বা ঙা ল না মা

তেভাগার পূর্বকাল উত্তরকাল

Posted by bangalnama on June 1, 2010


লিখেছেন – প্রণব দে


ছয় দশক আগে, অবিভক্ত বাংলার প্রায় সমগ্র অঞ্চল জুড়ে তেভাগা আন্দোলনের প্রসার ঘটেছিল। ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতার মুখে দাঁড়িয়ে। ব্যাপকতা ও তীব্রতার বিচারে, স্বাধীনতাপূর্ব বাংলায় এবং স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে, এই ধরণের কৃষক আন্দোলনের নজির নেই। ১৯৪৬ সালের আগষ্ট মাসে কলকাতায় এবং অক্টোবরে নোয়াখালিতে ভয়াবহ দাঙ্গার মাত্র দুই মাস পরে, সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ভাবে, বাংলার কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এখনও পর্যন্ত তেভাগা আন্দোলনের সবথেকে বড় বিস্ময়।


তেভাগার অর্থ তিনভাগ। উৎপন্ন ফসলের একভাগ খাজনা হিসাবে পাবে জমির মালিক এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ আধিয়ার বা বর্গাদার তথা ভাগচাষীর জিম্মায় থাকবে – এটাই ছিল তেভাগার মূল দাবী। আধাআধি ভাগ ছিল সাধারণ নিয়ম। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে খাজনা প্রদানের বিভিন্ন রেওয়াজ ছিল। কোথাও কোথাও, নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল খাজনা দেওয়ার প্রথাও প্রচলিত ছিল। এতদিন যে আধাআধি বখরার প্রথা চলে আসছিল, তা’ বাতিলের দাবীতে সরব হয়ে উঠেছিল, গ্রাম বাংলার কৃষক সম্প্রদায়। পুলিশের নির্মম দমন-পীড়ন এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। তেভাগার দাবীর ন্যায্যতা সরকারি স্তরে নীতিগতভাবে স্বীকৃতি পেলেও, স্বাধীনতার পূর্বে এই দাবী আইনগত স্বীকৃতি পায়নি।


এরপর দেশ স্বাধীন হয়েছে, দ্বিখন্ডিত হয়েছে, স্বাধীন দেশে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এসেছে, জমিদারি বিলোপ হয়েছে, ভূমি সংস্কার আইনে ভাগচাষীদের কিছু অধিকার দেওয়া হয়েছে, ১৯৬৭-তে যুক্তফ্রন্ট এবং ১৯৭৭-এ বামফ্রন্টের মাধ্যমে বামপন্থীরা সরকারে আসীন হয়েছে- ইত্যাদি ঘটনাস্রোতের মধ্য দিয়ে ৬০টি বছর অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু তেভাগার দাবীকে অতিক্রম করে ভাগচাষীদের আর অগ্রসর হতে দেখা গেল না। বামফ্রন্ট সরকারও ‘অপারেশন বর্গা’য় এসে থেমে গেল। আধা-সামন্ততান্ত্রিক এই প্রথা অবসানের কোনো চেষ্টা বামফ্রন্ট করে নি, বরং প্রশ্নটাকে বামপন্থীরা সযত্নে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে এসেছে।


১৯৩৬ সালে, ‘বঙ্গীয় কৃষক সভা’ গঠিত হওয়ার পর, তেভাগাই প্রথাম বড় মাপের কৃষক আন্দোলন, যেটাতে কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি আই) সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪০ সালে স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের নেতৃত্বে ‘ভূমি রাজস্ব কমিশন’ যে রিপোর্ট পেশ করে, তাতেই এক-তৃতীয়াংশ খাজনার সুপারিশ করা হয়েছিল। তারপর থেকেই তেভাগার দাবীর সপক্ষে কৃষকরা ক্রমশঃ সমবেত হতে শুরু করে। ১৯৪০ সালের জুন মাসে, অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার পাঁজিয়াতে অনুষ্ঠিত, ‘কৃষক সভা’র চতুর্থ সম্মেলনে ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার দাবী গৃহীত হয়। দাবীগুলি ছিল- “১) অবিলম্বে আইন করিয়া জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ করা হ’ক। ২) রাইতওয়ারী প্রথা আমরা চাই না। রাজস্ব বা রেভিনিউ-এর বদলে আমরা চাই ইনকাম ট্যাক্স বা আয়কর। … ৪) খাসমহল প্রথাও তুলিয়া দেওয়া হ’ক। … ৫) আইন করিয়া বর্গা প্রথা তুলিয়া দেওয়া হ’ক, কেহ যেন চাষের জমি বর্গা দিয়া ভাড়া খাটাইতে না পারে। হয় জমি ছাড়িয়া দিতে হইবে, নয় নিজে চষিতে হইবে। এখন যে জমিতে যে বর্গা চাষ করে সেই জমিতে সে যেন স্বত্ববান হয়। … ইত্যাদি।” প্রস্তাবের শেষে বলা হয়েছিল- “এই দাবি অনুসারে আইন কতদিনে হইবে অথবা আদৌ হইবে কিনা তার ঠিক নাই। অথচ বর্গা চাষীরা আজ মারা যাইতেছেন। কাজেই কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাইবার দাবি লইয়া আজই চাষীরা সংঘবদ্ধ হইয়া প্রবল সংগ্রাম শুরু করিয়া দিন।” (সূত্র- কৃষকসভার ইতিহাস – আবদুল্লাহ রসুল)।


