বা ঙা ল না মা

অবিস্মরণীয় তেভাগা সংগ্রাম ও দিনাজপুর

Posted by bangalnama on September 13, 2010


– সুশীল সেন


সম্প্রতি বালুরঘাটের খাঁপুর গ্রামে তেভাগা সংগ্রামের রজত জয়ন্তী পালিত হইল। এই খাঁপুর গ্রামে ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র পুলিশ ঐ সংগ্রাম দমনের জন্য কৃষকদের উপর একদিনে ১২১ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করিয়া ২২ জন কৃষককে হত্যা করে। আহতদের বালুরঘাট হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার মৃত্যুপথযাত্রী একজন কৃষককে তাঁহার শেষ ইচ্ছা জানিবার জন্য জিজ্ঞাসা করিলেন — “আপনি কী চান?” ক্ষীণকন্ঠে সংগ্রামী কৃষকটি উত্তর দিলেন– “তেভাগা চাই।” তারপরই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেদিন তেভাগার দাবি ঐ জিলার নিপীড়িত কৃষকদের মনে কত গভীর রেখাপাত করিয়াছিল তাহা ঐ উক্তি হইতেই উপলব্ধি করা যায়।


১৯৪৬-৪৭ সালের ধানকাটার মরশুমের সেই অবিস্মরণীয় দিনগুলিতে অবিভক্ত বাংলার প্রায় ১৯টি জিলার কৃষকরা ঐ তেভাগা সংগ্রামে যোগদান করে। সংগ্রামের প্রধান এলাকা ছিল উত্তরবঙ্গ — দিনাজপুর, রংপুর ও জলপাইগুড়ি জিলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ঐ অঞ্চলে বর্গাদাররা আধিয়ার নামে পরিচিত। আর এই আধিয়ার কৃষকদের অধিকাংশই ছিল রাজবংশী বা ক্ষত্রিয় এবং সাঁওতাল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এবং কৃষক সমিতির পরিচালনায় ঐ সংগ্রাম সংগঠিত হইয়াছিল। সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থার সীমাহীন শোষণের বিরুদ্ধে নিপীড়িত কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ বিদ্রোহের যে ব্যাপক বিস্ফোরণ সেদিন ঘটিয়াছিল তাহা অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয়। অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার ৩০টি থানার মধ্যে ২২টি থানার আধিয়ার কৃষকরা ঐ সংগ্রামে যোগ দেয়। ঐ এক জিলাতেই চারটি অঞ্চলে পুলিশের গুলিতে ৪০ জন কৃষক শহীদ হয়। দুই হাজার কৃষক কারাবরণ করে। শত শত কৃষক কর্মী গ্রেপ্তারী পরোয়ানা উপেক্ষা করিয়া সংগ্রাম পরিচালনা করেন ও আত্মগোপন করিয়া থাকেন। কৃষকদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের হয়। স্বাধীনতা লাভের পর ঐ সকল মামলা ও ওয়ারেন্ট প্রত্যাহৃত হয়।


পাঁজিয়া সম্মেলন


১৯৪০ সালের শুরুতে ফজলুল হক মন্ত্রীসভা নিয়োজিত ভূমি রাজস্ব কমিশন (ফ্লাউড কমিশন)-এর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। কমিশন বর্গাদারদের জন্য উৎপন্ন ফসলের ১/৩ অংশ খাজনা দিবার সুপারিশ করে। ঐ বছরই যশোর জিলার পাঁজিয়াতে প্রাদেশিক কৃষাণ সভার যে বাৎসরিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে আলোচনায় ঐ রিপোর্ট বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। পাঁজিয়া সম্মেলন হইতে বর্গাদারদের উৎপন্ন ফসলের ২/৩ অংশ পাইবার দাবিতে সংগ্রামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ফ্লাউড কমিশনের নিকট ইতিপূর্বেই প্রাদেশিক কিষাণ সভা হইতে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হইয়াছিল।


