বা ঙা ল না মা

মেদিনীপুরে তেভাগা সংগ্রাম

Posted by bangalnama on September 13, 2010


– লিখেছেন ভূপাল পান্ডা


মেদিনীপুর জেলার কৃষক সমাজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন স্তরে ছিল সবচেয়ে আগুয়ান। ১৯২০-২৪ সালে অসহযোগ আন্দোলনে, ১৯৩০-৩৪ সালে অহিংস আইন অমান্য আন্দোলনে। ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনে চার-ছয় আনা চৌকিদারী ট্যাক্স না দিয়ে বহুমূল্যের গরু-ছাগল ও তৈজস-পত্রাদি পুলিসকে ক্রোক করে নিয়ে যেতে ছেড়ে দিয়েছে, তেমনি আবার এই জেলায় তিন-তিনটি অত্যাচারী সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার ঘটনায় হাসিমুখে নির্যাতন সহ্য করেছে উৎসাহ নিয়ে। বৃটিশের অধীনতা মুক্তির সংগ্রামের সাথে বৃটিশের শোষণমুক্তির জন্য বৃটিশ জমিদারী কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই, খড়গপুর থানায় ধারেন্দা পরগণার সাঁজাভাঙা আন্দোলন, নন্দীগ্রাম, সুতাহাটা, মহিষাদল, ময়না থানাগুলিতে আনিশুনি আবওয়াব আদায় বন্ধ ও কর্জা ধানের সুদ কমানোর আন্দোলন এবং জমিদারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তমলুক, পাঁশকুড়া, দাসপুর, কেশপুর ও চন্দ্রকোণা প্রভৃতি থানাগুলিতে সংগঠিত কৃষক সংগ্রাম দীর্ঘ বছর ধরে চলেছিল। ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ডাকে ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’-এ তাই এ-জেলার কৃষক সমাজ সারা জেলাতেই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর যখন এল ১৯৪২-এর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, মহামারী ও দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের অকালমৃত্যু, তারও বিরুদ্ধে লোন রিলিফ ও বাঁচার সংগ্রামে কৃষকরা পিছিয়ে পড়েনি।


এই অবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিপুল করভারে জর্জরিত, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্য সংকটের চাপে অতিষ্ঠ মেদিনীপুরের কৃষক সমাজ, বিশেষ করে গরিব কৃষক, ভূমিহীন ভাগচাষী ও ক্ষেতমজুর শ্রেণী জীবনের অভিজ্ঞতায় এক নতুন চেতনা নিয়ে এগিয়ে এল প্রাদেশিক কৃষক সভার তেভাগার জন্য নতুন সংগ্রামের ডাকে। কৃষক সভার ডাক ছিল — ‘এই ফসলেই তেভাগা চাই, রসিদ ছাড়া ধান নেই’। সেজন্য ‘জোতদারের খামার নয়, চাষীর হেফাজত খামারে ধান তোল, তেভাগার দাবি আদায় কর’। এই ডাক জেলার সমগ্র ভাগচাষ প্রধান অঞ্চলে গরিব কৃষক ও ভূমিহীন ভাগচাষীদের সামনে বাঁচার নিশানা হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করে।


জেলার কৃষক নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে জেলার ভাগচাষ প্রধান এলাকাগুলিকে ভিত্তি করে এই আন্দোলনকে দ্রুত সংগঠিত করতে এবং কৃষি মজুরদের মজুরি বাড়ানোর দাবি তুলতে হবে। আবার সংগ্রামী ভাগচাষীদের পাশাপাশি ছোট মাঝারি রায়ত প্রজাদের সংগ্রামী ঐক্য রাখার জন্য জমিদারদের বিরুদ্ধে ‘বাকী বকেয়া খাজনা মকুব, হাজাশুকায় খাজনা ছাড়, সেচ ও নিকাশীর সুব্যবস্থা’র দাবিতে খাজনা বন্ধ আন্দোলনকেও যথাসম্ভব প্রসারিত করা প্রয়োজন, যাতে বৃটিশ সরকার পুলিশ জুলুম চালিয়ে একক ভাগচাষীদের সংগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে ও দমিয়ে দিতে না পারে। সুতরাং জেলা নেতৃত্বকে সেইমতো বিভক্ত করে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই তেভাগা আন্দোলনের দায়িত্ব পড়ে কমরেড ভূপাল পান্ডা, অনন্ত মাজী, সরোজ রায়, রাখাল বাগ, বঙ্কিম গিরি, পতিত জানা প্রমুখ নেতৃস্থানীয় কর্মীদের উপর। আরও সিদ্ধান্ত হয়, যেহেতু তমলুক মহকুমাতে বিশেষ করে নন্দীগ্রাম থানা ব্যাপক ভাগচাষ প্রধান সেজন্য এখানেই আন্দোলনকে সুসংগঠিত করে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে হবে। ব্যাপক প্রচার সংগঠিত করার জন্য ছাত্রকর্মী দল পাঠানো হয় গ্রামাঞ্চলে। মহিলা নেত্রী বিমলা মাজীকে পাঠানো হয় মেয়েদের সংগঠিত করার জন্য।