আহ্বান রাখলেও, তদানীন্তন পরিস্থিতিতে তৎক্ষণাৎ সংগ্রাম শুরু করা যায় নি। বিশ্বযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রাধিকার তো ছিলই, তার ওপর ১৯৪৩ সালের পঞ্চাশের মণ্বন্তর বাংলার চাষীদের সর্বস্বান্ত করে। যাই হোক, তেভাগার দাবীতে আন্দোলন শুরু হলেও একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায় – প্রায় সত্তর বছর আগে কৃষকসভার মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি আই) যে মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছিল, আজ পর্যন্ত তা’ রূপায়ণের জন্য তারা সচেষ্ট হল না কেন? বস্তুতঃ ভাগচাষীদের সম্পর্কে ফ্লাউড কমিশনের প্রথাম সুপারিশ ছিল, বর্গাদারদের প্রজা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান। সেই সুপারিশটা বাক্সবন্দী করে রাখার ক্ষেত্রে, কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট অথবা বামফ্রন্ট সরকারের মধ্যে অদ্ভুত ভাবগত ঐক্য দেখা গেছে। তেভাগা আন্দোলনকে যদি পিছন ফিরে দেখতে হয়, এই প্রশ্নগুলো আলোচনার মধ্যে আনা উচিত।


ভাগচাষীরা কৃষকশ্রেণীর কোন পর্যায়ভুক্ত হবে, এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে বিগত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে। প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের কৃষিসমাজকে মূলতঃ তিনটি বর্গে ভাগ করা যায়ঃ ১) জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী বা খাজনাভোগী শ্রেণী, ২) রায়ত ও অধীনস্থ রায়ত অর্থাৎ মূলতঃ কৃষিজীিব সম্প্রদায়, এবং ৩) কৃষিমজুর ও ভাগচাষী। জমিদাররা ছিল মালিক, রায়তরা ছিল প্রজা। কিন্তু ভাগচাষীদের জমির উপর কোনো স্বত্ব ছিল না আবার তাদেরকে কৃষিমজুর শ্রেণীভুক্তও করা চলে না, কারণ চাষের খরচ এবং ঝুঁকি বহন করতে হত ভাগচাষীকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে যে নতুন জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল, তারাই ছিলেন সমাজের অভিজাত ভদ্রলোক। জমিদার বনাম রায়ত অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর দ্বন্দ্বই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর কৃষি সমাজের মুখ্য দ্বন্দ্ব। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দীতে ‘অভিজাত’ শ্রেণীর পশ্চাদপসরণ শুরু হয় এবং গ্রামীণ রাজনীতিতে ধনী কৃষক ও নিম্নতর ভূস্বামী সম্প্রদায়ের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভূস্বামী শ্রেণী থেকেই আধুনিক বুদ্ধিজীিব শ্রেণীর উদ্ভব।
‘By the 1870s, this differentiation between the older wealthy zamindars and the much larger group of petty proprietors-tenure holders-cum-professionals became apparent in the political, social and cultural life of Bengal. From the last decades of the nineteenth century, for instance, provincial politics in Bengal came to be dominated by the class of small rentiers in land. … It was also the stratum of society from which came the early generation of successful professionals in law, journalism, medicine, teaching and the civil and judicial services. This class formed the core of an expanding status group widely known as Bengali bhadralok and often referred to as an ‘elite’ group” (See Bengal 1920-1947 by Partha Chatterjee)। বাংলার রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রশাসন- সর্বত্রই এই নব্য আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণীর প্রতিপত্তি। এমন কি পরবর্তীকালে বামপন্থী রাজনীতিতেও ‘এলিটদের’ প্রাধান্য। অগ্রগণ্য এই শ্রেণীর অর্থনৈতিক মূল কিন্তু প্রোথিত ছিল সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির গভীরে- “They lived entirely on ‘revenue’; only the distribution of the surplus concerned them, they had no role in its creation.” (ibid)


