বা ঙা ল না মা

খলসেকোটার গল্প

Posted by bangalnama on October 25, 2009


এই যেটা লিখছি, সেটা বেসিকালি আত্মজীবনীর অংশ গোছের কিছু, ছোটবেলা কাটানোর রাস্তায় দেখে চলা কিছু জিনিসকে মনে করার চেষ্টা করা আর সেইখান থেকে বাঙাল আইডেন্টিটির কোনও দিশা দ্যাখা যায় কিনা দেখবার চেষ্টা করা। জায়গাটি আমার বাড়ির ঠিক পাশেই, কলিকাতা বিমান বন্দরের অতীব সন্নিকটে বাঙাল অধ্যুষিত একটি পল্লী। পল্লী বলাটাই সমীচীন হলো কারণ সন ১৯৯৬ অবধি এই অঞ্চলগুলি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন ছিলো, অনেকগুলি ইঁটের রাস্তা আর আদ্ধেক-বুজে আসা পুকুর-ডোবায় সম্পৃক্ত হয়ে। ওপার বাংলায় বরিশালের খলিসাকোটা নামে কোনও বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিলো, ৪৭-এর দেশভাগের আশেপাশের সময় ধরে সেখানকার সম্পন্ন হিন্দুরা গ্রাম তথা দেশ ছাড়তে শুরু করলেন, ছড়িয়ে পড়লেন শহর কলিকাতার চারধারে। আর পাঁচটা উদ্বাস্তু আন্দোলনের মতন করে জমি দখল করে এই খলিসাকোটা কলোনীর জন্ম হয় নি। সেই ছড়িয়ে পড়া মানুষগুলি এ পারে বিভিন্ন আলাদা আলাদা ঠাঁই জুটিয়ে নিয়েছিলেন, তারপর নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বিভক্ত ভারতবর্ষে। এর পর শুরু হলো হারিয়ে ফেলা পরিচয় খুঁজে পাওয়ার পালা- এক গ্রামের লোকেরা নিজেদের খুঁজে পেতে শুরু করলেন আর তারপর নতুন একটা গ্রাম বানালেন ফেলে আসা গ্রামের নামে, সেইটিই এই খলিসাকোটা কলোনী। বিমানবন্দর আর বিরাটির মাঝখানে মুসলমান চাষীদের কাছ থেকে জমি কেনা হলো। একঘর দু’ঘর করে ওপারের গ্রামের লোকেরা এসে ঘর বানাতে থাকলেন ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে। এঁদের অনেকেই ততদিনে মোটামুটি ভাবে একটা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্য অর্জন করে ফেলেছেন, তাঁরা বাকি আত্মীয় ও গ্রামবাসীদের ডেকে আনলেন এই জায়গাটিতে। ক্রমশঃ ইস্কুল, খেলার মাঠ, লাইব্রেরী, বারোয়ারি পুকুর নিয়ে ভদ্রস্থ জনপদ গড়ে উঠলো।


