বা ঙা ল না মা

বাঙালবৃত্তান্ত ঃ পর্ব দুই

Posted by bangalnama on December 31, 2009


(প্রথম পর্বের পর)


হাজরাদি’ পরগণা


একজন নামজাদা গল্পবলিয়ে অনেক অনুরোধ-উপরোধে ঢঁেকিগিলে গলাখাঁকারি দিলেন। আড্ডার সবাই নড়েচড়ে বসলো।
– “আমার একটা শর্ত আছে; এখানে হাজরাদি’ পরগণার কেউ হাজির থাকলে বলে ফেলুন। তাহলে আমি আর মুখ খুলছিনে।”
সবাই চুপচাপ। বক্তা সবার মুখে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গল্প শুরু করলেন।
– “এক যে ছিল নদী, আর তার পাড়ে ছিল এক গাছ। তার পাতার এমনি গুণ যে তা’ জলে পড়লে হয় কুমির, আর ডাঙায় পড়লে বাঘ।”
– “আচ্ছা, যদি পাতাটা অর্ধেক জলে পড়ে আর অর্ধেক ডাঙায়! তা’হইলে কি দশা হইব? খুইল্যা ক’ন মশয়!”
সবার অবাক করা চোখ এখন নতুন বক্তার দিকে।
– “এই যে, সত্যি কথাটা আগেভাগে কেন স্বীকার করলেন না! বলেছিলুম না হাজরাদি’ পরগণার লোকের সামনে মুখ খুলব না!”


এই ‘কিসসা’টি শুনিয়ে আমার বাবা ফোড়ন কাটলেন,- “বুঝলে তো, এই হল তোমাদের হাজরাদি’ পরগণার লোক। এমন কুতর্ক! ভূ-ভারতে জোড়া পাওয়া ভার। যেমন তোমাদের নীরদ চৌধুরিমশায়।”
পিতৃদেব নীরদ চৌধুরিমশায়ের ইতিহাসবোধ ও মেঠো রসিকতা দু’টোই অপছন্দ করতেন। সেদিন প্রসঙ্গ ছিল নীরদবাবুর “দেশ” পত্রিকায় ‘হিন্দুর মেয়ের মুসলমানি পোশাক’ নামে সদ্যপ্রকাশিত প্রবন্ধটি।
– “কিন্তু ওনার বাড়ি তো যদ্দুর জানি আজকের বাংলাদেশের মৈমনসিং জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমায়।” আমি ফুট কাটি।
– “তোমাদের নিয়ে এইতো মুশকিল। লেখাপড়াটা ভাল করে করলে না। পড়েছ শুধু ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, তা’ও সবটা নয়, মেরেকেটে হর্মন বা অস্ট্রিয়ান সংস্করণের ভূমিকাটুকু। তবু তর্ক করা চাই।- শোন, শের শাহ সুরি খাজনা আদায়ের সুবিধের জন্যে গোটা দেশটাকে অনেকগুলি পরগণায় ভাগ করেছিলেন। কিশোরগঞ্জ মহকুমার প্রায় সবটাই হাজরাদি’ পরগণার মধ্যে পড়ে।”


কিন্তু আমাদের পৈতৃক ভিটে! মৈমনসিং জেলার মানিকখালি রেলস্টেশনে নেমে ক’মাইল হাঁটাপথ পেরিয়ে আঠারবাড়িয়া গ্রাম। হঠাৎ মাথার মধ্যে টিউবলাইট জ্বলে ওঠে। বাবাকে জিগ্যেস করে ফেলি।
– “আমরা কোন পরগণার লোক, বাবা?”
বাবার স্বর খাদে নামে;- “হাজরাদি’ পরগণার।”



কপোল মানে কপাল


১৯১৯ সালের চৈত্রমাসের এক দুপুর। মৈমনসিং শহরের সদর আদালতের বার লাইব্রেরি। সেক্রেটারি সতীশচন্দ্র রায়মশায়ের সামনে পড়ে থাকা দেওয়ানি মোকদ্দমার ফাইলে কিছুতেই মন লাগছে না। গিন্নি সরযূবালার আবার বাচ্চা হবে। পিঠোপিঠি দুটি মেয়ের পর এবার কি যে কপালে আছে! -আটচালার ঠাকুরঘরে অধিষ্ঠিত গোবিন্দজীউ, শালগ্রাম শিলা। মা ভরসা দিয়েছেন- পৌত্রকামনায় ওনার উপোস বৃথা যাবে না। ক’দিন আগে দোলপূর্ণিমায় সাতগাঁয়ের বৈরাগীদের নেমন্তন্ন করে পাতপেড়ে খাওয়ানো হয়েছে। এ’সব কি বৃথা যাবে?