ভবানী সেনের রংপুর মিটিং


তখন যুদ্ধ চলিতেছিল। যুদ্ধের মধ্যেই আসে মণ্বন্তর। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কৃষক সমিতিগুলি রিলিফ ও খাদ্য আন্দোলন লইয়াই প্রধানতঃ ব্যস্ত থাকে। ১৯৪৪ সালের জুন মাসে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটি সম্পাদক কমরেড ভবানী সেন দিনাজপুর, রংপুর ও জলপাইগুড়ি — পার্টির এই তিনটি জিলা কমিটির এক যুক্ত অধিবেশন আহ্বান করেন। রংপুরের জিলা সম্পাদক কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন তাঁদের পার্টি কম্যুন-এ তিনদিনব্যাপী এই মিটিং-এর ব্যবস্থা করেন। জলপাইগুড়ি জিলা সম্পাদক ছিলেন তখন কমরেড শচীন দাশগুপ্ত। তিনটি জিলাই সেদিন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়িয়াছিল। পার্টি ও কৃষক আন্দোলনের তখনকার শক্তিশালী ঘাঁটি এই তিনটি জিলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করা এবং তিন জিলায় যুগ্মভাবে একই দাবির ভিত্তিতে গ্রামাঞ্চলে শক্তিশালী কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত করার বিষয়টিই ঐ সভায় প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল। কমরেড ভবানী সেন প্রথম শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থাকিয়া তিনদিন ঐ আলোচনা পরিচালনা করেন। সেই আলোচনার ভিত্তিতে কৃষক আন্দোলন প্রসারিত ও সংগঠিত করা হয় এবং জোতদারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তারপর ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাদেশিক কৃষক কাউন্সিলের সভায় তেভাগা সংগ্রামের সিদ্ধান্তের পর অক্টোবরের শেষে কমরেড ভবানী সেন রংপুরে ঐ তিন জিলার নেতৃস্থানীয় কমরেডদের নিয়ে এক সভায় পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেন। সভার শেষে কমরেডদের আলোচনার ভিত্তিতে কমরেড ভবানী সেন যুক্ত আন্দোলনের সাধারণ দাবিগুলি শ্লোগান আকারে সভায় উপস্থিত করেন। উহার মধ্যে এমন তিনটি শ্লোগান ছিল যাহা পরবর্তীকালে তেভাগা সংগ্রামের মূল রণধ্বনি হইয়া উঠিয়াছিল সমগ্র উত্তরবঙ্গে। শ্লোগান তিনটি হইতেছে — (১) নিজ খোলানে ধান তোল; (২) আধি নাই — তেভাগা চাই; (৩) কর্জা ধানের সুদ নাই। কমরেড ভবানী সেন ছিলেন উহার রচয়িতা। এই রণধ্বনি লইয়াই সেদিন আধিয়ার কৃষকরা সমগ্র উত্তরবঙ্গ কাঁপাইয়া তুলিয়াছিল।


১৯৩৯ সালের আধিয়ার আন্দোলন


কৃষক সমিতির নেতৃত্বে ১৯৩৯ সালে একবার দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ি জিলার আধিয়ার কৃষকরা জোতদারের খামারের পরিবর্তে িনজেদের খোলানে ধান তুলিবার দাবিতে আন্দোলন করিয়াছিল। সে আন্দোলনের সঙ্গে তেভাগার কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেদিনের ঐ তিন জিলার তোলাবটি আন্দোলন ও মেলার লেখাই-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ঐ আধিয়ার আন্দোলনও ছিল মূলতঃ জোতদারদের নানারকম আবওয়াব ও বে-আইনী আদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সংগ্রাম। ধান কাটিয়া জোতদারের খামারে তুলিলে আধিয়াররা তাহাদের উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশও ঠিকমতো পাইত না। জোতদাররা ছিল খুবই শক্তিশালী ও বিরাট। নিজেদের অর্ধাংশ লইয়াই তাহারা খুশি থাকিত না। আধিয়ারের অংশ হইতে মার্চা, তহুরী, খোলানচাঁহা, মহলদারী, গোলাপূজা, বরকন্দাজী, মন্ডপসেলামী, সন্ন্যাসী, হাতি খোয়া (হাতির খোরাকী), মাছ খোয়া, পার্বণ, গাজন, থিয়েটার প্রভৃতি বিভিন্ন নামে বে-আইনীভাবে দফায় দফায় ধান কাড়িয়া লইত এবং কর্জা ধান পরিশোধ লওয়ার নামে আধিয়ারের অংশ হইতে সুদসহ দ্বিগুণ-তিনগুণ ধান কাটিয়া লইত। ইহারই বিরুদ্ধে আধিয়াররা তখন প্রতিরোধ করিয়াছিল এবং শেষ পর্যন্ত ঠাকুরগাঁ মহকুমা শাসকের মধ্যস্থতায় আপস হয় ও ‘দশের খোলানে’ ধান তোলা সাব্যস্ত হয়। পরবর্তীকালে ঐ চুক্তিও জোতদাররা বাতিল করে।


