সম্পাদকীয়, ১লা জুন, ২০১০
Posted by bangalnama on June 1, 2010
মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক জ্যোতির্ময় অধ্যায় তেভাগা আন্দোলন। আজ, অর্ধেক শতাব্দীর বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর, হয়তো শুধু সোমনাথ হোরের ছবিতে, সলিল চৌধুরীর গানে, আখতারুজ্জামানের উপকথায় আমরা সেই জনজাগরণের স্মৃতি খুঁজে পাই, কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এই মুহূর্তেও এ দেশের কৃষিজীবী মানুষের নিজের জমি আর ভূমিজ ফসলের ওপর যে অধিকার রয়েছে তার দৃঢ়তার পিছনে এক ঋজু স্তম্ভ তেভাগা আন্দোলন।
১৭৫৯ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে এক নতুন ধরণের জমিদারশ্রেণীর পত্তন হয়, যাঁদের জমির সঙ্গে মূল সম্পর্ক ছিল ব্যবসাভিত্তিক, বৃটিশ শাসককে নির্ধারিত খাজনা দেওয়ার পর বর্গাদারের থেকে আদায় খাজনার সম্পূর্ণ লভ্যাংশ তাদেরই থাকতো। এই লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলার জন্য চলতে থাকত নিজের জমিদারির মধ্যে চাষীদের অপর অনিয়ন্ত্রিত অত্যাচার। ১৯২০ সাল থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকরা কর-মকুব, কর-ছাড়ের আন্দোলন করতে থাকেন। পাঞ্জাবে গদর পার্টির নেতৃত্বে, গুজরাটে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কর-মকুব করার দাবী নিয়ে কৃষকরা সংগঠিত হতে থাকেন। ১৯২৯-এ বিহার প্রাদেশিক কিষাণ সভা এবং ১৯৩৬-এ সারাভারত কৃষক সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলতঃ এই সময়টা দিয়ে কৃষকরা উপলব্ধি করতে থাকেন যে শুধুমাত্র দুর্যোগের বছরগুলিতে করহ্রাসের লড়াই দিয়ে নিজেদের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা অর্জন করা যাবেনা। প্রয়োজন জমিদারের তৈরী করা নিয়মগুলোকে বদলাবার- দাবি উঠতে থাকে ফসলের এক-তৃতীয়াংশের বেশি খাজনা না দেওয়ার। ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম ফসলের ওপর প্রজার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রজারাই এগিয়ে আসেন। চিরকল্যাণময়ী বাংলার মাটিতে গাঁথা হয় হয় তেভাগা আন্দোলনের উপকথা যার উপসংহারে লেখা থাকে সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ-ভবিষ্যৎ।
তেভাগা লড়াইয়ে সার্বিকভাবে মানুষের অনমনীয় প্রতিবাদ তার বিশাল ও বিচিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। ৪৬-৪৭ এর ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেন অনুন্নত হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা। দু সম্প্রদায়ের মানুষ লাঠিতে লাঠিতে শব্দ করে শপথ নেন কৃষকের মধ্যে হানাহানি নয়, বরং ‘একজন মেহনতীর বদলে সাতজন জোতদার’ (রংপুর, ১৯৪৬)। কোথাও শ্রমিকেরা স্বেচ্ছাসেবক হয়ে তাঁদের চাষী ভাইবোনদের পাশে দাঁড়ান (জলপাইগুড়ি, ১৯৪৬), আবার কোথাও বা পুলিশ কর্মীরা অস্বীকার করেন ঊর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশ মেনে নিজের বাপ-দাদার সমতুল্য কিষাণ জনতার ওপর গুলি চালাতে (নড়াইল, ১৯৪৭)। লাঠি আঁশবটি, দা নিয়ে সশস্ত্র কৃষক রমণীরা মোকাবিলা করেন আক্রমণকারী পুলিশ-লেঠেল দের (শহীদ রাসমণির নেতৃত্বে পুর্ব ময়মনসিংহ, ১৯৪৬; নন্দীগ্রাম-মহম্মদপুর, ১৯৪৭)। যশোহর, সুন্দরবন প্রভৃতি অঞ্চলে জোতদার-পুলিশের আধিপত্য দূর করে মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠে। লয়ালগঞ্জের নাম পালটে হয়ে যায় লালগঞ্জ। পুলিশের আক্রমণের হাত থেকে লালগঞ্জের মুক্তাঞ্চলকে বাঁচাতে ছুটে আসেন সারা সুন্দরবনের সংগ্রামী মানুষ, আবার অহল্যা-মা (চন্দনপিঁড়ি, ১৯৪৯)-র মৃত্যুর পরে আক্রান্ত চন্দনপিঁড়ির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পাশে দাঁড়ান লালগঞ্জের সংগ্রামী মানুষ। সব মিলিয়ে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষকসভার নেতৃত্বে সারা বাংলার সংগ্রামী মানুষ নিজেদের আন্দোলনের সঙ্গে এক করে ফেলেছিলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাঁরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে গেছেন সাম্রাজ্যবাদী-সামন্তী শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে। মুক্তাঞ্চলে তৈরী করেছিলেন নিজেদের প্রশাসন। মহিলা এবং আদিবাসীরা নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন আর জনগণের মধ্য থেকে দাবী এসেছিল যৌথখামার, ফসলের সামাজিক সঞ্চয় (পুঁজ) গড়ে তোলার। ঘরে ধান আসায় কিষাণীরা নিজেদের ও সন্তানদের জন্যে শিক্ষার দাবী করতে থাকেন পার্টির কাছে। অধিকারবোধের পাশাপাশিও শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকেও এক উত্তরণ ঘটে বাংলার কৃষক সমাজের।