এ’ছাড়াও আছে। মা তিনপুরুষের গুরুঠাকুর ত্রিপুরার গোস্বামী পরিবারের কর্তাকে চিঠি লিখে প্রসাদী ফুল এনে সরযূবালার মাথায় ছুঁইয়ে দিয়েছেন। ইন্দ্র পদবীধারী আঠারবাড়িয়া-বাজিতপুরের খাস তালুকদার পরিবারের বংশরক্ষা হবে না, সে কি হয়!


এ’দিকে বার-লাইব্রেরিতে সিনিয়র, আধা-সিনিয়র উকিলবাবুরা আরামকেদারায় আধশোয়া হয়ে চৌরিচৌরাতে উগ্র জনতার থানা জ্বালিয়ে দেওয়ায় ‘কু্ইনের রাজত্ব’ কতটা বিপন্ন হল, ১৯০৮-এ সিভিল প্রসিডিওর কোড-এর পর এবার ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড সংশোধন করা জরুরি কি না, কলিযুগ তিনপোয়া পেরিয়েছে, কি সিকিকাঠা আটকে আছে- এ’নিয়ে গভীর আলোচনার পর শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে ব্রতী হলেন। আজকাল স্কুলে যে কিচ্ছু পড়াশুনো হচ্ছেনা, মাস্টারেরা যে কিছুই পড়ায় না- এ’ব্যাপারে সবাই একমত হলেন (একুশে শতাব্দীতেও কৃতী পুরুষেরা এ’ব্যাপারে দ্বিমত ন’ন)।


সতীশচন্দ্র একসময় মাস্টারি করেছেন; কলিগ্্দের মধ্যে ‘শিক্ষাগুরুদের পিন্ডদান’ শুরু হলে উনিই একমাত্র ডিফেন্স কাউনসিল। অন্যমনস্ক সতীশচন্দ্র পড়শি উমানাথবাবুর খোঁচায় জেগে উঠলেন।–
– “শুনছেন নাকি সতীশবাবু, যতীনমাস্টারের কান্ড! ‘কপোল’ মানে নাকি কপাল।”
– “কি রকম, উমানাথবাবু একটু খুইল্যা ক’ন দেহি!” আড্ডার মুখ এদিকে ফিরল।
– “আর কইয়েন না। ক্লাসে মাস্টারে কবিতা পড়ায়- ‘কপোল ভাসিয়া গেল নয়নের জলে’। আমার পুত্র জিগায়- কপোলের মানে কইয়া দেন; ত’ মাস্টারে কয়- কপোল মানে কপাল। ছেলেও মুখস্থ করে- ‘কপোল মানে পকাল, কপোল মানে কপাল’। গুরুর কথা যে বেদবাক্য। কিন্তু নয়নের জলে কপাল ক্যামনে ভাসব হেইডা কেডা বুঝায়? আমারই পুড়া কপাল!”


সবার মুচকি হাসির মাঝখানে হঠাৎ সতীশচন্দ্রের গলার আওয়াজ শোনা গেল;- “হইতে পারে, কপোল মানে কপাল কবিতায় হইতে পারে।”
– “এইডা কি কইলাইন সতীশবাবু? গল্পের গরু গাছে চড়ে জানতাম, কিন্তু, কবিতায় এমুন হইতে পারে!”
– “আপনের হিন্দু সিভিল কোডে হয় না, কবিতায় বিলক্ষণ হইতে পারে।” তরজা জমে উঠেছে; দোহার উঠল,- “খুইল্যা ক’ন সতীশবাবু, খুইল্যা ক’ন।”
– “শুনেন; কবিতা যখন, দুই লাইন মিলাইতে হইব না? ‘দুই ঠ্যাং বাইন্ধা দিল কদম্বেরি ডালে, কপোল ভাসিয়া গেল নয়নেরি জলে’। এইবার দ্যাখেন নয়নের জলে ‘কপাল’ ভাসে কি না!”
হাসির হররা এবার বার লাইব্রেরি ছাড়িয়ে বারান্দায় পৌঁছে গেল।


