বা ঙা ল না মা

আমোদিনী’র হেঁশেল – চতুর্থ পর্ব

Posted by bangalnama on September 13, 2010


লেখা ও ছবি – দেবলীনা সেন

(তৃতীয় পর্বের পর)


শুভদিনের ভোজ


ছেলেমেয়েরা কয়েকদিন পরীক্ষা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল। আদা-জল খেয়ে পড়াশুনা করেছে এবং পরীক্ষার ফলাফল সকলেই মোটামুটি ভাল করেছে। গণু বড়ই ফাঁকিবাজ, আমোদিনী ওনার মেজ ছেলেকে চোখে চোখে রাখেন। তাতে এবারও কাজ হয়েছে, গণু ফার্স্ট ডিভিশানে পাশ করেছে।


পারুলের পড়ায় বিশেষ মন নেই, কিন্তু মেয়েটা সত্যিই খাটতে পারে। সবরকমের কাজে ওকে পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রমই যেন পারুলের সাধনা।


গৌরী সবচেয়ে ছোট – খুব আদুরে মেয়ে। পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন বেরোয়, বাবাকে এসে খুব খুশিভাবে বলেছে, “বাবা, আমি পাশও না, ফেলও না।” এই অদ্ভুত খবর সকলের কানে পৌঁছাতেই সকলে এগিয়ে এল জানতে যে ব্যাপারটা কী।


গৌরী সবে ক্লাস টু’তে পড়ে। বাবা অনুকূলের কোলে বসে গৌরী বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা। ক্লাসে যারা সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করেছে, সেই প্রথম তিনজনকে সামনে ডেকে প্রশংসা করা হয়েছে। এবং যারা সবচেয়ে খারাপ রেজাল্ট করেছে, তাদেরও ডেকে বলা হয়েছে যে তারা যেন পরের বার আরো ভাল করে পড়াশুনা করে পাশ করে, তারা যেন বেশি মন খারাপ না করে। বাদবাকী মাঝের ছাত্রীদের রেজাল্ট খামে করে দিয়ে ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। সুতরাং শিশু গৌরী ভাবল যে ও এবং বাকী ছাত্রীরা ‘না পাশ না ফেল।’


আমোদিনী’র আটটি সন্তান। সকলকে রোজ চার হাতা ভাত, ডাল এবং ডিমসেদ্ধ খাইয়ে স্কুলে পাঠানোর নিয়মের ফলাফলে আজ সবাই হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। আজ আমোদিনী ওদের জন্যে একটু বেশি ভাল রান্না করে খাওয়াবে। এটা ওদের উপহার। তাই আজ বানানো হবে লুচি, আলুর তরকারি, বেগুনভাজা, ছানার ডালনা, বাঁধাকপির তরকারি, ইলিশ মাছের সর্ষেবাটা, সাদা আতপ চালের ভাত, চালতার চাটনি আর পায়েস। এতজনের জন্য লুচি বানানোটা কষ্টকর, কিন্তু এমন দিনে একটু কষ্ট তো করতেই হবে…


তবে ভাল করে লুচি বানাতে গেলে কিছু নিয়ম জানবার প্রয়োজন হবে। আজ আমোদিনী’র তৃতীয় কন্যা পাখি, যার এখন দশ বছর বয়স, প্রথমবার লুচি বানাতে শিখবে। আমোদিনী’র বড় দু’জন মেয়ে মণি এবং পারুল বেশ ভালই লুচি বানাতে পারে। তারাও ছোট বোন পাখিকে সাহায্য করবে। লুচির ত্রুটি যেন না হয়!


