বা ঙা ল না মা

তেভাগা আন্দোলন ও সলিল চৌধুরীর গান

Posted by bangalnama on September 13, 2010


– লিখেছেন সমীর কুমার গুপ্ত

(সম্পূর্ণ রচনা থেকে তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিকা সংক্রান্ত অংশ বাদ রেখে গণনাট্য সংঘ, তেভাগার গান ও সংগীতকার সলিল চৌধুরীকে নিয়ে লেখা বাকি অংশটি তুলে দেওয়া হল – সম্পাদক।)


তেভাগা আন্দোলন শুরু হবার আগে থেকেই (১৯৩৯) সলিল চৌধুরী কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিদ্যাধরী নদীর বন্যার ত্রাণের কাজে ধর্মতলার রিলিফ কমিটির সাহায্যে গ্রামবাসীর কষ্ট দূর করতে চেষ্টা করতেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার রাজপুর-সোনারপুর-বারুইপুর অঞ্চলের ক্ষেপুদা (খগেন রায়চৌধুরী), হরিধন চক্রবর্তী এবং নিত্যানন্দ চৌধুরীর মতো কমিউনিস্ট পার্টি নেতাদের পরিচালনায় সলিল চৌধুরী, রঘু চক্রবর্তী ও অনিল ঘোষের মতো তরুণরা সক্রিয় রাজনীতিতে নেমে পড়েন। ক্ষেপুদাই সলিলদার সাংগঠনিক ক্ষমতার পাশাপাশি তার সাংস্কৃতিক ক্ষমতা আবিষ্কার করেন। তিনিই সলিল চৌধুরীকে গণসংগীত রচনা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। কলকাতার ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেবার আগেই ১৯৪৫ সালে সলিল চৌধুরী তাঁর প্রথম গণসংগীত সৃষ্টি করেন। বিদ্যাধরী নদীর বানভাসি অঞ্চলে কৃষকদের ওপর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে রচনা করেন, ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে।’ সেই সময়কার কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরীর আরেকটি গণসংগীত হলো ‘কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলে আকাশে’। এই গানে পঞ্চাশের মণ্বন্তরের কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের নিয়ে আরো গান তিনি রচনা করেছিলেন, যেমন –


“তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে”,


“পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে”,


“আয় বৃষ্টি ঝঁেপে ধান দেব মেপে”


এহেন সলিল চৌধুরী তেভাগা আন্দোলনের জন্যে সার্থক গণসংগীত রচনা করবেন সে তো জানাই কথা।


গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ গণসংগীত রচনা ছাড়া বজায় ছিল সাহিত্য-নাটক-চিত্রাঙ্কন ও নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে। কবিতার ক্ষেত্রে বিষ্ণু দে’র ‘মৌভোগ’ এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘দুর্মর’ ও ‘….’ (নানারঙে, পৃ: ৩১) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সুকান্তের কবিতার কথা ‘হয় ধান নয় প্রাণ’ ছিল শ্লোগানের কথা।


গণনাট্য সংঘের তখন নাটক এবং গণসংগীত ব্যালের স্কোয়াড তৈরী হয়ে গেছে। তেভাগা আন্দোলনের সবচেয়ে সফল ছিল অনিল ঘোষের একাঙ্ক নাটক ‘নয়ানপুর’। এই নাটকটি কাকদ্বীপ সুন্দরবন অঞ্চলের আন্দোলনের যেন জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। আরেকটি নাটকও অনুষ্ঠিত হত যার নাম ‘মৃত্যু নেই’। শচীন ভট্টাচার্যের অনুমানে নাটকটি সলিল চৌধুরীর রচনা।