হাসি থামলে হুঁকোবরদার এসে খবর দিল যে সতীশবাবুর জন্যে বাইরে একজন মক্কেল অপেক্ষা করছে। শশব্যস্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখেন, – হরি, হরি! মক্কেল কোথায়? এ’তো এন্তাজ মিঞা উরফ লাউয়া; – রায়পরিবারের গোমস্তা-কাম-বাজারসরকার, আঠারবাড়িয়ায় মাতাঠাকুরাণীর ম্যানফ্রাইডে। পিতৃদেব ‘পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ’ মেনে বৃন্দাবন গেলে মা সুখময়ী রায় এদের ভরসাতেই গেরস্তি চালিয়ে এসেছেন।
লাউয়া মিঞার টেকো চেহারায় একগাম হাসি। খোদার কৃপায় এবার ছেলে হয়েছে। সবাই ভাল আছে। িকন্তু মা’ঠাকুরাইন আজকেই বাড়ি ফিরতে বলেছেন, আর বলেছেন একটি নাম ঠিক করতে।
নাম- মানে নাউন, নোমেনক্লেচার? এ’ছেলে তো আজ নয়নের জলে কপাল ভাসিয়ে ছাড়ল! তাহলে- নয়ন? নয়নকুমার? না, না; সতীশচন্দ্রের ছেলে নয়নচন্দ্র? এঃ, বড্ড মেয়েলি। – পাওয়া গেছে, একটু মডার্ন নাম- সলিলকুমার।



সতীনের নাম আরশোলা


নৌকা চলেছে মেঘনা নদী বেয়ে। শরতের আকাশ, পঁেজা তুলোর মত মেঘ ভেসে যায়। পালে হাওয়া লেগেছে। ছই থেকে বেরিয়ে এসে নীলাম্বরবাবু একটু উসখুস করছেন। সিগারেট গেছে ফুরিয়ে, কিন্তু কলকাতার মেসবাড়ির অভ্যেস। ভাবছেন মাঝির সঙ্গে ভাব জমিয়ে হঁুকো চাইলে কেমন হয়? চোখে পড়লো আরেক জন, গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে একই পথের পথিক। এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করলেন,-“মশায়ের পরিচয়?”
জবাব এল,- “নন্দীপুরের নন্দী আমি- ঈশান চন্দ্র নন্দী। আপনার?”
– “ধাড়ীশ্বরের ধাড়ী আমি নীলাম্বর ধাড়ী।”
– “এইডা কেমুন নাম হইল, মশয়?”
– “যেমুন আপনার। আপনার গ্রাম নন্দীপুর, আমার গ্রাম ধাড়ীশ্বর।”
– “হ’, বুঝেছি। যেমুন আমার মামার নাম মহাভারত রায়।”
– “আর আমার মামার নাম রাজকৃষ্ণ রায়ের গ্রন্থাবলী। কেমুন বুঝছেন?”
– “বুঝলাম যে আমি আধা বুঝছি আর আপনে পুরা বুঝছেন।”


যাহোক, দু’জনের বাগযুদ্ধের শেষমেশ মধুরেণ সমাপয়েৎ হল একজন আরেকজনের মুখে আগুন দিয়ে। ধোঁয়া টানতে টানতে নীলাম্বর ঈশানচন্দ্রকে বললেন, “একটা কথা জিগাই, শুনছি আপনার নন্দীপুরের একজন নাকি মাইয়ার বিয়া নিজের বন্ধুর লগে দিছে! হাছা না মিছা?”
– “হাছা কথা! আর কইয়েন না। এরা নামে ভদ্রলোক, কায়স্থ, পদবী নন্দী, ব্যবহারে ছুডুলোকের অধম। পয়সার লোভে সোনার পুত্তলি মাইয়াডারে বাপের বয়সি বুইড়া বরের লগে বিয়া দিল।”
– “বর কেডা?”
-“মৈমনসিংহের জংগলবাড়ির হরেন্দ্র কারকুন। সুদের কারবারি, মেলা পয়সা।” দু’জনে খানিকক্ষণ মৌনীবাবা হয়ে ধোঁয়া গিললেন। তারপর নীলাম্বরের কৌতূহল আর বাঁধ মানল না।
– “মেয়ের মা রাজি হইল?”
– “তার রাজি আর অরাজি! নন্দী বুইড়া ঘইন্যা ত্যান্দড়, মেয়ের মায়েরে জানায় নাই। সিধাসাধা মানুষটা, খবর শুইন্যা কাইন্দা আকুল। নন্দীবুড়া ধমকায়,- চোখ মুছ, মেয়ে-জামাই আইলে ভাল কইরা বরণ কর। চোখের জলে মেয়ের অমঙ্গল হইব।”
– “অমঙ্গলের আর বাকিডা কি, তারপর?”
– “মেয়ে বড় তেজী। বুইড়া বরে দিছিল গা’ভরা সোনার গয়না; পাল্কির ভিতরে সারা গয়না খুইল্যা পোঁটলা বাঁন্ধল। পাল্কি নামতেই মা আইলেন বরণডালা নিয়া। মেয়ে কয়, -‘মা আঁচল পাৎ।’ আঁচল পাততেই গয়নার পোঁটলা ঝপাৎ কইরা দিল মায়ের কোলে ফালাইয়া। কইল, নে, এর লোভেই তো আমারে বাপের বয়সী বুড়ার সঙ্গে বিয়া দিলি। এই নে।”
– “এমুন জবাব দিল? মাইয়া এমুন তেজী! শেষে বুড়ার ঘর করল? সতীন কয়জন? মানে বুড়ার আগের পক্ষের?”
– “একজনই সতীন আছে; কিন্তু সে’ মানুষ নয়।”
– “সতীন আছে, মানুষ নয়! তবে কি ভূত-প্রেত?” নীলাম্বরের চোখ বড় বড় হয়। নন্দীপুরের নন্দী গঁোফের ফাঁকে মুচকি হাসেন।
– “না, বছর পনেরোর মাইয়া সুষমা নন্দীর সতীন হইল তেলচুরা, – যারে কইলকাতার ভাষায় কয় আরশোলা।”


