বা ঙা ল না মা

বাঙালবৃত্তান্ত – পর্ব চার

Posted by bangalnama on December 22, 2010


– লিখেছেন রঞ্জন রায়

(তৃতীয় পর্বের পর)


আগেই একবার বলেছিলাম — ময়মনসিংহের নাম-মাহাত্ম্য অপার। বাপ-মায়ের দেয়া নাম চুলোয় গেল। গোটা গাঁয়ের লোক তার নামকরণ করবে কোন অদৃশ্য নিয়মে। সারা গাঁ তাকে সেই নামে ডাকবে, আর সেই ব্যক্তিটিও বিনা কোন হেলদোল সাড়া দেবে। কারো নাম মেঘার মা, কারো ঠান্ডার মা, কারো নাম বাচার মা। কেউ বা মিছার বাপ।


কিন্তু জানবেন যে তাদের কারোরই ছেলেমেয়েদের নাম মেঘা, ঠান্ডা, বাচা বা মিছা নয়। অর্থাৎ তাদের সন্তানের নাম যা খুশি হতে পারে কিন্তু গাঁয়ের লোকের বাপ-মাকে দেয়া নিকনেম-এর সঙ্গে তার উৎস খোঁজা বৃথা! ‘না বিইয়েই কানাইয়ের মা’ এই প্রবাদ কি আসলে ময়মনসিংহ থেকেই শুরু হয়েছিল?


কোলকাতায় ছোটবেলায় বাংলা গ্রামারে পড়া মূলশব্দ –> অপিনিহিতি –> অভিশ্রুতি (যেমন, রাখিয়া –> রাইখ্যা –> রেখে) যেন ময়মনসিংহ হয়ে কোলকাতা এমন মনে হত। ময়মনসিংহের সমস্ত অসমাপিকা ক্রিয়া অপিনিহিতি রূপেই আমাদের দেখা দেয়। এই গানটি দেখুনঃ


বুইড়া কালে নূপুর দিছি পায়,
মা গো মা, ঝি গো ঝি, কৈ গেলি গো বইনদিদি,
দেইখ্যা যা লো কেমন দেহা যায়।
হিজলকুসুম ফুইট্যা আছে, যমুনার জল উজান বহিছে।
এমন চান্দিনীরাইতে পরাণডা মোর কিডা চায়?
দেইখ্যা যা লো কেমন দেহা যায়!


আর বিশিষ্ট গাঁয়ের নামগুলি? তাদের যে কি হাল হয়! সম্ভ্রান্ত মধ্যমবর্গের গ্রাম হল কায়স্থপল্লী। এর নাম প্রথমে হল কায়েতপাগলী, তার পর কাইপ্যাওলী ! উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার-সত্যজিতের পৈতৃক গ্রাম মসূয়া– ময়মনসিংহের জিভে অপিনিহিতি সূত্রের নিয়ম মেনে হল মউস্যা!


তেমনি একটি বিশিষ্ট গ্রাম হল জয়সিদ্ধি, লোকের মুখে জয়সিধ্্। বাংলার প্রথম ‘র্যাংলার’ আনন্দমোহন বসুর বাড়ি। এসব ছোটবেলায় কোলকাতায় জেনারেল নলেজের বইয়ে পড়েছি। তবে ঐ বিখ্যাত পরিবারের সঙ্গে আমার মামাবাড়ির যে একটি সম্পর্ক ঘটনাচক্রে গড়ে উঠেছিল তা বড় হয়ে জানলাম। সেই ‘ডুবিয়াস’ সম্পর্কের কথা পরে বলছি। আপাততঃ ওদের নাম মাহাত্ম্য শুনুন। আনন্দমোহন বসুর নাতিরা হলেন সম্ভবতঃ ছয়জন। সবাই গুণী। একজন বিখ্যাত ক্রিকেটার কার্তিক বসু, যিনি একবার মরিস টেটকে স্কোয়ার কাট করে ছয় মেরেছিলেন।


স্কোয়ার কাট করে ডিপ থার্ডম্যানের মাথার ওপর দিয়ে ছয়? কেন? আজকাল তো শেহবাগ মাঝেমধ্যেই মারেন। কিন্তু তার আগে? সেই গোঁড়া ইংলিশ ঘরানার যুগে অমন কালাপাহাড়ি ব্যাপারের বুকের পাটা স্রেফ বাঙালদেরই ছিল!