কংসারি হালদার ও অশোক বোসের নেতৃত্বকালে কাকদ্বীপ বুধাখালি থেকে একদল কমরেড এসে অনুরোধ জানান একটি ছোট গণসংঘের দলকে তাদের সঙ্গে পাঠাতে যারা নাটক ও গান দুইই করতে পারবেন। সলিল চৌধুরী একদিনেই একটি একাঙ্ক নাটিকা লিখে পাঁচ ছয়জনের দল গড়ে তাদের সঙ্গে যান। নৌকা করে তাঁরা গন্তব্য স্থানে গিয়ে অনুষ্ঠান করেন। গভীর রাতে গা ঢাকা দিয়ে কলকাতায় ফেরেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডেকার্স লেনে নাটকের দল কলহ শুরু করে। চারু প্রকাশ ঘোষ, সুধী প্রধান, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ গানের দল নাটক করায় আপত্তি প্রকাশ করেন। খালেদ চৌধুরী বলেন নবান্ন করতে ৪০ জন শিল্পী লাগে অথচ নাটক স্কোয়াডের হাতে তখন তেভাগা আন্দোলনের উপর নাটক নেই। তাঁর প্রশ্ন নিয়মের জন্য আই.পি.টি.এ. না আই.পি.টি.এ.-র জন্য নিয়ম? সংগীত ব্যালের দল ছোট হলেও নাচ, গান ও নাটক করতে সক্ষম, অতএব সে কাজটা তারা করে থাকলেও আপত্তি করার কিছু ছিল না। সলিল চৌধুরীর সেই নাটকটির নাম জানা যায় নি।


তেভাগা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাহিনী হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারাণের নাতজামাই’। সলিল চৌধুরী মুম্বাই ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে ফেরার পর গল্পটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন কার্তিক পাইক। সংগীত পরিচালনা করেন সলিল চৌধুরী। চলচ্চিত্রটির মুখের একটি নতুন গান ছাড়া আর সব গান ছিল তাঁর নিজের কৃষক আন্দোলন ও তেভাগা আন্দোলনের গান ও বিনয় রায়ের তেভাগা আন্দোলনের গান ‘আর কতকাল বল কতকাল’। তেভাগা ও কৃষক জীবন নিয়ে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল ‘ছিন্নমূল’, ‘দো বিঘা জমিন’ (কাহিনীকার সলিল চৌধুরী), ‘রিকসাওয়ালা’ ও ‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’।


দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত বইটিতে ৪ এপ্রিল ১৯৪৭ সালের জোতদার দয়ানাথের খোলানে তেভাগা হবার কথা আছে। আর আছে কৃষকনেতা লাল শুকরার কথা। তাঁর চরিত্রাঙ্কন পরিতোষ দত্তর মন পীড়িত করে। লাল শুকরা তেভাগার গান রচনায় যে নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন তা সঠিক ভাবে যাচাই করলে তাঁকে দাশরথীলালের সমকক্ষের বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। সুরসমেত তাঁর গান পেলে সেগুোর সঠিক মূল্যায়ন করা যেত।


দু’বছর তুবড়ির মতো আলোকরশ্মি ছড়িয়ে জ্বলে উঠে ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে আন্দোলন হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে যায়। সোমনাথ হোর-এর তেভাগার ডায়েরি পড়লে বোঝা যায় আন্দোলনের গোড়া থেকেই জানা গিয়েছিল কৃষক কমরেডদের দৃঢ়তার কথা, তাদের গোপনস্থানে মন্ত্রণা করা এবং ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বিপন্ন করে কাজ উদ্ধার করার কথা। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি হয়ে যায়। তাদের স্লোগান ছিল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। অনেক কৃষকনেতা ও কর্মী জেল খাটেন। তেভাগা আন্দোলনের সময়কাল ছিল পরাধীনতার সময় থেকে বিভক্ত দেশের স্বাধীনতা পাবার পরের কিছুকাল পর্যন্ত। সলিল চৌধুরীর নিত্যসঙ্গীদের মধ্যে রঘু চক্রবর্তী ও অনিল ঘোষ জেলবাস করেন। সলিল চৌধুরীর নামে তখন এবং পরে একাধিক ওয়ারেন্ট বের হলেও তাঁকে ধরা পুলিশের গোয়েন্দাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়নি।