নীলাম্বরের মুখের হাঁ বন্ধ হয় না। নন্দীমশায়ের করুণা হল। বুঝিয়ে বললেন যে সুষমা হলেন তাঁর স্বামীর পঞ্চমপক্ষ। প্রথম তিনজন গত হওয়ায় সুষমাকে বিয়ে করার আগে সুতো বঁেধে একটি আরশোলাকে সাতপাক ঘুরিয়ে বুড়ো বর যমকে ফাঁকি দিলেন। ফলে সুষমা চতুর্থ না হয়ে পঞ্চম হলেন। নইলে নাকি একবছরের মধ্যে বিধবা হতেন!


বাদল সরকারের ‘খাট-মাট-ক্রিং’ নাটকে মানুষ মানুষকে খাট-মাট-ক্রিং করে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিলে শুধু আরশোলারা টঁিকে থাকে।


আরশোলার জান বড় কড়া হয়। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে টঁিকে থাকার মন্ত্র জানে। বুদ্ধিমতী সুষমা সতীনকে দেখে বঁেচে থাকার কৌশল শিখলেন। একছেলে একমেয়েকে নিয়ে বিধবা সুষমা (আমার সেজপিসির ননদ) দেশভাগের পর কোলকাতার পাতিপুকুর অঞ্চলের তঁেতুলতলায় উদ্বাস্তু কলোনিতে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে তুললেন এবং দীর্ঘজীবি হলেন। কিন্তু সে আরেক গল্প।



“রাধে রাধে, কমিনভাই, টিক্কা জ্বালাইয়া তামুক খাই”


