বা ঙা ল না মা

১৯৪৭ সালের ১২ই মার্চ বঙ্গীয় আইনসভায় জ্যোতি বসুর প্রদত্ত ভাষণ

Posted by bangalnama on June 1, 2010


“কৃষিজমির বর্গাদারকে তার উৎপাদিত ধানের দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ দেবার আইনসিদ্ধ অধিকার সরকার কর্তৃক পরিত্যাগ করার স্বেচ্ছা-প্রণোদিত এবং বিশ্বাসঘাতক নীতির আমি তীব্র বিরোধীতা করছি। কৃষকদের মধ্যে ৪১ শতাংশ-ই বর্গাদার। তারা যে ধান উৎপাদন করেন তার দুই-তৃতীয়াংশ তাদেরই প্রাপ্য। এ সম্পর্কে সরকার সম্পূর্ণ সচেতন। তাঁদের এই ন্যায্য দাবি ১৯৪০ সালে ভূমি রাজস্ব কমিশন কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। আশ্চর্যের হলেও মুহূর্তের বিস্মরণে এবং দর্শকদের সামনে অভিনয়ের সাময়িক খেয়ালে মন্ত্রী-পরিষদ বর্গাদারের ধানের দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ দেবার নীতিকে স্বীকার করে একটা খসরা বিল গ্রহন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এখন তা শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে।”


“মন্ত্রীসভার মনে রাখা উচিত যে, এইসব কৃষকেরা বছরের পর বছর তাঁদের দাবি পূরণের আশায় অপেক্ষা করছেন। এ সম্পর্কে ভূমি রাজস্ব কমিশন কর্তৃক বর্গাদারদের পক্ষে রিপোর্ট দাখিলের পরও তারা সাত বছর ধরে অপেক্ষা করছেন। এখনও তা কার্যকর হলো না। কিন্তু তারা দুই-তৃতীয়াংশ ভাগের সেই ন্যায্য দাবি যখন করেছেন তখনই আমরা আইন-শৃঙ্খলার প্রতি চ্যালেঞ্জের কথা শুনতে পাচ্ছি। আইন শৃঙ্খলার প্রতি চ্যালেঞ্জের কথা যখনই শোনা যাবে তখনই বুঝতে হবে যে, সেই আইন হচ্ছে শোষণ করার আইন এবং শৃঙ্খলা হচ্ছে কৃষক আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করার শৃঙ্খলা। তাই আমরা দেখি দূর দূর গ্রামে কৃষক ও বর্গাদারদের ঘর বাড়ি নিশ্চিহ্ন করার কাজে সরকারি যন্ত্রকে নিযুক্ত হতে। আমরা দেখি তাদের স্ত্রীলোককে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে। স্টেনগান, রিভলভার ও রাইফেল নিয়ে গ্রামাঞ্চলকে আতঙ্কিত করতে। বর্গাদারদের দাবিটা কোনো প্রচলিত সামাজিক রীতি নীতি পরিবর্তনের জন্য নয়। তথাপি, সরকার নিজেকে সমস্ত মানুষের না হলেও অন্ততঃ মুসলমানের বন্ধু বলে ভান করছেন। মন্ত্রীসভা অবশ্য নিশ্চিতভাবে জানেন যে, বর্গাদারদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী, তফসিল জাতি ইত্যাদি সকলেই আছেন। একটি সহজ দাবির জন্য এদের সকলকেই ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলা হচ্ছে। আমরা এটাও দেখেছি-আমি নিজে স্বচক্ষে খুলনা, জলপাইগুড়ি ও ময়মনসিংহ এবং দিনাজপুরের পাঠানো রিপোর্ট দেখেছি যে কৃষকরা কোথাও মারমুখী হয়ে ওঠেনি। একটা থানা বা একজন জোতদারের বাড়িও পোড়েনি, জমিদার বা জোতদার একজনও খুন হয় নি, তথাপি যখন বর্গাদারেরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য ভাগ দাবি করেন মাত্র, তখনই আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে শোনা যায়। এই মানুষেরা আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন বলে সোরাবর্দি আমাদের শুনিয়েছেন। কিন্তু আমি নিজে যতগুলি স্থানে গিয়েছি, সেখানে সর্বত্রই দেখেছি পুলিশই ধ্বংসাত্মক কাজগুলি করেছে। মন্ত্রীদের আমি জিজ্ঞেস করি কোন আইনের বলে পুলিশ গিয়ে কৃষকদের ঘর-বাড়ি ভেঙ্গেছে, মেয়েদের লাঞ্ছিত করেছে এবং কৃষক হত্যা করেছে।”


“আমি নিশ্চিত যে, তাঁদের এই প্রাণদান ব্যর্থ হবে না। পুলিশের বুলেট যখন তাদের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, তখনো তাঁরা ‘তেভাগা চাই-জান দেবো তবু ধান দেবো না’ বলে লুটিয়ে পড়েছেন। কারণ তারা জানতেন যে, নিজেদের জীবনদান করেও যদি তাঁদের দাবি পূরণ হয়, তবে আগামী দিনে তাঁদের সন্তানরা ভালোভাবে বাঁচতে পারবে এবং তারাই তাদের প্রিয়জনদের চোখের জল মোছাতে পারবে। এই কয়েক দানা শষ্যের জন্য তারা প্রাণ দিলেন।”

Leave a comment