ভারত ভাগ হবার পর পূর্ববাংলার জেলাগুলো পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্গত হয়ে যায়। সেখানে সামরিক বাহিনী কঠিন হাতে আন্দোলন রোধ করে।


তেভাগা আন্দোলনের প্রথম দুই শহীদ ছিলেন চিরির বন্দর এলাকার দরিদ্র চাষী সমিরুদ্দিন এবং সাঁওতাল আধিয়ার শিবরাম। তঁাদের আমরা ভুলে গেলেও চব্বিশ পরগণা ও সুন্দরবন অঞ্চলের শহিদদের কথা গানে গানে অমর হয়ে আছে। আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। পুরণচাঁদ যোশী ও রণদিভের নীতির অনেকখানি বৈপরীত্য থাকায় এবং কিছু পঞ্চমবাহিনীর নেতা কংগ্রেসের লেজুড় বৃত্তি গ্রহণ করার ফলে আন্দোলনের পালের হাওয়া থেমে যায়। যোশী ছিলেন উদারপন্থী। তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চেয়েছিলেন। রণদিভে ছিলেন চরমপন্থী। অজয় ঘোষের মত মধ্যপন্থার নেতারাও নেতৃত্ব দিতে পারেননি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের অবস্থার অনের পরিবর্তন হলেও আজও ভাগচাষীদের সংখ্যা নগণ্য নয়।


যে সব ঘটনা গ্রামজীবনকে প্রভাবিত বা আক্রান্ত করার পর গ্রামবাসীর মনে স্থায়ী রেখাপাত করে সে সব ঘটনা সহজভাবে লোকগানে ফুটে ওঠে। গ্রামবাসী সেই গান গ্রহণ করে এবং গেয়ে থাকে। তেভাগা আন্দোলন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের অঙ্গ। গ্রামেগঞ্জে গ্রামীণ কবি গান বেঁধেছেন এবং সেই গান উদ্দীপনার সঙ্গে গাওয়াও হয়েছিল। তবু আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী ও পুরোপুরি সফল না হওয়ায় তেভাগার গান আজ লোকে ভুলে গেছে। এমন অনেক গানের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকার তেভাগা সংখ্যা (১৪০৪), বর্তিকা পত্রিকার জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৩ সংখ্যায় এবং অনুরাধা রায়ের ‘চল্লিশ শতকের বাংলায় গণসংগীত আন্দোলন’ বইটিতে।


রংপুরের সুপরিচিত লোকগান, ‘ডাঙুয়ার বধুয়া তুই’-গানটি ভেঙে বিনয় রায় সৃষ্টি করেন, ‘গরীব দেশবাসী গরীব কিষাণ ভাই’। কালক্রমে গানতি তাদের কন্ঠচ্যুত হয়ে যায়। সেই পুরনো ডাঙুয়ার বধুয়া তুই – গানটিই আবার তারা গেয়ে ওঠে। আপাত বিচারে গানটি হাস্যরসাত্মক মনে হলেও তরুণী স্ত্রীর হাতে বৃদ্ধ স্বামীর প্রতারণা শ্রোতাদের মনে দুঃখ সঞ্চার করে। গ্রাম্য সংগীত যে কত উচ্চমানের হতে পারে তার নিদর্শন এ গানটির মতো আরও অনেক গানে আছে।


সলিল চৌধুরীর মতো বেশ কয়েকজন গণসংগীত রচয়িতা তেভাগা আন্দোলনের স্মরণযোগ্য গান রচনা করেছিলেন। তবে সলিল চৌধুরীর তেভাগার গান অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী স্থায়িত্ব পেয়েছে। তেভাগা আন্দোলনের দুয়েকটি গান আজও প্রাসঙ্গিক। সলিল চৌধুরী নিজেই তাঁর গানের কথা বিভিন্ন আন্দোলনের প্রয়োজনে সামান্য পালটে দিয়ে সময়ের উপযোগী করে দিতেন। তেভাগা আন্দোলনের গান পরের খাদ্য আন্দোলনের সময়ে যথেষ্ট গাওয়া হয়েছে।