নির্বাচন ও তেভাগা


রংপুর মিটিং-এর পর ঐ দাবিগুলি প্রচার হইতে থাকে। ১৯৪৬ সালের শুরুতে আইনসভার যে নির্বাচন হয় তাহাতে এই তিনটি জিলাতে, বিশেষ করিয়া তফসিল আসনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনের প্রচার অভিযানের মধ্য দিয়া ঐ দাবিগুলি জিলাগুলির একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ব্যাপকভাবে কৃষকদের মধ্যে প্রচারিত হয়। দিনাজপুরে কমরেড রূপনারায়ণ রায় জয়লাভ করেন। কমরেড রূপনারায়ণ খুব কম লেখাপড়া জানা গরিব রাজবংশী কৃষক। তিনি কংগ্রেস প্রার্থী ভবেশ সিং-কে পরাজিত করেন। ভবেশ সিং ছিলেন বিরাট এক জোতদার। সমগ্র জিলাব্যাপী ছিল ঐ নির্বাচন কেন্দ্র। সেদিন জিলার সমগ্র নির্বাচনী সংগ্রাম হইয়া উঠিয়াছিল জমিদারী ও জোতদারী প্রথা উচ্ছেদের সংগ্রাম। নির্বাচনে জোতদার ভবেশ সিং-এর পরাজয় জিলার আধিয়ার ও গরিব কৃষকদের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। উহা তেভাগা সংগ্রামকে ত্বরাণ্বিত করে। নির্বাচনের পর জোতদাররাও ব্যাপক আধিয়ার উচ্ছেদ শুরু করে।


মৌভোগ সম্মেলন


১৯৪৬ সালে মৌভোগ কৃষক সম্মেলনে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ’ বিষয়ক প্রস্তাবে জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের শেষ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইতে আহ্বান করা হয়। বর্গাদারদের জন্য তেভাগা আইন প্রণয়নের দাবিও করা হয় ঐ সম্মেলন হইতে। ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কৃষক কাউন্সিল সিদ্ধান্ত লয় যে পরবর্তী ফসলের মরশুমেই তেভাগা সংগ্রাম শুরু করিতে হইবে।


অক্টোবর মাসে দিনাজপুরে পার্টির জিলা কমিটি ও জিলা কৃষক সমিতির সভায় নিজ খোলানে ধান তোল; আধি নাই তেভাগা চাই এবং কর্জা ধানের সুদ নাই– এই তিনটি দাবির ভিত্তিতে জিলায় তেভাগা সংগ্রাম শুরু করার সিদ্ধান্ত ও বিস্তৃত পরিকল্পনা লওয়া হয়। পরিকল্পনার সময় নিজ খোলানে ধান তুলিবার উপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।


‘কমরেড, ইনক্লাব’


গ্রামের মাঠে মাঠে তখন পাকা ধানের সোনালী রং-এর সমারোহ। আর হাটবাজার ও পথেঘাটে সমারোহ লাল ঝান্ডা ও লাঠিধারী ভলান্টিয়ারের। শ্লোগানে শ্লোগানে সারা গ্রাম কাঁপিয়া উঠিতেছে। পাকা ধানের শীষগুলিও কাঁপিতেছে। সংগ্রামের দামামা বাজিয়া চলিয়াছে। “কমরেড, ইনক্লাব” — ঐ ধ্বনিতেই বজ্রমুষ্ঠি উঁচাইয়া কৃষকরা একে অপরকে সংগ্রামী সম্ভাষণ জানাইতেছে। অন্য গ্রামের প্রস্তুতির খবরাখবর লইতেছে। গ্রামের পর গ্রাম ঐ একই চিত্র। গ্রামগুলি হইয়া উঠিয়াছে জমাট বাঁধা কৃষক ঐক্যের প্রতীক। ক্ষেতমজুর, আধিয়ার, মাঝারি কৃষক, কিছুটা সচ্ছল অবস্থার কৃষক– সকলেই আধিয়ারের পক্ষে লাঠি ধরিয়াছে। ভলান্টিয়ার হইয়াছে।