“ময়ান দিবি ঘি দিয়ে, লুচি ভাজবি সাদা তেল আর ঘিয়ের মিশ্রণে।”
“নরম লুচির জল হইব গরম, আর ফুসফুসে লুচির জল হইব ঠান্ডা।”
“ময়দা মাখবি যতক্ষণ ময়দা এক্কেবারে তরল হইয়া যায়।”
“লেচি কাইট্যা, লেচিগুলিরে ভাল কইরা টিপ্যা হাতের গোড়ায় গোল পাকাইবি – তা হইলে দেখবি একটু শামুকের মতন দেখতে লাগব। যখন লুচি বেলবি, লুচির আকার গোল হইতে সুবিধা হইব। যখন লুচি ভাজবি, এই শামুকের মধ্যিখানটা বেশি কইরা ফুলব।”
“ভাজবার তেলটা য্যান খুব গরম, যাতে লুচি তক্ষুণি ফুইল্যা ওঠে। লুচিগুলিরে হাতা দিয়া তেলের তলায় ডুবাইতে হইব, প্রথমে এক পাশ, তারপর অন্য পাশ। কিন্তু লুচি য্যান ধবধবে সাদা থাকে। লালচে রঙ হইলে ভাল লুচির ত্রুটি।”


লুচি


কি কি লাগবেঃ (গোটা ২০-২৫ লুচির জন্য)
ময়দা – ২ কাপ(৮ আউন্সের কাপ)
ময়ান(ঘি) – ৪-৫ বড় চামচ
জল – ১/৩-১/৪ কাপ
লবণ – ১/৪ ছোট চামচ


প্রণালী
ময়ান আর লবণ দিয়ে ময়দাকে ভাল করে মেশাতে হবে, পাঁউরুটির গুঁড়োর মত দেখতে লাগবে। তারপর জল আস্তে আস্তে করে দিয়ে, নরম করে মাখতে হবে। আঠাভাব যেন না থাকে।


এই মাখাটা সমানভাবে ভাগ করে, উপরুক্ত কথাগুলি মাথায় রেখে, লুচি ভেজে ফেলতে হবে।


আলুর তরকারি


আমোদিনী’র হেঁশেলের আলুর তরকারির খুব সুনাম। আলু হবে রাজা, মশলা খুব কম। সামান্য হলুদ – মৃদু হলুদের সুবাস এবং হালকা হলুদ রঙের চেহারা, কালো জিরা এবং কাঁচালঙ্কার একটা রেশ। বেশি হলুদ দিলে স্বাদই নষ্ট হয়ে যাবে, এবং তরকারির চেহারা তীব্র লাগবে দেখতে।


কি কি লাগবে
আলু’র ছোট টুকরো – ২ কাপ(খোসাগুলো দিয়ে আলুর খোসা ভাজা করা হবে পরের দিন)
হলুদ বাটা বা গুঁড়ো – ১/২ ছোট চামচ(গুঁড়ো হলে একটু জলে গুলে দিলে ভাল হত)
কাঁচালঙ্কা – ২-৩ গোটা(ইচ্ছা করলে আরো দেওয়া যাবে)
কালোজিরে – ১/২ ছোট চামচ
লবণ – ১ ছোট চামচ
চিনি – ১/২ ছোট চামচ
তেল – ৩ বড় চামচ


প্রণালী
কড়াইতে তেল গরম করে, কালোজিরে এবং আস্ত কাঁচালঙ্কা ছেড়ে দিতে হবে। কালোজিরে একটু ভেজে উঠলেই আলু ছেড়ে দিয়ে দু’একবার নাড়াচাড়া করতে হবে। আলু যেন সাঁতলে না যায়। হলুদ দিয়ে আলুগুলোকে ভাল করে মিশিয়ে দিয়ে লবণ, চিনি দিয়ে এক মিনিট মতন নাড়াচাড়া করতে হবে (হলুদটা যেন একটু সাঁতলে যায় – যাতে কাঁচা হলুদের গন্ধ না থাকে)। তারপর আরো জল (আলুগুলো ঢেকে যায় যেন) দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে। আঁচ নামিয়ে, কড়াইটাকে ভাল করে ঢেকে কিছুক্ষণ রান্না চলুক, যতক্ষণ না আলুগুলো নরম হয়ে যায় (কিন্তু ঘেঁটে না যায়)। আঁচ থেকে নামাবার পর আলু আরো ঝোল টেনে নেবে – তাই শেষে তরকারি বেশ ঘন হয়ে উঠবে।