গণসংগীত ছিল গণনাট্য সংঘের গান। গণনাট্য সংঘ পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি চালিত সেটা না মেনে উপায় নেই। ১৯৬৪ সালে পার্টি বিভক্ত হবার পর থেকে সিপিএম পার্টির তত্ত্বাবধানে গণনাট্য সংঘ বিরাজ করছে পশ্চিমবঙ্গে (কেন্দ্রীয় ভাবে তা সিপিআই প্রভাবিত)।


সলিল চৌধুরীর তেভাগা আন্দোলনের গান রচিত হয়েছিল তাঁর গাঁয়ের বধূ ও অন্যান্য গণসংগীত গ্রামাফোন রেকর্ডে দেশবাসীর কাছে পৌঁছবার কিছু আগে। সলিল চৌধুরীর জনপ্রিয়তা তখনও তুঙ্গে ওঠেনি। আন্দোলনের সময়ে তাঁর যে সব গান ব্যঙ্গরসে ভরা ছিল সেগুলো গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা মনে রাখলেও জনসাধারণ ক্রমশ ভুলে যায়। সলিল চৌধুরী তখন তেভাগা আন্দোলনের গান ‘আয়রে ও আয়রে ভাইরে ও ভাইরে’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুকন্ঠে রেকর্ড করান। সলিল চৌধুরীর গণসংগীত তাই অন্য রচয়িতাদের মতো লুপ্ত হতে পারে না। দেশ স্বাধিন হবার আগে ব্রিটিশ সরকার এবং পরের কংগ্রেস সরকার গ্রামাফোন রেকর্ডে সলিল চৌধুরীর গণসংগীত প্রকাশ করবে না জেনেই তিনি গানের কথা অনেক মৃদু অর্থাৎ নির্রথক করে তবেই করিয়েছেন। আন্দোলনের জোরালো বক্তব্য ও ভাবমূর্তি এমন গানে পুরোপুরি ফোটেনি।


কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা গণসংগীতকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কংগ্রেস বিরোধী এবং স্লোগানধর্মী গান হিসেবে। গণসংগীত বা ‘মাস সং’ এর গুরুত্ব কতখানি, প্রমোদ দাশগুপ্ত ও জ্যোতি বসু পরে স্বীকার করেছেন যে তারা বুঝতেন না। পুরণচাঁদ যোশীর পর গণনাট্য সংঘকে রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টা আর কেউ করেননি। গণনাট্য সংঘের প্রথম যুগে গণসংগীত রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারে কারণ সেই সময়ের সংগীত স্রষ্টারা ছিলেন অসাধারণ ক্ষমতার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র, বিনয় রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখের সংগীতের উৎকর্ষ ছিল অনস্বীকার্য।


সলিল চৌধুরীর তেভাগা আন্দোলনের কিছু গান আজও সভা সমাবেশে গাওয়া হয় কারণ সেগুলোয় রয়েছে স্থান-কাল ছাপিয়ে চিরকালীন হবার উপাদান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ যে গান দেশকে দিয়েছিলেন তা আজও আমাদের সম্পদ হয়ে আছে।


তেভাগা আন্দোলনের স্লোগানগুলো ছিল মর্মস্পর্শী, যেমন ঃ-


‘লাঙল যার জমি তার’


‘আধি নয় তেভাগা চাই’


‘জান দেব তবু ধান দেব না’


‘দখল রেখে চাষ করো, ফসম কেটে ঘরে তোলো’


‘কৃষক সমিতির জয়’


‘জমিদারী প্রথা ধ্বংস হউক’


‘কৃষকদের গান্ডি নাই’ (হাটের ইজারাদাররা প্রতিদিন তোলা বা গান্ডি নিত)


