বা ঙা ল না মা

একুশের চিঠি

Posted by bangalnama on February 21, 2009



বিদেশ-বিভুঁয়ে বসে, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে ফেব্রুয়ারী পড়লেই, দেশ বা ভাষা নিয়ে বাঙ্গাল-ঈ যদি আদিখ্যেতা করে তাহলে কি তাকে ভন্ড বলে ভাবা হবে? যদি হয় তাহলে তাই হোক, কি আর করা! মানুষ মাত্রেই তাই, ১০০% নিরপেক্ষ কেই বা কবে হতে পেরেছে? কলকাতা থেকে এক ঘটি বন্ধু জানতে চেয়েছে, ২১শে ফেব্রুয়ারীতে দেশে, অর্থাৎ বাংলাদেশে, আমরা সাধারণত কি কি করে থাকি। কাকতালীয় বটে! এই বন্ধুর সাথে আমার সম্পর্ক যে টিকে আছে এতগুলো বছর ধরে, এর অন্যতম কারণ তার জন্ম ২১শে ফেব্রুয়ারীতে! বলতে নেই, খাঁটি ঘটিদের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধুত্ব বজায় রাখা বেশ চাপ কি না! 😉


প্রিয় লোবান,


তুমি জানতে চেয়েছ, কেমন করে কাটাতাম, বহুবছর আগের সে ফেব্রুয়ারীর দিনগুলো? এ প্রশ্নের জবাব দিতে দিই ডুব, স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনি মণিমুক্তো – হৃদয় খুঁড়লে শুধু কি বেদনাই জাগে, সুখস্মৃতি জাগে না?


আহা, প্রাণের মেলা, বইমেলা!


বছরের সব চেয়ে ছোট মাস, অথচ কি বিপুল তার পরিচিতি, ব্যাপকতা! ছোট দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে দিকে দিকে তার জয়ধ্বনি, কেবল বাঙ্গাল-ঈ রা নয়, বিপুল সম্মান আর যথাযথ মর্যাদার সাথে দিনটি পালন করে সমগ্র বিশ্ববাসী, আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।


ভাবতেই অহংকার হয়।


জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে আসছি এই মাসকে ঘিরে দেশবাসীর সে কি উন্মাদনা-আবেগ-আকুলতা! জাতিগত ভাবেই আমরা আবেগ আক্রান্ত; তার ওপর তা যদি হয় মায়ের মুখের বুলি কেড়ে নেবার চক্রান্ত, তাহলে সে আবেগ রুখে এমন শক্তি কার? এক সাগর তাজা রক্তের বিনিময়ে তা ছিনিয়ে আনার জন্যে বাঙ্গাল-ঈ শুধু একবার নয়, বারবার এগিয়ে যাবে নির্দ্বিধায়।


ভাষাকে ঘিরে লড়াই, সংগ্রাম আর ত্যাগের এহেন দুনিয়া-কাঁপানো ঘটনায় বাঙ্গাল-ঈ অহংকারে দীপ্ত হয়ে উঠতেই পারে, নয় কি! তাই তো ফেব্রুয়ারীর একদম শুরুতেই দেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় উত্তাল উৎসব। প্রকৃতিও বুঝি তাতে যোগ দেয় পরম আনন্দে-গৌরবে। ফাগুনের আগুনে রাঙ্গানো কৃষ্ণচূড়া-পলাশ-শিমূল মাথা উঁচু করে গেয়ে ওঠে, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী।


দেশে, অমর একুশের অন্যতম প্রধান আর্কষণ ‘একুশে বইমেলা’। প্রায় সারা বছর ধরে লেখক-প্রকাশক আর পাঠক-সাধারণ, অর্থাৎ আমরা, কী আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম এ-মেলার জন্যে! ঢাকা শহরে বাংলা একাডেমীর সুবিশাল প্রাঙ্গণ নিয়ে গড়া এই বইমেলায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল (টেকনাফ থেকে তেঁতুনিয়া) থেকে দলে দলে হাজির হতেন বইপ্রেমীরা।


