জীবন তরীর সফর – পর্ব এক
Posted by bangalnama on December 31, 2009
প্রাক-কথন ঃ এই লেখাটা সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলার আছে। এটা একটা জীবনকথা হয়েও ঠিক জীবনকথা নয়। এটা একজন অত্যন্ত সাধারণ মানুষের বড় হয়ে ওঠার গল্প, তাঁর বাল্যকাল থেকে বার্ধক্যে পৌঁছনোর কাহিনী। তাঁর চোখ দিয়ে দেশভাগ আর তার প্রভাবকে ফিরে দেখা, আর সময়ের দ্রুত বদলে যাওয়া-কে মাপার চেষ্টা করা। এই লেখার রসদ কিছুটা তাঁর নিজের মুখ থেকে শোনা, কিছুটা আশপাশের লোকের মুখ থেকে, আর বাকিটা বিভিন্ন সময়ে ওঁর কথাবার্তা থেকে আন্দাজ করে নেওয়া। সেই জন্যই এটা গল্প, জীবনী নয়। ওঁর জীবনের ইতিবৃত্তের এই Jigsaw Puzzle টা কতটা সমাধান করতে পেরেছি, মানে ছবিটা কতটা স্পষ্ট আর উপভোগ্য হয়েছে, সেটা পাঠক বিচার করবেন। শুধু একটা কথা – লেখাটার যা কিছু খামতি তার দায় আমি মাথা পেতে নিলাম; আর এটার মধ্যে উপাদেয় কিছু থেকে থাকলে তা বাঙালনামার সম্পাদকদের কৃতিত্ব। ওরা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে না নিলে এই লেখার জন্ম সম্ভব ছিলনা।
***
আস্তে আস্তে আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। তারাগুলো টুপ টুপ করে ডুবে যাচ্ছে। উঁচু উঁচু গাছের মাথাগুলো একটু একটু করে দেখা যাচ্ছে। এখনো সূর্য উঠতে দেরি আছে। শীতের সকাল হালকা একটা কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। পুকুরের জলের ওপরে পাতলা দুধের সরের মত কুয়াশা ভাসছে। হঠাৎ এই নিস্তব্ধ পরিবেশের মধ্যে একটা কাক ডেকে উঠল, তারপরে এক এক করে আরো কয়েকটা…। এক মুহূর্তে যেন আলোও অনেকটা বেড়ে গেল। আরেকটা দিন শুরু হয়ে গেল।
ঠিক এই সময়ে শ্যামের ঘুম ভাঙল। রোজই এই সময়েই ঘুম ভাঙে। কিছুটা অভ্যেসে, কিছুটা বাবা’র গম্ভীর স্বরে গীতা’র শ্লোক আবৃত্তির আওয়াজে। বাবা রাখালচন্দ্র স্থানীয় সাব-ডিভিশনাল স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার, একডাকে এই মাদারিপুর শহরের সকলে চেনে, ইংরেজি আর সংস্কৃত পড়ান। সম্পূর্ণ গীতা রাখালচন্দ্রের মুখস্থ। প্রত্যেকদিন সকালে উঠে তারই খানিকটা করে আবৃত্তি করেন তিনি, বালক শ্যাম ঘুম ভেঙে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শোনে আর মাথার কাছের খোলা জানলাটা দিয়ে আকাশটাকে আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে দেখে লেপের ভেতর থেকে মাথা বের করে। বাবার আবৃত্তি শেষ হয়, শ্যামও লেপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। বাবা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন, “কি রে খোকা! এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি?” শ্যাম কোনো উত্তর না দিয়ে হাসিমুখে একটা দাঁতন নিয়ে ছুটে যায় পুকুরপাড়ে। পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেখানে হালকা কুয়াশা ভাসছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা মাছরাঙা জলে ঝাঁপ দেয় আর মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে যায় জলের শান্ত সমাহিত রূপ। শ্যাম চোখ খুলে তাকায় দূরের মাঠের দিকে। দিগন্তে সু্য্যিঠাকুর উঠি উঠি করছেন, রোজকার আবির খেলা শুরু হয়ে গেছে। শ্যাম চাদরটাকে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওইদিকে। রোজের দেখা দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি দেখবার জন্যে মনে মনে তৈরি হয়।
শ্যামের ভালো নাম অমিতাভ, বাবার দেওয়া। যদিও স্কুলের বাইরে ওকে এই নামে ডাকার লোক প্রায় নেই, এক চক্রবর্তীদের বাড়ির মেয়ে সুষমা ছাড়া। শ্যাম স্কুলে যায়, পড়াশোনাও করে, কিন্তু ওর সারা মনপ্রাণ জুড়ে থাকে প্রকৃতি…এই মাদারিপুর ডিস্ট্রিক্ট টাউনের যে দিকটাতে ওরা বাসা ভাড়া করে থাকে সেদিকটাতে তাও খানিকটা প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায়, একদিকে বিস্তৃত মাঠ, আশেপাশে কিছু পুকুর আর গাছপালাও আছে। কিন্তু সেগুলো পেরোলেই ইউনিয়ন বোর্ডের মোরাম বিছানো রাস্তা, তারপরে সব বড় বড় দোচালা বাড়ি, স্কুল, ইউনিয়ন বোর্ড অফিস, বাজার…। ওর ভালো লাগে না, বার বার মনে পড়ে ওর গ্রামের বাড়ির কথা। বিক্রমপুর জিলার আইড়লখাঁ নদীর তীরে ওই একই নামের গ্রামের কথা…আহ! মনে হলেই যেন বুকটা ভরে যায়। ভাবতে ভাবতে শ্যাম বুকভরে বেশ কয়েকটা বড় বড় শ্বাস নেয়। যেন শুষে নিতে চায় এই ভোরের সব রঙ, রস, গন্ধ। ওদিকে মাঠের ওপারে সু্য্যিঠাকুরও টুপ করে একটা ছোট্ট লাফ মেরে উঠে পড়েন। ঘর থেকে মায়ের ডাক ভেসে আসে “শ্যাম!…কই গ্যালি রে? তর মুখ ধোয়ান হইল?”…“নাহ! হয় নাই, এই আসি…”, বলে শ্যাম ব্যস্ত হয়ে পড়ে দাঁতন নিয়ে। তার দিন শুরু।
ঘরে শ্যামের মা তখন ব্যস্ত সকলের জন্যে খাবার তৈরি করতে। স্বামী আর তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার, ছেলে শ্যাম আর জহর (রাখালচন্দ্রের রাখা নাম, বিখ্যাত দেশনেতার নামে), মেয়ে বকুল – যার ভালো নাম ইলোরা। শীতের সকালের জলখাবার বলতে সকলের জন্যে দুধ আর মুড়ি, সঙ্গে কলা আর খেজুরের গুড়। শ্যামের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। সকলের জন্যে মা এই খাবার তৈরি করতে করতেই শ্যাম মুখ ধুয়ে এসে হাজির। বোন বকুল আর ভাই জহরকে ঘুম থেকে তুলে আদর করে নিয়ে এসে চাটাই পেতে রান্নাঘরে বসে পড়ে খাওয়ার জন্যে। রাখালচন্দ্র একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখেন আর হাসেন, মনটা ভরে ওঠে কানায় কানায়। তাঁর হাতে দাঁতন আর তেলের শিশি। মুখ ধুয়ে চান করে তবে তাঁর দৈনিক কাজ শুরু হবে। তারপরে একটু পড়াশোনা করে তৈরি হবেন স্কুলে যাওয়ার জন্যে।
