দাদুর গল্প
Posted by bangalnama on March 9, 2009
দাদু-নাতি সম্পর্কটা মনে হয় দুনিয়ার সেরা আদুরে সম্পর্ক। নাতনীরা দোষ নেবেন না যেন, পোলিটিক্যালি কারেক্ট হতে বলি, নাতি মানে পুং-স্ত্রী সকলেই। দুনিয়ায় এমন কে আছে যে কারুর না কারুর নাতি বা নাতনী নয়! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সকলের কপালে দাদুর আদর খাওয়া হয়ে ওঠে না। আমার ঠাকুর্দাদা মারা গিয়েছিলেন যখন আমার বছর খানেক বয়স। দাদু(মাতামহ) থাকতেন কলকাতায়, আর আমরা শিলিগুড়িতে। তাই, যদিও উনি আমাকে খুবই ভালবাসতেন, দেখা হত ন’মাসে ছ’মাসে একবার। এঁরা ছাড়াও, আমার সৌভাগ্য যে আমি আরেকজন দাদুর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম।
তাঁর নাম গোপীমোহন রায়চৌধুরী। উনি আমার কিরকম দাদু হন তা আমি বহুদিন পর্যন্ত জানতাম না। ছোটবেলায় জানার খুব একটা ইচ্ছেও হয়নি, প্রয়োজনও ছিল না। মা একবার বলেছিলেন যে উনি বাবার খুড়ো হন। মা ও ডাকতেন তাঁকে কাকাবাবু বলেই। সুতরাং ব্যাপারটা মানিয়ে গেছিল।
আমরা যদিও পূর্ববঙ্গীয় ছিলাম, মা ও বাবা পড়াশোনা করেন কলকাতায়। তাই আমাদের ভাষায় পূর্ববঙ্গীয় ছাপ খুব একটা ছিল না। যদিও বাবা মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে কথায় বাঙাল ভাষা ব্যবহার করতেন। আমি বলতাম শিলিগুড়ির একটা লোকাল ডায়ালেক্ট যেটা বাঙাল ভাষার গা-ঘেঁষা একটা উপভাষা বা ‘sub’ভাষা বলা চলে। কিন্তু দাদু বলতেন পাঁড় বাঙাল ভাষা, তাই দাদুর কথাবার্তা-গল্পসল্প সবই একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছত। এখানে ছোট্ট করে দাদুর একটা বর্ণনা দিয়ে নিই। দাদু লম্বা-চওড়া লোক ছিলেন, যদিও এখন দাদুর ছবি দেখলে কেউ আর সেকথা বিশ্বাস করবে না। অবশ্য বয়সও তো অনেক হল। তাই সেটাই স্বাভাবিক, না? যতদূর মনে পড়ে, কোনোদিনও দাদুর মাথায় একটাও কালো চুল দেখিনি। দাদুর মাথাভরা সাদা চুল ছিল, টাক ছিল না। ভারী বাহারে পরিপাটি করে মাথায় তেল মেখে সোনার বোতাম লাগানো পরিষ্কার সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে দাদু বেরোতেন – সকালে একবার আর সন্ধ্যাবেলায় একবার। রিকশায় ওঠা পছন্দ করতেন না তেমন। রুপো-বাঁধানো লাঠি হাতে টানটান হেঁটে যাওয়া দাদুর শরীরটা একটা চেনা চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল শিলিগুড়িতে।
দাদুর বিছানায় সারা বছর কম্বল পাতা থাকত। সেযুগে শিলিগুড়িতে বিশেষ গরম পড়ত না। দাদুর বিছানায় দাদুর কোলের কাছে আধশোয়া হয়ে বহু গল্প শুনেছি। সে গল্পে রাজপুত্র-রাজকন্যা থাকত না। আমার দাদু বানিয়ে গল্প বলতেন না। বলতেন তাঁর জীবনের নানা গল্প। আজ সেই গল্পের কিছু স্মৃতিচারণা করব।