‘নিজ খোলানে ধান তোলো, দখল রেখে ভাগ করো’


গানের কলিতে এমন সব স্লোগান স্থান পেয়েছিল —


সলিল চৌধুরীর তেভাগা আন্দোলনের গানগুলো লিপিবদ্ধ করা হল ঃ


‘ও ভাই চাষী ক্ষেতের মজুর
যতেক কিষাণ কিষাণী (সজনী)
এই বেলা নাও তেলেঙ্গানার পথের নিশানী।


আর এই মোরা রক্ত ঢেলে জমিন চষে
পরগাছা পুষিলাম,
সেই পরগাছা হইল যে রাজা,
আর আমরা তারি গোলাম,
(মরি হায় হায় হায় হায় রে)!
এই দেশ জমিনের থেকে
এবার আগাছা দাও নিড়ানি (সজনী)


মোদের মেরে কেউ বানালো
দালান অট্টালিকা
আর খদ্দরে ভদ্দর হল
কত যে চামচিকা
(মরি হায় হায় হায় হায় রে)
তারা দুলিয়ে ভুঁড়ি ঠ্যাংটি নাচায়
মোদের ভাঁড়ে ভবানী (সজনী)।


মোদের দুধের বাছা দুধের বদল
খায় যে ফ্যানের পানি
আর বউবেটিদের নেইকো শাড়ি
অঙ্গে ছঁেড়া কানি,
(মরি হায় হায় হায় হায় রে)
আর জমিদারের বউয়ের দেখো
ওই রেশমী শাড়ির ঝলকানি (সজনী)।


ও ভাই, গামছা বঁেধে পেটেরে ভাই
আমরা খামার ভরি,
ওদের তাই না এত চ্যাটাং চ্যাটাং
বুলির বাহাদুরি,
(মরি হায় হায় হায় হায় রে)
আমরা চাইলে খেতে ওদের চোখে
সরষে ফুলের চমকানি (সজনী)।


এই বন্ধ যদি রাখি রে ভাই,
ক্ষেতখামারে খাটা
আর বড়বাবুরা খাবেন খাবি
চক্ষু হবে ভাঁটা,
(মরি হায় হায় হায় হায় রে)
আর পন্ডিতের পন্ডিতি ঘুচে
বন্ধ হবে কপচানি (সজনী)


এমনি করে পশুর মতো
আর তো যে সহে না,
শত শহীদ ডাক রে ভাই
শুধতে হবে দেনা
(মরি হায় হায় হায় হায় রে)
আমাদেরই হাতে ওদের আছে
মরণ বাণ জাননি (সজনী)


এক সাথে সব দাঁড়াও এবার
ফুলিয়ে বুকের ছাতি
আর অন্যায় কে রুখবো
মোরা জঙ্গি মজুর সাথী,
(মরি হায় হায় হায় হায় রে)
লাল ঝান্ডা হাতে নাও,
আছে ভাই জঙ্গি মজুর সাথী
(মরি হায় হায় হায় হায় রে)!
এই বিধানেই ধ্বংস হবে
শত বিধান-নালিনী
মোরা এমনি করে গড়বো মোদের
সুখী জীবন জাননি (সজনী)।’


এই গানটি সলিল চৌধুরীর ব্যাঙ্গাত্মক গান রচনায় দক্ষতার পরিচয় দেয়। বিদ্বেষ বিরূপতা প্রকাশ করার এমন ভঙ্গি আন্দোলনের সময়ে খুবই কার্যকরী হয়েছিল। এই গানের ব্যাঙ্গোক্তি ছাড়া ছন্দের দোলা ও শব্দের ঝংকার উৎকৃষ্ট মানের কাব্যগুণের সাক্ষ্য রাখে। গানটি দিলীপ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘গণনাট্য সংঘের গান’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। গণনাট্য সংঘের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক মন্টু ঘোষের কন্ঠে গানটি ধৃত হয়েছে। তাঁর আকর্ষণীয় গায়কী এখনো গানটিকে জীবন্ত করে তোলে।


