দাদু-নাতি সম্পর্কটা মনে হয় দুনিয়ার সেরা আদুরে সম্পর্ক। নাতনীরা দোষ নেবেন না যেন, পোলিটিক্যালি কারেক্ট হতে বলি, নাতি মানে পুং-স্ত্রী সকলেই। দুনিয়ায় এমন কে আছে যে কারুর না কারুর নাতি বা নাতনী নয়! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সকলের কপালে দাদুর আদর খাওয়া হয়ে ওঠে না। আমার ঠাকুর্দাদা মারা গিয়েছিলেন যখন আমার বছর খানেক বয়স। দাদু(মাতামহ) থাকতেন কলকাতায়, আর আমরা শিলিগুড়িতে। তাই, যদিও উনি আমাকে খুবই ভালবাসতেন, দেখা হত ন’মাসে ছ’মাসে একবার। এঁরা ছাড়াও, আমার সৌভাগ্য যে আমি আরেকজন দাদুর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম।
তাঁর নাম গোপীমোহন রায়চৌধুরী। উনি আমার কিরকম দাদু হন তা আমি বহুদিন পর্যন্ত জানতাম না। ছোটবেলায় জানার খুব একটা ইচ্ছেও হয়নি, প্রয়োজনও ছিল না। মা একবার বলেছিলেন যে উনি বাবার খুড়ো হন। মা ও ডাকতেন তাঁকে কাকাবাবু বলেই। সুতরাং ব্যাপারটা মানিয়ে গেছিল।
আমরা যদিও পূর্ববঙ্গীয় ছিলাম, মা ও বাবা পড়াশোনা করেন কলকাতায়। তাই আমাদের ভাষায় পূর্ববঙ্গীয় ছাপ খুব একটা ছিল না। যদিও বাবা মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে কথায় বাঙাল ভাষা ব্যবহার করতেন। আমি বলতাম শিলিগুড়ির একটা লোকাল ডায়ালেক্ট যেটা বাঙাল ভাষার গা-ঘেঁষা একটা উপভাষা বা ‘sub’ভাষা বলা চলে। কিন্তু দাদু বলতেন পাঁড় বাঙাল ভাষা, তাই দাদুর কথাবার্তা-গল্পসল্প সবই একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছত। এখানে ছোট্ট করে দাদুর একটা বর্ণনা দিয়ে নিই। দাদু লম্বা-চওড়া লোক ছিলেন, যদিও এখন দাদুর ছবি দেখলে কেউ আর সেকথা বিশ্বাস করবে না। অবশ্য বয়সও তো অনেক হল। তাই সেটাই স্বাভাবিক, না? যতদূর মনে পড়ে, কোনোদিনও দাদুর মাথায় একটাও কালো চুল দেখিনি। দাদুর মাথাভরা সাদা চুল ছিল, টাক ছিল না। ভারী বাহারে পরিপাটি করে মাথায় তেল মেখে সোনার বোতাম লাগানো পরিষ্কার সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে দাদু বেরোতেন – সকালে একবার আর সন্ধ্যাবেলায় একবার। রিকশায় ওঠা পছন্দ করতেন না তেমন। রুপো-বাঁধানো লাঠি হাতে টানটান হেঁটে যাওয়া দাদুর শরীরটা একটা চেনা চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল শিলিগুড়িতে।
দাদুর বিছানায় সারা বছর কম্বল পাতা থাকত। সেযুগে শিলিগুড়িতে বিশেষ গরম পড়ত না। দাদুর বিছানায় দাদুর কোলের কাছে আধশোয়া হয়ে বহু গল্প শুনেছি। সে গল্পে রাজপুত্র-রাজকন্যা থাকত না। আমার দাদু বানিয়ে গল্প বলতেন না। বলতেন তাঁর জীবনের নানা গল্প। আজ সেই গল্পের কিছু স্মৃতিচারণা করব।