সেজকাকা চটে লাল; দোষের মধ্যে আমার বোন গুন গুন করছিল কলেজ-সোশ্যালে শোনা গান,- ‘যেখানেতে ঘটে যত অনিস্টি, সকলের মূলে কমিউনিস্টি।’ না হয় দিনকাল কিছু পালটেছে, বাজার ভগবান হয়েছে, তা’বলে নতুন জেনারেশন এইসব আজেবাজে গান গাইবে আর আমাদের শুনতে হবে! পুরনো দিনের পার্টিমেম্বার আমার কাকাকে বোঝানো মুশকিল যে এটা আসলে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা বিখ্যাত ছড়া, আর সুর দিয়েছেন গণশিল্পী অজিত পান্ডে।
– “আচ্ছা, তোমরা কি স্যাটায়ার বোঝা না? পুরনোদিনের কমিউনিস্টরা কি রামগরুড়ের ছানা! সারাক্ষণ খালি ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’ ভাব নিয়ে থাকা।”
– “বাজে বকিস না। সাধন গুপ্ত মশায়ের গলায় ‘মাউন্টব্যাটন সায়েব ও, তোমার হাতের ব্যাটন কার হাতে দিয়ে গেলায় ও’ শুনেছিস? সমরেশ বসুর গল্প নিয়ে গণনাট্য সঙ্ঘের ‘কিমলিস’ নাটক দেখেছিস? কমিউনিস্টরা হাসে না! হঁঃ।”
– “যাই বল, তোমরা পুরনো কমিউনিস্টরা কিন্তু দ্বৈতবাদী। ইউরোপের ডায়লেকটিক্স ভারতে এসে দ্বৈতবাদ হয়েছে। নেতারা এসেছেন সব উচ্চবর্ণ থেকে;- হয় রাজবাড়ি-জমিদারবাড়ি, নয়তো বিলেতফেরত ব্যারিস্টার। মৈমনসিংহের রাজবাড়ির স্নেহাংশু কান্ত আচার্য (দোদোবাবু), জ্যোতি বসু এরা। আর এক দল হলেন লম্বাচুলদাড়ি, পাজামা-পাঞ্জাবি, রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ ভক্ত ধোঁয়াগেলা কবি-কবি কমিউনিস্ট। চিন-ভারত যুদ্ধের সময় পার্টি দু’ভাগ হল। ডান আর বাম, সেই দ্বৈতবাদ। একদিকে ভবানীবাবু-চিনুবাবু-ননিবাবু-সুভাষবাবু; আর একদিকে দোদোবাবু-জ্যোতিবাবু-রতনলাল ব্রাহ্মণরা। নকশালজমানাতেও কোন ইতরবিশেষ হয়নি; চারু মজুমদার-কানু সান্যাল-সুশীতল রায়চৌধুরি-অসীম চাটুজ্জে, অর্থাৎ ব্রাহ্মণবাদেরই জয়জয়কার।”
– “মন্দ বলিস নি। শুনতে ভাল, কিন্তু ওপরচালাকিয়া বাজে কথা। তুই চল্লিশের দশক আর ষাটের দশক গুলিয়ে ফেলেছিস। ভুলে মেরে দিয়েছিস ট্রাম আর বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা মহম্মদ ইসমাইল আর মহম্মদ ইলিয়াসকে, নোয়াখালির কৃষকপরিবারের মুজফফর আহমেদকে। আর ইংরেজবিরোধী বিপ্লবীদলগুলোর থেকে আন্দামানফেরৎ সংগঠকরা? অনুশীলন আর যুগান্তরদলের লোকজন? মনে রাখিস পূববাংলা ছিল অনুশীলন দলের শক্ত ঘাঁটি। সতীশ পাকড়াশি, গণেশ ঘোষ আর কল্পনা দত্ত! বিপ্লবী ইলা মিত্রের তো নামও শুনিস নি।” সেজকাকার গলায় রাগ আর দুঃখ মিলেমিশে একাকার।
– “শুনব না কেন? ‘ইলামিত্র ফুচিকের বোন, ইলামিত্র স্তালিননন্দিনী-‘, গোলাম কুদ্দুসের কবিতাটা পড়েছি।” কাকা একটু শান্ত হলেন।
– “তবে হ্যাঁ, দু’ধরণের কমিউনিস্ট আমরাও দেখেছি। একদল মাটি থেকে উঠে আসা, আরেকদল ইংরেজিশিক্ষার কলমপেষা।”
– “বেশ তো, তোমার দেখা দু’রকম কমিউনিস্টদের কথাই বল।”
– “আমরা জানতাম মণি সিং, মহেন্দ্র সিং কে। হাজং-এর রাজপরিবারের দু’ভাই। কিন্তু হাজং উপজাতিদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয়। এঁরা হচ্ছেন শুধু মৈমনসিংহেরই ন’ন, একেবারে পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। মৈমনসিংহের উত্তরপূর্বে গারোপাহাড়ের নীচে হাজং উপজাতির বসবাস। তেভাগার সময় একদিকে পুলিশবাহিনী, আরেকদিকে তীরধনুক নিয়ে হাজং।
“মনে পড়ে ছোটবেলায় গাঁয়ে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী ঢুকেছে। আমরা ছোটোরা ভয়ে খাটের নীচে। পেছনবাড়িতে তীরধনুকধারী ক’জন হাজং রাগে ফুঁসছে;- ‘অদা, কমরেড, অদা।’ অর্থাৎ, অর্ডার দাও কমরেড, পুঙ্গির পুতদের একবার দেখে নিই।”
– “ওরে বাবা! এ’যে একেবারে নকশালবাড়ি-খড়িবাড়ি-ফাঁসিদেওয়া!”
– “ফুট কাটিস নে;। প্রায় সে’রকমই। একটা থেকেই আর একটা।”
– “সে যাকগে; তুমি বল ভদ্দরলোক কমিউনিস্টদের প্রথম কবে দেখলে?”
– “সেবার নেত্রকোণা শহরে দু’তিনদিন ধরে কমিউনিস্ট সম্মেলন হল। নদীর পাড়ের মাঠে ম্যারাপ বাঁধা হল, আলো জ্বললো, মাইক বাজলো, কোলকাতা থেকে অনেক লোকজন এল। একজন আরেকজনকে বলছে – ‘কমরেড’।
আমার যত দাদা ছিল, খুড়তুতো-মামাতো-মাসতুতো-পিসতুতো, সবাই একদিনে কমিউনিস্ট হয়ে গেল। মেজদা’র ছিল মিষ্টির দোকান। সে’ও গিয়ে কমিউনিস্ট বুকস্টল থেকে কিছু বই কিনে আনল। আমার তখন গল্পের বই পড়ার শখ। সেই প্রথম নাম জানলাম গোপাল হালদারের। মানিক বাঁড়ুজ্জের বই পড়ি আরও পরে।