আর এক ভাই হলেন চিত্রপরিচালক নীতিন বসু। এনার কথা বিস্তৃত কি আর বলব? সারা ভারত জানে! দিলীপকুমার-বৈজয়ন্তীমালার সুপারডুপার হিট ফিলিম ‘গঙ্গা-যমুনা’র ডিরেক্টরের নাম বলুন তো?


আমার পছন্দ আরেক ভাই হেমেন্দ্রনাথ বসু। ব্যবসায় বিমুখ বাঙালীর জগতে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। মার্কেট ইকনমি নিয়ে আমরা আজ যাই বলি না কেন উনি সে’ সময়েই মার্কেট-কনজিউমার-ক্যাম্পেন এসব ভালোই বুঝতেন। এবং রবিঠাকুরের জ্যোতিদাদার তুলনায় অনেক বেশি সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।


নাঃ, উনি জাহাজ-টাহাজ নিয়ে ভাবেন নি। ওনার চোখ গেল মহিলাদের প্রসাধনদ্রব্য ও লঁজারির দিকে। ‘কুন্তলীন’ মাথার তেল, ‘দেলখোশ’ সুগন্ধি, ‘বকুল-পারুল’ গায়েমাখার সাবান, ‘হীরামোতি’ ও ‘পুণ্যপ্রভা’ বডিস-সেমিজ ইত্যাদি ছিল ওনার প্রোডাক্ট। ক্যাম্পেন হিসেবে প্রতিবছর করাতেন ‘কুন্তলীন’ সাহিত্য প্রতিযোগিতা। তাতে পুরস্কার-প্রাপ্ত গল্প-কবিতা নিয়ে কুন্তলীন পত্রিকা বেরুতো। আজকের দিনের স্যুভেনির আর কি! শর্ত থাকতো ওই রচনাগুলিতে ‘কুন্তলীন’ বা অন্য প্রোডাক্টের নাম অন্ততঃ একবার নিতে হবে।


অনেকেই জানেন যে কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত রচনা এই কুন্তলীন পুরস্কারের সৌজন্যেই প্রকাশিত হয়েছিল।


আমি নমুনা হিসেবে দিচ্ছি এমনি একটি পুরস্কারপ্রাপ্ত কুন্তলীন-ঘুমপাড়ানি গান। ছোটবেলায় মার মুখে শোনা। স্মৃতিতে কিছুটা অসম্পূর্ণতা ও বিকৃতির সঙ্গে যতটুকু মনে আছে আর কি!


“ঘুমপাড়ানী ঘুমের রাণী সোনার খুকু কোলে,
ঘুম দিয়ে যাও খুকুর চোখে বসে নিরিবিলে।
বসতে দেব রূপোর পঁিড়ি, শুইতে সোনার খাট,
খেলার তরে তাস-পাশা, হাওয়া খেতে মাঠ।
বর্ষাকালে নৌকা দেব, উড়িয়ে যেও পাল,
পূর্ণিমাতে চড়তে দেব লেডিজ্্ বাইসিকেল।
স্নানে দেব টার্কিশ টাওয়েল ডজন ডজন ভরা,
‘বকুল-পারুল’ সাবান দেব গন্ধে মনোহরা।
কুন্তলে ‘কুন্তলীন’ পূজবো এইচ্্ বোস্্,
আদর করে রুমালেতে মাখবো ‘দেলখোস্্’।
দামে ভারি পার্শি সাড়ি, তরল আলতা পায়,
‘হীরামোতি’, ‘পুণ্যপ্রভা’ বডিস্্-সেমিজ গায়।
সঁিথিতে সঁিদুর দেব সতী-শোভনা,
গায়ে দেব কোলকাতাতে তৈরি গহনা।
সরুচালের ভাত দেব, থাল ভরা লুচি,
পুদিনার চাটনি খেয়ে মুখে হবে রুচি।
রুইমাছের মুড়ো দেব হবে রাজযোগ,
বাগবাজারের রসগোল্লা, উষ্ণ মোহনভোগ।
বাটাভরা পান দেব, গাল ভরে খেও,
যত ছেলেমেয়ের ঘুম খুকুর চোখে দিও।”


এদেরই এক ভাই সুরেন বোস গাঁয়ের বাড়িতে দোল-দুর্গোৎসব করাতেন। হয়তো একটু হিসেবি ছিলেন। লোকের মুখে মুখে রং চড়ে গল্প তৈরি হল যে উনি বাড়িতে অতিথ্্ খেতে বসলে একটুকরোর বেশি মাছের কথা বলতেন না। আর তারপরেই চট্্পট্্ হুকুম করতেন–অ্যাই, দুধ নিয়ে আয়।