আমি অবশ্য লিখছি আশির দশকের কথা, পালাবদলের পালা পেরিয়ে বাংলা তখন শান্ত, নিরুপদ্রব জীবনযাপন এবং ভিটেমাটি হারিয়ে এপারে আসা লোকগুলি বার্ধক্যের দোরগোড়ায়। বাবার মামাবাড়ির গ্রাম, ফলে ঠাকুমার রক্ত ও গ্রাম-সম্পর্কের অনেক আত্মীয় সেখানকার, তবু আমি নিজে খলসেকোটায় একজন আউটসাইডার-ই ছিলাম। আমাদের বাড়িটা যেখানে, পরিকল্পনামতো তার ঠিক পর থেকেই খলসেকোটা কলোনী শুরু হওয়ার কথা, কিন্তু পার্টিকুলারলি এই জায়গাটায় কয়েকঘর পুরোনো বাসিন্দা থেকে গিয়েছিলো (এই এলাকার পুরোনো বাসিন্দা সকলেই ধর্মে মুসলমান, সুলতানপীরের নামে পঞ্চায়েতের নাম সুলতানপুর), আর এসে জুটেছিলো ঢাকা-বরিশাল-খুলনা-কুমিল্লার পাঁচমিশালি বাঙালরা। ফলে ১ নং খলিসাকোটা পল্লী সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, বরং ২ থেকে ৫ নং অবধি ব্লকেই বিস্তৃত এবং ৫-এর এ তে সংযোজিত যা শেষ হচ্ছে বিরাটি স্টেশনের কাছাকাছি। এতদঅঞ্চলের একটা বড়োসংখ্যার লোক নিজেদের মধ্যে বরিশালী ডায়ালেক্টে কথা বলতেন, এমন কী আমি যে স্কুলটাতে প্রাইমারীতে পড়তাম সেখানকার শ্যামল-মাস্টারমশাই (যিনি কালাচাঁদদা নামে অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়) পড়া ধরতেন ‘তুই বলো দেহি, গঙ্গানদী কোনখান থিক্যা উৎপত্তি হইতাসে?’। সেই বরিশালী ডায়ালেক্ট প্রতিসৃত হয়ে এসেছিলো আমাদের জেনারেশনের মধ্যেও। ইস্কুলে ফার্স্ট বেঞ্চে দাঁড়ালে পেছন থেকে আওয়াজ আসতোঃ ‘অ্যাই ছেলে, বয় না!’। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ছিলো ধোপা-নাপিত-পুরোহিত প্রভৃতি পেশাগুলি বাংলাদেশের খলিসাকোটা গ্রামের বংশানুক্রমে এখানেও চলে আসছিলো। আর, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের সময়েও গ্রামসম্পর্কগুলিকে প্রেফারেন্স দেওয়ার ব্যাপার দেখতাম। একটু বয়স্ক লোকজনের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় খুব স্বাভাবিক ভাবে উঠে আসতো ‘তোমার দাদু, তোমার ঠাকুমার বাবা, তোমার ঠাকুমাদের দ্যাশের বাড়ি’ জাতীয় প্রসঙ্গগুলি। আর, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের নিজেদের মধ্যেকার গল্পগাছায় দেশবাড়ির কথা একটা বড়ো জায়গা নিয়ে থাকতো। জীবনের এক প্রান্তে পৌঁছে ভিটেমাটি হারানোর ধকল সামলানো মানুষগুলি নিজেদের আবার নতুন ক’রে খুঁজে নিয়েছিলেন এই নতুন খলসেকোটায়। কলকাতার একদম উপকন্ঠে বাস করেও কলকাত্তাই হয়ে যেতে তাঁরা চান নি- শহর কলকাতার সঙ্গে কেমন ভাবে যেন একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চাইতো এই অঞ্চলটি। ‘এখানে কলকাতার দামে কয়লা পাওয়া যায়’ জাতীয় সাইনবোর্ড দ্যাখা যেত দোকানের সামনে। বইয়ের দোকানে প্রশ্নবিচিত্রা আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে দোকানী বলতেন- ‘বুধবার কলকাতা যাবো (কলেজস্ট্রীট নয়), সন্ধের দিকে খোঁজ কোরো।’ লক্ষণীয়, জায়গাটি দমদম বিমানবন্দর থেকে ১ মাইল দূরত্বেও নয়। পাড়ার দাদুদের আড্ডায় আলোচনা শুনেছিঃ ‘ছেলে কলকাতার থিক্যা একখান কড়া আম্রুতাঞ্জন আনছে, হেইডারে কয় চাইনিজ় বাম’।


এবং যেটা বলছিলাম, গ্রামসম্পর্কগুলি খুব সিরিয়াসলি রক্ষা করে চলতেন দাদু-ঠাকুমা প্রজন্মের লোকজন, এমন কি তাঁদের ইমিডিয়েট পরের প্রজন্মও। কোনও বাড়িতে বিয়ে-অন্নপ্রাশন-শ্রাদ্ধ ইত্যাদি হলে পুরোনো গ্রামের হিসেবে প্রতি ঘর থেকে অন্ততঃ একজন করে নিমন্ত্রিত থাকতো। ওপারে যাদের বাড়িতে যে যে পুজো হতো, এখানেও সেই ধারা চলে আসছিলো। দুর্গাপূজা হয়তো ব্যায়ভার সংকোচনের চাপে শুধু অষ্টমীর ঘটপুজোয় পর্যবসিত, তবু সারাগ্রামের সবঘরের লোক অষ্টমীপুজোর ভোগ নিতে আসছে সেই বাড়িটিতেই ওপারে যেখানে মহিষবলির ঘটা হতো। অনুরূপে কালীপুজো, মনসাপুজো ও একএকটি বাড়ির নিজস্ব উৎসব ছিলো যেখানে সারা গ্রামের সবকটি ঘরের লোক অংশ নিতেন। দেশজ আচারগুলি খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যেত এই পুজোগুলির সময়ে, মনসাপুজোর আগে কোনও কোনও বাড়ি থেকে শোনা যেত রায়ানী গানের সুর, পাড়ার আর দশটি ঘরের মহিলা এসে গলা মেলাতেন তাতে।


ক্রমশঃ কলকাতা আরও বড়ো হয়ে ওঠে, গিলে ফেলে তার চারপাশের ভিন্ন আইডেন্টিটিগুলি। বর্ষার বিকেলে রায়ানী গানের সুর হারিয়ে যায়, খলসেকোটার পরের প্রজন্ম আরও বেশি করে ক্যালকেশিয়ান হয়ে ওঠে- ফ্ল্যাটবাড়ি ওঠে, গ্রামপরিচিতির বাইরের লোক এসে বসবাস শুরু করে। এ সব-ই সমাজের স্বাভাবিকতা, কিন্তু ওই দেশভাগের মোকাবিলা করা মানুষগুলির আইডেন্টিটি বজায় রাখার প্রয়াস অলিখিত ইতিহাস হয়ে থেকে গ্যালো কিছু মানুষের না-মুছে-যাওয়া স্মৃতির ভগ্নাংশে।