বেগুন ভাজা


এটা তো সোজা। শুধু কিছু বক্তব্য – কচি সবুজ(কাশী’র) বা সাদা বেগুন হলে, ফালাগুলো ১/৪ ইঞ্চির মত উঁচু হয়ে থাকলে ভাল। কিন্তু এতে তেল বেশি লাগবে, যদিও বেগুনভাজা মুখে মাখনের মত গলে যাবে। ছোট বেগুনের মিহি ফালি ভাল হয়।


আমোদিনী ওনার বেগুন ভাজায় হলুদ মাখাতেন না, বরং অল্প লবণ আর চিনির একটু ছিঁটে মাখাতেন।


ইলিশ সর্ষেবাটা ভাপে


কি কি লাগবেঃ (৬ জনের আন্দাজ পরিমাণে)
ইলিশ মাছের টুকরো – ৬ (একবারের বেশি হালকা করে ধুলে মাছের স্বাদ কমে যাবে!)
সর্ষেবাটা – সর্ষে (১/২ কাপ, রাতভর দুধ+জল-এ ভেজানো)
কাঁচালঙ্কা (৫-৬)
হলুদবাটা (২ ছোট চামচ বা ১ চামচ হলুদ গুঁড়ো)
লবণ (১ ছোট চামচ)+ ঘানির সর্ষের তেল (১/৩ কাপ, ঘানি না থাকলে বোতলের তেলই চলবে)
(সর্ষে বাটার সময়ে অল্প দুধ দিয়ে বাটলে সর্ষে তেতো লাগবে না।)


প্রণালী
মাছগুলো বাটনায় মাখিয়ে কোনো ভাল ঢাকনা দেওয়া কৌটোতে ভরে, ভাতের হাঁড়িতে ভাত হওয়ার সময় রেখে দিলে সুন্দর ভাপে রান্না হয়ে যাবে। পরিবেশনের সময় আরেকটু কাঁচা তেল ওপর থেকে ছড়িয়ে দিলে বেশ সুন্দর ঝাঁজ হবে।


মাছের ‘তেল’(মাছের নাড়িভুঁড়ি) আলাদা করে ভেজে ভাতের সাথেও খাওয়া যাবে।


ছানার ডালনা


কি কি লাগবেঃ (৬ জনের পরিমাণে)
ছানার টুকরো – ১/২ কেজি (ভাল করে ছেঁকে একটু শুকিয়ে, ঘিয়ে ভেজে একটু লালচে রঙ ধরলেই তুলে রাখতে হবে)
আলু’র টুকরো – ছোট করে কাটা
আস্ত গরম মশলা – এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি (কয়েকটা করে টুকরো)
তেজপাতা – ২
শুকনো লঙ্কা – ২
হলুদ – ১ ১/২ ছোট চামচ
জিরে – ১ ১/২ ছোট চামচ
ধনে – ১ ছোট চামচ
ঘি – ৫ বড় চামচ (ছানার ডালনাতে তেলের চেয়ে ঘি-তে অনেক বেশি স্বাদ হয়)
লবণ – প্রয়োজন মত


প্রণালী
ঘি গরম করে, তেজপাতা, আস্ত গরম মশলা এবং শুকনো লঙ্কা হালকা করে ভেজে, ছানা এবং আলুর টুকরো দিয়ে সাঁতলাতে হবে। তারপর হলুদ, জিরে, ধনে, শুকনো লঙ্কা দিয়ে আরো মিনিট দুই-এক সাঁতলাতে হবে।


লবণ আর পরিমাণমত জল দিয়ে, ঢাকা দিয়ে হালকা আঁচে রাঁধতে হবে – আলুগুলো গলে গেলে ডালনাটা নামিয়ে নেবেন।