আসলে তখন বাঙালদের বাড়িতে শেষপাতে দুধ-কলা দেয়ার রেয়াজ ছিল। কারণ সবার ঘরেই অঢেল থাকত। কিনতে হত না।


কিন্তু উনি আদেশের সঙ্গেই চাকরদের ইশারা করতেন কেটে পড়তে। কয়েক বার হাঁক-ডাক করেও যখন কারো সাড়া পাওয়া যেত না, তখন বিনয়ের সঙ্গে অতিথিকে জানাতেন– কি আর কইয়াম মশয়! আইজকাইলের চাকর-বাকর! একটাও কথা হুনে না। ডাইক্যা ডাইক্যা গলা শুকাইয়া গেল একটারও যদি দেখা পাওয়া যায়।


অতিথির তখন চক্ষুলজ্জার খাতিরে উঠে পড়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।


সে-সময় দোল-দুর্গোৎসব হলে আশেপাশের গোটা পাঁচেক গাঁয়ে সম্ভ্রান্ত বাড়িতে নাপিতের হাতে পান হলুদ ও সঁিদুর দিয়ে নিমন্ত্রণ দেয়ার প্রথা ছিল। এইসবের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন পারিবারের মধ্যে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠতো।


কালক্রমে বসুপরিবারের সবাই কোলকাতাবাসী হলেন। জয়সিদ্ধি গাঁয়ে ওদের ভূসম্পত্তির দেখা শোনা করতেন নায়েব সুধা চৌধুরি মশাই। আমার মামাবাড়ি হল পাশের গ্রাম উয়ারা। সেজমামা মতি দত্ত মশায়ের সঙ্গে সুধা চৌধুরির বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। একটি গ্রামের মুসলমান প্রজাদের থেকে বকেয়া খাজনা আদায় করতে উননি বন্ধু মতি দত্তের সাহায্য চাইলেন। সেজমামা বকেয়া সাত হাজার টাকা আদায় করে নায়েব সুধা চৌধুরিকে জমা দিলেন। কিছু সময় গত হলে গাঁয়ের লোকের চোখে পড়ল সুধা চৌধুরির বাড়ি ঘর ও অন্যান্য সম্পত্তি বেশ দ্রুত বর্ধিত হচ্ছে। জিভ নড়তে লাগল। কথা বাড়তে লাগল। কোলকাতায় বসুপরিবারের বাড়িতে বেনামি চিঠি পৌঁছুতে লাগল। শেষে সম্ভবতঃ ছোট ভাই সোমেন বোস জয়সিদ্ধি গ্রামের বাড়িতে এসে ঘাঁটি গেড়ে নায়েবকে ডেকে হিসেব পরীক্ষা করতে লাগলেন। প্রথম রাউন্ডে অনভিজ্ঞ সোমেন বা ছোটবাবুকে নায়েব সুধা চৌধুরি ঘোল খাইয়ে দিলেন। নায়েব হিসেব মিলিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন গোলায় আছে ১০০ মণ ধান। কিছু টাকা পড়শি গ্রামের সম্পন্ন ব্যক্তিরা ধার নিয়েছেন, এখনও ফেরত দেন নি। তাদের মধ্যে উয়ারা গ্রামের মতি দত্তের নামে ধার সাত হাজার টাকা।


সোমেনের অনুরোধে পাশের গ্রাম থেকে মতি দত্ত দেখা করতে এলেন। উনি অনেক কিন্তু কিন্তু করে বল্লেন– কিছু মনে করবেন না আপনি কি কখনও—?


মতি দত্ত হেসে বল্লেন– প্রশ্নই ওঠে না। আমার টাকার দরকার পড়লে নিজের গাঁয়েই ধার দেবার অনেকে আছেন। আপনি এককাজ করুন। আপনার নায়েবের গত ছ’মাসের আদায়-ওয়াসিল-তবিলের হিসেবের জাবদা খাতাটা একবার দেখাতে বলুন।


সেই খাতা এলে উনি দেখিয়ে দিলেন কবে উনি মুসলমান প্রজাদের থেকে সোমেনদের বকেয়া টাকা আদায় করে সুধা চৌধুরির কাছে নগদ জমা করেছেন।


অতি বিনয়ী সুভদ্র সোমেন মাপ চাইলেন। তাঁর নায়েবের প্রতি বিশ্বাস টাল খেল। তারপর গাঁয়ের লোক বল্লো– ছোটবাবু! ওঁয়ার মুখের কথা না মেনে গোলা খুলে দেখুন।