“তারপর পার্টি অফিস হল, নাটক-গান নিয়ে গণনাট্য সঙ্ঘ হল। আর হ্যাঁ, কৃষকসভা’ও হল। কিন্তু আমাদের মফঃস্বলী ছোট শহরে সবার যেটা চোখ টাটাল তা’হল ওদের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে সহজে মেলামেশা করে। যেটা কোলকাতা-ঘঁেষা ব্রাহ্মসমাজের লোকজন ছাড়া বর্ণহিন্দুর গাঁয়ে অকল্পনীয়। তবে কমিউনিস্ট মেয়েগুলো কেমন যেন! সাদাখোলের বা একরঙ্গা শাড়ি। পাউডার-কাজল? যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় লাগানো হয়েছে। তবে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিত ঠিকই।


প্রথমে পাড়ার লোকে মুচকি হাসল। তারপর পেছনে লাগল। সমাজের মাথায় বসা কংগ্রেসিরা ঠোঁট বঁেকিয়ে বললেন- পার্টি অফিস না প্রজাপতি অফিস! ফক্কড় ছোঁড়ারা কমরেডদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো,
– ‘রাধে-রাধে কমিনভাই, টিক্কা জ্বালাইয়া তামুক খাই’ বা শুধু ‘রাধে-রাধে’। এই নিয়ে মাঝে-মাঝে কথাকাটাকাটি-হাতাহাতি হয়ে যেত।
“কিন্তু তেভাগা এসে সব ওলটপালট করে দিল। খেতেখামারে লালঝান্ডা পুঁতে চাষিরা ধান কেটে আগে তাদের ধর্মগোলায় তুলবে, তার পরে মালিকদের সঙ্গে ভাগাভাগি হবে।


“রাজ্যসভার জাঁদরেল কমিউনিস্ট নেতা স্বর্গত ভূপেশ গুপ্তের গাঁ হল জয়সিদ্ধ। পাশের গ্রাম উয়ারা’র উকিল রমেশ ধর মশাইয়ের অগাধ জমিজমা। বড় ছেলে বেণু ধর নতুন কমিউনিস্ট কর্মী। ঠিক করলেন যে তেভাগা প্রথম নিজের বাড়িতেই শুরু করবেন। বাবা যখন আদালতে ব্যস্ত, ছেলে তখন লালপতাকা উড়িয়ে নিজেদের ক্ষেতে ধান কাটাতে লাগলেন। পাইক-বরকন্দাজ করবে কি! মালিকের ছেলে নিজে ধান কাটছেন। যাহোক, খবর পেয়ে রমেশবাবু অগ্নিশর্মা হয়ে যখন পৌঁছুলেন, তখন আদ্দেক ক্ষেত নেড়া হয়ে গেছে। রাগে বাক্যহারা হয়ে তিনি ঘরের দেয়াল থেকে টেনে নামালেন দো’নলা বন্দুক, দৌড়লেন সোজা মাঠের দিকে,- যেখানে তখনও ধানকাটা চলছে। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। কিন্তু বেণু ধর ‘মুঘল-এ-আজ়ম’ এর শাহজাদা সেলিম নন। দিলেন মাঠ পেরিয়ে চোঁচা দৌড়। পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন কিছুদিন পরে। উনি এবং ওনার জনাদুই তুতোভাই ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা শেষমেশ জেলে থেকেই দিলেন।”


“আটচল্লিশে কমিউনিস্ট পার্টি বলল- ইয়ে আজ়াদি ঝুটা হ্যায়, অর্থাৎ কংগ্রেসি আজ়াদি। আর ছেলে-বুড়ো, জোয়ান-মদ্দ সবাই মিলে লেখাপড়া-চাকরিবাকরি ছেড়ে নেমে পড়ল সাচ্চা আজ়াদির খোঁজে।
– আর আজ? আজ আরেক আর্থিক আজ়াদি রক্ষার জন্যে কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেস সরকারের কাছে দায়বদ্ধ!”