কমরেড গুরুদাস তালুকদারের এলাকাটি ছিল জিলার দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল। ঠাকুরগাঁর ঐ পশ্চিমাঞ্চল ছিল জিলার পার্টি ও কৃষক সমিতির সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি। ঐ এলাকা হইতেই ধানকাটা শুরু করার সিদ্ধান্ত হয় এবং উহা শুরু করার দায়িত্ব দিয়া পার্টির জিলা সম্পাদককে (এই জিলা সম্পাদক হইলেন আলোচ্য প্রবন্ধের লেখক সুশীল সেন) ঐ এলাকায় পাঠানো হয়।


মহিলা নেত্রী দীপশ্বরী


ধানকাটা শুরু হইয়াছে। একদল ভলান্টিয়ার লাল ঝান্ডা লইয়া স্কোয়াড করিয়া ধান কাটিতেছে। অপরেরা পাহারা দিতেছে। গ্রামের মেয়ে পুরুষ সকলেই মাঠে নামিয়াছে। ধান কাটিয়া আধিয়ারের বাড়িতে তোলা হইল। পুলিস কোনো বাধা দিল না। পরদিন সশস্ত্র পুলিস গ্রামে হানা দিয়া জিলা সম্পাদকসহ ৩২ জন কৃষক কর্মীকে গ্রেপ্তার করিল। ধান চুরির অভিযোগে সকলকে ঠাকুরগাঁ চালান দিল। কিন্তু ধানকাটা বন্ধ হইল না। পুলিস এবার মাঠে নামিয়া ভলান্টিয়ারদের ধান কাটায় বাধা দিতে গেল। কৃষক মহিলা কমরেড দীপশ্বরী লাঠি হাতে মাঠে উপস্থিত ছিলেন। লাঠি উঁচাইয়া তিনি পুলিসের দিকে ছুটিয়া গেলেন। অপর ভলান্টিয়াররা তঁাহাকে অনুসরণ করিল। পুলিস পিছু হটিল। মাঠ ছাড়িয়া চলিয়া গেল। কমরেড দীপশ্বরীর ঐ সাহসিক ঘটনা ও পুলিসের পিছু হটার কথা বিদ্যুৎবেগে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। সর্বত্র প্রবল উদ্দীপনা। জোর কদমে ধানকাটা সব এলাকাতেই আগাইয়া চলিল। পুলিস মাঠে নামিয়া ধান কাটায় আর বাধা দিল না বটে, তবে সব এলাকাতেই কর্মীদের নামে মিথ্যা ধান চুরির দায়ে হাজার গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বাহির করিল। জিলা শাসক ও মহকুমা শাসকদের নিকট জোতদারদের দল বাঁধিয়া ছুটাছুটি, কঋকদের মধ্যে আতঙ্ক ও সন্ত্রাস সৃষ্টির প্রচেষ্টা ও ধানকাটা স্থগিত রাখিবার জন্য জোতদাদের আপসের গালভরা প্রস্তাবের প্রচার সত্ত্বেও আধিয়াররা দ্রুত ধান কাটিয়া নিজ খোলানে তুলিতে লাগিল। পুলিস গ্রেপ্তার করিতে গ্রামে ঢুকিলে এবার প্রতিরোধের সম্মুখীন হইল।


প্রথম শহীদ শিবরাম-সমিরুদ্দিন


৪ জানুয়ারি, ১৯৪৭ সাল। দিনাজপুর শহরের সন্নিকটে চিরির বন্দর এলাকায় সশস্ত্র পুলিস কৃষকদের উপর গুলিচালনা করে। গুলিতে কমরেড শিবরাম ও সমিরুদ্দিন নিহত হন। তেভাগা সংগ্রামের প্রথম শহীদ শিবরাম ও সমিরুদ্দিন। সমিরুদ্দিন ছিলেন ক্ষেতমজুর আর শিবরাম গরিব সাঁওতাল আধিয়ার। একজন পুলিসও তীরবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।