যেহেতু এই গরীব ভূমিহীন ভাগচাষীদের উপর সরকার ও জোতদার-মহাজনদের শোষণের বোঝা ছিল সর্বাধিক এবং সংখ্যাগত দিক থেকে এরাই কৃষক সাধারণের অধিকাংশ, সেজন্য তেভাগা সংগ্রাম তৎকালীন অন্যান্য সব আন্দোলনকে ছাপিয়ে ব্যাপক রূপ নেয়। নন্দীগ্রাম থানায় বড় বড় জোতদার মনুচকের দেওয়ান সাহেব, কেন্দেমারীর জানা পরিবার, মহম্মদপুরের পড়ুয়া ও মাইতি পরিবার, গড়চক্রবেড়িয়ার খাঁ পরিবার, কালীচরণপুরের সাগরদাস পরিবার, গোপাল চকের সিং পরিবার প্রভৃতির বিরুদ্ধে, মহিষাদলের মাইতি পরিবার, সুতাহাটার শ্যামাচরণ ত্রিপাঠী, পাঁশকুড়ার হরিসাধন চক্রবর্তী চৌধুরী, ময়নার আসনামের দাস পরিবার, কেশপুর-আমনপুরের চৌধুরী পরিবার প্রমুখ জোতদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই সব বড় জোতদাদের অধীনে ভাগচাষী প্রধান গ্রামগুলিতে কৃষকদের সংগ্রাম কমিটি গঠন করে প্রতি মালিকের বিরুদ্ধে পৃথক আঞ্চলিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। আর ঐসব আঞ্চলিক সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধিদের এবং জেলা কৃষক নেতাদের নিয়ে থানা সংগ্রাম কমিটি গড়ে ওঠে, যেখান হতে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্দিষ্ট নির্দেশমতো সংগ্রাম পরিচালিত হয়। প্রতি গ্রামে সংগ্রাম কমিটির অধীনে জঙ্গী যুবকদের নিয়ে ভলান্টিয়ার বাহিনী ও জঙ্গী মেয়েদের নিয়ে নারী বাহিনী গঠিত হয়।


প্রথমত, তেভাগার দাবির ন্যায্যতা, ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ, রসিদ না দিয়ে জোতদার-মহাজন শ্রেণীর নির্মম শোষণের ঘটনাবলী তুলে ধরে এই অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের কৃষকদের ও ভাগচাষীদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাটে-বাজারে ব্যাপক প্রচার, পোস্টারিং চলে। মাঝে মাঝে সংগঠিত কৃষক বাহিনীর লাল ঝান্ডা উড়িয়ে আন্ডোলন, এলাকা জুড়ে জঙ্গী কৃষক ভলান্টিয়ার মার্চ সমগ্র এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। জেলার সর্বত্র গরীব ভাগচাষীদের মনে প্রবল উৎসাহের সঞ্চার হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রামের পর গ্রামে ভূমিহীন ভাগচাষী ও ক্ষেতমজুরেরা এই আন্দোলনে সামিল হয়ে নিজেদের সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলে। সর্বত্র একই আওয়াজ — ‘এই ফসলেই তেভাগা চাই, রসিদ ছাড়া ধান নেই, মালিকের খামার নয়, চাষীর পঞ্চায়েত খামারে ধান তোল, তেভাগার দাবি আদায় কর।’


