বা ঙা ল না মা

আমার অবিশ্বাস ঃ হুমায়ুন আজ়াদ

Posted by bangalnama on August 31, 2009


উচ্ছৃঙ্খলতা গ্রাস করেছে সেই ছোট্ট থেকে। যতই চাই কন্সেন্ট্রেট করতে, হয় না। সবই বোধহয় কালপুরুষের প্রভাব – অস্থিরতা উপগ্রহের তাড়না। মোক্ষম সময়ে স্বজনদের ডোবানোটাও আমার সহজাত – এটা বাঙালনামার বন্ধুরা বোঝেন বিলক্ষণ। যাইহোক, বিবেকের ‘ইয়ে’ (আসলে ঘটি তো, তাই ‘ইসে’টা খুব একটা বেরোয় না) বলেও তো কিছু একটা হয়, তাই এই চিঠি/না-চিঠি/অ-চিঠি বা সেই জাতীয় কিছু।


পায়ের তলায় সর্ষে, ফতুয়ার পকেটে বিড়ি-লাইটার এবং হাতে হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ – এই নিয়েই আপাতত আমি। আজাদ পড়ছি অনেককাল। সত্যি বলতে কি, রাসেল বা মার্ক্সের ঢের আগে থেকেই আজাদ আমাকে আজাদ করেছেন কুলুঙ্গিতে রাখা ‘কেষ্টনগরীয়’ শিল্পকর্মের হাত থেকে। চরম প্রতিক্রিয়াশীল কেতাব থেকে শিখেছিলুম জীবনের তিনটি মহামন্ত্র – মাভৈ (ভয় করো না), মাগৃধ (লোভ করো না) এবং চরৈবেতি (এগিয়ে চলো); নন-কম্যুনিস্ট আজাদের লেখা পড়ে যুক্ত হয়েছে আরেকটি – “Knowledge never springs from faith. It springs from doubt.” ‘সভ্যতার সংকট’-এর একেবারে শেষে বৃদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, “মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ”; কিন্তু বলতে ভুলে গেছিলেন যে মানুষের শ্রেণীভিত্তি থাকে, তার ফলে গোটা সমাজটাকে বিশ্বাস করতে গেলে প্রোফ. ফার্মিকির সাথে রোঁলাকে একাসনে বসাতে হয় – জার্মানি-ভ্রমণ ও রাশিয়া-গমনের একই মানে দাঁড়ায়।


মোদ্দা কথা হল – আমার অবিশ্বাস দীর্ঘজীবী হোক!


যাক সে কথা, বলছিলাম তো আজাদকে নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর লাভ করে তরুণ বাঙালী যুবক পাড়ি জমিয়েছিলেন এডিনবরা য়ুনিভার্সিটিতে। ভাষাতত্ত্বের কৃতী ছাত্র, ফলে মনেপ্রাণে বিজ্ঞানী এবং স্বাভাবিকভাবেই ‘কি’, ‘কেন’, ‘কিভাবে’.. ইত্যকার শব্দের ওপর অধিক নির্ভরশীল। “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর” – আমার ঠাকুমার কাছে শোনা এই ‘বেদবাক্য’টির অ্যান্টিথিসিস গড়ে উঠেছে আজাদের শরীর জুড়ে সংবহনকারী সর্ববৃহৎ কোষের প্রতিটি কণার মধ্যে। অন্ধকারের আত্মজর সাথে বিদ্যুৎরেখার কন্ট্রাডিকশনটাও নেহাতই অ্যান্টাগনিস্টিক, ফলে দ্বান্দ্বিক য়ুনিটির কোনো গপ্প নেই, অন্ততঃ এই ক্ষেত্রে।


“তারা বা সূর্য-ই শুধু নয়, আমরাও মহাজগতের অধিবাসী, আমরাও ঘুরে চলেছি মহাজাগতিক গগনে; কিন্তু আমরা কোনো দেবতা দেখিনি, বিধাতা দেখিনি, যদিও এদের কথা দিনরাত শুনতে পাই। বিশ্বাসীরা ভীত আর লোভী মানুষ; অন্ধকারে থাকতেই তাদের আনন্দ।” — ‘আমার অবিশ্বাস’ – হুমায়ুন আজাদ