ধানকাটা শেষ হইয়া আসিয়াছে। সংগঠিত এলাকার সর্বত্রই আধিয়াররা ধান কাটিয়া নিজ খোলানে তুলিয়াছে। পুলিসী সন্ত্রাস তাহাদিগকে দমন করিতে পারে নাই। সংকল্পে তাহারা ছিল অটল। তবে অসংগঠিত এলাকাগুলিতে আধিয়াররা প্রথমতঃ জোতদারদের খোলানেই ধান তোলে। নিজ খোলানে ধান তুলিতে সাহস করে না।


জোতদারদের উপর আধিয়ারের নোটিশ


ইতিমধ্যে সংগঠিত এলাকায় কিছু কিছু ধান ঝাড়াই ও ধান ভাগ শুরু হইয়াছে। কৃষক সমিতির ছাপ দিয়া জোতদারদের তারিখ ও সময় জানাইয়া ধান ওজন ও ভাগ করিবার সময় উপস্থিত থাকিয়া নিজ অংশ বুঝিয়া লইবার জন্য নোটিশ দেওয়া হইতেছে। জোতদাররা উপস্থিত হইতেছে না। গ্রামের লোকের উপস্থিতিতে সাক্ষী রাখিয়া ধান ওজন ও ভাগ হইতেছে। অনুপস্থিত জোতদারের ১/৩ ভাগ ধান ধর্মগোলায় জমা রাখা হইতেছে তাহাদের নামে নামে। দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকরা ঐ সকল ধর্মগোলা তৈরি করিয়াছিল।


ভান্ডনীর পুলিস গ্রেপ্তার


গ্রামে পুলিসের হানা অব্যাহত আছে। পুলিস গ্রামে ঢুকিলেই ঘন্টাধ্বনি হয়। কাঁসর-শঙ্খ বাজিয়া উঠে, এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। আর ধ্বনিত হয় ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান। কৃষক রমণীরাই ইহার সংগঠক। সঙ্গে সঙ্গে সকল বাড়ি হইতেই কৃষক মহিলারা লাঠি ঝাঁটা ও গাইন হাতে বাড়ির বাহিরে সমবেত হয় এবং পথে নামিয়া পুলিসের গ্রামে ঢুকিবার পথে প্রতিরোধ সেষ্টি করে। সর্বত্রই চলিয়াছে এই প্রতিরোধ। রাতদুপুরে ঠুমনিয়া অফিসে খবর আসিল যে রানীশঙ্কাইল-এ একটি বন্দুকধারী পুলিস মহিলা ভলান্টিয়ারদের প্রতি সম্মানহানিকর উক্তি করায় কমরেড ভান্ডনীর নেতৃত্বে মহিলারা পুলিসটিকে ‘গ্রেপ্তার’ করিয়া একটি ঘরে আটক রাখিয়াছেন। পুলিসটিকে ছাড়িয়া দিবার নির্দেশ ঠুমনিয়া হইতে না যাওয়া পর্যন্ত সারারাত কমরেড ভান্ডনী বন্দুকটি নিজ কাঁধে তুলিয়া লইয়া ঐ পুলিসকে ঘরে বন্দী করিয়া পাহারা দিতে থাকেন অন্যান্য কৃষক মহিলাদের সঙ্গে। বিভিন্ন রকমের বীরত্বের জনির সৃষ্টি করেন এই সকল রাজবংশী কৃষক মহিলারা।


সরকারী ভাঁওতা


এই সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে লীগ সরকার তেভাগা সংক্রান্ত বিল আইনসভায় আনিতেছেন। ঐ বিলের খসড়া ২২ জানুয়ারির গেজেটেও প্রকাশিত হয়। তীব্র সংগ্রামের মুখে সরকার ঐ ঘোষণা করিতে বাধ্য হন।


