ফুটবল তো আমার প্রথম প্রেম। যা নামডাক হয়েছে সবই তো ওই ফুটবলের জন্যেই। আবার সঙ্গীতও আমার ভীষণ ভালবাসার একটা জায়গা। দুটোই থাকুক না!

সঙ্গীত সাধনার একটি মুহূর্তে, সুকুমার সমাজপতি

সঙ্গীত সাধনার একটি মুহূর্তে, সুকুমার সমাজপতি

_________________________________
(ছবি সৌজন্যে : শ্রীজাতা ও সন্দীপন সমাজপতি)

One Response to “বাঙালনামা’র সঙ্গে আলাপচারিতায় সুকুমার সমাজপতি – শেষ পর্ব”

  1. Excellent interview. I know Sukumar Samajpati more as a vocalist than a football player. But unfortunately he has not been recognized well enough for either of his talent.

Leave a comment