বা ঙা ল না মা

তেভাগা নেত্রী কমরেড ইলা মিত্রের জবানবন্দী

Posted by bangalnama on September 13, 2010


(তেভাগা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে নাচোল বিদ্রোহের উপর পুলিশি দমনপীড়ন ও ব্যাপক ধরপাকড়ের পর রাজশাহী কোর্টের মামলা চলাকালীন কমরেড ইলা মিত্র তাঁর ওপর পুলিশি অত্যাচারের যে ঐতিহাসিক জবানবন্দীটি পেশ করেছিলেন, বানান অবিকৃত রেখে সেটি এখানে তুলে দেওয়া হল। প্রসঙ্গতঃ, বাঙালনামার তেভাগা সংখ্যায় কমরেড ইলা মিত্রের জীবন ও কাজ নিয়ে ওনার ছেলে মোহন মিত্রের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। – সম্পাদক)


“কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিগত ৭.১.৫০ তারিখে আমি রোহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোলে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধোর করে এবং তারপর আমাকে একটা সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকান্ড সম্পর্কে সব কিছু স্বীকার না করলে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে বলে এস.আই আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলার মতো কিছু ছিলো না, কাজেই তারা আমার সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ ভাবে সেলের মধ্যে আমাদের বন্দী করে রাখে।”


“আমাকে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি, একবিন্দু জল পর্যন্ত না। সেদিন সন্ধাবেলাতে এস.আই-এর উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত শুরু করে। সে সময়ে আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর আমার কাপড় চোপড় আমাকে ফেরত দেওয়া হয় এবং রাত্রি প্রায় বারোটার সময় সেল থেকে আমাকে বের করে সম্ভবত এস. আই. কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে এ ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম না।”


“যে কামরাটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তারা নানারকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালালো। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। এবং সে সময় চারিধারে যারা দাঁড়িয়েছিলো তারা বলছিলো যে আমাকে ‘পাকিস্তানী ইনজেকশন’ দেওয়া হচ্ছে। এই নির্যাতন চলার সময় তারা একটা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বঁেধে দিয়েছিলো। জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলেছিলো। সেপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে হাঁটার ক্ষমতা ছিল না।”


“সেলের মধ্যে আবার এস.আই। সেপাইদের চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বললো, ‘এবার সে কথা বলবে’। তারপর চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিৎ করে শুইয়ে রাখলো এবং একজন আমার যৌন অঙ্গের মধ্যে একটা গরম ডিম সেদ্ধ ঢুকিয়ে দিলো। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।”


“৯.১.৫০ তারিখে সকালে যখন আমার জ্ঞান হলো তখন উপরোক্ত এস.আই এবং কয়েকজন সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুটে করে আমার চেপে লাথি মারতে শুরু করলো। এরপর আমার ডান পায়ের গোড়ালীতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হলো। সেই সময়ে আধা অচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এস.আইকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম ঃ আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করো তাহলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে এস.আই. এবং সিপাইরা ফিরে এলো এবং তারা আবার সেই হুমকি দিলো। কিন্তু যেহেতু তখনো কিছু বলতে রাজী হলাম না তখন তিন-চার জন আমাকে ধরে রাখলো এবং একজন সিপাই সত্যি সত্যি ধর্ষণ করতে শুরু করলো। এর অল্পক্ষণ পরই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। পরদিন ১০.১.৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন আমি দেখলাম যে আমার দেহ থেকে দারুণ ভাবে রক্ত ঝরছে এবং কাপড় চোপড় রক্তে সম্পূর্ণভাবে ভিজে গেছে। সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হল। নবাবগঞ্জ জেল গেটের সেপাইরা জোর ঘুষি মেরে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো।”


“সে সময়ে আমি একেবারে শয্যাশায়ী ছিলাম। কাজেই কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন সেপাই আমাকে একটা সেলের মধ্যে বহন করে নিয়ে গেল। তখনো আমার রক্তপাত হচ্ছিল এবং খুব বেশী জ্বর ছিলো। সম্ভবতঃ নবাবগঞ্জ সরকারী হাসপাতালের একজন ডাক্তার সেই সময় আমার জ্বর দেখেছিলেন ১০৫ ডিগ্রী। যখন তিনি আমার কাছে আমার দারুণ রক্তপাতের কথা শুনলেন তখন তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে একজন মহিলা নার্সের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হবে। আমাকে কিছু ওষুধ এবং কয়েক টুকরো কম্বল দেওয়া হল। ১১.১.৫০ তারিখে সরকারী হাসপাতালের নার্স আমাকে পরীক্ষা করলেন। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়েছিলেন সেটা আমি জানি না। তিনি আসার পর আমার পরনে রক্তমাখা কাপড় ছিলো সেটা পরিবর্তন করে একটা পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হলো। এই পুরো সময়টা আমি নবাবগঞ্জ জেলে-র একটি সেলে একজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব বেশী জ্বর ছিলো, তখনো আমার দারুণ রক্তপাত হচ্ছিলো এবং মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। ১৬.১.৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসা হলো এবং আমাকে বলা হলো যে পরীক্ষার জন্য আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। খুব বেশী শরীর খারাপ থাকার জন্যে আমার পক্ষে-এ কথা বলায় লাঠি দিয়ে আমাকে একটা বাড়ি মারা হলো এবং স্ট্রেচারে উঠতে আমি বাধ্য হলাম। এরপর আমাকে অন্য এক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। আমি সেখানে কিছুই বলিনি কিন্তু সেপাইরা জোর করে সাদা কাগজে আমার সই আদায় করালো। তখন আমি আধা-অচেতন অবস্থায় খুব বেশী জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু আমার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিল সেজন্য পরদিন আমাকে নবাবগঞ্জে সরকারী হারপাতালে পাঠানো হলো। এরপর যখন আমার শরীরের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হলো তখন আমাকে ২১.১.৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানকার জেল হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলো।”


“কোন অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি এবং উপরে যা বলেছি তার বেশি আমার আর বলার কিছু নেই।”

3 Responses to “তেভাগা নেত্রী কমরেড ইলা মিত্রের জবানবন্দী”

  1. নির্যাতনের যে বর্ণনা পড়লাম তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও বহু গুণে হার মানায়! তার পরেও তিনি অবিচল থেকেছেন। বঞ্চিত মানুষের জন্য সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। আসলেই তিনি মহান। ছিলেন মহান নেত্রী।
    অথচ আমাদের আজকালকার নেতারা! উনারা চোখের সামনে এমন আদর্শ রেখেও কি কিছু শিখতে পারে না!

    এই মহীয়সী নেত্রীর প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

    শুভকামনা আপনার জন্য।

  2. […] মিত্রের জবানবন্দী বিস্তারিত জানতে এই লিঙ্কে ক্লিক […]

  3. […] তেভাগা আন্দোলন একটি বাস্তব রূপ পায়। কৃষকদের প্রতিরোধের মুখে আপাতভাবে তেভাগা কার্যকর করা হলে ভূমি মালিকরা থেমে থাকে নি। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারিবাহিনী নানাভাবে কৃষকদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে কৃষকরা পুলিশ কর্মকর্তা ও ৫ জন কনস্টেবলকে হত্যা করেন। তাদের দায়ের করা হয় পুলিশ হত্যা মামলায় প্রধান আসামির মধ্যে ইলা মিত্রকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার ওপর চলে অমানুষিক অত্যাচার। যে নির্যাতন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। এ সম্পর্কে তথা ইলা মিত্রের জবানবন্দী বিস্তারিত জানতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন। […]

Leave a comment