বাঁধাকপির তরকারি


এই রান্নার আশ্চর্য্য ব্যাপার হল যে বাঁধাকপির কাটার ধরণের উপর স্বাদ নির্ভর করে! এটা বাড়ির সকলের প্রিয়, খেলেই বোঝা যাবে কেন! এই রান্নার জন্যে সবকিছু জোগাড় করে একজায়গায় রাখলে ভাল – সবকিছু পরপর খুব তাড়াতাড়ি লাগবে।


*নিরামিষ পদ্ধতিটাই দিলাম, আমিষ ইচ্ছা করলে কুচো চিংড়ি দেওয়া যেতে পারে।


কি কি লাগবে
বাঁধাকপি – অতি মিহিভাবে কাটা (বাঁধাকপিটাকে চার ফালা করতে হবে। মাঝের ডগা বা শাঁসটা কেটে বাদ দিতে হবে। তারপর খুব ধারালো ছুরি বা বঁটি দিয়ে অতিরিক্ত মিহিভাবে কপিটা কেটে একবার জল দিয়ে ধুয়ে রাখতে হবে)
সর্ষের বা সাদা তেল – ৫ বড় চামচ
জিরে বাটা বা গুঁড়ো – ১ বড় চামচ
লঙ্কা বাটা বা গুঁড়ো – ১ ছোট চামচ
হলুদ গুঁড়ো – ১ ছোট চামচ
দারচিনি – ১-২ বড় টুকরো
লবঙ্গ এবং বড় এলাচ(কালো) – ১-২(ইচ্ছে হলে দিতে পারেন)
তেজ পাতা – ২
ঘি – ১/৪ কাপ
লবণ – পরিমাণ মতন


প্রণালী
তেল গরম করে জিরে গুঁড়ো ছেড়েই সঙ্গে সঙ্গে শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো (পর পর) দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে আঁচ কমাতে হবে (এই দুটো মশলা খুব তাড়াতাড়ি পুড়ে যায়, তাই খুব চটপট রান্না করতে হবে)।


বাঁধাকপিটা কড়াইতে দিয়ে তেল-মশলার সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে। একটু সাঁতলে, হলুদ গুঁড়ো এবং লবণ দিয়ে আরো মিনিট দুই-তিন সাঁতলাতে হবে। তারপর তেজপাতা, দারচিনি (এবং বাকি গরম মশলা যদি ব্যাবহার করা হয়) দিয়ে ধীমে আঁচে সাঁতলাতে হবে। এই তরকারিটাতে একটু লালচে বা পোড়া ভাব দেখা দিলে তরকারির স্বাদ আরো বেশি ভাল হয়। তাই একটু ধৈর্য্য ধরে সাঁতলাতে হবে। পরিবেশন করার পূর্বে একটু গলানো ঘি উপরে ছড়িয়ে দিলে উত্তম।


*ইচ্ছে হলে ছোট করে কাটা আলু, কড়াইশুঁটি বা কুচো চিংড়িও দেওয়া যায়। এগুলো দিলে, হলুদ দেওয়ার সময় দিতে হবে।


খাওয়ার সময় অনুকূল দাশগুপ্ত, আমোদিনী’র স্বামী, হেসে বললেন, “পাকঘরে ময়দার সঙ্গে ঘি-এর সঙ্গম হইসে, আমাগো আর এইখান থেইক্যা উঠানো যাইব না!”


