আমোদিনীর হেঁশেল – তৃতীয় পর্ব
Posted by bangalnama on October 25, 2009
গ্রীষ্মের দিন শেষ হতেই শুরু হয় বর্ষার দিন। আর বর্ষার দিনের পর আসে সেই কুয়াশা-ঢাকা ভোরবেলা, গুচ্ছে গুচ্ছে কাশফুলের বান আর আসে বাঙালীদের প্রিয় পার্বণ – বিশ্বকর্মাপুজো, দূর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, ঈদ…
আমোদিনী দৈনিক রান্নার সীমানা পেরিয়ে সেই পার্বণের বিশেষ রান্নার জোগাড় করতেন। একটু হয়তো তেল বা ঘিয়ের ভাণ্ডার লুটে নিতেন এই সময়। পার্বণ তো! আনন্দের দিনে কি আর হিসাব-নিকাশ করা যায়? আমোদিনীর হেঁশেল থেকে দু’টো হারানো খাদ্যের সন্ধান আজ জানাই।
প্রথমটা হল ‘কাওইনের চালের পোলাও’ এবং দ্বিতীয়টা ‘আমাদার সন্দেশ।’
কাওইনের চালটা ঠিক কোনো রকমের ধানের চাল না। এক প্রকারের বীজ – যেটাকে cereal বলা যায়। খুব ছোট্ট ছোট্ট দানা, একটু বাদামের মতন স্বাদ। এই চাল খুব অল্প পরিমাণে উৎপাদন করা হয়। তাই এটা পার্বণের জন্যে আলাদা করে বানানো হয় – কোনো বিশেষ উৎসবের জন্যে…
আজকাল কাওইনের চাল বাজারে মাত্র কয়েকটা দোকানে পাওয়া যায়। আর সেইসব দোকান একটু খুঁজে বার করতে হয়। কিন্তু এই আহার খেয়ে যা আনন্দ পাবেন সেটা এই জোগাড়ের মেহনতকে ভুলিয়ে দেবে বোধহয়।
কাওইনের চালের পোলাও
কি কি লাগবেঃ
কাওইনের চাল – এক পেয়ালা বা বাটি। ভালো করে মিহি ছ্যাঁদার ছাঁকনিতে ধোয়া।
(সাধারণ চালের মতন ধোয়াটা মুশকিল কারণ দানাগুলো এত ছোট – জল ঝাড়তে গেলে পড়ে যাবে)
জল – চালের সমান পরিমাণে, এবং আরো ১/৪ পেয়ালা
কুচোনো আদা বা আদাবাটা – এক বড় চামচ
জিরেবাটা বা গুঁড়ো – দুই ছোট চামচ
হলুদবাটা বা গুঁড়ো – এক ছোট চামচ
কালোজিরে – ১/৪ ছোট চামচ
ঘি – তিন/চার বড় চামচ
তেজপাতা – দু’টো
আস্ত গরমমশলা (লবঙ্গ, এলাচ, দারচিনি) – অল্প
কাঁচালঙ্কা – গোটা দুই
কড়াইশুঁটি – আধ পেয়ালা (কচি না হলে একটু সেদ্ধ করা)
নারকেল কোরা – ১/৪ পেয়ালা (শুকনো হলেও চলবে)
বাদাম, কিশমিশ – ইচ্ছা অনুযায়ী
লবণ – আধ ছোট চামচ
চিনি – দুই বড় চামচ
প্রণালীঃ
কড়াইয়ে ঘি গরম করে তেজপাতা, গরম মশলা, কালোজিরে আর কাঁচালঙ্কা ভেজে নিতে হবে। তারপর, বাদাম-কিশমিশ ওই কড়াইতে একটু নাড়াচাড়া করেই, কাওইনের চালটা দিয়ে তিরিশ সেকেণ্ডের মতন ভাজতে হবে। হলুদ আর জিরেটা এর পরে দিতে হবে। একটু কষে নিয়ে কড়াইশুঁটি, নারকেল কোরা দিয়ে আরেকটু কষে নিতে হবে। লবণ, চিনি দিয়ে জল ঢেলে দিতে হবে। জলটা ফুটে উঠলেই, সঙ্গে সঙ্গে, আঁচ কমিয়ে দিতে হবে, ভালো করে ঢাকনা দিয়ে মিনিট পাঁচেকে পোলাও তৈরি। কাওইনের দানাগুলো যেন আঠা না হয়। পোলাওটা ঝুরঝুরে হবে। কোনো ভাজা এবং চাটনির সাথে খেতে ভালো লাগবে।
