– লিখেছেন অরণ্য লাহিড়ী
“তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর ‘পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো!
তার বেলা?”
অন্নদাশঙ্কর রায় এই ছড়াটা লেখেন ১৯৪৭ সালে। ছড়াটিকে প্রায় প্রফেটিক বলা চলে, কারণ এটা লেখার পরেই দেশভাগ হয়। লোকমুখে প্রচলিত হতে হতে এটি পরে প্রবাদতুল্য হয়ে ওঠে। সলিল চৌধুরীর সুরে গানও হয়। এই তো সেদিন ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়েরের গোল্ডেন জুবিলী(২০০৯)তে, কয়েরের ছোটরা গেয়ে শোনালো। অন্নদাশঙ্করের নিজের যদিও ছড়াগান সম্বন্ধে কিছু বিরুপতা ছিল। ‘হিতে বিপরীতও হতে পারে’- এই ছিলো তাঁর সাবধান বাণী, সুরের যদি বেশী জটিলতা বা কারিকুরি থাকে তবে সুরের ভারে ছড়া হারিয়ে যেতে পারে।
তাঁর ‘সেতুবন্ধন’ (১৯৯৪) প্রবন্ধে দেশভাগ নিয়ে অন্নদাশঙ্কর লিখেছেনঃ–
“ভারতভাগ আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো না। কিন্তু বাংলাভাগ ছিলো আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। ঘটনাটা একবার ঘটে যাওয়ার পর তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য গতি ছিল না। বুদ্ধি দিয়ে মেনে নিলে কী হবে, অন্তর দিয়ে মেনে নিতে পারি নি। হৃদয়ে যে বেদনা ছিলো, সে বেদনা এখনও রয়েছে।”
এই বেদনা থেকে উৎসারিত হয়েছে বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অনেক উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গান, নাটক ও ফিল্ম। কিন্তু চারটি অব্যর্থ লাইনে এমন অনবদ্যভাবে দেশভাগের অযৌক্তিকতাকে মনের ভেতরে গেঁথে দিতে আর কিছু পেরেছে কি? ‘বুড়ো খোকা’ ও ‘ধেড়ে খোকা’দের এই ‘ভাঙ্গাভাঙ্গির হরির লুট’কে এরকম চমতকার একটা অল্টারনেটিভ পার্স্পেক্টিভে যে দেখা যায়, আর দেখলে যে দেশভাগের তথাকথিত রাজনৈতিক অনিবার্যতার তত্ত্ব খন্ডন করতে যে কোন পন্ডিতী কচকচির দরকার পড়ে না, তা ছোট বড় সব পাঠকের কাছেই অতি সহজে বোধগম্য হয়ে ওঠে। শুধু তাই না, পুরো ছড়াটার সহজ সরল শব্দগুলোর মধ্যে এমন একটা দুলকি চাল ও অন্ত্যমিল যে মনের মধ্যে তা স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়, কিছুতেই ভোলা যায় না।