আমোদিনী মুচকি হাসেন। সন্তানের পেট ভরলে, ওনারও পেট ভরে যায়।


সমাপ্তি, মিষ্টিমুখ এবং কিছু অন্তর্দর্শন


সকালে সবাই ভাত খেয়ে কাজে এবং স্কুলে চলে গেলে, আমোদিনীর বাড়িতে প্রচুর কাজ, সব একাই করতে পারেন। অবশ্য মেয়েরা বাসন ধোয়া, আলনা গুছানো, বিছানা ঝাড়া, ঘর ঝাঁট দেওয়া, সবেতেই যোগ দেয়। আমোদিনী’র চার পুত্রও মাঝে মধ্যে বাড়ির কাজ করে, কিন্তু এই রকমভাবে ছেলেরা বাড়ির কাজ করাটা ওঁদের সমাজে একটা নতুনত্ব। তাও দাশগুপ্ত পরিবারে ছেলেমেয়েদের কাজ ধীরে ধীরে অদল-বদল হচ্ছে।


তবে ছেলেগুলো ভারী ফাঁকিবাজ, পারলেই ফুটবল খেলতে পালিয়ে যায়। আমোদিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সকলের জামাকাপড় ধুয়ে উঠানের দড়িতে টান করে মেলে দেন। ভাতের ফেন দিয়ে কাপড়ে মাড় লাগান। তারপর কাপড় শুকিয়ে এলে, গরম কড়াইয়ে কয়েকটা জ্বলন্ত কয়লার টুকরো পুরে দিয়ে সেই জামাগুলি কাঠের চৌকির ওপরে রেখে ‘ইস্তিরি’ করেন। ওনাদের বাড়িতে ‘ইস্তিরি’ নেই। ধোপাকে অত টাকা দেওয়া সম্ভব নয়, তাই আমোদিনী নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে এই ব্যবস্থা করেছেন।


ওনার একজন ভাই যিনি জাহাজে কাজ করতেন, দেশে-বিদেশে ঘুরে এসে একবার বলেন, “দিদি, তোমাগো বাড়িতে মনে হয়, যখনই প্রয়োজন, আলমারি থেইক্যা ১০০০/- টাকা বার কইর‌্যা দিতে পারবা।” কিন্তু আমোদিনী শুধু মুচকি হাসেন। উনি জানেন যে এতজন সন্তানকে নিয়ে সংসার চালানো কত কঠিন। পূর্ববঙ্গের বেশিরভাগের মহিলারাই এইভাবে হিসাবী সংসার চালাতেন। বড়লোকী ঢং ওনাদের আকর্ষণ করেনি। কোনো কিছু ফেলবার আগে দেখতেন সেগুলো কোনোরকমে কাজে লাগানো যেতে পারে কিনা।


দৈনিক রান্না শেষ হলে কাঠকয়লার উষ্ণ আঁচে জল গরম করা হত, নানা কাজের যোগাড়ে। আর হত আমোদিনীর কয়েকটি বিশেষ ভালবাসার রন্ধন – নারকেলের নানারকম মিষ্টি।


চিকন চিঁড়া


পাকা নারকেলের টুকরো নিয়ে, খুব ধারালো বঁটি বা ছুরি দিয়ে অতি মিহি টুকরো করতে হবে। সেগুলোকে ছোট করে কাটতে হবে, যেন দেখতে ঠিক চিঁড়ার মতন হয়। লোহার কড়াইতে ধীমে আঁচে একটু করে চিনি ছিটিয়ে নাড়তে হবে। চিনি যেন গলে যায় কিন্তু লালচে ভাব না হয়। বেশ কিছুটা ধৈর্য্যের প্রয়োজন হবে।


এই চিকন চিঁড়া ঠাণ্ডা হলে একটু কড়কড়ে খেতে হবে। মুখে পুরলে প্রথমে নারকেলের সুগন্ধ পাবেন, শেষদিকটা চিবিয়ে খেলে একটি অসাধারণ মুখরোচক স্বাদ পাবেন।


গঙ্গাজল


হ্যাঁ, এটাও একটা নারকেলের মিষ্টি। নামের কারণটা ঠিক জানা নেই। সম্ভাব্য কারণ হল যে এই মিষ্টিটা মুখে পড়লে জলের মত উধাও হয়ে যাবে, শুধু রয়ে যাবে একটা রেশ।