এবার একটা সন্দেশের বিষয়ে লিখি। আমাদা এক প্রকারের ডাঁটা (rhizome), মাটির তলায় হয়। মাটির উপর সুন্দর পাতা দেখা দেয়। সাধারণ আদার চেয়ে অনেক ছোট এবং সরু। ছবিতে দেখা যাবে – কিভাবে প্রধান ডাঁটার থেকে ছোট ডাঁটা বেরিয়ে আসে। অনেকটা কাঁচা হলুদের মতন দেখতে। কিন্তু একটা টুকরো ভাঙলেই এর সুবাসে তফাত বোঝা যাবে। ঠিক যেন কাঁচা আমের সুবাস।
আমোদিনীদের বাড়ির পেছনে এই আমাদা খুব হত। তাই এটার ব্যবহার করতেন সন্দেশে।
আমাদার সন্দেশ
কি কি লাগবেঃ
ছানা – আড়াইশো গ্রাম, বা আধ পাউণ্ড বা আন্দাজে দেড় পেয়ালা। টাটকা ছানা (*বাড়িতে বানানো) সবচেয়ে উত্তম।
চিনি – একশো গ্রাম, বা আন্দাজে আধ-৩/৪ পেয়ালা
আমাদা (খুব মিহিভাবে কুচোনো বা বাটা) – দুই-তিন ছোট চামচ (আদাটা ছুলে নিতে হবে)
সামান্য ঘি বা মাখন (কড়াইতে লাগাবার জন্যে)
প্রণালীঃ
ছানা, চিনি এবং আমাদা একসঙ্গে বেটে নিতে হবে। আজকালকার দিনে মিক্সি বা ফুড প্রসেসরে করা যাবে। প্রয়োজন হলে দুধের ছিটা দিয়ে বাটলে আসান হয়। কড়াইতে একটু ঘি বা মাখনের ছোঁয়া লাগিয়ে, এই মিশ্রণটা অল্প আঁচে কিছুক্ষণ সাঁতলে নিতে হবে। পুড়ে না যায় খেয়াল রাখতে হবে। ঘন হয়ে উঠলে (এবং চিনিটা গলে গেলে), আঁচ থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। ইচ্ছামতন ছাঁচে বা এমনি হাতে গোল করে সন্দেশের আকারে বানিয়ে ফেলতে হবে।
*ছানা বানাতে হলে – গরুর দুধের ছানাটা সবচেয়ে ভালো হয়, তরল এবং স্বাদে ভালো। ফুল ক্রিম বা হোলমিল্ক – গরম করতে হবে ফুটে ওঠা অবধি। সাবধানে করতে হবে কারণ পাত্রের তলায় একটু লেগে গেলেই সমস্ত দুধে এবং ছানাতে পোড়া গন্ধ হয়ে যাবে। ফুটে উঠলে, সঙ্গে সঙ্গে এক চামচ পাতিলেবুর রস, এক বড় চামচ সাদা ভিনিগার আর এক গ্যালন (৩.৮ লিটার) দুধ ঢেলে দিয়ে মিনিটখানেক ভালো করে মেশাতে হবে। এর বেশি মেশালে ছানা শক্ত হয়ে যাবে। ছানাটা কেটে গেলে আঁচ থেকে নামিয়ে একটা কাপড়ে ছেঁকে আট-দশ ঘণ্টা কাপড় থেকে ঝুলিয়ে বাকি জলটা ঝেড়ে নিতে হবে।
প্রথম ছবিতে কাওইনের চালের পোলাও দেখা যাচ্ছে। কেউ যদি কাওইনের চালের বিষয়ে আরো কিছু জানাতে পারেন – খুব কৃতজ্ঞ হব।
দ্বিতীয় ছবিতে সন্দেশের কিছু সামগ্রী দেখানো হল। এই পাথরের বাটিটা আমোদিনীর সমসাময়িক। এটা দীনেন্দ্র সেনের ঠাকুমার বাটি ছিল। একটা খল-নুড়ি দেখা যাচ্ছে? সেটাতে স্বর্ণসিঁদুর বাটা হত। যখনই কারুর শরীরে ক্লান্তি বা গ্লানি বোধ হত – স্বর্ণসিঁদুর খাওয়ানো হত। আশ্বিন-কার্তিকের পার্বণের পর, একটু স্বর্ণসিঁদুর অনেকেই খেতেন।
আচ্ছা, আজ আসি। দেখা হবে পরের পর্বে।
(চলবে..)