১৮৮৫ সালে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন’
(Bengal Tenancy Act) প্রণীত হয়। জমিদার ও প্রজার বিভিন্ন ধরণের আন্তঃসম্পর্ক, অধিকার এবং ভূমিস্বত্বকে এই আইনে সূত্রবদ্ধ ও সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়। প্রজার সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল- “tenant means a person who holds land under another person, and is, or but for a special contract would be liable to pay rent for that land to that person”। অর্থাৎ উপরিস্থিত মালিককে খাজনা দিলেই যে কোন ব্যক্তি প্রজা হিসাবে সাব্যস্ত হবে। খাজনা নগদে অথবা দ্রব্যে (in money or in kind) – যে কোন প্রকার হতে পারে। এই আইন প্রচলিত হওয়ার পর অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে স্বত্বলিপি (Records-of-rights) প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়। বাস্তব অবস্থার নিরিখে, ইংরেজ প্রশাসকরা (সেটেলমেন্ট অফিসার) প্রাথমিকভাবে বর্গাদারদের প্রজা হিসাবে নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেয়। কারণ বর্গাদাররা অন্যের জমিতে নিজ ব্যয়ে চাষ করে এবং ফসলে খাজনা প্রদান করে। দ্বিতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বর্গাদারদের প্রতি কিছুটা অনুকূল মনোভাব সৃষ্টি করে। অনেক বর্গাদারই আসলে ছিল সংশ্লিষ্ট জমির পূর্বতন মালিক বা প্রজা। খাজনা অনাদায়ে বা ঋণের দায়ে, যেটা সে সময়ে অভাবিত ছিল না, হয়তো জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর জমিদার-ভূস্বামীর কৃপায় বর্গা শর্তে জমি চাষ করার অনুমতি পেয়েছে। জমিদার-ভূস্বামীরা এই প্রথাকে পছন্দ করত কারণ বিনা বিনিয়োগে ফসলের মাধ্যমে তারা অতিরিক্ত খাজনা পেত এবং তারা জানত, জমির প্রতি মমত্ব বশতঃ কৃষক কখনো জমিকে অভেলা করবে না। বর্গাদারদের প্রজা হিসাবে গণ্য করাকে জমিদার-ভূস্বামীরা একেবারেই মেনে নিতে পারে নি এবং ব্যাপক হারে ভাগচাষীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে থাকে। শ্রী চ্যাটার্জী, পূর্বোল্লেখিত বইয়ে, মেদিনীপুরের সেটেলমেন্ট রিপোর্ট উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন- “যতদিন ভাগচাষীদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে নি, ততদিন জমিদাররা, কয়েকটি ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে বর্গাদারদের ফসলে ভাগ দেওয়ার কড়ারে বছরের পর বছর জমিতে চাষ করতে দিয়েছে। কিন্তু যে মুহূর্তে বর্তমান অবস্থানের ভিত্তিতে তাদের একটা নির্দিষ্ট মর্যাদা দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হলো, সেই মুহূর্ত থেকে সমস্ত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শক্তি একযোগে ঐ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিল।”