নারকেল কুরিয়ে একটা পাত্রে রাখতে হবে। এর মধ্যে এক লিটারের মত গরম জল ঢালতে হবে। নারকেল কোরা গরম জলে দু-এক মিনিট মিশিয়ে দিয়ে ছেঁকে তুলতে হবে। নারকেলের এইভাবে বানানো ‘দুধ’ চিংড়ি মাছের মালাইকারিতে ব্যাবহার করা যায়। ছাঁকনিতে বাকি যে নারকেলটা রয়েছে, সেটাকে একটা লোহার কড়াইতে ধীমে আঁচে সামান্য চিনি(১/৩ কাপ) দিয়ে আস্তে আস্তে নাড়তে হবে। শুকিয়ে যাবে, কিন্তু রঙ যেন সাদা থাকে। ঠাণ্ডা হলে ছোট বাটিতে পরিবেশন করা যাবে।


চন্দ্রপুলি


ক্ষীর, চিনি এবং নারকেল কোরা, সমান পরিমাণে মিশিয়ে ধীমে আঁচে নাড়তে নাড়তে কড়াপাক হবে। একটু ঠাণ্ডা হলে, চন্দ্রপুলি’র ছাঁচে(অর্ধচন্দ্র) ভরে গড়ে নিতে হবে। চাইলে এলাচ গুঁড়োও ক্ষীরের সাথে মেশানো যায়।


এই ক’টা হারানো মিষ্টি খান, আর ভেবে দেখুন, আমোদিনীর সময়ে অল্পেতে কত কী করা যেত।


আমোদিনী’র হেঁশেলের শেষ রান্নাটা ওনাকে সশ্রদ্ধ নিবেদন জানিয়ে লিখছি। সেটা হল রুগির জন্যে বানানো মুর্গির সূপ।


মুর্গির সূপ! আশ্চর্য্যের কারণ থাকতেই পারে। এটার পেছনে একটা গল্প আছে। আগে গল্পটা বলে ফেলি।


আমোদিনী’র বয়স অনেক। উনি তখন বৃদ্ধা। অনুকূল বাবুর মৃত্যুর পর আমোদিনী বিধবার সাদা ধুতি পরতে লাগলেন। ওনার আলাদা নিরামিষ রান্নাঘর হল। মেজ ছেলে গণুর ঘরে আমোদিনীর একটি সুন্দর ফুটফুটে নাতনি জন্মেছে। ছোট্ট মায়া বড় আদরের সন্তান। যখন মায়ার বয়স দেড় বছর, সে হঠাত খুব আমাশায় ভোগে। শিশু মায়ার শরীর এই প্রবল অসুখ সহ্য করতে পারে না, প্রায় মরার পথে চলে যায় সে। ডাক্তাররা অনেকরকম ওষুধ খাইয়েও বাচ্চাকে সুস্থ করতে পারলেন না। একজন অল্পবয়সী ডাক্তার এসে মায়ার বাবা-মা’কে বললেন, “যদি পারেন, একটু মুর্গির সূপ দিয়ে দেখতে পারেন, আর তো কিছু করা যাচ্ছে না।” এই শুনে বাড়ির রান্নার ঠাকুর বড়ই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। হিন্দু বাড়িতে মুর্গি রান্না! জাত ধ্বংস হয়ে যাবে! ওনার এই পাকঘরে মুর্গি রান্না হলে উনি আর এই বাড়িতে কাজ করবেন না। পরিবারের সকল সদস্য রান্নার এই ঠাকুরকে বোধহয় বেশি সম্মান দিলেন – সবাই চুপ। আমোদিনী দোতলার পুজোর ঘর থেকে এইসব চ্যাঁচামিচি শুনতে পেলেন। বেরিয়ে এসে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নার ঠাকুরকে তক্ষুণি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। বাড়ির বাকি বিস্মিত লোকজনকে খুব বকলেন, “একটা বাচ্চার প্রাণ আর জাত-ধর্মের কথা! ত’গোর কি বুদ্ধি-বিবেচনা নাই? এই মুর্গি আমার নিরামিষ রান্নাঘরে বানানো হইব। ওষুধ মনে কইরা বানানো হইব আর ওষুধ মনে কইরা মাইয়ারে খাওয়াবি। দেখি আমার জাত নিয়া কে এত টানাটানি করে, কার এত সাহস!”