বাংলার মাটিতে কৃষক অসন্তোষের স্ফুলিঙ্গ জ্বলতে শুরু করে তিরিশের দশকের শেষভাগ থেকেই। কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহের নেতৃত্বে ১৯৩৭-৩৮ সাল নাগাদ ময়মনসিংহের চাষীরা ধানে খাজনা দেওয়ার পদ্ধতির (টংক প্রথা) বিরোধিতা করে সংগঠিত হন; ১৯৩৯-এ দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ির আধিয়ার চাষীরা জোতদারদের অনিয়ন্ত্রিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করেন। ক্রমে টংক ও আধিয়ারদের উদাহরণে অনুপ্রাণিত হয়ে আন্দোলনে নামতে থাকেন বাংলার বাকি অংশের চাষীরা। এই পরিস্থিতিতে ফজলুল হক মন্ত্রীসভা ‘ভূমি রাজস্ব কমিশন’ (ফ্লাউড কমিশন) নিয়োগ করেন। ১৯৪০-এ ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টে সময়ের দাবীকে স্বীকৃতি দিয়ে এক-তৃতীয়াংশ (তেভাগা) খাজনা দেওয়ার সুপারিশ করা হয় কিন্তু প্রত্যাশিত ভাবেই সেই সুপারিশ কার্যকর হয়না এবং চাষীরা স্লোগান তোলেন তেভাগা মতে উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে লড়াইয়ে নামবার। ১৯৪০ সাল থেকেই খুলনার কৃষকরা তেভাগার অতিরিক্ত ফসল খাজনা দিতে অস্বীকার করেন এবং ধান কেটে নিজের গোলায় তুলতে থাকেন। জমিদারের লেঠেলের সঙ্গে সংঘর্ষ হতে থাকে তাঁদের, পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় কৃষক পরিবারের সকলকে, আর এই পরিস্থিতিতে তেভাগার সংগ্রাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও পুলিশ-লেঠেলের অত্যাচার আন্দোলনকে দমন করে দেয় আর কোথাও চাষীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ধান কেটে ঘরে তোলেন এবং জমির মালিকদের দিয়ে তেভাগা স্বীকার করিয়ে নেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকরা জোতদারদের গোলা থেকে বেআইনি ভাবে মজুত ধান-চাল উদ্ধার করে জনগণের মধ্যে সরকারি দরে বিলি করতে থাকেন। ৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির সিদ্ধান্তে ঘোষিত হয় উত্তরবঙ্গে তেভাগা লড়াইয়ের মূল দাবিগুলি- নিজ খেলানে (গোলায়) ধান তোলো, আধি (অর্ধেক) নাই- তেভাগা চাই; কর্জা (ধার করা) ধানের সুদ নাই। ১৯৪৬ সালে খুলনার মৌভোগে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে সারা বাংলা জুড়ে তেভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দাবি করা হয় বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ।
১৯৪৬-৪৭-এ দিনাজপুর-রংপুর-জলপাইগুড়ি-ময়মনসিংহ-যশোর-খুলনা-মেদিনীপুর-দক্ষিণবঙ্গ-সুন্দরবন দাবানলের মতো তেভাগার দাবি ও লড়াই ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। এর মধ্যেই আসে ভারতের স্বাধীনতা, স্বাধীনতার পরও দেশীয় শাসকরা উপেক্ষা করেন মানুষের দাবি, ফলে লড়াই চলতে থাকে। এই সংখ্যায় আমরা স্মরণ করবো তেভাগার মৃত্যুঞ্জয়ী বীরেদের। দেখবো তাঁদের অধিকার বুঝে নেওয়ার প্রখর দাবি কীভাবে কাঁপিয়ে তুলেছিল বাংলা তথা ভারতের আকাশ-বাতাস। প্রতিবাদী মানুষের জীবনবোধের শিক্ষাগুলিকে সূত্রায়িত করবার চেষ্টা করবো এবং রাজনৈতিক যাথার্থ্যের আঙ্গিক থেকে বুঝে নিতে চাইবো সেই গণঅভ্যুত্থানের ওঠাপড়াগুলিকে।
অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা;
অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা।
অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,
অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।
অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার
অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওঁকার।
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।
(অন্নদেবতা, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়)
তেভাগার জয় হোক। জয় হোক আমাদের অন্নদাতাদের। জয় হোক মানুষের বেঁচে থাকার চিরন্তন লড়াইয়ের।
_____________________________________________________
তথ্যসূত্রঃ তেভাগা সংগ্রাম, সুপ্রকাশ রায়, র্যাডিক্যাল প্রকাশনা, জানুয়ারী ২০০৯
এই তেভাগা সংখ্যাটি সংকলিত করতে পারার জন্য যাদের কাছে বাঙালনামা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ, পরিশেষে তাদের অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানাই- শঙ্কর রায়, সুভানু ভট্টাচার্য্য, অনির্বাণ দাশগুপ্ত, আকাশ, ঋতেন মিত্র।
ayan saha said
please give some books name and writers nane on tevanga andolon to reference of role of women specially of south 24:pgs