বা ঙা ল না মা

স্বপ্নপুরণের কথকতা

Posted by bangalnama on October 25, 2009


‘স্বাধীনতা তুমি
পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদির রং

স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’
– শামসুর রাহমান


প্রবল ইচ্ছাশক্তির (উইশফুল থিঙ্কিং) খাতিরে ধরে নিলাম, বাঙালি মাত্রেই এই কবিতার কিছু পংক্তির সাথে পরিচয় আছে; সেই সঙ্গে কবির নামের সাথে। ওহ…নেই নাকি ? তাহলেও অসুবিধা নেই, সবার সব কিছু জানতেই হবে এমন দিব্যি তো কেউ কাউকে দেয়নি।


বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা আর একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙ্গাল-ই’দের কাছে একে অন্যের পরিপূরক বলা যেতে পারে। আমরা বাঙ্গালিরা, কেন কি জানি বিখ্যাত বা/এবং জনপ্রিয়দের কবিকূলের নামের সাথে বিশেষ বিশেষণ জুড়ে দিতে দারুণ পারদর্শী। যেমন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি নজরুল, পল্লী কবি জসীমুদ্দীন, প্রধান কবি শামসুর রাহমান ইত্যাদি …… এহেন প্রধানকবি আমারও খুব প্রিয়!
কেউ যদি জানতে চান, কেন প্রিয়?
আমার উত্তর হবে, জানি না!


একদিন আমার এক বিখ্যাত ইতিহাসবিদ-লেখক-আঁতেল বন্ধুর কাছে দরবার করলাম, প্রিয় কবির সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে। সাল-টা ১৯৯৩, এক বুদ্ধিজীবী বন্ধু রাজী হল আর সেই সাথে শল্লা দিল, আমাদের দেশের নামী দামী কবি-লেখক-শিল্পীদের তো বেশ বয়স হয়ে গেছে, যেকোন দিন, যে কেউ দুম করে চলে যেতে পারেন। সময় করে এদের সাথে দেখা করে, ছবি তুলে, অটোগ্রাফ নিয়ে রাখা ভাল!


কথাটা আমার খুব মনে ধরলো! আমরা দুজন একটা মনপসন্দ্ লিষ্টি তৈরি করলাম। (সত্যি বলতে কি, তা করতে গিয়ে নিজেদের কেমন যেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী বুদ্ধিজীবী-শিকারী রাজাকারদের মত লাগছিল)।


মনে ভীষণ উত্তেজনা, প্রিয় সব মানুষের দেখা পাব বলে! আমরা বেশ দামী দুটো অটোগ্রাফ খাতাও যোগাড় করে রাখলাম। আমাদের তাক করা বুদ্ধিজীবীদের মাঝে ছিলেন- বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, শামসুর রাহমান, কবি ফয়েজ আহমেদ, কার্টুনিস্ট রনবী (রফিকুন নবী)……আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনা (তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী)। সব কিছু ভারি গুছিয়ে তৈরি করে ওঁদের সবার সাথে সাক্ষাতের সময় নেয়াও সারা, এমন ক্ষণে আমার মায়ের হল প্রাণঘাতী রোগ ক্যানসার। মাকে নিয়ে যেতে হল কলকাতা।


আমার বন্ধুটি যথাসময়ে একাই গেল সবার সাথে দেখা করতে, সাথে নিয়ে গেল আমার অটোগ্রাফ খাতাটিও। তাঁরাও সব দিব্যি সেই খাতায় সই দিলেন (আমাকে না দেখেই)……নাহ, এরপর আন্তরিক ইচ্ছা সত্ত্বেও এঁদের কারো দেখাই আর মেলেনি।


মাঝে বেশ ক’টা বছর পার হয়ে গেছে, আমরা তখন সিঙ্গাপুরবাসী…তখন সময় ১৯৯৯। একদিন ঢাকা থেকে আব্বা খবরটা দিল। আমাদের সাপ্তাহিক ফোনালাপ এর শেষে বলল, তোর প্রিয় কবি ত খুব অসুস্থ রে। আমার বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল- কতটা অসুস্থ, কবে থেকে, কি হয়েছে্, প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে তুললাম আব্বা কে।


আব্বা জানালেন, বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য পাঠান হয়েছে। আরো বললেন, তোর কাছাকাছি আছেন, একবার গিয়ে দেখে এলেও তো পারিস। শান্তি পাবি, কিছুটা। আমার অস্বাভাবিক লোকভীতির কথা জানেন বলেই বেশ অনুনয়ে করেই কথাটা বললেন।


আসলেই তো, মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটাল, আমার আরশীনগর! সেখানেই কবির আপাতবাস। আর আমি একদিনও তাঁকে দেখতে যাব না! অন্য কার কাছে নয়, নিজের কাছেই যে এর জন্য কঠিন জবাবদিহি করতে হবে, সে দায় এড়াবার জন্যে তৈরি হতে লাগলাম। সত্যি কথা বলতে কি বাবাকে ঠান্ডা ভাব দেখালেও ভেতরে বেশ দুশ্চিন্তা-মিশ্রিত উত্তেজনা হচ্ছিল। আর, এই উত্তেজনা ভাগ করে নেবার মত কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এই কাঁচ-কংক্রিটের জনঅরণ্যে আমি কি যে ভীষণ একা।


ছেলে হাইস্কুল শেষ করে আর মেয়ে তা শেষ না করেই প্রথম সুযোগেই পাড়ি দিয়েছে তাদের স্বপ্নভূমিতে। দ্বিতীয়বারের মত নাড়িছেঁড়া করে ওদের বিদেশে রেখে এসে আমি এই বয়েসেই গুন গুন করি, ‘হরি, দিন তো গেলো সন্ধ্যা হল পার কর আমারে’- হ্যাঁ, বলতে গেলে প্রায় সারা দিনই। ওদের কথা ভাবতেই মনে হল, তারা থাকলেও কি নিতে পারত আমার এই উত্তেজনার ভাগ? বাংলা লেখালেখির বিশাল জগতে তারা আপাততঃ ‘হুমায়ূন-এ-হাফেয’। আমেরিকায় তাদের মন খারাপের দাওয়াই ‘হোটেল গ্রোভার ইন’। হুমায়ূন আহমেদ এর বই এর লাইন মাত্রই তাদের কাছে ‘কোটেবল কোট’।


প্রস্তুতি..