বাংলার ভূস্বামী গোষ্ঠী প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনের জন্য সরকারের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। সরকার বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য ‘জন কের’
(John Kerr) কমিটি গঠন করে। কিন্তু কের কমিটির সুপারিশ (১৯২৩) ভূস্বামীদের সন্তুষ্ট করতে পারে নি। কমিটি সুপারিশ করেছিল, “ফসল-খাজনা প্রদানকারী কৃষক যদি নিজেই হাল-বলদ-বীজ সরবরাহ করে এবং যদি তার স্বাধীনভাবে শস্য নির্বাচনের অধিকার থাকে, তাহলে সেই কৃষককে ‘রায়ত’ হিসাবে গণ্য করা উচিত।” তদানীন্তন প্রাদেশিক বিধানসভায় এই সুপারিশ অনুযায়ী বিল পেশ করা মাত্র, কংগ্রেস, স্বরাজ্য প্রভৃতি জাতীয়তাবাদী দল, বিলের বিরোধিতা করে। বিলটি পরিত্যক্ত হয়। অবশেষে, ১৯২৮ সালে নতুন সংশোধনী বিল আইনসভায় পেশ করে, প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করা হয় এবং বর্গাদারদের প্রজার সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই সংশোধনীকে কেন্দ্র করে বিধানসভা খাড়াখাড়ি ভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে, দলমত নির্বিশেষে ভূস্বামী গোষ্ঠী অপর দিকে সাধারণ কৃষকদের গোষ্ঠী। একদিকে ‘elite’ গোষ্ঠী অপর দিকে ‘commoner’। অবশ্য ব্যতিক্রম দু’তরফেই ছিল। ঘটনাচক্রে কৃষকদের মধ্যে মুসলমানদের প্রাধান্য থাকায়, এই ঘটনাটাকে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের সূচনা হিসাবে অনেকে মনে করেন। আট দশক আগে বাংলাদেশে ভাগচাষীরা যা হারিয়েছিল, তা’ আর পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।


প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনের প্রায় দশ বছর পর, ৫ই নভেম্বর ১৯৩৮, স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের নেতৃত্বে ‘ভূমি রাজস্ব কমিশন’ গঠিত হয়। ইতিমধ্যে ‘কৃষক সভা’ গঠিত হয়েছে। ফ্লাউড কমিশনের নিকট কৃষক সভা স্মারকলিপি ও বক্তব্য পেশ করে। জমিদার এবং কৃষক প্রজাদের তরফে অন্যান্য সংগঠনও স্ব স্ব বক্তব্য দাখিল করে। আশ্চর্যের বিষয়, কমিশনের কাছে কমিউনিস্ট পার্টির
(CPI) নেতৃত্বাধীন কৃষকসভা সুস্পষ্ট কোন দাবী তুলে ধরতে পারেনি। বর্গাদারদের প্রজা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে কিনা, এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে শ্রী বঙ্কিম মুখার্জী বলেন- “বর্গাদাররা যেহেতু বীজ-বলদধাল সরবরাহ করে, সেহেতু তারাই চাষের ব্যয়ভার বহন করে। সভার লক্ষ্য যদি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বুঝিয়ে বলা যায়, তারা বর্গাদারদের অধিকার প্রদানে সম্মত হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে তারা সেরকম কিছু করবে না।” (“He agreed that a bargadar who supplies seed, cattle and plough, finances agriculture, and thought that if the Sabha’s scheme was explained to the middle classes they might agree to give rights to the bargadars. At present they would not do so.”) (সূত্র- ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট, ৬ষ্ঠ খন্ড)। একমাত্র কৃষক প্রজা পার্টি ছাড়া, বর্গাদারদের সপক্ষে আর কেউই সওয়াল করেনি। কমিশনের সুপারিশে কিন্তু কোন ধোঁয়াশা ছিল না। তারা স্পষ্ট ভাষায় বর্গাদারদের রায়ত হিসাবে গণ্য করার সুপারিশ করে- “Our recommendation is that the provision of Sir John Kerr’s Bill should be restored, by which it was proposed to treat tenants bargadars who supply the plough, cattle, and agricultural implements. If it is thought too difficult to frame a workable definition, then all bargadars should be declared to be tenants. We also recommend that the share of the crop legally recoverable from them should be one-third, instead of half, although we recognise there may be practical difficulties in enforcing this limitation”


ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশের সূত্র ধরে তেভাগা আন্দোলন হল। এমন কি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উক্ত কমিশনের সুপারিস মেনে জমিদারি ব্যবস্থা বিলোপ করা হল, কিন্তু ঐ একই কমিশনের বর্গাদার সংক্রান্ত সুপারিশ রূপায়ণের জন্য, ডান-বাম কোন পক্ষই দাবী উত্থাপন করল না। যখন জমিদারি প্রথা বিলোপ করার আইন প্রণীত হল, তখনই ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু না, বর্গাদারদের মৌলিক অধিকারের দাবী উত্থাপন করতে কাউকে দেখা যায় নি।