দেশ স্বাধীন হবার পরও কংগ্রেসী সরকারের শোষণনীতি অব্যাহত থাকার প্রতিবাদ করা হয়েছে।


কালোবাজারি ব্যবসায়ী এবং কংগ্রেসি নেতাদের কুকর্মের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। জমিদার-জোতদার এবং অকর্মণ্য তাত্ত্বিকদের অবস্থা আন্দোলনের পর কি হবে সেটা জানানো হয়েছে।


বন্ধনীর ভেতরের গানের অংশগুলো প্রথমে গাওয়া না হলেও বিভিন্ন সমাবেশের ও মিছিলের প্রয়োজনে পরে গাওয়া হত।


‘হেই সামালো হেই সামালো
হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো
জান কবুল আর মান কবুল
আর দেব না আর দেব না
রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।


চিনি তোমায় চিনি গো জানি তোমায় জানি গো
সাদা হাতির কালা মাহুত তুমিই না
পঞ্চাশে লাখ প্রাণ দিছি, মা বোনেদের মান দিছি
কালো বাজার আলো কর তুমি না।


মোরা তুলব না ধান পরের গোলায়
মরব না আর ক্ষুধার জ্বালায় মরব না
তার জমি যে লাঙল চালায়
ঢের সয়েছি আর তো মোরা সইব না
এই লাঙল ধরা কড়া হাতের শপথ ভুলো না।’


‘আয়রে ও আয়রে ভাইরে ও ভাইরে’ গানটি তেভাগা আন্দোলনে যেমন গাওয়া হত (তেমনিই) প্রথমে দেওয়া হল। পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে কন্ঠে রেকর্ডে এবং সলিল চৌধুরী পরিচালিত ঘুম ভাঙার গান ক্যাসেটে যেমন শোনা গিয়েছিল গানের সেই পরিবর্তিত এবং অপেক্ষাকৃত অকার্যকর ভাষায় লেখা গানটিও উদ্ধৃত হল। প্রথমটি আন্দোলনের সময়কালীন গান ঃ


আয়রে ও আয়রে
ভাইরে ও ভাইরে
ভাই বন্ধু চল যাইরে
ও রাম রহিমের বাছা
ও বাঁচা আপন বাঁচা
চলো ধান কাটি আর কাকে ডরি
নিজ খাবার নিজে ভরি, কাস্তেটা শানাই রে।


(এই) চাষী হবে জমির মালিক স্বরাজ হলে শুনি
এখন মালিক যত ঘুঘু শালিক পেশাদারি খুনি
আর নেতা বড় বড়, সব বক্তৃতাতে দড়
এখন নিজ হাতে ভাগ্য গড়ার এসেছে সময় রে।


লাল বাঁদরের পোষা হাতির অত্যাচারে কত
(এই) ভেঙেছে ঘর মরেছে ভাই মা-বোন লক্ষ শত
ঐ কমলাপুর বড়া, আর কাকদ্বীপ ডোঙ্গাজোড়া
এসেছে ডাক চলোনা সবাই সোনা তুলি ঘরে।


ও গাঁয়ের যত জোয়ান মরদ লাঠি নিও হাতে
ঐ খুনে রাঙা ঝান্ডা যেন থাকে সবার সাথে
আর দুশমন যদি আসে, যেন চোখের জলে ভাসে
যেন লুটে খাবার ক্ষুধা তাহার মেটে একেবারে।


ও গাঁয়ের যত মা-বোন আছে, তোমরা থেকো ঘরে
ঐ আঁশবটি আর কাটারিটা রেখো হাতে করে
যেন দালাল বেইমান যত, পায় শিক্ষা উচিত মতো
(এই) বাংলাদেশের মা-বোন কত শক্তি হাতে ধরে।