[একটা ছোট্ট disclaimer দিই এখানে, যে এই গল্পগুলো আমার ছোটবেলায় শোনা আর গতবার বাড়ি গিয়ে নেওয়া দাদুর একটা সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে লেখা। দাদুর বয়স এখন ৯৫-৯৬ (ঠিক করে বলতে পারেন না, কত)। স্মৃতিশক্তি বেশ কমে এসেছে আর কানেও ঠিক করে শুনতে পান না। তাই সাক্ষাৎকার নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল, আর গল্পের কালরেখা অনেকাংশেই বুঝতে পারছিলাম না। দাদু নিজের খেয়ালে গল্প বলে চলেছিলেন তাঁর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় নিয়ে। আমি আমার মত করে সেটাকে সাজাবার চেষ্টা করেছি। পাঠকরা ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]
পূর্ববঙ্গের সিলেট জেলায় রামপুর গ্রামে দাদুর জন্ম। দাদুর ঠাকুর্দা ছিলেন ব্রিটিশযুগের খেতাবধারী জমিদার, সেই সুত্রেই প্রাপ্ত পদবী। তবে দাদুর বাবা ছিলেন একনিষ্ঠ বৈষ্ণব, জমিদারীর কাজকর্মে তাঁর মন ছিল না। সকালে উঠে বেলা তিনটে পর্যন্ত তিনি পূজার্চনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। জমিদারীর সমস্ত কাজকর্ম চালাতেন একজন বাজার সরকার গোছের ভদ্রলোক।
দাদু বিশেষ পড়াশোনা করেননি। সে আমলে পাড়াগাঁয়ে পড়াশোনার তেমন চল তো ছিলই না, উপরন্তু দাদুর বিশেষ মনোযোগও ছিল না পড়াশোনায়। তবে গাঁয়ের পাঠশালায় গিয়ে অক্ষরজ্ঞানটা তাঁর হয়েছিল। তারপর একটু দূরের এক স্কুলেও তিনি কিছুদিন যাতায়াত করেন, তবে তা বিশেষ কার্যকর হয়নি।
ঠিক কি কারণে জানি না, দাদু বাড়ি ছাড়েন একবস্ত্রে। আজও দাদুকে জিজ্ঞেস করলেও কিছুতেই বলেন না কেন তিনি বাড়ি ছাড়লেন। বাবা কে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম, সম্ভবতঃ বিষয়সম্পত্তি নিয়ে কোনো বিতর্কে তিনি সমস্ত আত্মীয়পরিজনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে একদিন গৃহত্যাগী হয়ে বেরিয়ে পড়েন। নিঃসম্বল অবস্থায় তিনি ঘুরে বেড়ান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
ছোটবেলা থেকেই গানবাজনার প্রতি দাদুর আগ্রহ ছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর তিনি বিভিন্ন জায়গায় গানবাজনা শেখেন। এরমধ্যে বেশ কিছুদিন তিনি বাউল-ফকিরদের সাথে এক কুঁড়েতে থেকেছেন। তাদের ভিক্ষা করে আনা চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খেতেন। তাদের কাছে বাউল গান শিখেছেন। এইরকমই ঘুরতে ঘুরতে একদিন দাদু এসে পৌঁছলেন মাইহার।
মাইহারে দাদু গান ও সেতার বাজানো শেখেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খান ও তাঁর ভাই উস্তাদ আয়েত আলি খানের কাছে। দাদুর মুখে আলাউদ্দিন সাহেবের অনেক গল্প শুনেছি। আয়েত আলি সাহেবের বাদ্যযন্ত্রের দোকান ছিল। সেখানেই সন্ধ্যাবেলায় সব ছাত্রদের এক আড্ডা বসত। তার মধ্যমণি হয়ে বসতেন আলাউদ্দিন সাহেব।
দাদু বলেন, আলাউদ্দিন সাহেবের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ব্রাহ্মণ সেবায়েত, সিলেটের কোনো মন্দিরে। এক খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ে তাঁরা ধর্মচ্যুত হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। এটা অবশ্য কতদূর সত্যি-মিথ্যে দাদু জানেন না, তবে সে আমলে মাইহারের সকলেই এ ঘটনা জানত।