আমরা সমস্বরে বলি- “রাধে! রাধে!—–“



“ধরিয়াছে কি আশ্চর্য শোভা মনোহর”


সতীশচন্দ্র পড়িয়াছেন মহাফ্যাসাদে। ইংরেজ সরকারের মতিগতি বোঝা ভার। কুইনের কি যে মর্জি! ভারতসাম্রাজ্যের রাজধানী নাকি কলিকাতা হইতে দিল্লী যাইবে। ইহা যে দিল্লাগী বই কিছু নয় তাহা যবনশাসককুলকে কে বুঝাইবে!


কলিকাতার রিপন কালেজ হইতে আইন পাস করিবার পর সতীশচন্দ্র ভারত সরকারের সেক্রেটারিয়েটে চাকুরি করিতেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। রাজধানীসহিত আস্ত সেক্রেটারিয়েট দিল্লী যাইবে, সঙ্গে যাইবে করণিককুল। দিল্লীগামী সমস্ত কর্মচারী পাইবে বিশেষ রাজধানী ভাতা। যাহারা যাইবে না তাহাদের জন্য বরাদ্দ অন্তিম বেতনসহ প্রেমপত্র।


এখন রাজধানী কলিকাতা হইতে ‘দিল্লী শহরে যাক, যাক না আগ্রা; মাথায় পাগড়ি দেব পায়েতে নাগরা’ রবিবাবু অনায়াসে লিখিতে পারেন। কারণ, তিনি চাকুরিজীবি ন’ন, মসিজীবি। তাঁহার শিলাইদহের জমিদারি অটুট থাকিবে। কিন্তু সতীশচন্দ্রের সামান্য তালুকদারি দেখাশুনা করে কে!


পিতা গগন চন্দ্র সফল উকিল, কিন্তু নিষ্ঠাবান হিন্দু। ‘পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ’ নীতি অনুসরণ করিয়া বৃন্দাবনবাসী হইয়াছেন। একমাত্র পুত্র সতীশচন্দ্র মায়ের দুঃখের সহভাগী। তবে মায়ের প্রখর বাস্তববুদ্ধির প্রতি তাঁহার বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধা। কোন জটিল সমস্যার মুখোমুখি হইলে তাঁহার অন্তিম বাক্য ‘মা যা বলেন’। সংসারের কোন ঝড়-ঝাপটাতেই মায়ের প্রতি এই বিশ্বাস টলে নাই। কিন্তু আজ সাকযোগে প্রাপ্ত মায়ের একটি পত্র তাঁহাকে যারপরনাই বিচলিত করিয়াছে। বৃন্দাবন হইতে সন্ন্যাসীপিতা মাকে জানাইয়াছেন যে সতীশচন্দ্র বঙ্গদেশ ছাড়িয়া দিল্লীগামী হইলে তিনি পুত্রকে সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিবেন।


সতীশচন্দ্র কিঞ্চিৎ বিস্মিত, কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ। সংসারত্যাগী পিতা হিন্দু সিভিল কোডের কোন ধারায় পুত্রকে বঞ্চিত করিবেন? আর আপন অভিমত উনি পুত্রকে সোজাসুজি জানাইলেন না কেন?


মাতাকে সন্দেহ করা সতীশচন্দ্রের পক্ষে অকল্পনীয়। মাতা সুখময়ী দেবী তাঁহার চক্ষে আদর্শ রমণী। আজও সপ্তাহান্তে বা মাসান্তে দেশের বাড়ি গেলে তিনি মায়ের জন্য এক হাঁড়ি কলিকাতার রসগোল্লা লইয়া যান এবং নিজহস্তে একটি একটি করিয়া মায়ের হাঁ-মুখে দিয়া পরমানন্দ লাভ করেন। তবে মাঝে মাঝে বিঘ্ন ঘটে। কোথা হইতে হাজির হয় গ্রামের মঘা পাগলা। মায়ের নিকটে আসিয়া ফিসফিসাইয়া বলে,- ‘ঠাকুরাইন, আমার সঙ্গে গুপ্ত-বৃন্দাবন যাইবেন?’


