বা ঙা ল না মা

সিলেট-কাছাড়ের বাউল পরম্পরা

Posted by bangalnama on December 22, 2010


– লিখেছেন সঞ্জীব দেবলস্কর

যদিও দুটি অঞ্চল দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্গত, তবু সিলেট-কাছাড়কে আমরা একটি শব্দবন্ধে আনছি – কারণ প্রাচীন, মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এই অঞ্চলটি একটি একক সাংস্কৃতিক অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই অঞ্চলটির লোকায়ত জীবন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা আশ্চর্য্যজনকভাবে সমন্বয়ধর্মী, উদার এবং সংস্কারমুক্ত একটি সংস্কৃতির পরিচয় পাই। সাংস্কৃতিক দিকে এই অঞ্চলটি শাহজালাল-শ্রীচৈতন্যেরই অঞ্চল। এখানে সুফিতত্ত্ব এবং বৈষ্ণবতত্ত্ব মিলে-মিশে এক হয়েছে। মধ্যযুগে যে সুফিমতের ইসলাম ধর্ম এখানে এসেছিল এর সঙ্গে বাংলা প্রচলিত যোগমার্গ এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধন মার্গের একটা সমন্বয় গড়ে উঠেছে। শাহজালাল-শ্রীচৈতন্যের আত্মপ্রকাশের পূর্বে, দশম-একাদশ শতকে এই অঞ্চলটিতে বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শন ও সাধনতত্ত্ব প্রচলিত ছিল।

চতুর্দশ শতকে হজরত শাহজালালের আগমনের পর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও সিলেটের লোকধর্ম এবং সামাজিক সংস্কার ও সংস্কৃতিতে কোন মৌল পরিবর্তন ঘটেনি। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের আবরণের নিচে বাঙালির নিজস্বতা, যা সে সময় থেকেই এদের জাতিগঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি সুস্পষ্ট অবয়ব ধারণ করার পথে চলছিল, তা অক্ষতই রয়ে যায়। যে মুসলিম সাধকেরা এদিকে এলেন, তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন মুখ্যত সুফি দর্শন। শাহজালাল এবং সঙ্গে যে ৩৬০ আউলিয়া এদিকে এসেছিলেন, এরা একাধারে ছিলেন সুফি সাধক এবং যোদ্ধাও(warrior saint, যেমন বলেছিলেন ঐতিহাসিক সুজিৎ চৌধুরী)। এরা সিলেটে ধর্মপ্রচার যেমন করেছেন, তেমনি রাজা গৌড়গোবিন্দের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধও করেছেন। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি, এদের সঙ্গে এই সুফি দর্শন এসেছে এমন এক ভূখন্ডে যেখানে ইতিপূর্বে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন তত্ত্বের একটি অধ্যায় সবে সমাপ্ত হয়েছে।

শাহজালালের অব্যবহিত পরেই সিলেট-কাছাড়ে এল বৈষ্ণব ধর্মাচারের এক প্রবল জোয়ার। এখানে উল্লেখ করে নেওয়া প্রয়োজন, বৈষ্ণবশাস্ত্রে শ্রীচৈতন্যদেবের পিতৃপুরুষের আদি ভূমি হল সিলেটের ঢাকা দক্ষিণ। যদিও মহাপ্রভুর মূল কর্মক্ষেত্র শ্রীহট্ট নয়, তবু তিনি শ্রীহট্ট থেকে পেয়েছেন একাধিক অনুগামী, এবং বৈষ্ণব ধর্মাচারের প্রভাব ভারতের অন্যান্য স্থানের তুলনায় এই ভূখন্ডে কোন অংশেই কম নয়। তবে এখানের বৈশিষ্ঠ্য হল এখানে সুফি তত্ত্ব বৈষ্ণব তত্ত্ব মিলে মিশে এক হয়েছে। সিলেট-কাছাড়ে আউল-বাউল-মারিফতি এবং পাঁচালি-কীর্তন-দেহতত্ত্বের বিপুল উৎসারণের সূত্র সম্ভবত এখানেই। প্রচলিত সনাতন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের সংঘাত ঘটার মত কোন পরিস্থিতি এখানে কখনও সৃষ্টি হয়নি। বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশের প্রাথমিক পর্ব থেকেই শ্রীহট্ট-কাছাড়ে একটি মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠতে থাকে। এই মিশ্র সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটেই লালিত হয়েছে সুফি-মরমিয়া-বৈষ্ণব মতাদর্শ আশ্রিত বাউল ধর্ম। এই বাউল সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য। বাউল ধর্ম-সুফি ধর্মই বাঙালির প্রাণের ধর্ম, নিজের ধর্ম, এবং এই ধর্মের নির্যাসটি চর্যাপদ থেকে চন্ডীদাস-লালন, হাসন-রাধারমণ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম পর্যন্ত প্রবাহিত। এই বাউল তত্ত্বেই বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে একসাথে মজেছে।