কংগ্রেসকে বামপন্থীরা জোতদার-জমিদারদের দল হিসাবে বরাবর বর্ণনা করে এসেছে। বর্গা প্রথা অবসানের বা বর্গাদারদের স্বাধীন কৃষক হিসাবে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা বোধগম্য। কিন্তু বামপন্থীদের এই সামন্ততান্ত্রিক প্রথার অবসানে এত অনীহা কেন? ১৯৭২ সালে হরেকৃষ্ণ কোঙার দাবী রাখছেন- “বর্গাদার ছাড়া সমস্ত প্রজাদের সরাসরি জমির মালিকানা দিতে হবে, বর্গাদার প্রথা একটি খুব সেকেলে প্রথা এবং উৎপাদনের পক্ষে ক্ষতিকর। সে জন্য এর বিলোপের পক্ষে তত্ত্বগতভাবে যুক্তি আছে। কিন্তু বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোয় এর বিলোপ করা যায় না।” (সূত্র- ভারতের কৃষি সমস্যা, জাতীয় সংস্থার নিকট পত্র, হরেকৃষ্ণ কোঙার)। কেন যায় না? অসুবিধাটা কোথায়? কারণটা নিহিত আছে অর্থনৈতিক শ্রেণী-ভিত্তির মধ্যে। প্রগতিশীল রাজনীতি বা রক্ষণশীল রাজনীতি, যে যাই করুক না কেন, নিজস্ব সামাজিক-অর্থনৈতিক ভিত্তির শিকড়ের টান কেউই অস্বীকার করতে পারে নি। বিশেষতঃ নির্বাচনসর্বস্ব রাজনীতিতে শ্রেণী সংগ্রামের থেকে শ্রেণী সমন্বয় যখন অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত।


ফল সেটা হয়েছে, ভাগচাষী-বর্গাদারদের অবস্থা তেভাগার যুগ পেরিয়ে আর অগ্রসর হতে পারে নি। ১৯৯২-৯৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গঠিত মুখার্জি-ব্যানার্জী কমিটির রিপোর্টে বলা হচ্ছে, মালিক-বর্গাদারদের এক অলিখিত সমঝোতার ফলে, পশ্চিমবঙ্গে এখনও বর্গাদাররা তাদের আইনত প্রাপ্য ৭৫ শতাংশ ভাগ পায় না-
“From the qualitative angle, we came across numerous cases in which crop sharing is not according to law and is adverse to the bargadars’ interest. In Jalpaiguri district, it is almost universally on 50:50 basis against 75:25 ratio prescribed by law. When, in a roadside meeting, we brought this to the notice of the elected Panchyat functionary of the locality, his whispered response was that these were “Mutual arrangements” and that neither the peasants, organisation nor the Panchyats thought it appropriate to intervene as that might upset cordial relationship.” (Source: New Horizons for West Bengal’s Panchyats- Nirmal Mukarji and D. Bandyopadhyay)


এটা একটা ঐতিহ্যবাহী সমঝোতা। এই সমঝোতার ভার বর্গাদাররাই বহন করে, জমির মালিক করে না। আর স্থিতাবস্থা বজায় রাখাও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আসলে সমস্যার সমাধান আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের পছন্দ নয়। সামাজিক সমস্যাগুলিই রাজনীতি ব্যবসায়ের মূলধন। তাই “বস্তুত বিধানচন্দ্র রায় থেকে শুরু করে হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরি সহ আজকের ৭ম বামফ্রন্ট পর্যন্ত সবাই ‘এখনও সময় হয়নি’ বলে বর্গাদারদের রায়তি স্বত্ব দেবার মৌলিক দায়িত্ব অস্বীকার করার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।” (সূত্র- দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কারের কয়েকটি দিক, অনীক, জানু-ফেব্রু, ২০০৬)।


এখন তো আবার ধুম লেগেছে শিল্পায়নে। ইমারত-প্রাসাদে বদলে যাচ্ছে আকাশরেখা। উন্নয়নের হোমানলে আহুতির উপাদান হওয়া ছাড়া কৃষকদের কোন গতি নেই। উচ্ছেদ হতে হচ্ছে ভাগচাষীদের- কোন দাবী ছাড়াই। তেভাগা এবং তেভাগা উত্তর সামাজিক আন্দোলনগুলির দিকে ফিরে তাকালে মনে হয়- আন্দোলনের বাহকেরা যতদিন না চালকের আসনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, ততদিন কোন আন্দোলনই বোধ হয় ঈপ্সিত পরিণতি অর্জনে সক্ষম হবে না।

Leave a comment