দ্বিতীয়টি রেকর্ডের গান ঃ


‘আয়রে ও আয়রে
ভাইরে ও ভাইরে
ভাই বন্ধু চল যাইরে
ও রাম রহিমের বাছা
ও বাঁচা আপন বাঁচা
চলো ধান কাটি আর কাকে ডরি
নিজ খাবার নিজে ভরি, কাস্তেটা শানাই রে।


এই মাটিতে কলিজার আশায় স্বপনের বীজ বুনি
আর চোখেরি জল সেচ দিয়ে ফসলের কাল শুনি
ক্ষেতের আলে আলে আজ সোনালী ঢেউ খেলে
আহা মাটি মাতা দুই হাতে অন্ন চালে
ফের ঘরে ঘরে নবান্নে বই হবে কি রোশনাইরে।


আহা কার ঘরে জ্বলেনি দীপ কে আছ আঁধারে
আহা কার বাছার জোটেনি দুধ আছ অনাহারে
আয় আয় মাটির টানে কন্ঠ ভরি গানে
মাটি মোদের মাতা আমরাই তো বিধাতা
এই মাটিতে নবজীবনের রঙমহলে নাইরে।’


সলিল চৌধুরীর জঙ্গি মনোভাবের প্রকাশ মূল এই গানটিকে উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বম্বে অধিবেশনে সলিল চৌধুরী এই গানটিই গেয়েছিলেন। গানের বক্তব্য জোরালো এবং সহজবোধ্য। পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে রেকর্ডিং করার সুযোগ এলে বোঝেন গানের বক্তব্য নরম ও কংগ্রেস সরকারের গ্রহণযোগ্য না করলে হেমন্তবাবু গাইবেন না এবং রেকর্ড কোম্পানীও বাধ সাধবে। গানটির পরিবর্তিত রূপটির সাংগীতিক মূল্য যথেষ্ট। জনগণের কাছে পৌঁছবার উপায় বের করতে যদি চাতুর্যের সুযোগ নিয়ে থাকেন তবে সেই দোষটি অনেকখানি খন্ডিত হয়ে যায় তাঁর লেখনির মুন্সিয়ানায় এবং গানটির সাংগীতিক উৎকর্ষে। সলিল চৌধুরী তাঁর ‘ঘুম ভাঙার গান’ ক্যাসেটে বলেছেন যে গানটি ১৯৪৮ সাল রচিত।১৯৪৮-এর ২৯ জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘট হলে সলিল চৌধুরী ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’ গানটি লেখেন এবং সেদিনই মনুমেন্টের নিচে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে সে গান গাওয়া হয়। এই গানটি তেভাগা আন্দোলনের স্রোতে জোয়ার আনতে লেখা বলেই মনে হয়। ১৯৪৮ সালের আগেই লেখা সম্ভবত। সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর।


এই গানটি নিঃসন্দেহে তার একটি শ্রেষ্ঠ সংগীতকীর্তি। সাংগীতিক জ্ঞানে ও ক্ষমতায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তখন গণনাট্য সংঘের উচ্চাসনে। সলিল চৌধুরী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সান্নিধ্যে যতখানি উপকৃত হয়েছিলেন সে কথা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করে গেছেন। তবু যে অসাধারণ ক্ষমতা থাকলে ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ’ বা ‘লা পালুমা’-র মত সর্বাঙ্গ সুন্দর গান সৃষ্টি করা যায় সেই গুণ ছিল সলিল চৌধুরীর। এই গানটির বাঁধন, মনমাতানো শব্দের প্রয়োগ, দেশজ সুরের আবেদন ও গ্রামীণ ছবি ফোটাবার সাফল্য সব মিলিয়ে আজো দেশবাসীর মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই গান ‘কোয়ানটানামেরা’-র মতো চির আদরণীয় হবার কথা। বড় আনন্দ হয় যখন এই গানটি অ-কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশেও গাওয়া হয়। গানের উৎকর্ষ পার্টির গন্ডির বাইরে গানটিকে নিয়ে গেছে।