নদীমাতৃক সভ্যতার গড়ে ওঠা এবং তার পারে বসবাসকারীর কাছে ‘ফিশ প্রোটিন’-এর সহজলভ্যতা কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে। অবশ্য প্রাথমিক ভাবে উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধি এর কারণ। কিন্তু এইটাও তো সত্যি যে এই কল্পনাশক্তির দৃঢ়তা উৎকৃষ্টতার সাথে সাথে দান করেছে ধর্ম নামক নিকৃষ্টতাটাকে, যা তাকে ফেলে রেখেছে অন্ধকার এবং সংকীর্ণ মহাজগতের এক শোষিত অধিবাসী রূপে। কয়েক হাজার বছর পেরিয়েছে, তবু শহীদুল্লাহ সাহেব কানে কানে বলে চলেছেন, “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে..”


হিঁদু-মোছলমান-কেরেস্তান হবার পেছনে যেমন কাজ করেছে শোষক শ্রেণীর সাম্রাজ্য-বিস্তারের অভীপ্সা, তেমনি তা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে আমাদের শ্রেণীগত ক্রাইসিস এবং অবশ্যই “দীপহীন অপ্রত্যক্ষের” প্রতি বিশ্বাস। ক্যামেরা আবিষ্কারের পর হয়তো প্রত্যক্ষ বিষয়টাও গাঁজার ধোঁয়ার মতই ‘মায়া’, তবু তো প্রত্যক্ষ। সেরিব্রাল কাল্টিভেশনের মাধ্যমে সেটার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি। উদ্ধত ‘ভজ গৌরাঙ্গের’ তালে তালে স্বল্পবসনা নারী ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত হতে হতেও চিৎকার করে বলতে পারে, “চ্যালেঞ্জ নিবি না শালা!” পোড়ার দেশে এটুকুও যদি কেউ করত! বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সহ, সমস্ত আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশগুলোতে আজাদের মত লোকেদের গুরুত্ব এইখানেই – অন্ধকার নিরর্থকতার মাঝে “হঠাৎ আলোর ঝলকানি”।


“কয়েক হাজার বছর ধরে (শোষিত শ্রেণীর) মানুষ উৎপীড়িত হয়ে আসছে নানা নামের অতিমানবিক সত্তাদের দ্বারা। এই পীড়নে অবশ্য ভূমিকা নেই কল্পিত সত্তাদের, তারা কাউকে (প্রত্যক্ষ ভাবে) পীড়ন করে না, তারা জানেও না যে তারা আছে, সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের, কিন্তু তাদের নামে সুবিধাভোগী একদল মানুষ পীড়ন করে অন্য মানুষদের।” –‘আমার অবিশ্বাস’ – হুমায়ুন আজাদ


লৌহ-দৃঢ়তার সাথে এইসব কথা উচ্চারণ করলেও আজাদের চিন্তায় সমাজের শ্রেণীগত বৈষম্যগুলো ধরা পড়েনি। আদিম সাম্যবাদী অবস্থার পর থেকে উৎপাদনের শক্তির বিকাশের সাথে বেড়ে চলা বৈষম্য ও সংগ্রাম থেকে গেছে তাঁর অগোচরে। দ্বন্দ্বের দিকগুলো প্রচ্ছন্ন থেকেছে রাসেলের ‘Why I am Not a Christian’-এর মতই। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রতি সংকীর্ণমনা হবার ফলে তাঁর স্টেটমেন্টগুলো থেকে গেছে নিতান্তই ‘স্টেটমেন্ট’। তবু যে লোক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক ভিত ধরে হ্যাঁচকা টান দিতে পারেন, তাঁর প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য। নিরর্থকতার নিয়তিকে মেনে নিয়ে যে সিসিফাস নিয়তিকে ভাঙার স্বার্থে পাথর ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করে, তাকে অভিনন্দন জানানোটা আমার অবশ্য কর্তব্য – নাই বা হল তা রক্তিম।