আলাউদ্দিন সাহেবের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী আজকালকার দিনে গোঁড়া মৌলবাদীদের কাছে একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। তিনি খুবই ধার্মিক মুসলমান ছিলেন, আবার একই সঙ্গে সঙ্গীত সাধনার জন্যে তাঁর স্থাপিত এক সরস্বতী মন্দিরও ছিল। সেখানে তিনি সঙ্গীত সাধনা করতেন। আলাউদ্দিনের বড়ভাইয়ের নামটা দাদু বিছুতেই মনে করতে পারলেন না। কিন্তু মেজভাই হলেন আফতাবউদ্দিন মিঁয়া। তিনি ছিলেন কালীসাধক। তাঁর তিন মেয়ের নাম আবার চপলা, বগলা ও বাসন্তী। এর পরের ভাই ছিলেন আয়েত আলি। ইনি ছিলেন দাদুর সেতার-শিক্ষক।
আলাউদ্দিন সাহেব ছোটখাটো চেহারার লোক ছিলেন। কিন্তু দাদু বলেন তাঁর রাগ ছিল সাঙ্ঘাতিক। মাইহারের রাজা ছিলেন আলাউদ্দিন সাহেবের ছাত্র। রাজাকে তিনি শেখাতেন বেহালা বাজানো। একদিন কি এক কান্ড হয়েছে, রাজা খুবই ভুল বাজাচ্ছেন, আলাউদ্দিন গেলেন ভয়ঙ্কর চটে, দিলেন এক বেহালার ছড়ের বাড়ি বসিয়ে রাজার পিঠে। বসিয়ে দিয়ে আলাউদ্দিনের খেয়াল হল এ কি করলেন তিনি! চুপচাপ বেহালা গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। পরের দিন আর যাননি বেহালা শেখাতে। ভেবেছেন এত বড় অপমান কি আর রাজার সহ্য হবে, উনি নিশ্চয়ই তাঁকে ছাঁটাই করবেন এবার সঙ্গীত-শিক্ষকের পদ থেকে। এরকম ভাবে কিছুদিন গেল। রাজা খোঁজ নিতে দূত পাঠালেন, সাহেব কেন আর আসেন না বেহালা শেখাতে। সব ব্যাপার শুনতে পেয়ে তিনি নিজে এলেন আলাউদ্দিনের বাড়ি। পা ছুঁয়ে প্রণাম করে তাঁকে সাদরে ডেকে নিয়ে গেলেন বেহালা শেখাতে।
ছেলেবেলায় আলাউদ্দিন বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। কলকাতার রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন – এই অবস্থা থেকে একদিন নুলুবাবু নামে এক উদার ভদ্রলোক তাঁকে বাড়ি নিয়ে যান। ইনি গানবাজনার শৌখীন ছিলেন। আলাউদ্দিনের বড়ভাইয়ের বাজনদারের দল ছিল। তাই বাড়িতে বাদ্যযন্ত্রের অভাব ছিল না। আলাউদ্দিন ছোটবেলা থেকেই সেইসবে হাত পাকিয়েছেন। তবে, বলা যায়, নুলুবাবুই আলাউদ্দিনকে স্বরগ্রাম ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে প্রথম শিক্ষা দেন। নুলুবাবু ছিলেন কঠিন শিক্ষক। তাঁর কাছে আলাউদ্দিনের হাতেখড়ি বৃথা যায়নি। তিনি আলাউদ্দিনকে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে পরিপক্ক করে তোলেন। দাদুর কাছে শুনেছি, আলাউদ্দিন তিনশো-সাড়ে তিনশো স্বরগ্রাম মুখস্থ রাখতে পারতেন সেইসময়।
আলাউদ্দিন এরপর গান শেখেন ওয়াজির খান সাহেবের কাছে। ইনি তানসেনের দৌহিত্র-বংশীয়। নবাবের দরবারে রাজসঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন ওয়াজির খান সাহেব। আলাউদ্দিন একদিন পাড়ি দিলেন রামপুর – এনার কাছে সরোদ শিখবেন বলে। কিন্তু গেলেই তো আর দেখা পাওয়া যায় না। তিনি মানীগুণী লোক আর আলাউদ্দিন এক পুঁচকে ছোকরা। সাহেবের বাড়িতে ঢুকতে গেলে দারোয়ান দেয় গলাধাক্কা। তাই অপেক্ষা করতে হল বেশ কিছুদিন।