সংগ্রামের জঙ্গী অধ্যায় খোলান ভাঙা


সংগ্রাম এবারে নতুন মোড় লইল। এক নতুন জঙ্গী অধ্যায় শুরু হইল। ইহা খোলান ভাঙা আন্দোলন নামে পরিচিত। তেভাগা সম্পর্কে আইন হইতেছে এই সংবাদ অসংগঠিত এলাকার আধিয়ারদের চঞ্চল করিয়া তুলিল। তাহারা জোতদারের খামারেই ধান তুলিয়াছিল এবং আন্দোলনের গতি লক্ষ্য করিতেছিল। আইন হইলেও জোতদারের খামার হইতে তাহারা তাহাদের ন্যায্য অংশ পাইবে না এই আশঙ্কায় তাহারা দলে দলে কৃষক সমিতির কাছে আসিয়া সাহায্য চাহিল যাহাতে তাহারা জোতদারের খামার হইতে নিজ নিজ ধানের পূঁজ ভাঙিয়া নিজ খোলানে আনিতে পারে।


এক মানুষ, এক লাঠি, এক টাকা


সংগ্রামের জন্য সমিতির সাংগঠনিক শ্লোগান ছিল ঃ এক লাঠি–এক মানুষ–এক টাকা। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি হইতে একজন লাঠিধারী ভলান্টিয়ার, একজন কৃষক সমিতির সভ্য ও এক টাকা সংগ্রাম তহবিলে চাঁদা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঐ কাজ শেষ করিয়াই তাহারা আসিল সমিতির অনুমতির জন্য। এই আধিয়ারদের বিরাট অংশ ছিল মুসলমান কৃষক। জিলার মুসলিম লীগের নেতারা নোয়াখালি হইতে কিছু মৌলভি আমদানি করিয়া ঐ সকল মুসলমান কৃষকদের দিয়া দাঙ্গা বাঁধাইবার চেষ্টাও করিয়াছিল, কৃষক নেতা হাজী মহম্মদ দানেশকে খুন করিবার ষড়যন্ত্রও করিয়াছিল। সেই সকল মুসলমান আধিয়ার কৃষকরাই এবার হাজী সাহেবের নিকট জোতদারের খোলান হইতে ধানের পূঁজ ভাঙিয়া নিজ খোলানে আনিবার ‘হুকুম’ আনিতে যায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পূঁজ ভাঙা আন্দোলন আগুনের মতো চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। হাজার হাজার ভলান্টিয়ার দিনের পর দিন লাল ঝান্ডা হাতে মিছিল করিয়া জোতদারের খামার হইতে নিজ নিজ ধানের পূঁজ ভাঙিয়া লইয়া আপন বাড়ির খোলানে মজুত করিতে লাগিল। নিজ ধানের পূঁজ ভিন্ন জোতদারের বাড়ির অপর কিছুই তাহারা স্পর্শ করে না। জোতদাররা এবার আতঙ্কিত হইয়া গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করিল। জিলা শহর ও মহকুমা শহরে তাহারা ভীড় করিল। কেহ বা কলকাতা ছুটিল। জিলা হইতে সহস্র সহস্র টেলিগ্রাম ছুটিল মন্ত্রীদের কাছে– লুঠতরাজ ও ডাকাতির কাল্পনিক অভিযোগ আনা হইল সংগ্রামী কৃষকদের বিরুদ্ধে। কংগ্রেস নেতা শ্রী নিশীথনাথ কুন্ডু জোতদারদের এক প্রতিনিধিদল লইয়া কলকাতা রওনা হইলেন। জোতদারদের চাপে লীগ সরকার পিছু হটিল। গেজেট প্রকাশিত হইলেও তেভাগা বিলটি আইনসভায় উত্থাপিত হইল না। ইহার পরিবর্তে আসিল নৃশংস দমন-পীড়ন। জিলার বিভিন্ন স্থানে ৩৫টি পুলিস ক্যাম্প বসিয়াছিল। সেই সকল ক্যাম্প হইতে শুরু হইল গ্রামে গ্রামে ব্যাপক পুলিসী অভিযান।