ধর্ম প্রসঙ্গেও আজাদ উগ্র ক্রিটিকাল। ধর্ম বিষয়টাকেই রেখেছেন আক্রমণের বর্শাফলকের ডগায়। এই নিয়ে অতিরিক্ত দার্শনিক ডিসকোর্সের মধ্যে তিনি ঢোকেননি। সোজা কথাটা সোজাভাবে বলেছেন। ‘এটা পেগান, ওটা অর্গানাইজড,’ বা ‘পেগানটা অর্গানাইজডের চেয়ে ভাল,’ – এইজাতীয় অন্তঃসারশূন্য তর্কে প্রবেশ করেননি। এই প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। বছরখানেক আগে এক কবির ঘরে বসে ধর্ম নিয়ে বেশ কূট-তর্ক চলছিল। সকলেই প্রায় নেশায় বুঁদ, ফলে বেশিরভাগ কথাই অসংলগ্ন। এহেন আলোচনার মাঝে সবার মধ্যমণি কবি এবং অধ্যাপক ধর্মের ও রিলিজনের তফাত নিয়ে অনেকক্ষণ বললেন। সেই নিয়েও নানারকম তর্ক বেধে গেল। বামপন্থী অধ্যাপককেও দেখলাম নেশার ঘোরে পেগানিজমকে সমর্থন করতে গিয়ে হিন্দুইজমকে সমর্থন করে ফেললেন। হেসে ফেললাম। মট লেনের পানশালা থেকে আনানো দিশি মদের আগ্নেয় তরলে চুমুক দিয়ে বললাম, “আরে _ _ _‘দা, আপনি বোধহয় এঙ্গেলসের করা ফয়েরবাখের সমালোচনাটা পড়েননি। বর্তমানকালের ব্যবহারিক প্রয়োগ না দেখে তর্ক করলে বাহবা জোটে বটে, ক্রাইসিসটা আইডেন্টিফায়েড হয় না। যাইহোক, কাবা’র পাথরটাও কিন্তু পেগান চরিত্র বহন করে। ওটার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে!” আসলে প্রয়োগহীন দর্শনের ফুটো দিয়ে হাতিও গলে যায় – বামপন্থীও ধার্মিক হয়, শ্রেণীশত্রু হয়ে ওঠে ‘রেড ক্যাপিটালিস্ট।’ বলাবাহুল্য, আজাদ এমন কোনো ‘ফুটো’ রাখেননি। সোজাসাপটা ঘোষণা করেছেন যে ধর্ম ব্যাপারটাকে অস্বীকার এবং পরিত্যাগের মধ্যে দিয়েই মানুষের এগিয়ে চলা। ধর্মের মধ্যে সাদা-কালো খুঁজতে যাওয়ার চেয়ে বড় মূর্খামি আর নেই, কারণ ধর্মের কোনো মানবিক অস্তিত্বই নেই। এটা একদল মানুষের ভীতিজাত বিকৃতি এবং তা ব্যবহার করেছে, সৃষ্টি করেছে, আরেকদল মানুষ, যাদের উদ্দেশ্য শোষণ-লুণ্ঠন – পিতৃতন্ত্রের ভিত মজবুত করা।