এদিকে প্রচন্ড আতঙ্কিত বড় বড় জোতদার মালিকগোষ্ঠী বৃটিশ জেলা ও মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটদের দফতরে গিয়ে ধর্না দিতে থাকে। তাদের দাবি, সর্বনাশ! গ্রামের ছোটলোকদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে ঐ লালঝান্ডার দল, ধান নিয়ে পালাবে, আমাদের কি হবে? এখুনি পুলিশ চাই, পান্ডাদের গ্রেপ্তার করুন, যে খুনজখম, বে-আইনী লুটপাট বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি করছে, দমন করুন।


বৃটিশ সরকারও তার বশংবদদের রক্ষার জন্য ত্বরিতগতিতে থানায় থানায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পাঠাতে থাকে। সমস্ত আন্দোলন এলাকাগুলিতেই মাঝে মাঝে পুলিশক্যাম্প বসে যায় – প্রধানত কাছারি বাড়ি বা গ্রাম্য স্কুলগুলি দখল করে।


এরপর শুরু হয় মাঠের ধান খামারে তোলার সংগ্রাম। আতঙ্কিত বড় জোতদার মালিকগোষ্ঠী এখন সমস্বার্থে ছোট মাঝারি জমির অ-কৃষক মালিক মধ্যবিত্তদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে দিনরাত পরামর্শ চালায় কী করে এই চাষীদের একতা ভাঙা যায়, ধান নিজ খামারে আনা যায়। সুকৌশলে চলে প্রথমত একদিকে মিথ্যা প্রচার– ‘মালিকদের খামারে যে ধান তুলবে, সে বাকী বকেয়া মকুব পাবে, জমি তার কায়েম থাকবে। যে না আনবে — বাকী ধানের নালিশ হবে, পুলিশ দিয়ে জেলে পাঠাব, ঘরবাড়ি লুঠ হবে, সবংশে ধ্বংস হবে।’


অন্যদিকে টাকা পয়সা ঘুষ দিয়ে, দালাল ধরে সংগ্রামী কৃষকদের মাঝে আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচার– ‘ওরা পালাবে, তোমরা মরবে। মালিক ছাড়া তোমাদের গতি নেই।’


দ্বিতীয়তঃ — চাষীদের ধান কাটতে বাধা দেওয়া নয়, কাটা ধান পুলিশ দিয়ে মালিকের খামারে তুলতে বাধ্য করা। অন্যথায় মাঠেই ধান ফেলে রাখতে বাধ্য করা।


তৃতীয়তঃ, মূল মূল জঙ্গী কৃষক ও তাদের নেতাদের নামে হাটে বাজারে প্রচার করা ‘ধরে দিলে পুরস্কার পাবে’।


অন্যদিকে সংগ্রাম কমিটির ঘোষণা হল– ‘জোতদারদের খামারে নয়, চাষীর নিয়ন্ত্রণাধীন পঞ্চায়েত খামারে একত্র ধান তোল। এই ফসলেই তেভাগা চাই, রসিদ ছাড়া ধান নেই।’


সুতরাং বরাবরের মতো গ্রামকে গ্রাম একত্র মিলে এক ধান হতে সমস্ত ধান দিনে কাটতে থাকবে, আবার যেদিন ধান উঠবে– সর্বত্র একই সঙ্গে নিজ নিজ মাঠের ধান তুলবে গ্রাম্য পঞ্চায়েত খামারে।


ক্যাম্পের পুলিশ এলে ধান নিজ নিজ চাষের ক্ষেতে কাটতে থাকবে– পুলিশ দূরে চলে গেলে কাটা ধান চাষীর খামারে তুলে নেবে। কোন কাটা ধান মাঠে ফেলে রাখবে না।


এভাবে পুলিশকে এড়িয়ে বিভিন্ন মালিকের প্রায় সারা মাঠের ধান চাষীরা দল বঁেধে নিজেদের পঞ্চায়েত খামারে তুলে নিল। কিন্তু পুলিশ ক্যাম্পের পাশাপাশি কয়েকশো বিঘা জমির ধান তখনো মাঠে পড়ে আছে। কী ভাবে ঐ ধান তোলা হবে? মিটিং বসল থানা সংগ্রাম কমিটির। কমিটির স্থানীয় নেতারা দাবি তুলল– ‘যে করেই হোক ঐ ধান তুলে আনতেই হবে, নচেৎ লালঝান্ডার ইজ্জৎ থাকে না।’ ‘প্রয়োজনে শত শত কৃষকের জঙ্গী মিছিল দিয়ে ক্যাম্প পুলিশদের ঘেরাও করে ঐ ধান তুলে আনা চাই’।


জেলা নেতা ও স্থানীয় অভিজ্ঞ কৃষক নেতাদের কয়েকজন প্রশ্ন তুলল — ‘সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর মুখোমুখি ফাঁকা মাঠে লড়াই, জয় সম্ভব কী’?