রক্তঝরা খাঁপুর


পতিরাম-খাঁপুরেও আন্দোলন ছড়াইয়া পড়ে। পতিরামে জোতদারের খোলান হইতে ধানের পূঁজ ভাঙিয়া ভলান্টিয়াররা আধিয়ারদের নিজ খোলানে ধান তুলিয়া দেয়। পার্শ্ববর্তী গ্রাম খাঁপুরেও আন্দোলন শুরু হয়। খাঁপুরের সিংহকাছারির জমিদার খুব প্রতাপশালী। জোতদারের ধানের খোলান ঘেরা ছিল না। আধিয়ার কৃষকদের গরু গিয়া ঐ ধান খাইলে জোতদার আধিয়ারদের সব গরু ধরিয়া খোঁয়াড়ে পাঠাইবার জন্য বরকন্দাজদের হুকুম দেয়। বরকন্দাজরা গরু খোঁয়াড়ে লইতে গেলে কৃষকরা উহা কাড়িয়া লয়। জোতদার ক্রুদ্ধ হইয়া পুলিস ডাকে। সতেরোজন আধিয়ার কৃষকের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা লইয়া সশস্ত্র পুলিস গ্রামে গিয়া গ্রেপ্তার শুরু করে। আগুনের মতো সংবাদ ছড়াইয়া পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে ঐ স্থানে ভলান্টিয়ারদের বিরাট সমাবেশ ঘটে। কৃষকরা অন্যায় গ্রেপ্তার প্রতিরোধ করে। বিরাট কৃষক বাহিনীর সম্মুখীন হইয়া পুলিস ১২১ রাউন্ড গুলি চালনা এবং ২২ জনকে হত্যা করে। কমরেড কালী সরকার ছিলেন ঐ এলাকার জিলা সংগঠক। ঐ দিনই খাঁপুরের ঐ ঘটনাস্থলে বিরাট কৃষক সমাবেশ হয়। কমরেড অবনী লাহিড়ী ঐ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।


পুলিসের খুনের নেশা


পুলিস তখন খুনের নেশায় মাতিয়া উঠিয়াছে। পরদিনই ঠাকুরগাঁর পশ্চিল অঞ্চলে ঠুমনিয়ায় গুলি চলিল। কমরেড সুকুরচাঁদ ও তাঁহার স্ত্রীসহ ৪ জন কৃষক গুলিতে নিহত হইলেন। খাঁপুর-ঠুমনিয়ায় গুলি চালানোর প্রতিবাদে ঠাকুরগাঁ শহরে কৃষকদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হইল। শান্তিপূর্ণ সেই মিছিল ও সমাবেশকে হঠাৎ বে-আইনি ঘোষণা করা হইল এবং কোনো রকম সময় বা সতর্কীকরণ ছাড়াই পুলিস কৃষকদের উপর আবার বেপরোয়া গুলি চালনা করিল। পাঁচজন কৃষক নিহত হইলেন। কমরেড সৌরি ঘটক ঠাকুরগাঁ শহরে সরকারী চাকুরি করিতেন। গোপন যোগাযোগ কেন্দ্রটির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁহাকে জিলা হইতে বহিষ্কার করা হইল। সারা জিলায় দমননীতির তান্ডব চলিল। ঠাকুরগাঁর কৃষক সমাবেশ উপলক্ষে দিনাজপুর শহর হইতে মহিলা নেত্রী কমরেড রানী মিত্র (দাশগুপ্ত) ও বীণা গুহকে ঠাকুরগাঁ পাঠানো হইল। পুলিস তাহাদিগকে সমাবেশের স্থানে যাইতে দেয় না। ঠাকুরগাঁ শহর হইতে ফেরত পাঠাইয়া দেয়। কলিকাতা হইতে ছাত্র, যুবক, ডাক্তার ও সাংবাদিকদের যে-সকল সৌভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধিদল পাঠানো হইত তাহাদিগকে জিলার মহিলা নেত্রীরাই সংগ্রামের এলাকাগুলিতে লইয়া যাইতেন। উহাও পুলিস বন্ধ করিয়া দিয়া বহির্জগৎ হইতে এলাকাগুলিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিল। খাঁপুরেও মেডিক্যাল মিশনকে ঢুকিতে দিল না। এবার শুরু হইল পুলিসের বাড়ি বাড়ি হানা, মারপিট, গ্রেপ্তার ও লুটপাট। পুলিস আধিয়ার কৃষকদের বাড়ি হইতে ধান লইয়া জোতদারদের বাড়িতে তুলিয়া দিতে লাগিল। কৃষকরা বাড়ি ছাড়িয়া জঙ্গলে আশ্রয় লইল। পুলিস জঙ্গলগুলিতেও আগুন ধরাইয়া দিতে লাগিল। মেয়েদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালাইল। কর্মীদের গ্রেপ্তার করিতে না পারিয়া তাহাদের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করিবার পরোয়ানা বাহির করিল। এবার সকল প্রতিরোধ ভাঙিয়া পড়িল। দমন-পীড়নের অন্ধকারময় দিনগুলির মধ্যেই আসিয়া উপস্থিত হইল সেই স্মরণীয় দিনটি– ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। আমরাও গ্রামের গোপন কেন্দ্র হইতে প্রকাশ্যে বাহির হইলাম। দেশের সকল মানুষের সঙ্গে আধিয়ার কৃষকদের লইয়া মিছিল করিয়া স্বাধীনতালাভের বিজয়-উৎসব পালন করিলাম।