কাম সম্পর্কেও আজাদ যথেষ্ট সোচ্চার। বোকাচ্চিও’র ‘ডেকামেরন’-এর সেই সন্ত এবং তরুণীর শয়তানকে নরকে পুরে ফেলার গল্পটাও শুনিয়েছেন। সেক্স কিভাবে ট্যাবুতে রূপান্তরিত হয়েছে বা নারীর কামকে কিভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছে পুরুষ-সমাজ, সেই সম্বন্ধেও বেশ কয়েক পাতা জুড়ে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর অলক্ষ্যে থেকে গেছে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নটা। এক-বিবাহের প্রচলন যে আসলে নারীর হাত থেকে কাঠামোগত কর্তৃত্ব-উৎপাদনের উপায়ের প্রভুত্ব-লুণ্ঠনের একটা উপলক্ষ মাত্র, এটা তিনি কোথাও বলেননি। শুধু বহুগমনে যে মুক্তি আসে না, এটা মার্ক্সবাদের খুঁটিনাটিতে বিচরণ করার বহু আগেই জেনেছিলাম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়। তখন আমার বয়স কুড়ি কি একুশ। অনেকক্ষণের রতিক্রিয়ার পর পাশে শুয়ে সহপাঠিনী বলে উঠল, “তোর চেয়ে আকাশ বেটার। তুই ভীষণ উগ্র, ওয়াইল্ড। আকাশ অনেক প্যাশনেট।” এমন তথাকথিত আধুনিকা মেয়েটির মধ্যেই পরে দেখেছি নানারকম পিতৃতান্ত্রিক চিন্তার নক্সা। সহস্র বছরের অর্থনৈতিক অবদমনটা মনে তৈরি করে দিয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি। ওটা শুধু বহুগমনে কাটে না। নারীমুক্তি কোনো ‘কাম-কেন্দ্রিক’ বিষয় নয়। ওটা প্রাথমিকভাবে কাঠামোগত, এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সংস্কৃতিগত প্রশ্ন। কোনো সোজা সল্যুশন নেই। এই জায়গায় আজাদের ব্যর্থতা। লক্ষ্য ভুলে উপলক্ষকে বড় দেখার সমস্যা তিনি তাঁর গুরুর থেকেই লাভ করেছেন। সমস্ত আদর্শকে চুরমার করতে গিয়ে অজান্তে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব এক ‘এস্ট্যাবলিশমেন্ট।’


আজাদ বাস্তববাদী। জীবনকে তাই তিনি বলেছেন ‘নিরর্থক।’ কারণ যা জন্মেছে, যা বিকশিত হয়েছে, তার পরিণতি বিনষ্ট হওয়া। বলাবাহুল্য, এটি আজাদের আরো একটি সমস্যা। বাস্তবের উপাসনায় তিনি বস্তুকে অস্বীকার করেছেন। হেসি’র সিদ্ধার্থ জীবনের শেষে এসে বুঝেছিল, “This stone is not just a stone. It is an animal. It is the Buddha.” দুঃখের বিষয়, হেসি’র দেশে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা আজাদ তা বুঝলেন না। বস্তুর গতিপরিবর্তন, বিকাশ এবং রূপান্তরের অভিমুখটাই যে বস্তুজগতের সার, এইটা অন্ধকারেই থেকে গেল।


তবু আজাদ আজাদই। কাঠমোল্লা-সহ সমস্ত ধর্মগুরুর আতঙ্কের নাম হুমায়ুন আজাদ। আজও তিনি বাংলাদেশের আপামর (শিক্ষিত) জনগণের কাছে ব্রাত্য। এই বঙ্গেও তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা নিতান্ত কম। তবু শতাধিক সমস্যা নিয়েও আজাদ একশোভাগ সামাজিক। নির্বাসিত লেখিকার ভক্তরা যদি দয়া করে ওঁর লেখাগুলো পড়েন, তাহলে তাঁদের শিক্ষার মানের উন্নয়নের সাথে সাথে মনে জমে থাকা কালিগুলোও দূর হবে।


একটি ব্যক্তিগত ডিসক্লেমারঃ উত্তরবঙ্গের খরস্রোতা নদীর জলোচ্ছ্বাস আমার কপাল জুড়ে ফ্রয়েডিয়ান ঘামের বিন্দু তৈরি করলেও লেখাটা জার্গন-সর্বস্বই রয়ে গেল। কি আর করা…হয়তো কোনো একদিন…


লিখেছেন – বাসু আচার্য্য

One Response to “আমার অবিশ্বাস ঃ হুমায়ুন আজ়াদ”

  1. brishti said

    পূজাসংখ্যায় যেমন প্রথমেই বিশেষ প্রিয় লেখকের লেখা খুঁজি পড়ে ফেলি,ঠিক তেমনই বাঙ্গালনামায় বাসু আচার্য্য আমার প্রথম পছন্দ 🙂
    আমার সাক্ষাত শিক্ষাগুরু কে নিয়ে বাসুর লেখা টা অসম্ভব ভাল লাগল ।
    বড্ড ভাল লেখে বাসু 🙂

Leave a comment