কিন্তু তখন অনেকখানি জয়ে উদ্দীপিত কৃষকদের জিদ। ভোটে পাশ হয়ে গেল ঐ ধান পুলিশকে প্রতিরোধ করে তুলে আনতে হবে। স্থির হল, পরের দিন সকালেই চারিদিক থেকে শত শত কৃষকদের মিছিল এসে পুলিশ ক্যাম্প ঘেরা হবে, ধান তোলা হবে। প্রথম বাহিনীকে পরিচালিত করবে ভূপাল পান্ডা। সকাল হতেই চারিতিক হতে কেন্দেমারী অভিমুখে কৃষক বাহিনীদের অভিযান এগিয়ে চলল। প্রথম বাহিনী উত্তর দিক থেকে ক্যাম্পের পাশে ধাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোতদারের ভাড়াটিয়া মজুরেরা দৌড়ে ক্যাম্পে পালাল। সেই সঙ্গে বেরিয়ে এল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী সহ জোতদার ও তাদের গুন্ডাদল, দুদিক দিয়ে ঐ প্রথম বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। লাঠিতে লাঠিতে চলে সংঘাত, সংঘর্ষ, ফাটাফাটি-রক্তারক্তি, কয়েকজন জঙ্গী কৃষক যুবক আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।


কিন্তু সময় জ্ঞানের ত্রুটির ফলে তখনো অন্যান্য কৃষক বাহিনীগুলি দূর মাঠপ্রান্তে। অবশেষে পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনী এই জঙ্গী কৃষক দলটিকে ঘিরে বঁেধে ক্যাম্পে আটকে ফেলে, তখন অপরাপর কৃষক বাহিনীগুলি ক্যাম্প ঘেরাও করার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসে — পশ্চিমদিকে এসে জড়ো হতে থাকে। ইতিমধ্যে থানার রিজার্ভ সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীও এসে পড়ে এবং আক্রমণমুখী কৃষক বাহিনীকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য গুলি ছোঁড়ে ও এগিয়ে যায়। তখন কৃষকেরা দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়।


এই প্রথম জঙ্গী কৃষক দলটিকে গ্রেপ্তার করে জোতদার ও পুলিশ বাহিনীর মনোবল বেড়ে যায়। তখন তারা চক্রান্ত করে চাষীর পঞ্চায়েত খামার ভেঙে ধান মালিকের খামারে তুলে আনার। সেজন্য তারা প্রথম বেছে নেয় মহম্মদপুর দাসপাড়ার পঞ্চায়েত খামার এবং কয়েকদিন পরেই ঐ খামারে পুলিশ সহ জোতদার ও গুন্ডাবাহিনী অভিযান করে। কিন্তু কমরেড বিমলা মাজীর নেতৃত্বে জঙ্গী কৃষক নারী বাহিনী দা, বঁটি ও ঝাঁটাসহ কোচড়ে ধূলার সঙ্গে লংকা নুন নিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে যায়। খামারের মধ্যে শুরু হয়ে যায় প্রথম সংঘাত। নারী বাহিনী কোচড় হতে লংকার গুঁড়ো ওড়ালে পুলিশ গুন্ডাদল তখন চোখের জ্বালায় আতঙ্কবোধ করে পালাতে শুরু করে। এই সময়ে লাঠিধারী ভলান্টিয়ারদের তিন-চার ব্যাচে শ্লোগান দিয়ে পাড়ার ভিতর থেকে দৌড়ে আসতে দেখে ঐ সশস্ত্র পুলিশ গুন্ডাবাহিনী ছুটে পালাতে বাধ্য হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত সংগ্রামী এলাকাগুলিতে।


এর পরদিন হতে খামারে খামারে চাষীরা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়ে ধান ঝাড়াই মাড়াই করে নেয় সমস্ত পঞ্চায়েত খামারের।