গুপ্ত-বৃন্দাবন কোথায় তাহা তিনি জানেন না। কিন্তু তাঁহার হাড়পিত্তি জ্বলিয়া উঠে এবং তিনি হারামজাদা পাগলাকে জুতাইয়া দেউড়ির বাহির করিতে নির্দেশ জারি করেন।


সতীশচন্দ্র পুরুষকারের অপেক্ষা নিয়তির উপর অধিক নির্ভরশীল।


সরকারি চাকুরি এবং মায়ের টান- এই শ্যাম রাখি না কুল রাখি দোটানায় সতীশচন্দ্র কি করিবেন তাহা নিয়তি নির্ধারিত। কাজেই তিনি ইস্তফা দিয়া ঘরে আসিয়া মায়ের কথামত মৈমনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের পদের জন্য উমেদারি করিতে লাগিলেন।


স্কুল কমিটিতে সৈয়দ রহিমুল্লা খান তাঁহার পিতার শাঁসাল মক্কেল ছিলেন। তিনি সতীশচন্দ্রকে আগামী রবিবার স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় ইংরেজিতে লেকচার দিতে আমন্ত্রণ করিলেন। ইংরেজি ভাষার সহিত খান সাহেবের সম্বন্ধ নিষিদ্ধ মাংসের প্রতি ভয়মিশ্রিত আকর্ষণের সঙ্গে তুলনীয়। পাটের কারবারি খানসাহেবের পাটোয়ারি বুদ্ধি বেশ পাকা। সতীশচন্দ্রের লেকচার শুনিয়া উপস্থিত ভদ্রজন চমৎকৃত হইলে ইংরেজি-টিচার পদে নিযুক্তি সহজ হয়।


বার্ষিক উৎসবে অন্যদের তুলনায় সতীশচন্দ্রের লেকচার অতি উপাদেয় হইল। সবশেষে ‘ভোট অফ থ্যাংকস’ দিতে খানসাহেবকে অনুরোধ করা হইলে তিনি যাহা বলিলেন তাহাও কিছু কম উপাদেয় নয়।


– “এতক্ষণ আপনারা যাহা শুনিলেন তাহা অত্যন্ত হৃদয়ংগম ও চিন্তাশীল। এইরকম বচ্ছর বচ্ছর পেরাইজ দিলেই ছাত্রবাবুরা বইল্যা পড়ব আর ইশকুলেরও নামডাক হইব।”


কিন্তু সতীশচন্দ্রের চাকুরি হয় নাই; কারণ, ইংরেজি-টিচারের পদ খালি ছিল না। বাংলা শিক্ষকের পদে সেকেন্ড পন্ডিতমশায় কাজ চালাইতেছিলেন। কিন্তু বাংলামাস্টারের বেতন কম, সতীশচন্দ্র প্ড়থমে রাজি হইলেন না। পরন্তু চাকুরি বড় বালাই। কিন্তু বৃদ্ধ সেকেন্ড পন্ডিতমশায় সকলের শ্রদ্ধেয় তায় ব্রাহ্মণ। হেডমাস্টারের বিবেকে বাধিল। খানসাহেব কমিটিকে জানাইলেন যে উনি ব্যাকরণে দড় কিন্তু বাংলা সাহিত্য পড়াইতে অপারগ। কমিটি হেসমাস্তারকে পরখ করিয়া রিপোর্ট দিতে বলিল। কাজেই তিনি সিক্সথ ক্লাসের বাংলাপিরিয়ডের সময় বারান্দায় আড়ি পাতিলেন।


ক্লাসের ফার্স্টবয় বই খুলিয়া পড়িতেছিল, “ফুটিয়াছে সরোবরে কমলনিকর; ধরিয়াছে কি আশ্চর্য শোভা মনোহর”। ছাত্রদের অনুরোধে পন্ডিতমশায় টীকা করিলেন,- “সরোবর মানে পুষ্কুনি, রাত্রে ঠান্ডায় পুকুরের জলে সর পড়ছে- কাজেই নাম হইল সরোবর। কমলনিকর ফুটিয়াছে – মানে মুখ ভ্যাটকাইয়া রইছে। পরের লাইন- মনোহর, মানে আমাগো উকিলবাবুর ছ্যামড়া মনোহয়রা, ডাকতরবাবুর মাইয়া শোভারে ধরছে। হেইয়া দেইখা পন্ডিতে কয়- কি আশ্চর্য!”


পরের দিন সতীশচন্দ্র বাংলার টিচার নিযুক্ত হইলেন।


(চলবে..)


লিখেছেন – রঞ্জন রায়

One Response to “বাঙালবৃত্তান্ত ঃ পর্ব দুই”

  1. said

    অসাধারণ জমাটি লেখা!
    ধারাবাহিক চলুক। লেখককে লালসেলাম।

Leave a comment