লিখেছেন – সোমনাথ রায়

15 Responses to “খলসেকোটার গল্প”

  1. Mahasweta said

    ভালো লাগলো। বিরাটী গেছি কয়েকবার, তাই খলিসাকোটা পল্লী লেখাটা অনেক দোকানের সাইনবোর্ডেই দেখেছি। কিন্তু তার ইতিহাস যে এইরকম, সেট কোনদিন ভাবিনি।

  2. sir
    I am from khalisakota high school.barisal after 7 year 100 year past.so advice us for yours slabretion

  3. Somnath said

    Hello Mr. Sultan Hossain. great to get in contact with someone from the original khalisakota. I would like to know in more detail about that place. Can I hace your email address? Mine is mechsom@gmail.com

    • md sultan hossain said

      mr somnath
      ami attanto anandito je amar lekha chokeh pareseh.amra dui deser hoteh pari kintu amader vhasa sanskriti ek. ma mahavharot.tateh pls help original khalisakota (on education)abong bhuliben na amar phone no 008801720110518
      sikkha anuragi khalisakota high school.k.kota pallir sakol srenir proti amar pranum o salam.google map a khalisakotar sobi dekhen.amar bari daser bari.atiter building gulo bortomaneh khuleh khuleh porseh pray dhongso.chakhar fazlul hoque college er dayitteh100 acor sampatti aseh.baki d.c.r katia muslim lokera dhokhol kareh aseh. amar ityhas janteh bhalo lageh
      md.sultan hossain

  4. Madhumita said

    Somnath
    Eto sporsho korey gelo tor lekha ta…amar dadu-thakuma Narayanganj er chilen…khas Kolkata r Manicktala, Beadon street e 1947 er por theke 1992 sal porjonto chilen kintu manoshik bhabe Padma ar tader gram key kono din bholennyi ar Kolkata o konodin tader apon hoyni. Chotobelay jokhon kichu bhujtam na khub rege jetam tader ei Bangladesh-priti dekhle, jokhon bujhte shiklam toto din e tara dujonei saggey gechen! Amar ektai santona, Mississippi-Missouri r Hudson dekhar agey ami Padma ghure esechi nijer chestay.

  5. Somnath da, khub bhalo laglo lekha ta…amader dadu didima der onekei praner kachhe kore tader nijaswa identity tuku bnachiyye rakhar proyas korechhilen. dadur golpo to likheichhi. kintu kholisakota pollir sommeilito bhabe sonskriti ke boye niye cholar kahini ta khub sundar. tumi ki oi onchol er? tahole aro kichhu lekho tomar smriti theke…

  6. Sandeep Sengupta said

    Somnath,

    I never knew over the last 6 years that you have roots in Kholisakota. Trying to visit the place in February 2011. Wanna join us? 🙂

    And did you by any change get a reply from Mr. Sultan Hossain? I am unable to locate Kholisakota on google map.

    Warm regards,
    Sandeep

  7. . said

    sandeep ki sandy-da? bangladesh-er kholsekotay jachchho? february te to hobena.. but amader kholsekotay ele I’ll be there to welcome you 🙂

  8. Somnath said

    are ekTa fake-e login kore chhilam, sekhan theke post kore felechhi 😦

  9. Sandeep Sengupta said

    Photos of Kholisakota (anyone can open, public access):
    http://www.facebook.com/album.php?aid=47438&id=100000272881541&l=dd995cf4df

    Total 200 photos. 2nd February – 6th February 2011.
    A journey in search of thy roots.

  10. বাঙালনামার পক্ষ থেকে দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা oral history সংগ্রহ করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আপনাদের অনুরোধ, আপনারা এতে অংশ নিন। আপনাদের পরিবার পরিজনদের জবানবন্দী লিখিত ভাবে, মৌখিক ভাবে, তথ্যচিত্রের আকারে আমরা সংরক্ষণ করতে চাই। বিস্তারিত জানতে দয়া করে ইমেলে যোগাযোগ করুন – bangalnama@gmail.com

    @Sandeep – অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার ‘দেশে ফেরা’র এই অভিজ্ঞতা আমাদের লিখে পাঠাতে অনুরোধ রইল।

  11. Dhrubajyoti said

    khub valo likhecho Somnath da……..being a resident of Khalishakota ..i also share the same spirit and feeling….

  12. sultan said

    dui banglar khalisakota school teacher ek sava korteh chai
    advice me
    sultan khalisakota
    barisal
    bangladesh

  13. D said

    jei elakay jonmechhi, jiboner 22ta bochhor katiyechhi, sei elaka somporke kotokichhui ojana theke jeto ei lekha na porle. jantam amra udbastu, baba-maa 2 pokkhoi opar banglar. bangal identity tao shebhabe konodin bhabay ni. shudhu dekhtam east bengal er khela hole amar chorom unnasik baba o prochondo aabeg probon hoye poren. “kolkata jai” phrase ta akhono chole eikhane.

Leave a comment