সোমেন ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন করলেন। এবার যাকে বলে চক্ষু চড়কগাছ! গোলায় পড়ে আছে নামমাত্র ধান। সুধা চৌধুরি গাঢাকা দিলেন। পুলিশ এল, সুধাবাবুকে ধরে নিয়ে যেতে। বাড়ি সার্চ করে তোষকের তলা থেকে বেরুলো নগদ নব্বুই হাজার টাকা।


সুধা চৌধুরি অগত্যা ছোটবাবুর পায়ে ধরলেন।— লোভে পড়ে করে ফেলেছি। এবারের মত মাপ করুন, আপনাদের নিমক খেয়েছি।


–আমি মাপ করার কে! মাপ করার অধিকারী কোলকাতাবাসিনী আমার মা। সেখানে চল। গিয়ে ওনার হাতে পায়ে ধর। যতটুকু পার ফিরিয়ে দাও, উনি ঠিক ক্ষমা করে দেবেন।


কোলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা করতে সোমেন সুধা চৌধুরির হাতেই কিছু টাকা দিয়ে বল্লেন– কাল সকালে ট্রেন ধরতে হবে। আজ রাতে আমরা গিয়ে ময়মনসিংহ শহরে হোটেলে থাকব। নায়েব মশায়! থাকা খাওয়ার যেন কোন ত্রুটি না হয়!


এদিকে অন্য এক সেরেস্তার ডাকসাইটে নায়েব হলেন সুধা চৌধুরির জ্যেঠুমণি। তিনি সব শুনে পাকা গোঁফে তা দিয়ে একটি গোঁফের চুল ছঁিড়ে মাটিতে ফেলে বল্লেন– আমার ভাইস্তারে জেলে আটকাইয়া রাখবো হেমন জেইল কইলকাতায় নাই!


তাই হল। সোমেন বসুদের হোটেলে তুলে দিয়ে সুধাবাবু সেই যে গা ঢাকা দিলেন! সোমেন বল্লেন– মা ওকে ঠিক মাপ করে দিতেন, এত দিনের পুরনো লোক। কিন্তু সেই সুযোগটি দিলেন না। এবার না চাইতেও পুলিশ-কোর্ট-কাছারি করতে হবে।


কিন্তু বিধি বাম। এমনি সময় হয়ে গেল হিন্দুস্তান-পাকিস্তান। সোমেন কোলকাতাবাসী অর্থাৎ ভারতের নাগরিক। সুধা চৌধুরিরা ময়মনসিংহবাসী অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক। ওদের টিকি ছোঁয় কোলকাতার কারো সাধ্য কি!


কোলকাতায় ১৯৫০-এ এই অধম রঞ্জনের জন্মের পর ঠাকুর্দা সতীশচন্দ্র গেলেন আঠারবাড়িয়ার খাস তাল্লুক বিক্রি করতে। কিনলেন সেই সুধা চৌধুরি! সদ্য প্রসূত পূর্ব পাকিস্তানে তখন ওদের ‘দুধো নহাও, পূতো ফলো’ অবস্থা।


জিগ্যেস করলেন– বড়ছেলেরে কই বিয়া করাইলেন?


— উয়ারা গ্রামের রসিকলাল দত্ত মশায়ের ষষ্ঠ কন্যা স্মৃতিকণা আমার বড়বৌমা।


— আরে! আমাদের পাশের গ্রাম, ভাল কইর্যা চিনি। খুকির দাদা মতিবাবু আমার বিশেষ বন্ধু।


শ্বশুরের বেত্তান্তটি শুনে স্মৃতিকণা মুখ বাঁকিয়ে বল্লেন– অমন বন্ধু যেন শত্রুরও না হয়!


(চলবে..)

One Response to “বাঙালবৃত্তান্ত – পর্ব চার”

  1. আকাশ said

    ভারতের প্রথম কল্প-বিজ্ঞান গল্পের পেছনেও কুন্তলীনের হাত,লিখেছিলেন জগদীশ বোস। রবি ঠাকুরের লেখাও ছাপা হয়েছিল, আর ওনাকে অন্যদের থেকে অনেকটাই বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছিল। বারিদবরণ ঘোষের সম্পাদনায় কুন্তলীন-এ প্রকাশিত লেখার একটা সংকলণ বেরিয়েছিল, সম্ভবতঃ মিত্র-ঘোষ থেকে।

Leave a comment