আবহমান কাল থেকেই সিলেট-কাছাড় অঞ্চলে মরমিয়া পির ফকির, আউল, বাউল, বৈষ্ণব বৈষ্ণবী শুনিয়ে আসছেন প্রেমের গান। সুরমা-কুশিয়ারা-বরাক-সোনাই-জাটিঙ্গা-ধলেশ্বরী-রুখনি-জিরি-চিরি-মধুরার ঢেউয়ে ভেজা সবুজ প্রান্তরে ধ্বনিত হয়েছে বাউল তত্ত্বাশ্রিত পদাবলি। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে হাসান-রাধারমণ-সৈয়দ শাহানুর-আরকুম শাহ-ইরফান শাহ-শিতালং শাহ-শেখ ভানু, দীন ভবানন্দ থেকে গুরুসদয় দত্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, একলিমুর রাজা, আমিনুর রসিদ চৌধুরী এবং আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরীর গীত। কোন আনুষ্ঠানিকতা, কোন উপলক্ষের অপেক্ষায় না থেকেই প্রাণের টানে এই অঞ্চলের জনজীবনে এদের পদ উচ্চারিত হয়। এতে রয়েছে মানুষের অন্তর্নিহিত আরেক মানব সত্ত্বার অন্বেষণ, প্রেমের কথা, মৈত্রীর কথা, এমনকী আশাভঙ্গজনিত দুঃখবোধের কথাও।

এই অঞ্চলের অন্যতম বাউল কবি হাসন রাজার কয়েকটি পদ উদ্ধার করা যাকঃ


১।

মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে।
কান্দে হাসন রাজার মন মনিয়া রে।।
মায়ে বাপে বন্দি কই লা, খুশির মাঝারে।
লালে ধলায় বন্দি হইলাম, পিঞ্জিরার মাঝারে।।
উড়িয়া যায় রে ময়না পাখি, পিঞ্জিরাইয় হইল বন্দি।
মায়ে বাপে লাগাইলা মায়া, মায়া জালের আন্দি।।
পিঞ্জিরায় সামাইয়ারে ময়নায় ছটফট করে।
মজবুত পিঞ্জরা ময়নাইয় ভাঙ্গিতে না পারে।।
উড়িয়া জাইব শুয়া পক্ষী, পড়িয়া রইব কায়া।
কিসের দেশ, কিসের খেশ, কিসের মায়া দয়া।।
ময়নাকে পালিতে আছি দুধ কলা দিয়া।
যাইবার কালে নিঠুর ময়নায় না চাইব ফিরিয়া।।
হাসন রাজায় ডাকব তখন ময়না আয় রে আয়।
এমন নিষ্ঠুর ময়নায় আর কি ফিরিয়া চায়।।


২।

হাসন রাজায় কয়, আমি কিছু নয় রে, আমি কিছু নয়
অন্তরে বাহিরে দেখি কেবল দয়াময়।।
প্রেম বাজারে হাসন রাজা হইয়াছে লয়
তুমি বিনে হাসন রাজা, কিছু না দেখয়।।
প্রেমের জ্বালায় জইলা মরলাম, আর নাহি সয়
যেদিকে ফিরিয়া চাই, দেখী বন্ধু দয়াময়।।
তুমি আমি, আমি তুমি, ছাড়িয়াছি ভয়
উন্মাদ হইয়া হাসন, নাচন করয়।।


৩।

(রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পদ)
মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম
নাকে পয়দা করিয়াছে খুশবয় বদবয়।…


৪।

রূপ দেখিলাম রে, আপনার রূপ দেখিলাম রে
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে।।


সিলেটের মুসলিম কবিরা যে মনেপ্রাণে বৈষ্ণব ছিলেন এর প্রমাণ রয়েছে তাঁদের অজস্র পদাবলিতে। হাসন রাজার তো বৈষ্ণব পদাবলি অগুনতি। যেমন,

কানাই তুমি খেইড় খেলাও কেনে।
এই কথাটা হাসন রাজার উঠে মনে মনে।।
স্বর্গপুরি ছাড়িয়া কানাই আইলায় এই ভুবনে।
হাসন রাজায় জিজ্ঞাস করে আইলায় কি কারণে।।
কানাইয়ে যে কর রঙ্গ রাধিকা হইছে ঢঙ।
উড়িয়া জাইব জুয়ার পতঙ্গ, খেলা হইব ভঙ্গ।।
হাসন রাজায় জিজ্ঞাস করে, কানাইয়া কোন জন।
ভাবনা চিন্তা কইরা দেখি কানাই যে হাসন।।


মুসলিম পদকর্তা আলি রেজা লিখেছেনঃ

বাঁশি সময় জানো না,
অসময়ে বাজাও বাঁশি পরাণ মানে না।।
আমি যখন বইসা থাকি গুরুজনার মাঝে
(তুমি) নাম ধরিয়া বাজাও বাঁশি আমি মরি লাজে।।…


কৃষ্ণর বাঁশী এদের কবিতায় নানা প্রতীকী রূপ ধরেও আসে। সৈয়দ শাহানুর লিখেছেনঃ

বাঁশিটি বাজাইয়া কানু থেল কদম ডালে
লিলুয়া বাতাসে বাঁধই রাধার রাধা বলে।
……
রাধা কানুর মিলন হইব আড়াই হতর তলে।।


সিলেট-কাছাড়ের বাউল পদাবলির উৎসে রয়েছে মিলনের তত্ত্ব। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সমন্বয়ী সাধনা থেকেই উৎসারিত এই বাউল সংস্কৃতি। বাংলার বাউল সম্বন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাক্যগুলো আশ্চর্যজনকভাবে শ্রীহট্ট-কাছাড়ের বাউলদের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। যেন কবি প্রেমধর্মে অনুপ্রাণিত এই পদকর্তাদের স্মরণ করেই লিখেছেনঃ


‘বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি – এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এ মিলনে সভা সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরল। গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান-পুরাণে ঝগড়া বাঁধেনি।’ (সংগীতচিন্তা, কলি-১৩৭৩, ৩১৩)

Leave a comment