নন্দীগ্রাম-মহম্মদপুরে কৃষক নারী বাহিনীর সশস্ত্র পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনীকে সম্মুখ প্রতিরোধের কৌশল জেলার সমস্ত সংগ্রামী এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সর্বত্র পুলিশ প্রতিরোধে কৃষক রমণীগণ অপূর্ব বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। যেমন, পাঁশকুড়ার চকগোপালে চাষীদের খামার ভাঙায় পুলিশ বাহিনীকেও বর্ণক্ষত্রিয় মেয়েরা ঐভাবে ঝাঁটা-বঁটি নিয়ে প্রতিহত করে। শেষ পর্যন্ত অত্যাচারী জোতদার চাষীদের সঙ্গে আপস করে ৪০ ভাগ নিতে এবং ৬০ ভাগ চাষীদের দিতে বাধ্য হয়। মহিষাদল, সুতাহাটা, কেশপুর সর্বত্রই চাষীরা সংগঠন অনুযায়ী মোট ফসলের অর্ধেকের বেশিভাগ ও বাকী বকেয়া মকুবে জোতদারদের বাধ্য করে।


মেদিনীপুর জেলায় এই ব্যাপক তেভাগার দাবির লড়াইয়ে জয় ঐ বছরে কেশপুর থানার পাঁচখুরিতে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে বিশেষ ভাবে অভিনন্দন লাভ করে।

________________________________________________
* লেখক নন্দীগ্রামের প্রাক্তন সিপিআই বিধায়ক ও মেদিনীপুরে তেভাগার সংগঠক।
(সৌজন্যে – তেভাগা পঁচিশ সংকলন গ্রন্থ)
‘নানারঙে’ পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

One Response to “মেদিনীপুরে তেভাগা সংগ্রাম”

  1. আকাশ said

    নন্দীগ্রামের লড়াই-এর প্রেক্ষিতে এই রচনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। নন্দীগ্রাম ও সন্নিহিত অঞ্চলের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে লাল সেলাম।

    এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। তখন সবে বিশ্বজিৎ মাইতি, শেখ সেলিমরা শহীদ হয়েছেন। সিপিআই-এমএলে(লিবারেশন)এর পক্ষ থেকে একটা দল গেছে ওখানকার মানুষের সাথে কথা বলতে,সংহতি জ্ঞাপন করতে । তার কিছুদিন আগেই একটা লিবারেশানের একটা টিম-কে নানান মিথ্যা চার্জে গ্রেফতার করে জেলে চালান দেওয়া হয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে আসার তাড়া ছিল,কারণ তখন কোনো শেল্টারও নেই ওখানে। কিন্তু এক ভদ্রলোক কিছুতেই ছাড়ছিলেন না ওই টিমের লোকজনদের,ওনার বাড়িতে নিয়ে যাবেনই। মেঠো বাড়ি, জনমজুর পরিবার। বাড়ির দরজার ওপরে একটা ছবি। ৮৩ বছরের ভদ্রলোক বারবার ছবিটা দেখাচ্ছিলেন। ছবিটা ভূপাল পান্ডার। তারপর উনি বললেন, যে ছ-জনকে নিয়ে নন্দীগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল উনি ছিলেন তার সদস্য। ভূপাল পান্ডা তখন সদ্য আন্দামান থেকে ফিরে ওখানে সংগঠন বানাবেন ঠিক করেছেন। এই ভদ্রলোক তখন ছিলেন নিরক্ষর জনমজুর। ওনার দায়িত্ব ছিল মিটিং-এর খবর সবাইকে জানানো। কিন্তু প্রকাশ্য জানানোর সুযোগ ছিল না। তাই আগে থেকেই কয়েকটা জায়গা ঠিক করা ছিল, আর সময়টাও একই থাকতো, আর জায়গা গুলোর নাম দেওয়া হতো ১,২ এইভাবে। উনি শুধু গিয়ে বলে আসতেন আজ ১ নং-এ। আর যদি বাড়ি গিয়ে দেখা না হতো চক দিয়ে লিখে দিতেন বাড়ির গায়ে। এই করে ওনার অক্ষর পরিচয়। আরো অনেক কথা বলেছিলেন।

    প্রসংগতঃ উনি শহীদ বিশ্বজিৎ মাইতির ঠাকুরদা। ১২ বছরের ছেলেটা মারা গেছিল জমি বাঁচানোর লড়াই-এ। এখনো প্রবল দরিদ্র পরিবার, বাবা সেই অবস্থাতেও পেটের ভাত জোগাতে রিকশা টানতে গেছিলেন।

    তার লড়াই যদিও এখনও শেষ হয় নি, লড়াই চলবে।

Leave a comment