একদিন রাস্তায় দেখেন ওয়াজির খান সাহেবের গাড়ি যাচ্ছে। আলাউদ্দিন একটা চিঠি লিখলেন। তাতে লিখলেন তিনি বহুদেশ ঘুরে এসেছেন সাহেবের কাছে গান শিখবেন বলে, কিন্তু তাঁকে কিছুতেই দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদি তিনি গান না শেখান তাহলে আলাউদ্দিন আত্মহত্যা করবেন। পরের দিন দাঁড়িয়ে রইলেন রাস্তায়। খান সাহেবের গাড়িটা কাছে আসতেই চিরকুটটা টুক করে ফেলে এলেন গাড়ির মধ্যে। আর সঙ্গে সঙ্গে হইহই রইরই রব। দারোয়ান কোচোয়ান সবাই এই মারে তো সেই মারে। তখন খান সাহেব চিঠি পড়ে দেখেন এই ব্যাপার।
তিনি আদেশ করলেন ছোকরাকে নিয়ে আসতে তাঁর বাড়িতে। সেদিনকেই আবার নবাবের বাড়িতে সঙ্গীতানুষ্ঠান ছিল আর বেহালা বাদক হয়ে পড়েছিলেন অসুস্থ। ওয়াজির খান ডেকে জিজ্ঞেস করলেন সে বেহালা বাজাতে পারে কিনা। আলাউদ্দিন অনেকদিন স্টার থিয়েটারে বেহালা বাজিয়েছেন। বেহালায় তাঁর হাত ভালোই পাকা, তিনিও সটান ঘাড় নেড়ে দিলেন।
সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু হতে সবাই অবাক – এক পুঁচকে ছোকরা বেহালা নিয়ে এসেছে বাজাবে বলে। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে আলাউদ্দিন যা বাজালেন সে শুনে নবাব তো নবাব, স্বয়ং ওয়াজির খান সাহেবও মুগ্ধ হয়ে গেলেন। আলাউদ্দিন ছাত্র হলেন খান সাহেবের। দাদু আয়েত আলি সাহেবের মুখে শুনেছেন, তিনি ওয়াজির খানের প্রিয় ছাত্র ছিলেন। তবে তাতে চড়-চাপটা খাওয়া থেকে মুক্তি মিলত না। ভুলচুক হলে খান সাহেবের কাছে গালাগালও শুনতে হত। তবে সেই পরিশ্রমের ফল যে কি মিঠে, সে যারা আলাউদ্দিন খান সাহেবের বাজনা শুনেছেন সকলেই জানেন।
একবার নাকি ওয়াজির খান সাহেব তাঁর সব সেরা ছাত্রদের ডেকে পরীক্ষা নিয়েছিলেন স্বরগ্রামের। কে কটা বাজাতে পারে একটানা। এক এক করে সবাই বাজায় কিন্তু কেউ আর গোটা পঞ্চাশেকের উপর একটানা বাজাতে পারে না। আলাউদ্দিনকে বলতেই তিনি শুরু করলেন। পেছনে রয়েছে নুলুবাবুর দেওয়া স্বরগ্রামশিক্ষা। তিনি বাজিয়ে চললেন সাড়ে তিনশো স্বরগ্রাম। ওয়াজির খান সাহেব বেজায় খুশি হয়েছিলেন সেদিন।
দাদুর কাছে আরো অনেক গল্প শুনেছি আলাউদ্দিন সাহেব এবং তাঁর ভাইদের ও পরিবারের। দাদু যখন আয়েত আলি সাহেবের বাড়ি গেছেন, আলাউদ্দিন সাহেবের স্ত্রী তখন বেশ অসুস্থ। অনেক লোকজন এসেছে দেখা করতে। এদিকে তাঁর ছোট মেয়ে এসে চাচার বাড়িতে আয়েত আলির দুই মেয়ে রিজিয়া ও মমতার সাথে খেলে বেড়াচ্ছে। আলাউদ্দিন ছোটখাটো হলেও বেশ রাগী পুরুষ ছিলেন। রেগেমেগে হাঁক পাড়লেন, “অন্নপূর্ণা, তর মায়ের লগে দ্যাখা করতে কত দূর থিক্যা লোক আইসে আর তুই এইখানে খ্যালতাসিস!” দাদুর সেই প্রথম অন্নপূর্ণা-দর্শন। দাদু তো খুব অবাক – শেখের ঘরে অন্নপূর্ণা! দাদু গিয়ে শুধালেন আয়েত আলি সাহেবকে। তিনি বললেন, “বাবা, আমাগো বাড়িতে ওসব কিছু নাই। আমার তো সুটো মাইয়াটার নাম মমতা, ওই দাদাই রাখসে।”