মুর্গির সূপ খেয়ে খেয়ে মায়া অবশেষে বেঁচে গেল।


আমোদিনী আরেকবার প্রমাণ করে দিলেন যে খাবার শুধু শরীরের পুষ্টির জন্যে না, মনের পুষ্টির জন্যেও প্রয়োজন। বারো বছর বয়সে মুর্গি খেতে চেয়েছিলেন, তখনও নিয়ম ভেঙেছিলেন, এখনও ভাঙলেন। খাবার শুধু নিয়মে বাঁধলে চলে না, নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা এবং ইচ্ছা সমতুল্য।


ওহ, হ্যাঁ! ভুলেই গেছিলাম, মুর্গির সূপ – মুর্গির টুকরো ধুয়ে একটু লবঙ্গ আর এলাচ, লবণ আর জল দিয়ে সেদ্ধ করলেই হল।


আশা করি আপনারা সকলেই আমোদিনীর হেঁশেলের রান্নার প্রণালী এবং গল্পগুলি পছন্দ করলেন। আজ এই রইল।

8 Responses to “আমোদিনী’র হেঁশেল – চতুর্থ পর্ব”

  1. মহাশ্বেতা said

    খুব ভাল লাগল পড়ে। বেশিরভাগ খাবার গুলিরই খুব চেনা নাম, খেয়েওছি, কিন্তু রান্নার পেছনের ছোট ছোট নিয়মগুলি অনেকগুলিই জানতাম না। ‘চিকন চিঁড়া ‘ আজাকাল কেউই পড়ায় বানাতে পারে না, তবে আমি একবার খেয়েছি আমার এক মামির কাছে, বেশ কয়েক বছর আগে। মামি অবশ্য নাম বলেছিলেন ‘নারকোলের চিঁড়ে’
    “… খাবার শুধু শরীরের পুষ্টির জন্যে না, মনের পুষ্টির জন্যেও প্রয়োজন…খাবার শুধু নিয়মে বাঁধলে চলে না, নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা এবং ইচ্ছা সমতুল্য।” – কথাটা আমার ভাল লাগল।

  2. brishti said

    বাঙ্গালনামায় ,শ্রীমতি দেবলীনা সেনের “আমোদিনীর হেঁশেল’ আমাদের সবার কাছেই বড়ই আদরের..আমি নিজে,সব সময় সব রান্না গুলো যে করতে চেষ্টা করি তা নয়…কিন্তু রন্ধন পদ্ধতি-উপকরণ-আয়োজন সেই সাথে তৎকালীন পারিবারিক-পারিপার্শ্বিকতার বিবরণ, এই সব পড়েই কেমন যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠে 🙂

  3. Devalina Sen said

    আপনাদের অসঙ্ক ধন্যবাদ জানাই।

  4. Sayantan Sarkar said

    Achha bnadhakopi te kucho chingri r poriborte Ilish machher matha to deoa jete pare?

    • Devalina Sen said

      @Sayantan
      Reply ditey deri holo- khoma korben.
      Haan- Bandhakopir torkari te Ilish Machher matha ditey paaren- tobey bandhakopi ta aaro mota korey katben, aar ilish machher mathata agey ektu shorsher tel e shNatley neben.

  5. ashadharon DD …

  6. sarmili mishra(chattopadhyay) said

    darun!

  7. ujjaini said

    khoob bhalo laglo ……………..aro lekha add karun !

Leave a comment