– লিখেছেন মিহির সেনগুপ্ত
চন্দ্রদ্বৈপায়ন মনুষ্যেরা রোমন্থন বা জাবরকাটায় যে জবরদস্ত এলোমেলোবাগীশ এ-কথা রাঢ়ে বঙ্গে সবাই জানেন। বরিশাল নামক ভূভাগটিকে এই রচনায় চন্দ্রদ্বীপ বলে এবং তৎস্থানীয় ভূমিপুত্রদের চন্দ্রদ্বৈপায়ন অভিধায় ভূষিত করলে, আশা করি কেউ আপত্তি করবেন না। নামে কী আসে যায়?
দেশভাগ, দাঙ্গা, ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওন ইত্যাদি অজস্র কারণে জাবরকাটা স্বভাবটি এই উজানি দেশের মানুষদের যেন ষোলোআনা থেকে আঠারো আনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। যাঁরা সেই স্থান ত্যাগ করে এপারে এসেছেন তাঁরাও যেমন, আবার যাঁরা সেই স্থানে ছিটেফোঁটা এখনো আছেন তাঁরাও, সমান দড়। তা বলে কেউ ভাববেন না যেন, আমি শুধু ছিন্ন-শেকড় সংখ্যালঘুদের স্বভাবের কথাই এখানে বলছি। এ-স্বভাব সেখানকার সংখ্যাগুরুদের ক্ষেত্রেও ষোলো থেকে আঠারো আনা রয়েছে।
স্বভাবটি নিতান্ত গো-স্বভাব বটে, কিন্তু তাতে বিলক্ষণ আত্মমগ্নতা। ফলত, এই সব ছিন্ন-শিকড় দ্বৈপায়নেরা যখন কোথাও ‘দলামোচা’ হন, তখন ‘সকায় নিরুত্তিয়া’য় তাঁদের মুখে যে খই ফোটে, তার তুল্য রসবর্ষা এ পোড়া পরবাসে বড় সহজলভ্য নয়। তখন কখনও ‘নাইরকোল সুবারির’ বাগান-বিষয়ক, কখনও নদী, হাওড়, বাওড়, ‘বৃহৎ পুষ্করিণী’, খাল, বিলের অতিকায় স্বাদু মৎস্যাদির এবং এককথায় অতি সমৃদ্ধ এককালের গেরস্থালির পরণ-কথা, কখনও-বা সেই স্বর্গ থেকে উৎখাত হওয়ার বীভৎস এবং করুণ স্মৃতি রোমন্থনে উদ্বেল হয়ে ওঠা। সেই ক্ষণে, এপারে লব্ধ শীলিত ভাষা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে খাঁটি চান্দ্রদ্বীপি সকায় নিরুত্তিয়ায় মুখর হলে প্রতিবেশী ‘ঘটি’ পুঙ্গবদের হৃদয়হীন ‘ডিম্বকরণে’র পাত্র হয়ে থাকেন এঁরা। দেশভাগের পর থেকে এ কেত্তন অদ্যাবধি অব্যাহত। চন্দ্রদ্বৈপায়নী বা চান্দ্রদ্বীপি নিরুত্তিয়াটি একটু অতিপ্রাকৃত স্বভাববিশিষ্ট এবং ঘটি শ্রোতাদের ক্ষেত্রে পায়ুপ্রদাহী সন্দেহ নেই, কিন্তু সে-ফৈজত তো ঐতরেয় ব্রাহ্মণের যুগ থেকেই চলে আসছে দেবভাষাভাষিদের সঙ্গে প্রাচীন প্রাকৃতভাষীদের, তৎকালে সে-কারণেই না তামাম বঙ্গীয়কুল ‘ভাষাহীন পক্ষী’ বলে দেবভাষীদের দ্বারা আখ্যায়িত হয়েছিলেন। যথা- ইমাঃ প্রজস্তিস্ত্র অত্যায় মায়ং স্তানি মানি বয়াংসি বঙ্গ– বগধাশ্চেরঃ পাদ্যান্যনা অকর্মভিতো বিবিশ্র ইতি। এই মানসিকতাটিরই সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে ঘটি-বাঙাল সংলাপজনিত কাজিয়ায়।
যদিও এ আলেখ্য বঙাল বঙ্গীয় ভাষা বা শব্দ বিষয়ক নয়, তথাপি প্রসঙ্গটি এ কারণে তোলা হল যে, রোমন্থনের যে-বিষয় নিয়া বাকতাল্লা মারতে যাচ্ছি, তা একান্তভাবে অথবা প্রধানত চান্দ্রদ্বীপি শব্দজ বচন-বাচনে অাকীর্ণ।