স্মৃতির গভীরে এখনো জ্বলজ্বলে হয়ে আছে, রাজ্যের ভিড়ভাট্টা, যানজট, হট্টগোল সবার উপরে ধুলোয় ধুলোয় ধূসরিত একাডেমী প্রাঙ্গণ – কোন কিছুই, কখনো, বাধা হতে পারেনি আমাদের নতুন বই-এর প্রথম গন্ধ নেবার পাগলপনার কাছে। নাকে-মুখে রঙ্গিণ রুমাল বেঁধে আমরা আতংকবাদীদের মত চষে বেড়াতাম বইমেলার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। চারপাশের যন্ত্রযানের দুঃসহ, বিকট আওয়াজ, এলোমেলো অগুন্তি রিক্সার টুংটাং, ফেরিয়ালাদের অবিশ্রাম হাঁকডাক বা টিএসসির সড়কদ্বীপ থেকে ভেসে আসা উন্মাতাল সংগীতের শব্দ পেরিয়ে বই মেলার ভেতরে ঢুকে পড়তে পারলেই যেন একুশের প্রাণ প্রতিষ্ঠা।


তখন ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভাল – এমন এক আচ্ছন্ন-দিশেহারা ভাব। হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, কার আগে কে কত বেশী বই কিনতে পারে তা নিয়ে।


আরো মনে পড়ে সেই শিকারীর মত ওঁত পেতে বসে থাকা। কে কার আগে প্রিয় কবি-লেখকের স্বাক্ষর নিতে পারে! সই নিতে গিয়ে কেউ অযাচিতভাবে কিছু বাড়তি শব্দ-বাক্য পেয়ে গেলে তা নিয়ে সে কি রংগ-রসিকতা! কত চাপা অভিমান, মনকষাকষি…

মরে যাব তবু ভুলব না সেই আশ্চর্য দিনগুলি। আহা, বসন্ত-ভালবাসা দিবস, একুশের আবেগে রঙ্গিন হয়ে ওঠা আমাদের সেই একুশে গ্রন্থমেলা, আজ ও অমর, অম্লান !


আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙ্গান ফেব্রুয়ারী!


তারপর আসতো একুশের সেই দিন! ছাত্রকালীন সময়গুলোতে একুশের ভোর বেলাতেই ঘুম থেকে চটপট উঠে পড়া – তখন ফেব্রুয়ারী মাসের ২১ তারিখেও চারদিকে বেশ শীতশীত ছোঁয়া, কুয়াশাভেজা শীতের অন্ধকার ভোরে প্রভাতফেরীর প্রস্ততি নেওয়া। পরণে কালোপাড়ের শাদা শাড়ি, খালি পা, হাতে ফুলের তোড়া, সদ্য-ঘুম-ভাঙ্গা চোখ অহংকারে উজ্জ্বল।


মিছিল করে বহুদূর হেঁটে (শহীদ মিনারে জুতো পায়ে কেউ যায় না) যাবার কষ্টকে, কষ্ট বলে মনেই হয়নি কখনও। সারি বেঁধে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গান একুশে ফেব্রুয়ারী’ গাইতে গাইতে সবাই যখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এসে দাঁড়াতাম, গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠত। স্পষ্ট চোখের ওপর ভেসে উঠত, বাহান্ন’র সেই রক্তভাসা দিন। সালাম-রফিক-বরকত আর নাম না জানা যত শহীদের তীব্র প্রতিবাদে মুখরিত সে’দিনের সেই ২১শে ফেব্রুয়ারী !!


একুশে মানেই মাথা নত না করা!


আজ এই মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে একবার আবার বলি, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা আমাদের বাংলাভাষা নিয়ে অহংকারে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি, তাঁদের আমরা ভুলব না।


“সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ, সেখানে হাজার বছর পরে
সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে থেকে তোমাদের স্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার ভেসে আসবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মত জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।”


একুশের সংগ্রামী ভালোবাসা নিও।


তোমার,
বৃষ্টি।


3 Responses to “একুশের চিঠি”

  1. Caesar said

    Mishti-di, eto kom lekho kyano? Aami saamne thaakle tomaay chaabuk mere aaro-aaro lekhataam.

  2. Caesar said

    Sorry, Brishti-di. Jachchetai typo korechhi! 😦

  3. Brishti dir lekha gulo normally mishti hoi…tai typo take ograjyo kora jete pare…by the way great piece. aro chai! 🙂

Leave a comment