এই দে পরিবার আদতে বিক্রমপুর জিলার আইড়লখাঁ গ্রামের বাসিন্দা। রাখালচন্দ্র একেবারে শৈশবে বাবা-মা দু’জনকেই হারান, বড় হন নিজের বড়বৌদির কাছে। তাঁকেই ডাকেন মা বলে। আর সেই মা শৈশব থেকে বাল্যকাল আর তারপরে কৈশোরে তীক্ষ্ণ নজর রেখে গেছেন রাখালের ওপরে। তিনি নিজে নিরক্ষর, কিন্তু রাখালের পড়াশোনায় তাঁর থেকে কড়া নজর আর কারো ছিল না। একটা রেড়ির তেলের বড় প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়তে বসত বালক রাখাল, শর্ত, যতক্ষণ ওই প্রদীপের তেল শেষ হয়ে নিভে না যায়, ততক্ষণ পড়াশোনা চলবে। আর মা-ও বসে থাকবেন রাখালের পাশে। এই অপরিসীম ধৈর্য্য আর পরিশ্রমের ফল পেয়েছিলেন তিনি যেদিন রাখাল সমগ্র জিলার মধ্যে এন্ট্রান্সে প্রথম হয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করে। চোখের জল সামলাতে পারেননি তিনি, সারা গ্রাম ভেঙে পড়েছিল বাড়ির উঠোনে কিশোর রাখালকে দেখতে। আর আজকে এই ১৯৪৪ সালে যখন সেই রাখালচন্দ্র আই.এ. পাশ করে সাব-ডিভিশনাল স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার, তখন তিনি, বৃদ্ধা হেমনলিনী দেবীর মনে হয় তাঁর মানব জনম সার্থক, বিশেষত যখন রাখালের বড় ছেলে শ্যামকে দেখেন, তখন তাঁর এত ভালো লাগে যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না।
১৯৩৩ সালে যখন রাখালচন্দ্র প্রথম এই স্কুলে পড়াতে আসেন গ্রামের ছোট স্কুল ছেড়ে, তখন মনে মনে একটু শংকিতই ছিলেন। বড় স্কুল, অনেক ছাত্র, হেড মাস্টার একেবারে গ্র্যাজুয়েট। তাঁদের সঙ্গে কাজ করা, পারবেন তো! আজকে এগারো বছর পেরিয়ে এসে তিনি উন্নীত সেকেন্ড মাস্টার পদে, অসংখ্য ছাত্রের প্রিয় মাস্টারমশাই, তাঁকে ছাড়া স্কুল চালানোর কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। হেডমাস্টারমশাই যে কথাটা অনেকবার বলেছেন, আগের সপ্তাহে স্কুল পরিদর্শনে এসে স্বয়ং জিলা পরিদর্শক সেই কথা আবার বলে গেলেন- “মাস্টারমশাই, বি.এ.টা করা থাকলে আপনার জায়গা ঢাকার হাই স্কুলে বা কোনো সাব-ডিভিশনাল স্কুলের হেডমাস্টারের চেয়ারে।” রাখালচন্দ্র একটু হেসেছিলেন, তাঁর প্রয়োজন বা উচ্চাকাঙ্খা বরাবরই খুব কম, তিনি যা পেয়েছেন তাই নিয়েই ভীষণ খুশি। একটা ছোট পরিবার, অসংখ্য ছাত্রদল আর শ্রদ্ধা-ভালবাসায় ভরিয়ে রাখা সহকর্মী আর প্রতিবেশী। তাঁর আর চাওয়ার মত কিছুই নেই, চানও না। এখানে মাদারিপুরের এই শান্ত জীবনে তাঁর চেয়ে সুখী লোক আর কেউ নেই। প্রত্যেক ছুটিতে সপরিবারে যান আইড়লখাঁ গ্রামে, সেখানে বৃদ্ধ বড়দা হাল ধরে আছেন পরিবারের আর পারিবারিক ব্যবসার। সেই ছুটিগুলোও কাটে দারুণ খুশিতে।
(চলবে..)
লিখছেন – অরুণাভ দে
Related
This entry was posted on December 31, 2009 at 11:20 pm and is filed under ছোটবেলা, দেশভাগ, ফিরে দেখা, স্মৃতিচারণা, Stories. Tagged: Ariyalkha, ফিরে দেখা, Madaripur. You can follow any responses to this entry through the RSS 2.0 feed. You can leave a response, or trackback from your own site.
বৃষ্টি said
ক্রমশঃ প্রকাশ্য লেখাগুলো কিঞ্ছিৎ উদবেগ-উৎকঠায় রাখলেও অরুনাভ দে-র লেখাটা পড়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি,” চলুক,চলুক !”
ভাল লাগচ্ছে ঃ)