পরবর্তীকালে এই অন্নপূর্ণার সাথেই রবিশঙ্করের বিবাহ স্থির হয়। আলাউদ্দিনের ছাত্র তিমিরবরণ ভট্টাচার্য্য সম্বন্ধ এনেছিলেন। অনেকেই সেই সময়ে ভীত ছিলেন যে সাহেব রাজি হবেন কিনা। কিন্তু আলাউদ্দিন সম্পূর্ণ অন্য মানসিকতার লোক। তিনি এককথায় রাজি, উপরন্তু বললেন যে বিবাহ যেন হিন্দুধর্ম মতে হয় আর অন্নপূর্ণাকে দীক্ষা দিয়ে যেন হিন্দু করে নেওয়া হয়। সেই আমলে অনেকেই রুষ্ট হয়েছিলেন, আলাউদ্দিনের উপর, এই নিয়ে।
[আবার আলাউদ্দিনের গল্প থেকে দাদুর গল্পে ফিরে আসি।]
দাদু পরবর্তীকালে মাইহার থেকে ময়মনসিংহে যান গান শিখতে। সেখানকার শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন সে আমলে ললিত সেন কবিরাজ। তাঁর ছেলের কাছে দাদু গান শেখেন পার্টিশন অব্দি। পার্টিশনের পরে দাদু চলে যান আসাম। এই সময়েই হাওড়ার সাঁতরাগাছির রমেন চৌধুরি ট্রান্সফার হয়ে আসেন গৌহাটিতে। দাদু এনার কাছেও কিছুদিন যাতায়াত করেন। পরবর্তীকালে দাদু গায়কী সেখার জন্য যান বীরন ফুল্কানের কাছে।
এই অব্দি শুনে আমার মনে একটা খটকা জেগেছিল যে গায়কী জিনিসটা কি। দাদু বললেন যে গান গায় সে জানে গায়কী জিনিসটা কি। এটা হল গানের মধ্যে আত্মার মত। গানে প্রাণ আসে না গায়কী না জানলে। যাইহোক আমার মত বেসুরো কাবুলিওয়ালার (এই নামেই দাদু আমাকে ডাকতেন যখনই আমি একটু নিভৃতে গুনগুন করার চেষ্টা করতাম) পক্ষে সেসব বোঝা সম্ভব নয়।
এইসময়েই তিনি গৌহাটিতে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে সেতার বাজাতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে রবিশঙ্করের সাথেও বাজিয়েছেন। এরপর যখন আসামে বঙ্গাল-খেদা আন্দোলন শুরু হল, তখন দাদু চলে আসেন শিলিগুড়িতে। আমার দাদুর সাথে তাঁর পরিচয় ছিল পান্ডুতে থাকাকালীন। তখন আমার দাদু (পিতামহ) ছিলেন সেখানকার স্টেশনমাস্টার। সেই সুত্রেই আলাপ। এরপর যখন তিনি শিলিগুড়িতে এলেন, প্রথমদিকে এক ছাত্রীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। এবং তার কিছুদিন পরেই আমাদের বাড়িতে ওঠেন।
দাদু যে আমলের ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলেন সেই অনুসারে এখনকার সঙ্গীতকলা তাঁর পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। হয়ও না। তাঁর লেখা অনেক গান, স্বরলিপি তিনি দান করে দিয়েছেন তাঁর ছাত্রদের। এখনো অনেক পড়ে রয়েছে। সেগুলোর উপর অব্যবহারে ধুলো জমছে। ইদানিং বেশ অশক্ত হয়ে পড়েছেন। আসলে আমাদের পরিবার যখন কলকাতা শহরে চলে আসে, তিনি খুব একটা রাজি ছিলেন না। তাঁর যে পরিচিতি ছিল শিলিগুড়িতে, সেটা ছেড়ে আসতে চাননি। হয়তো কলকাতা চলে আসাটা আমার মা-বাবার একটা আত্মকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত ছিল কারণ আমাদের সমস্ত আত্মীয়স্বজন কলকাতায়। তাই তাঁরা বুঝতে চাননি, দাদুর গানের যে ভুবন শিলিগুড়িতে ফেলে রেখে চলে আসতে হল সেটা তাঁর ভাল লাগেনি। কলকাতায় এসে আজকাল তিনি ঘরের মধ্যেই জীবন কাটান। সেই পেশীবহুল শক্ত চেহারায় কালের ধর্মে জরা এসে জায়গা নিয়েছে। আর সেই সঙ্গীতসাধক, জীবনের-সর্ব-অভিজ্ঞতায়-উৎফুল্ল, সকালে-সন্ধ্যায়-বিচরণকারী দাদু এখন সদা মৃত্যুকামনায় রত।