তেভাগার দাবি সেদিন আদায় করা যায় নাই। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ কৃষকদের রক্তের বন্যায় ঐ সংগ্রাম ডুবাইয়া দেয়। তবুও নিঃসংশয়ে ইহা বলা চলে যে ঐ সংগ্রাম সেদিন সাম্রাজ্যবাদসৃষ্ট জমিদারী-জোতদারী শোষণ ও ভূমি ব্যবস্থাকে আসামীর কাঠগড়ায় টানিয়া আনিয়া সমগ্র জাতির সম্মুখে হাজির করিয়াছিল। আর ঐ সংগ্রাম ছিল ইদানীংকাল পর্যন্ত বঙ্গদেশের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত সর্ববৃহৎ সংগঠিত কৃষক সংগ্রাম। স্বাধীনতা সংগ্রামী কমিউনিস্ট কর্মীরাই সেদিন দুর্গম গ্রামাঞ্চলে পশ্চাৎপদ, দারিদ্র্যপীড়িত, শোষিত ও নিরক্ষর কৃষকদের মধ্যে ধিনের পর দিন পড়িয়া থাকিয়া, অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া তাহাদের সংগঠিত করিয়াছিল। রাজনৈতিক শিক্ষা দিয়া ঐ কৃষকদের মধ্য হইতেই এক বিরাট সুশিক্ষিত কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করিয়া পার্টি গড়িয়াছিল। ঐ কর্মীবাহিনীই ছিল তেভাগা সংগ্রামের এলাকাভিত্তিক নেতা ও মূল শক্তি।


ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিলির দাবি অতীতে ছিল প্রধানতঃ কৃষকের দাবি। আজ উহা জরুরী জাতীয় দাবিরূপে স্বীকৃতিলাভ করিয়াছে। কারণ ইহা ছাড়া জাতীয় অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় গতিবেগ সৃষ্টি করা সম্ভব নহে। গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন সকল মানুষের মধ্যেই এই উপলব্ধি আজ দ্রুত প্রসারলাভ করিতেছে। তেভাগা সংগ্রামের দিনে অবস্থা ছিল বিপরীত।


সামন্ততন্ত্রের অবশেষগুলি আজও ভাল রহিয়াছে। গ্রামাঞ্চলে পরাক্রান্ত জোতদার-মহাজনের হাতে আজও গরিব কৃষক ও বর্গাদাররা নিপীড়িত হইতেছে। জোতদারের ভয়ে আজও বর্গাদাররা জরিপের সময় নিজ নাম রেকর্ড করাইতে সাহসী হয় না। আজও বর্গাদার উচ্ছেদ ব্যাপক। শক্তিশালী সংগঠিত কৃষক আন্দোলনই ইহার অবসান ঘটাইতে পারে। তেভাগা সংগ্রামের রজত-জয়ন্তীতে সেই সংকল্পই ঘোষিত হউক সর্বত্র।


পরাধীন ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে অব্যাহত রাখিবার জন্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থা ও তাহার শোষণকে নির্মমভাবে কায়েম রাখিয়াছিল এদেশে। তেভাগা সংগ্রাম ছিল সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। দরিদ্র কৃষকদের ঐ সংগ্রাম প্রকৃতই ছিল সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কৃষকের মুক্তি সংগ্রাম। ঐ সংগ্রামে কারাবরণকারী নির্যাতিত কৃষক ও কৃষক শহীদদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা অবশ্যই আমাদের এক জাতীয় কর্তব্য।


[তেভাগা আন্দোলনের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সময় প্রয়াত সেন এই প্রবন্ধটি রচনা করেন। ]

Leave a comment