আমাদের বহুতল আবাসন পার হয়ে রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটাল। ঝকঝকে লম্বা করিডোর পেরিয়ে সোজা চলে গেলাম রিসেপশনে, সাহায্যের আশায়। কবি এ বিশাল হাসপাতালের কোথায় আছেন সে নিয়ে কোন ধারণাই নাই আমার। রিসেপসনের মহিলা টেলিফোনে ব্যস্ত। ইশারায় শুভেচ্ছা জানিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। কাজ শেষ করে হাসি মুখে জানতে চাইল, আমার জন্যে সে কি করতে পারে?


আমি কবির নামধাম জানিয়ে জানতে চাইলাম, কোথায় পাব তাঁরে? কম্পিউটারে খুটখাট করে একটা কাগজে লিখে দিল নাম আর রুম নম্বর। তবে সেই সঙ্গে এও জানাল এটা কালকের খবর, আজকেরটা এখনো আসে নি। আমি কপাল ঠুকে রওয়ানা হতে গিয়েও থমকে দাঁড়াই…..


খালি হাতে কি করে যাব?


সামনেই ফল আর ফুলের দোকান। ভেতরে ঢুকতেই ফুলওয়ালী ঝলমলে মুখে এগিয়ে এল।


আমি ম্লান মুখে জানালাম সমস্যার কথা, কবি আছেন কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। সে ক্রেতা হারাবার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। বলল, ‘দাও নাম, আমি পাত্তা লাগাই’। ফোন তুলে জেনে নিল, কবি আছেন।


আমি স্বপনে রয়েছি..


লিফটে দাঁড়িয়ে দ্বিধান্বিত হলাম স্বভাব অনুযায়ী। সত্যিই কি কবির কাছে পৌঁছানো যাবে? সত্যিই একটু ছুঁয়ে দেখা যাবে তাঁকে? যথাস্থানে পৌঁছে সব দ্বিধা, সব আবেগ-উত্তেজনার অবসান। হিমশীতল, নির্জন ঘরে একা কবি, ধবধবে সাদা বিছানায় কবি একা।


ঘুমাচ্ছেন কি? চোখ ত বন্ধ। ধীর, নিয়মিত ছন্দে নিঃশ্বাস বইছে। আর, এত অসুস্থতা সত্ত্বেও কি ভীষণ আকর্ষণীয়। আমি শব্দহীন। কেমন এক ঘোরের মাঝে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত কবিকে টেলিপ্যাথি পাঠাতে লাগলাম, ‘কবি চোখ মেলেন, একটি বার তাকান আমার দিকে’। অনেক, অনেক ক্ষণ পর বুঝি কবির সাথে সংযোগ হল।


দৃষ্টিতে শূন্যতা, অপরিচয়ের অস্বস্তি। এক সময়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’
আমি হেসে বললাম, ‘আমি তেমন কেউ না।’
উনি হাত বাড়ালেম, আমি সেই বাড়ানো হাত ছুঁয়ে দিলাম।
ফুলগুলো হাতে তুলে দিলে, ফুল নয়, দেখতে চেষ্টা করলেন কার্ডে লেখা আমার নাম।
আবার চেনার চেষ্টা… জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোনো পত্রিকা থেকে?’
আমি মুখে ‘না’ বললেও মনে মনে বললাম, ‘হায় কবি, পুষ্প মাঝে কীটসম তৃষ্ণা কী জেগেই রইবে?’
জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছেন এখন?’
গভীর হতাশার সাথে উত্তর দিলেন, ‘আর কেমন থাকবো?’
একা এসেছেন?
নাহ, জামাই আছেন সাথে, বাইরে গেছে, খেয়ে আসবে।


আবার চুপচাপ, নিবিড় নিস্তব্ধতা। খেয়াল করলাম, উনি একটু পরপর অস্থিরভাবে নিজের চুল টানছেন। আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করি, ‘আমি আপনার চুল টেনে দেই?’ উনি কিছু না বলে নিজের হাত সরিয়ে নিলেন।


কাছে গিয়ে খুব ধীরে ধীরে তাঁর চুল টেনে দিতে লাগলাম। কী নরম রেশম-কোমল ধবধবে সাদা লম্বা চুল গুলো। কবি আস্তে আস্তে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।


আমার ঘোরলাগা মনে ভাবনা এলো, একি আমার সেই চিরকালীন, ব্যাকরণহীন সব স্বপ্নের এক টুকরো অংশ? প্রিয় কবিরও কি তাই মনে হয়েছিল?


লিখেছেন – বৃষ্টি সইদ ( ১৯৯৯ সালের ২২শে অক্টোবর, ডায়েরির পাতা থেকে। লেখাটি পূর্বপ্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রথম আলো’র ক্রোড়পত্রে।)

Leave a comment