দাদুর গল্প বলতে শুরু করলে শেষ করা যায় না। পঁচানব্বইটা বছরের এই বিচিত্র জীবনকাহিনীকে চার-পাঁচ পাতায় লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। তবু যেটুকু পারলাম লিখে রাখলাম। হয়তো দাদুর শেষচিহ্ন হিসাবে এই লেখাগুলো রয়ে যাবে। দাদুর বলা গল্প আমার মুখে শুনে যদি ভালো লাগে তাহলে তাঁর নিজের মুখে বলা জীবনকাহিনী শোনার জন্য esnips-এ একটা ফোল্ডার খুলেছি। নিচে link দিলাম। শুনতে পারো!
।। esnips-এ দাদুর (শ্রী গোপীমোহন রায়চৌধুরীর) সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ ।।
-রচনা ও ছবি সৌজন্যে: অঙ্কন পাল
[বাংলায় প্রতিলিখন – প্রিয়াঙ্কা রায়]
Related
This entry was posted on March 9, 2009 at 6:12 pm and is filed under ছোটবেলা, ফিরে দেখা, বাঙাল, সংগীত, স্মৃতিচারণা. Tagged: Alauddin, Alauddin Khan, All India Radio, Annapurna Devi, Ayet Ali Khan, ফিরে দেখা, সিলেট, Bangal Kheda, Biren Phulkan, Gopi Mohon Raychaudhuri, Lalit Sen Kabiraj, Maihar, Nulo Gopal, Ramen Chaudhuri, Rampur, Ravi Shankar, Siliguri, Star Theatre, Timirbaran Bhattacharya, Wazir Khan Beenkar. You can follow any responses to this entry through the RSS 2.0 feed. You can leave a response, or trackback from your own site.
Nilabhra Banerjee said
My thanks to Ankan for putting forward such a great article.
brishti aamaye said
ভীষণ ঝরঝরে আর অনেক অজানা তথ্য সমৃদ্ধ লেখা ।
কোথায়ও হোঁচট খেতে হয়না পড়ার সময়।
অংকন কে ধন্যবাদ,গোপীমোহন বাবু্র কথা এই প্রজন্মের বাংগালদের জানানোর জন্যে!
গোপীমোহন বাবুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে,অংকনের কাছ থেকে শিগগীর আর লেখা আশা করছি[:)]
The ancient mariner said
thenku thenku!! chesta korbo aro lekhar! 🙂
swati said
kromo bordhoman hok daadur kauthon[:)]
kallol lahiri said
আপনার লেখা খুব সুন্দর। কোনো এক স্মৃতি পথের দিশারী…এই ধরনের লেখা আজ খুব প্রয়োজন, বিশেষ করে আমরা যখন ভুলে যাচ্ছি…আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য গুলোকে…ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইলো…।
The Ancient Mariner said
dadu mara gelen soptaho khanek age. ami pashe thakte pari ni sesh somoi e… tar proti amar ei lekha tuku bohon koruk amar oseem srodhyarghyo! jekhanei thako, bhalo theko!