তেভাগা আন্দোলনের পত্তন কৃষকদের হাতে। এই গানে তাদের লক্ষ্যে স্থিত থাকতে আহ্বান করা হয়েছে। ‘কাস্তেটা দাও শান হো’ এর মতো করে ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’ – এই কথা অন্য গীতিকারেরাও লিখেছেন। ‘সাদা হাতির কালা মাহুত’ – কথাগুলোয় অত্যাচারী ব্রিটিশ প্রশাসক ও লীগ কংগ্রেসের মদতপুষ্ট শোষকদের চিত্র অপরূপ দক্ষতায় ফোটানো হয়েছে। হাতির উল্লেখ ডুয়ার্সের চা-বাগান অঞ্চলের অত্যাচারকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। রেবা রায়চৌধুরী ইউরোপে মাদার্স কনভেনশনে গিয়েছিলেন। সেখানে হেই সামালো গানটি গেয়ে মাত করে দিয়েছিলেন। তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল হেই সামালো।


তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিকায় গণনাট্য সংঘের অন্যান্য সংগীতকারেরা অনেক উচ্চমানের গান রচনা করেছিলেন। সলিল চৌধুরীর পাশাপাশি কৃতি সংগীত রচয়িতাদের কিছু গান হল ঃ-


‘শপথ’ —


সলিল চৌধুরীর রচিত কবিতার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত এই দীর্ঘ কবিতাটি। সুন্দরবনের চন্দনপঁিড়ির তেভাগা মিছিলে রাইফেলধারী পুলিশ গুলি চালায় ৬ নভেম্বর ১৯৪৮। নিরস্ত্র সংগ্রামী যাঁরা প্রাণ হারান তাদের মধ্যে ছিলেন অহল্যা, বাতাসী, সরোজিনী, অশ্বিনী, গাজেন এবং দেবেন। অহল্যা সন্তানসম্ভবা শহীদ। তাঁকে নিয়ে ও সরোজিনীর নামে গান বঁেধেছেন বিনয় রায়, অনিল ঘোষ প্রমুখ। গণনাট্য সংঘের ব্যালে দল অহল্যা নৃত্যনাট্য সৃষ্টি করে যার কাহিনী ও সংলাপ রচয়িতা ননী ভৌমিক, নৃত্য পরিচালনা করেন শক্তি নাগ। শম্ভু ভট্টাচার্যের নামে তখনও পুলিশের ওয়ারেন্ট। তাই দেবব্রত বিশ্বাস শক্তি নাগকে নিয়ে আসেন। সংগীত পরিচালনা করেন কৃষ্ণচন্দ্র বসু ও সলিল রায়। গীত রচনা করেন সলিল চৌধুরী, বিনয় রায় ও শক্তি চ্যাটার্জী।


সলিল চৌধুরীর এই কবিতারই অংশ বিশেষে সুর দিয়েছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। কবিতা পাঠের ফাঁকে ফাঁকে কবিতার কলি সুরে গাওয়া হত। এই গানটি নানা সমাবেশে পরিবেশিত হয়েছে। সংগীতাংশে মন্টু ঘোষের কন্ঠ রচনাটিকে অসাধারণ উচ্চমাত্রায় পৌঁছে দিত। বর্তমানে মন্টু ঘোষের কন্ঠ (কবিতাটির পাঠের সঙ্গে) গানের অংশে ধরে রাখা হয়েছে। কবিতার এই স্তবক, ‘তাই গ্রামনগর মাঠ পাথার’ নিয়ে সুরারোপ করেছিলেন প্রবীর মজুমদার।


সলিল চৌধুরীর কৃষকদের আন্দোলন উপলক্ষে রচিত গণসংগীতগুলো আন্দোলনে গাওয়া হত। তবে সেগুলো এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে রচিত নয় বলে সেগুলো বিস্তারিত আলোচনায় নেওয়া হল না।


____________________________________________
*লেখক গণনাট্য আন্দোলন বিষয়ক গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
‘নানারঙে’ পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

Leave a comment