লেখা ও ছবি – দেবলীনা সেন
Kasturi said
eTa hothat strike korlo. “Quinoa” bole ekti grain achhe, praachin Inca sobhyota’r amol theke Peru te lowke kheto. Ekhono alpo solpo porimane paoa jay mudi dokane. Phonetic similarity theke sondeho hochche, Quinoa-i Kaoin er ‘chaal’ noy to? Hoteo pare kintu. emnite Quinoa prochondo high-nutritious ekti grain.
Kasturi said
aami eTar katha bolchhi-
http://en.wikipedia.org/wiki/Quinoa
brishti aamaye said
কাওনের চাল ত দেশে বেশ পাওয়া যায় তো!
এই চাল এর পায়েস ও ভীষণ ভাল হয় ।
পোলাও কখনো বানাইনি,এরপর চেষ্টা করবো ।
“আমোদিনীর হেঁশেল”র রকমারি রান্নার সুগন্ধে বাঙ্গালনামা সুরভিত 🙂
kallol lahiri said
জানেন, কাওইনের চালের পোলাও এর ছবি দেখে আমার ঠাম্মার কথা মনে পড়ে গেলো। আর মনে হলো কতদিন খাই না। আসলে কিছু মানুষ চলে যাওয়ার সাথে সাথে কিছু রান্নাও চলে যায়। তবে রেসিপিটা কাজে আসবে খুব। ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।
Mahasweta said
আমআদার ব্যবহার চাটনিতে দেখেছি। সন্দেশের এই প্রস্তুত প্রনালীটা কিন্তু দারুন। নিশ্চয় বানানোর চেষ্টা করব একদিন।
bokom said
আমাদার সন্দেশ!!!নিরামিষ অম্বলে জিনিসটা দরকার হয়।কিন্তু সন্দেশ-এও। কালকেই একটা চেষ্টা চালাতে হবে।তবে মূলো,বেগুন,রাঙ্গালু,বড়ি দিয়ে অম্বলে আমাদার অনাবিল সৌরভ নান্দনিকতার পরাকাষ্ঠা বিশেষ। অবশ্য বাঙ্গাল্রা অম্বলের র কি বঝহে। আর কাওয়াইন-এর চালের কথায় আর একটা জিনিস মনে পড়ে গেল।চাল্ভাজার কুসুমদানা।
Sayantan Sarkar said
দয়া করে এই হেঁশেল ভাগটা প্রতি সঙ্খ্যায় দেওয়া হোক। শেষ দু সঙ্খ্যায় পেলাম না।
bangalnama said
সায়ন্তন, আপনার অনুরোধের জন্য ধন্যবাদ। পরের নিয়মিত সংখ্যায় ‘আমোদিনীর হঁেসেল’ অাবার পাবেন।
upasana mitra said
Amodinir Hesel…proti bar chai-i chai! Jemon sundor bornona,temon-i mon kemon kora harano diner ranna….khub khub bhalo laglo hotat ese pore ei web-site e.
Dhanyobad Debolina.